আসাদের জন্য এলিজি

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 20 Jan 2022, 06:26 AM
Updated : 20 Jan 2022, 06:26 AM

নরসিংদী জেলার শিবপুরের ধনুয়া গ্রামের মিয়াজী বাড়ি। আমরা গল্প-উপন্যাসে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের যে বিবরণ দেখি এম. এ তাহেরের পরিবারটি তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ। ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন এম. এ তাহের। শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম. এ তাহেরের ভালোবাসার বিষয় ছিল ইতিহাস। তাই নিজের দুই সন্তানকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। কিন্তু তিনি কখনো আঁচ করতে পেরেছিলেন ইতিহাস পড়তে আসা ছেলেটি একদিন ইতিহাসের নায়ক হয়ে উঠবেন। ইতিহাসের ছাত্র আসাদের নাম জ্বলজ্বল করবে আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসে।

ঊনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আসাদ পরিণত হয়েছিল আমাদের মুক্তির দূত হিসেবে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ 'মাতাল হাওয়া' বইটি উৎসর্গ করেছেন শহীদ আসাদকে। তিনি তার বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখেন,

'কোনো মৃত মানুষ মহান আন্দোলন চালিয়ে নিতে পারেন না।

একজন পেরেছিলেন। আমানুল্লাহ মোহম্মদ আসাদুজ্জামান।

তার রক্তমাখা শার্ট ছিল ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের চালিকাশক্তি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আসাদ। উল্লেখ্য আসাদ ১৯৬০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। এক বছর পড়াশোনা করে, বিভাগ পরিবর্তন করে ভর্তি হন মুরালী চাঁদ কলেজে। ১৯৬৯-এর এই দিনে 'পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' আইয়ুব সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রায় ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিশাল মিছিল বের হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে। মিছিলের সামনেই ছিলেন আসাদ। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পৌঁছলে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী মিছিলে বাঁধা দেয় ও হামলা চালায়। এ সময়ে আসাদ আধা ছত্রভঙ্গ মিছিলটি আবার সংগঠিত করে এগুতে শুরু করলে পুলিশ প্রথমে আসাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করে। এতে আহত হয়ে আসাদ মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ রিভলভার দিয়ে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক-রেঞ্জ থেকে আসাদের বুকে গুলি করে। এভাবেই শহীদ হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নেতা আমানুল্লাহ মোহামদ আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। আসাদের মৃত্যুই ছিল আইয়ুবশাহীর মসনদের কফিনে শেষ পেরেক। আসাদ-হত্যার প্রতিক্রিয়াতেই গণআন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যার চূড়ান্ত পরিণতি।

তার মৃত্যুর সংবাদ সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন্দ্রিক আন্দোলন আসাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সাধারণের সম্পৃক্ততায় গণঅভ্যুত্থানে রুপ নেয়। ঢাকা পরিণত হয় প্রতিবাদ ও মিছিলের নগরীতে। 'আসাদ-এর মন্ত্র: জনগণতন্ত্র' হয় সে সময়ের সব থেকে জনপ্রিয় শ্লোগান। 'খুনের বদলে খুন চাই, আইয়ুব খানের রক্ত চাই', 'আসাদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না'– এমন সব শ্লোগানে মুখরিত হয় ঢাকার রাজপথ।  স্বাধীনতার একেবারের শুরুর দিকের শহীদ আসাদ। খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। রক্তমাখা আসাদকে নিয়ে মেডিকেলের দিকে ছুটেছিলেন ছাত্ররা। কিন্তু জরুরি বিভাগে পৌঁছানোর আগেই মারা যান তিনি।

এরপরই আসাদ হয়ে ওঠেন সাহস আর প্রতিবাদের প্রতীক। আসাদের রক্তমাখা লাল শার্ট হয়ে ওঠে আমাদের পতাকা। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সেই সাহস আর প্রতিবাদের ভাষায় উজ্জ্বীবিত হয়ে বের করেন বিশাল শোক মিছিল।

আসাদ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী তিন দিনের শোক পালন শেষে ২৪ জানুয়ারি হরতালের ডাক দেয়। আসাদের মৃত্যুতে রাস্তায় নেমে আসা বিক্ষুব্ধ জনতাকে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন। আসাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই কবি হেলাল হাফিজ লিখে ফেলেন 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়':

