পাকিস্তানের হাল-হকিকত

শাহীন রেজা নূর
Published : 30 May 2020, 11:50 AM
Updated : 30 May 2020, 11:50 AM

কেমন আছে পাকিস্তান? সম্প্রতি সেখানে প্রকাশিত পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে- বিশেষ করে নারী ও শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা এক কথায় ভয়াবহ। অন্যদিকে আবার চীনা অর্থনৈতিক সহায্যকে ঘিরে যে লুটপাটের চিত্র অপর এক সরকারি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাও পাকিস্তানিদের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে বৈকি! ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব ধর্মাবলম্বী নারীদের উপর যে জঘন্যতম নির্যাতন চালায় বর্তমানে পাকিস্তানিরা নিজ দেশের নারীদের উপর চালাচ্ছে অনুরূপ নির্যাতন। অনার কিলিংয়ের নামে তো বটেই তাছাড়াও সার্বিকভাবে গ্রামে-গঞ্জে নারী নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বেশুমার। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০১৯ সালে ২৮৪৬টি শুধুমাত্র শিশুদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ নথিভুক্ত হয় সেখানে। আর অনথিভুক্ত অভিযোগ যে এক্ষেত্রে এর চাইতে ঢের বেশি সে কথা তো বলাই বাহুল্য! প্রতিবেদনটিতে পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে বহু 'সম্মান রক্ষায় খুন' বা অনার কিলিংসহ অজস্র নারী হত্যার বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে। আর পুলিশ ও বিচারবিভাগ এই অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাচ্ছে না বলে অভিযোগে প্রকাশ। পাক সেনারাই শুধু নয়, নারী নির্যাতনের ব্যাপারে ধর্মীয় নেতারাও পিছিয়ে নেই। সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিদিন পাকিস্তানের গ্রামগুলিতে গড়ে ১১ জন নাবালিকা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণ, 'সম্মান রক্ষায় খুন' আর বধূ নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা সেখানে। পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত ইমরান খানের দেশে গ্রামাঞ্চলে বলতে গেলে নারী শিক্ষার কোনো বালাই নেই। আর নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়? সে তো বাংলাদেশের তুলনায় 'বহুত দুরস্ত'। বাল্য বিবাহ রোধের কোনো উদ্যোগই নেই, নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় কোনো প্রকার পরিকাঠামোও তৈরি হয়নি সেখানে আজও। ধর্মীয় নেতা ও সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল বর্তমানের সরকার নারীদেরকে পর্দানশীন থাকতে বাধ্যই করছে মাত্র। মোদ্দাকথা, ঐ প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানে নারী স্বাধীনতা বলে কিছু নেই আর এক্ষেত্রে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্চ্য করলেই নেমে আসে সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন!

উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াউল হকের আমল থেকে এই নারী নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পবিত্র কোরানের অপব্যাখ্যা করে ধর্মীয় মৌলবাদীরা এই নির্যাতনকে সামাজিকভাবে 'জায়েজ' করে রেখেছে। মেয়ে হিসেবে জন্মানোটাই 'আসলি গুনাহ'- মৌলবাদীদের এমন মিথ্যা প্রচারণাও হালে পানি পাচ্ছে ধর্মীয় কুসংস্কারের অবাধ চর্চার কারণে।

এ তো গেল এক দিক। অন্যদিকে আবার পাকিস্তানের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্রও যে বড় নাজুক! ফলে, বেকারত্ব যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মানুষের অভাব-অনটন ও দুর্গতি। পুরুষদের অনেকেই জীবিকার প্রয়োজনে যেন-তেন প্রকারে দেশ ত্যাগ করছে আর নারীরা পোহাচ্ছে এমন দুরবস্থা যে বাঁচার জন্য তাদের অনেককেই পতিতাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হতে দেখা যাচ্ছে !

