নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন: নরেন্দ্র মোদী কি মুসলিম বিদ্বেষী?

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 24 Dec 2019, 09:38 AM
Updated : 24 Dec 2019, 09:38 AM

"আসল টুকরে টুকরে গ্যাঙ দিল্লির ক্ষমতায় যারা বসে আছে তারাই। তারাই দেশকে ধর্মের নামে, ভাষার নামে ভাগ করতে চাইছে।"

– রামচন্দ্র গুহ, ইতিহাসবিদ

১১ ডিসেম্বর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশের সাথে সাথে উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো ভারত। এ আইনের প্রতিবাদে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার বাদে দলমত, জাতি, ভাষা এবং ধর্ম নির্বিশেষে মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে সর্স্তরের মানুষ নেমে এসেছেন রাস্তায়। ভারত স্বাধীন হবার পর পুরো দেশ জুড়ে এমন প্রতিবাদ ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায় নাই।

পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, সব রাজ্যে, সব জায়গায় মানুষ শরিক হচ্ছেন বিক্ষোভে। সব মিছিলের, সব জনস্রোতের দাবি একটাই। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান আইন বাতিল করতে হবে। নাগরিকপঞ্জির নামে গরীব মানুষকে হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

নাগরিকত্ব আইনে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সাল পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন এবং পার্শিরা ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, এ আইনে বাদ দেওয়া হয়েছে মুসলমান এবং নাস্তিকদের। অর্থাৎ, মুসলমান এবং নাস্তিকরা নির্যাতিত হলেও নাগরিকত্ব পাবেন না।

আইনটি ১৯৫৫ সালের নাগরিক আইনের সংস্কার। এতে ভারতের সংবিধানের মূলনীতি সেক্যুলারজমের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে নাগরিকত্ব লাভের শর্ত হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব পাবার কথা বলা হলেও বাদ দেওয়া হয়েছে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং চীনের তিব্বতকে। উল্লেখ্য, এ দুটি দেশ এবং তিব্বতে সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় এবং জাতিগত কারণে নিপীড়নের শিকার।

এ আইনের ফলে হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় থাকলেও– যে কয়েক লক্ষ্য হিন্দু তামিল, বৌদ্ধ সিংহলী দ্বারা জাতিগত এবং ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে এসে তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিয়েছেন– তারা নাগরিকত্ব পাবেন না। হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও নাগরিকত্ব পাবেন না হিন্দু রোহিঙ্গারা। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১ শতাংশ হিন্দু।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় সংহতি বা ভাতৃত্ববোধের জায়গা থেকে এ আইনটি করা হয়নি। কেননা, অনেক হিন্দুও এ আইনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিক হতে পারবেন না। একটি হিন্দুত্ববাদী দল দুনিয়ার সকল হিন্দুর প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, সকল হিন্দুকে অন্তত একই চোখে দেখবেন, এটা মনে করাই স্বাভাবিক। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ সকল হিন্দুকে যেমন একই চোখে দেখে না, তেমনি সকল হিন্দুর স্বার্থ নিয়েও হিন্দুত্ববাদী নেতারা চিন্তিত নন।

হিন্দু ধর্মভিত্তিক এ রাজনৈতিক মতবাদ কার্যত উত্তর ভারতীয় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে চায়। দেশটির দলিত এবং দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা এ মতবাদের লক্ষ্য নয়। বস্তুত হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নয়, বরং বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার যে বৃহত্তর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে, সে পরিকল্পনার প্রথামিক ধাপ হিসাবে এ নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, তাদের বৃহত্তর পরিকল্পনাটা আসলে কী?

বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবার এবং তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদী কখনো তাদের পরিকল্পনার কথা গোপন রাখেননি। তারা বিভিন্ন সময় জনগণের কাছে ভারতকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ্যেই তুলে ধরেছেন। এ পরিকল্পনা অনুসারে ধাপে ধাপে তারা সেক্যুলার ভারতকে সম্পূর্ণরূপে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান।

গণতন্ত্র এবং সেক্যুলারিজম হল ভারতীয় সংবিধানের দুটি মূল স্তম্ভ। মোদী এবং তার দল বিজেপির প্রাথমিক লক্ষ্য হল এ সেক্যুলারিজম থেকে প্রথমে ভারতীয় রাষ্ট্রকে মুক্ত করা। তারপর ধীরে ধীরে পুরো ভারতীয় সমাজ থেকে সেক্যুলারিজমের আদর্শকে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র এবং সমাজের হিন্দুত্ববাদী রূপান্তর ঘটানো। আর এ সেক্যুলারিজম পুরোপুরি উচ্ছেদ হয়ে গেলেই সংবিধানের আরেক স্তম্ভ গণতন্ত্র আপনা আপনি ধ্বসে পড়বে।

ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা ভয়টা পাচ্ছেন এ জায়গাটাতে। তারা মনে করেছেন ভারতকে সেক্যুলারিজম থেকে বের করে এনে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্রমান্বয়ে ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেশটিকে একটি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে।

একটি রাষ্ট্র সেক্যুলার হলেই যে গণতান্ত্রিক হবে তা নয়। সেক্যুলার উপাদানকে ধারণ করেই বহু রাষ্ট্র এক দলীয় সমাজতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক হয়েছে। কিন্তু আবার এ সেক্যুলার উপাদানকে বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্র গণতান্ত্রিকও হতে পারেনি।

সাধারণত দেখা গেছে, যে সমস্ত রাষ্ট্রে সেক্যুলারজিমের উপাদান অধিক, সে সমস্ত রাষ্ট্র অধিক গণতান্ত্রিক। অপরদিকে, যে সমস্ত রাষ্ট্রে সেক্যুলারজিমের উপাদান কম, তুলনামূলকভাবে তারা কম গণতান্ত্রিক। কেননা, সেক্যুলারিজমের মূল ধারণাই হচ্ছে একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল ধর্ম এবং বিশ্বাসের মানুষকে রাষ্ট্র কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।

সেক্যুলারিজমের বিপরীতে "হিন্দুত্ববাদ", "ইসলামপন্থা", "জায়ানিজম"(ইহুদী মৌলবাদ) ইত্যাদি রাজনৈতিক মতবাদের লক্ষ্য হল বিশেষ বিশেষ ধর্মাবলম্বী বা বিশ্বাসের মানুষকে রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বিযুক্ত করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা। এ সমস্ত মতবাদের অনুসারীরা যে যে দেশে ক্রিয়াশীল, সে সমস্ত দেশের প্রধান ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তারা তাদের রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান প্রতিবন্ধক বা শত্রু মনে করে।

এ জন্য "জায়ানিজম" মুসলমানদের, "ইসলামপন্থীরা" দেশভেদে হিন্দু বা খ্রিস্টানদের এবং "হিন্দুত্ববাদীরা" মুসলমানদের তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের অন্তরায় মনে করে। কিন্তু এ সমস্ত মতবাদের আবার একটা জায়গায় মিল রয়েছে।

উপরোক্ত সমস্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারীগণ নাস্তিক্যবাদ এবং নাস্তিকদের রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য বিপদজনক মনে করেন। এর বিরুদ্ধে দেশ নির্বিশেষে তারা সবাই একই ভাষায় সোচ্চার।

নাস্তিকতাকে নিরূপণ করবার ক্ষেত্রে যারা শুধু চর্চা এবং বিশ্বাসের দিক থেকে নাস্তিক, শুধু তাদেরকেই চিহ্নিত করবার মধ্যে দিয়ে তারা সীমাবদ্ধ থাকেননি। তারা এর পরিধি আরো বিস্তৃত করে কমিউনিস্ট পার্টিসহ সমস্ত ঘরানার বামপন্থীদেরও এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, সারাবিশ্বের বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত নেতাকর্মীদের বড় অংশটি ব্যক্তি জীবনে বিশ্বাস এবং চর্চার দিক থেকে নাস্তিক নন। নাস্তিকতা প্রচার এবং প্রসারও তাদের উদ্দেশ্য নয়।

বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে "ইসলামপন্থী" এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা নাস্তিকতার ধারণাকে আরো ব্যাপক পরিসরে নিয়ে গেছেন। তাদের কাছে সেক্যুলার রাজনীতির সমর্থকরাও হচ্ছেন নাস্তিক।

এখন দেখা যাক হিন্দুত্ববাদের অনুসারী নরেন্দ্র মোদী এবং তার সঙ্ঘ পরিবার ভারতে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাদেরকে প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করেন। এ বিষয়টা বুঝতে পারলেই বোঝা যাবে কেন নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছে।

মোদী এবং তার অনুসারীদের কাছে মুসলমান এবং বামপন্থীরা হচ্ছে ভারত তথা হিন্দুত্ববাদের শত্রু। ভারত ও হিন্দুত্ববাদ তাদের কাছে সমার্থক এবং একে অন্যের পরিপূরক। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ইসলামপন্থীদের মতো ভারতের হিন্দুত্ববাদীরাও বামপন্থীদের নাস্তিক মনে করেন। তাই তারা ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই বাম এবং উদারনৈতিক ধারার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অধ্যাপকরা হামলা, মামলা, গ্রেফতার, খুন, হয়রানি ইত্যাদির শিকার হচ্ছেন। বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার চাচ্ছে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে তাদের চিরতরে নিশ্চুপ করে দিতে। একইভাবে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের লক্ষ্য হল মুসলিমদের রাষ্ট্র এবং সমাজের আরো প্রান্তে ঠেলে দেওয়া। আর নাগরিকত্ব আইন হল এরই একটি প্রথমিক পদক্ষেপ।

এ আইনের প্রাথমিক শিকার হবেন অতি দরিদ্র মুসলমানরা। কারণ, এ অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কাগজপত্র বহন করা বা বোঝা সম্ভব নয়। ফলে, এদের একটা বড় অংশকে নাগরিক না বলে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে, এ দুই দেশের সরকারকেও বিজেপি ক্রমাগত একটা বাড়তি চাপে রাখতে পারবে।

মুসলমানদের একটা অংশকে রাষ্ট্রহীন করার এ সংশোধিত নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে ভারতের মানুষ যে রুখে দাঁড়াবে, তাদের ক্ষমতার ভিত যে কেঁপে উঠবে, বিজেপি নেতৃবৃন্দ এটা ভাবতে পারেননি। অন্য অনেক কিছুর মত ধর্মের মোড়কে এ নাগরিক আইনকেও তারা গলধঃকরণ করাতে পারবে বলে ধরে নিয়েছিলেন।

বিজেপির ছয় বছরের ব্যর্থ শাসনে জনগণের একটা বড় অংশ এমনিতেই ক্ষুদ্ধ। গুজরাট মডেলের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসা মোদীর শাসনামলে ভেঙ্গে পড়েছে অর্থনীতি। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ অভিমুখী, যেখানে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ৮ এর উপরে। চাকুরী হারিয়েছে ৯০ লক্ষের অধিক মানুষ।

যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার ভয়াবহ। কৃষকদের আত্মহত্যার হার যেমন উর্ধ্বমুখী তেমনি নারী ধর্ষণ এবং নিপীড়ন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তার উপরে সঙ্ঘ পরিবার নারীদের ঘরে ফিরে যাবার ফতোয়া দিচ্ছে। ধর্ম নির্বিশেষে ভারতীয় নারীরাই বলছেন বিজিপির শাসনে ভারতে আজকে একটি গরুর মূল্য নারীর চেয়ে বেশি।

এমতাবস্থায়, সংশোধিত নাগরিক আইন জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে একটি ব্যর্থ সরকারের মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাবার ষড়যন্ত্র হিসাবে। তাই সংবিধনের সেক্যুলার মূলনীতির বিরোধী এ ধারার বিরুদ্ধে মাঠে নেমে এসেছেন সারা ভারতের জনগণ।