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

আসাদের মৃত্যুর ৪ দিন পর তার দেখানো পথে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে বিলিয়ে দেন রুস্তম আলী এবং স্কুলবালক মতিয়ুর। ২৪ জানুয়ারি সচিবালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান এই দুজন। লাশ নিয়ে মিছিল করতে করতে মানুষ গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করতে যায়। ছাত্রনেতাদেরকে সামনে রেখে এই আন্দোলন হয়ে ওঠে 'আইয়ুব পতনের আন্দোলন'। ১৪৪ ধারা কিংবা সান্ধ্য আইন দিয়ে ছাত্র আর সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার উপন্যাস 'চিলেকোঠার সেপাই'য়ে আসাদের নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠা গণমিছিলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন, "অনেক সামনে উঁচু একটা বাঁশের মাথায় উড়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের লাল ঝাণ্ডা। বাঁশের মাথায় এই শার্ট হলো দস্তিদারের হাতের লাল লন্ঠন। নদীর জাহাজ নয়, নদীই আজ ছুটতে শুরু করেছে দস্তিদারের লাল লন্ঠনের পেছনে। এই পাগলপারা জলোস্রোতকে আজ সামলায় কে?"

নরসিংদীর প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তান তরুণ আসাদের মৃত্যুতে সৃষ্ট জলস্রোত মুছে দিয়েছিল সারা দেশে আইয়ুবের নামের সব নিশানা। সারা দেশে আইয়ুবের নামের সব স্থাপনা চলে যায় 'আসাদ' নামের দখলে। বড় সাধ করে আইয়ুব ঢাকার মোহাম্মদপুরে নির্মাণ করেছিলেন 'আইয়ুব গেট', স্বতঃস্ফুর্ত জনতা তার নামকরণ করেন 'আসাদ গেট'। একই ভাবে 'আইয়ুব অ্যাভিনিউ' হয় 'আসাদ অ্যাভিনিউ' এবং 'আইয়ুব পার্ক' হয়ে যায় 'আসাদ পার্ক'।

আসাদের মৃত্যু পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে। এই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব মুক্ত হন। তিনি পরিণত হন বঙ্গবন্ধুতে।

হাজার বছর বাংলা বাঙালির ইতিহাসে আসাদ সজীব থাকবে শামসুর রহমানের কবিতায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষতা আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে তারুণ্যের প্রতীক আসাদের জন্য এই এলিজি। আমাদের মহান সংগ্রামের ইতিহাসে উপেক্ষিত আসাদ। আসাদের নাম তরুণ প্রজন্ম জানে কিনা জানি না। অনলাইনে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ট্রলে যেভাবে তরুণ প্রজন্মের জ্ঞান গরিমা তুলে ধরা হয় তাতে সন্দেহ থেকেই যায়।

আজ ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। আমাদের দেশে দৈনিক কোন না কোন দিবস পালিত হয়। নানা তারিখে আমাদের নানা আয়োজন। কিন্তু আসাদরা অচ্যুত থেকে যায়। ফলে সামাজিক ইতিহাস চর্চায় অবহেলিত হয়ে পড়েন এই বীররা। এই ধরুন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্কুল কলেজে হাত ধোঁয়া দিবস পালিত হয়। কিন্তু এসব জাতীয় বীরদের স্মরণে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কোনও ধারণা দেয়া হয় না। আজকে বাংলাদেশের কোনও স্কুল-কলেজে আসাদ দিবস পালিত হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। আর আমরা প্রতিনিয়ত বলছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হবে। চেতনা কোথা থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে নাজিল হবে জানি না! আমাদের অনেকের কাছে এখন মুক্তিযুদ্ধ মানেই সরকারি ইতিহাস। আবার অনেকের কাছে পুরো বিষয়টাকে অস্বীকার করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাসটি অনেক বড়। আসাদের মৃত্যু সেই ক্যানভাসের শুরু।

আমাদের তরুণ প্রজন্ম আজকে আসাদের বীরত্বের কথা জানে না। কিংবা আমরা আমাদের তরুণদের এসব বীরত্বগাথা জানাতে আগ্রহী না। আজ ২০ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে আসাদকে স্মরণের কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ নেই আসাদসহ স্বাধীনতার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়া শতসহস্র বীরদের স্মরণে কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।

তাই এই এলিজি আমাদের অসহায়ত্বের। এই এলিজি স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে এক বীরের প্রতি আমাদের ক্ষমা প্রার্থনার। প্রিয় আসাদ, শিরোনামহীনের গানের লিরিকে তুমি বার বার ফিরে এসো আমাদের তারুণ্যে।

'রক্তে ভেজা আসাদের শার্ট উড়ছে কফি শপের ঝাঁঝালো বাতাসে

আতাতায়ী নিঃশ্বাস হারিয়ে গেছে নিয়তির ঠিক আশেপাশে

সুতীক্ষ ফলায় রক্তের ফোয়ারা আসাদের শার্ট ছুঁয়ে দিতেও পারে

তবে কি আতাতায়ী খুন হয়ে যাবে শীতল দু'চোখের আজন্ম ভালবাসার অভিসারে?'