চীনা ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস

চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে যে বিপুল ব্যয় সাপেক্ষ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে বেশ কয়েকটি চীনা বেসরকারি কোম্পানির ব্যাপক অস্বচ্ছতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। পাকিস্তানে বিদ্যুতের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখার জন্য সম্প্রতি সরকার নিয়োজিত একটি তদন্ত কমিটির ২৭৮ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চীনা বেসরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় এক'শ বিলিয়ন রুপির দুর্নীতি করেছে। আর এর জের স্বরূপ বিদ্যুতের ক্ষেত্রে জনসাধারণকে দিতে হচ্ছে বাড়তি মূল্য। এতকাল পাকিস্তানি সামরিক কিংবা বেসামরিক সরকার মাত্রেই চীনকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে দেখে আসছে। শধু তাই নয়, তারা জনসাধারণের মনেও এই বিষয়টি নানা প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গেঁথেও দিতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের মোকাবেলায় চীন যে তাদের পরমতম মিত্র এই কথা তাই সেখানকার জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বৈকি! কিন্ত, চীনা বিনিয়োগ আর চীনা ব্যবসায়ীদের এই সব জাল-জুয়াড়ি ও প্রতারণামূলক কার্যকলাপ তাদের সে ভাবমূর্তি কতটা ধরে রাখতে সক্ষম হবে এবার সেটিই দেখবার পালা! কেননা, পাকিস্তানি নাগরিকেরা এখন পরম বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছে, সেই বিশস্ততম বন্ধু রাষ্ট্রের হৃদয়হীন ও অসাধু আচরণ !

তদন্ত প্রতিবেদনের মতে, কৃত ঐ এক'শ বিলিয়ন রুপির দুর্নীতির এক তৃতীয়াংশের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট চীনা প্রতিষ্ঠানগুলি সরাসরি জড়িত আর তারা এই কাণ্ড ঘটাতে পেরেছে স্থানীয় পাকিস্তানি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায়। ভুয়া কাগজপত্র দাখিলের মাধ্যমে স্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি, নির্মাণকালীন সুদের রেয়াত প্রাপ্তির ব্যবস্থাকরণ ও নির্ধারিত সময়ের চাইতে অনেক বেশি সময় যাবৎ এই সুবিধা ভোগ ইত্যাদি নানা প্রকারের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এই বাড়তি মুনাফা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। মোদ্দাকথা, এই জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে চীনা কোম্পানিগুলি মুনাফার নামে অবিশ্বাস্য অংকের অর্থ আদায় করেছে। এদিকে, ভীষণ রকমের নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দেশের অর্থনীতির সংস্কার সাধনের পরিবর্তে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলার ধুয়া তুলে ঋণের পুনর্বিন্যাস ও সুদ মওকুফের জন্য দাতাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। তবে, দাতারা পাকিস্তানের অর্থনীতির একের পর এক ধসের এই চিত্রদৃষ্টে বার বার একে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হবে কিনা সেটাও দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে সকলকে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে হাডসন ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক পরিচালক হুসেন হাক্কানির মতে, পাকিস্তানের প্রতি চীনের এই অশুভ আচরণের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা অর্থনৈতিক সংস্থাগুলির উচিত পাকিস্তানি অভিজাত শাসকগোষ্ঠীকে আর কোনোরকম সহযোগিতা না করা। এক প্রতিবেদনে সেখানকার বর্তমান সংকটাপন্ন অর্থনীতির বিশ্লেষণ-পূর্বক তিনি বলেন যে, পাকিস্তানে আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিরাট ফারাক দৃশ্যগোচর হয়ে উঠেছে আর এর কারণ হচ্ছে ব্যাপকহারে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও দায়বদ্ধতার একান্ত অভাব। আর এমত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সেখানে করের হার ও বিদ্যুতের মূল্য আরও বৃদ্ধির জন্য চাপ প্রয়োগ করে চলেছে। যাহোক, উপসংহারে বলা যায় যে, চীনা বিনিয়োগ এখন পাকিস্তানের জন্য গোদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে !