বজ্রপাত থেকে জনজীবনের সুরক্ষা ও বাস্তবতা

মোহন কুমার দাশমোহন কুমার দাশ
Published : 28 June 2020, 11:23 AM
Updated : 28 June 2020, 11:23 AM

শুরু করা যাক পরপর তিনটি শিহরণ জাগানিয়া ঘটনা দিয়ে।

ঘটনা-১: বজ্রপাতের একটি বিদ্যুৎচমকানোর আনুভূমিক দূরত্ব ৭০৯ কি. মি.। যা ঘটেছে ৩১ অক্টোবর ২০১৮ সালে দক্ষিণ ব্রাজিলে।

ঘটনা-২: বজ্রপাতের একটি একক বিদ্যুৎচমকানোর সর্বোচ্চ স্থায়ীত্ব ১৬.৭ সেকেন্ড। এটি হয়েছে আর্জেন্টিনায় গত ৪ মার্চ ২০১৯ সালে ।

ঘটনা-৩: বাংলাদেশে ৪ জুন ২০২০ একদিনে বজ্রপাতে মৃত্যু বরণ করেছে ২৫ জন।

প্রথমোক্ত ঘটনা দুইটি মাত্র তিনদিন আগে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বিজ্ঞানী প্যানেল কর্তৃক ঐতিহাসিক রেকর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্বীকৃতি বজ্রপাত নিয়ে এ যাবৎকালের সব ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছে। এ অভূতপূর্ব ঘটনা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে!

আর উল্লিখিত তৃতীয় ঘটনাটা বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক প্রত্রিকায় প্রকাশিত বজ্রপাতের রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে প্রতিবছর কম বেশি ৩০০ জন বজ্রপাতের দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

গত ২৫ জুন ২০২০ ভারতের বিহার রাজ্যে বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ে ৮৩ জন ও উত্তরপ্রদেশে ২৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে যার বেশিরভাগ ছিল মাঠে কাজ করার সময় আনুমানিক দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে।

এমন তীব্র বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ের কারণ হিসেবে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমীর বায়ু প্রবাহের ক্রম উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় পশ্চিমা ও পূবালী বায়ুর সম্মিলনে শুষ্ক ও অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বাতাস যা উষ্ণ জলীয়বাষ্পের সংযোগে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়েছিল। মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ অনসেটের সময় এটা ট্রানজিশন এবং ক্লাউড বার্স্ট রূপে ঘটে। এমনটা অভিমত ব্যক্ত করেছেন প্রথিতযশা আবহাওয়া বিজ্ঞানী ড. সমরেন্দ্র কর্মকার।

বজ্রপাতজনিত ঘটনায় মোট মৃত্যু, আহত, পঙ্গুত্ব, ক্ষতিগ্রস্ত এ তথ্যগুলো বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বজ্রপাতজনিত সব ঘটনা যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এমন নয়। তাই হয়ত কাছাকাছি একটা সংখ্যা আমরা জানতে পারি।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের পর্যবেক্ষণ, বজ্রপাতজনিত দুর্ঘটনা – এ জাতীয় তথ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা, প্রকাশনা খুবই সীমিত। এর অন্যতম কারণ বজ্রপাত পর্যবেক্ষণ খুবই অল্প এবং দুর্ঘটনার তথ্যের অসমন্বয়। এ সকল তথ্যে গবেষণার অনেক প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ অন্য অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বজ্রপাত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বেশিরভাগ কৃষি সংশ্লিষ্ট যারা জীবিকার প্রয়োজনে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে বাধ্য এবং পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

বজ্রপাত সুরক্ষায় আমাদের কিছু বাস্তবতা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে –

প্রথম বাস্তবতা, বজ্রপাত আগাম সতর্কতা এখনো জেলাভিত্তিক যা উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক করা সময়ের দাবি।

দ্বিতীয় বাস্তবতা, বজ্রপাতপ্রবণ একটি দেশে কৃষি ব্যবস্থায় বজ্রপাতকালীন সময়ের জন্য আপদকালীন আশ্রয় ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরি।

তৃতীয় বাস্তবতা, সুরক্ষার প্রয়োজনে সচেতনতা। এক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো – বিদ্যুৎচমকানো দেখা এবং বজ্রের শব্দ শোনা মাত্র নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।

চতুর্থ বাস্তবতা, বজ্রপাত নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা। দেশে আবহাওয়া গবেষণা নিয়ে অগ্রাধিকার বিবেচনা কোনো একদিন হবে নিশ্চয়।

সিভিয়ার থান্ডারস্টর্ম অবজারভেশনস অ্যান্ড রিজিওনাল মডেলিং (এসটিওআরএম) এর আওতায় ঢাকার আগারগাঁও-এর সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ২০০৯ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাত ও বজ্রঝড় গবেষণার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সোমেশ্বর দাশ। আমি নিজেও সৌভাগ্যবান যে এ টিমের সাথে কাজ করতে পেরেছি।

বজ্রপাত গবেষণা টিমের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ড. সমরেন্দ্র কর্মকার, সুজিত কুমার দেবশর্মা, ড. নজরুল ইসলাম, ড. মাহবুব আলম, ড. মো. আব্দুল মান্নান, ড. আব্দুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার, নাজলী ফেরদৌসী, ড. মো. মিজানুর রহমান, মো. মাজাজুল আলম সরকার, ড. নাজমুল আহসান, এস এম আবুবকর আব্দুল্লাহ, মো রফিক আকন্দ, ফারহানা ফকরুন নেছা।

আবহাওয়া বিজ্ঞানের অভিজাত জার্নাল বুলেটিন অফ আমেরিকান মেট সোসাইটি থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত "সার্ক স্টর্ম" আর্টিকেল ওএসএমআরসি থেকে প্রকাশিত "সার্ক অঞ্চলের বজ্রঝড়ের ক্লাইম্যাটোলজি", এটমোসফেরিক রিসার্চ জার্নাল থেকে প্রকাশিত "কম্পোসিট ক্যারেক্টারিস্টিকস অফ নর'ওয়েস্টার", ন্যাচারাল হ্যাজার্ডস থেকে প্রকাশিত "এসিমিলেশন অফ ডপলার ওয়েদার ডাটা" বজ্রঝড় গবেষণায় এ অঞ্চলের আবহাওয়ার গাণিতিক মডেলের প্রথম দিকের অনন্য দলিল।

পরিহাস ও পরিতাপের বিষয় এই যে, সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এসএমআরসি) এখন বিলুপ্ত!

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক প্রধান রেপুর্টিয়র প্রফেসর ড. রান্ডাল সের্ভেনি এর মতে, আধুনিক প্রযুক্তি বজ্রপাতের পুরো বৈজ্ঞানিক বিষয় বুঝতে সহায়ক হতে পারে যা জনজীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখবে। প্রযুক্তি ও গবেষণা থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান তথ্য বজ্রপাতের স্কেল ও মেগা বিদ্যুৎচমকানোর সীমা নির্ধারণে সহায়ক হবে যা প্রকৌশল, সুরক্ষা ও বৈজ্ঞানিক অনুধাবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লিখিত বাস্তবতায় চ্যালেঞ্জ হলো জীবন বাঁচাতে ও দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষা পেতে বজ্রপাতের আগাম সতর্কতা। এখন কথা হলো – বজ্রপাতের সময় ও স্থানভিত্তিক আগাম সতর্কতার সক্ষমতা আমরা কবে অর্জন করব? আর ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে এ তথ্য পৌঁছানোর চ্যানেল কী হবে?

বজ্রপাতের দুর্ঘটনা থেকে জনজীবন সুরক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতার জন্য দরকার নির্ভরযোগ্য আগাম সতর্কতা। সময় ও স্থানভিত্তিক নির্ভরযোগ্য আগাম সতর্কতার জন্য প্রয়োজন হলো সক্ষমতা অর্জন। যথাযথ সক্ষমতার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলো গবেষণা ও সঠিক আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার।

ডপলার ওয়েদার রাডার, জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সিস্টেম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা প্রযুক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমে সময় ও স্থানভিত্তিক বজ্রপাতের আগাম সতর্কতার পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। এজন্য ফোরকাস্ট এজেন্সির একটা নিজস্ব স্টুডিও থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। এ স্টুডিও থেকে বজ্রপাত, বজ্রঝড়, টর্নেডো প্রভৃতির আগাম সতর্কতা যেটা ৩০ মিনিট থেকে ৩ ঘন্টা আগে নাওকাস্ট আকারে জনস্বার্থে প্রচার করতে পারবে।

ডপলার রাডারের এনিমেশন ছবির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এলাকা সম্ভব হলে উপজেলা/ইউনিয়ন উল্লেখ করে ৩০ মিনিট থেকে ৩ ঘন্টা আগে কিছুক্ষণ পরপর জনসাধারণকে নিরাপদ জায়গায় থাকতে নির্দেশনা প্রদান করলে অনেক জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। যেহেতু বজ্রপাত অল্পসময়ের জন্য ঘটে তাই ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা নিরাপদ জায়গায় থাকতে পারলে এর থেকে সুরক্ষা সম্ভব।

বজ্রপাতের সুরক্ষা নিয়মভিতরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন: বজ্রপাতের সুরক্ষায় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে ৩০-৩০ রুল মেনে চলতে। যদি বজ্রপাতের বিদ্যুৎচমকানো দেখা এবং বজ্রের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৩০ সেকেন্ড এর কম হয়, তাহলে অভ্যন্তরে থাকুন। বজ্রপাতের শেষ বিদ্যুৎচমকটি দেখার পর ৩০ মিনিট অভ্যন্তরে অপেক্ষা করুন এবং বাইরের সব কাজ বন্ধ রাখুন। অতএব, বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় সবাইকে ৩০-৩০ নিয়ম মেনে চলতে হবে।