বিজেপি বুঝে উঠতে পারেনি যে, সমাজে সেক্যুলার মূল্যবোধের এখনো এত শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। তাই এ ধরণের গণবিস্ফোরণ বিজেপিকে স্তম্ভিত করেছে। ধর্মীয় রাজনীতির আফিমে আচ্ছন্ন বিজপির নেতারা তাই রাজনীতির হিসাবটা মিলাতে পারছেন না। তারা ধরে নিয়ে বসে ছিলেন, ভারতের বড় পরিবর্তন তারা ঘটিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। ধর্মের মোড়কে সব কিছুই তারা এখন এ জাতিকে খাওয়াতে পারবেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এ আইন বাতিলের দাবিতে একদিকে যেমন জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে, তেমনি নেমে এসেছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ জাতীয় আঞ্চলিক পর্যায়ের সেক্যুলার দলসমূহ। তারা শুধু প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তারা এখন এ আইন বাতিলের সাথে সাথে অমিত শাহ্‌র পদত্যাগেরও দাবি করছেন। বামপন্থীরা আরো এক ধাপ এগিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন ইনকিলাব জিন্দাবাদের।

এ বিক্ষোভে বাম দলগুলো অনেকটা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে। লক্ষ্যণীয় যে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে মুসলিমদের একটা বড় অংশ বাম দলগুলো থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখলেও, ভারতে মুসলমানদের প্রিয় হচ্ছে বাম দলগুলো।

মুসলমানদের কাছে বামপন্থীরা আগেও প্রিয় ছিলেন। এবারের বিক্ষোভে বামপন্থীদের ভূমিকা মুসলমানদের তাদের আরো কাছে এনেছে। তাই সারা ভারত জুড়ে মুসলমানদের হাঁটতে দেখা যাচ্ছে বামপন্থীদের মিছিলে। শুধু যে প্রগতিশীল হিসাবে পরিচিত মুসলিমরাই হাঁটছেন তা নয়। বামদের সাথে হাঁটছেন মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার ছাত্র, পর্দানশীন গৃহবধুরাও।

মুসলমানরা দাবি তুলছেন সেক্যুলার ভারত পুনরুদ্ধারের। একটা বিষয় ভারতের মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার। সেটি হল সেক্যুলারিজম ছাড়া হিন্দুত্ববাদ বা অন্য কোনো মতবাদ ভারতে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না। আর তাদের কাছে এ বিষয়টাও সব সময় পরিস্কার যে, বামপন্থীদের অন্য অনেক সমস্যা থাকলেও, ভারতবর্ষে সেক্যুলারিজমের প্রশ্নে তারা সব সময় আপোষহীন।

এখানে উল্লেখ্য যে, ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের মুসলমানদের সাথে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের একটা বড় দাগে পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় অংশ মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং "ইসলামপন্থার" রাজনীতি সমর্থন করেন। এর বিপরীতে ভারতের মুসলমানদের বড় অংশটি সেক্যুলার এবং বাম রাজনীতির সমর্থক।

সেক্যুলার সংবিধান, কংগ্রেসসহ শতাধিক সেক্যুলার (কাগজে কলমে হলেও) দল এবং সিপিআই(এম), সিপিআই-সহ বামপন্থী দলগুলোর শক্তিশালী উপস্থিতি ভারতে সেক্যুলারিজমকে একটা শক্ত বুনিয়াদ দিয়েছে। যার ফলশ্রুতি হল, মুসলমানদের বড় অংশের মাঝে সেক্যুলার এবং বাম ধারার উপস্থিতি।

অপরদিকে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে সেক্যুলার সংবিধানের অনুপস্থিতি, শাসক দলগুলোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে ধর্মের ক্রমাগত ব্যবহার, শতাধিক "ইসলামপন্থী" দলের উপস্থিতি- ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে। এ সংস্কৃতি জনগণের বড় অংশের মাঝে সেক্যুলারিজম এবং বামপন্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে।

এ নেতিবাচক ধারণার কারণেই পাকিস্তানে যখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি হওয়া সাংবিধানিকভাবেই অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ করা হল তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জনগণ রুখে দাঁড়ায়নি। তেমনি, তারা আজও কার্যকর অর্থে প্রতিবাদ দাঁড় করাতে পারছে না দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত ঘটে যাওয়া নিপীড়নের বিরুদ্ধে । আর এই জায়গাটিতেই ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা অঙ্গুলি নির্দেশ করছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। তারা প্রশ্ন তুলছে, নিজের দেশে সেক্যুলার রাষ্ট্র দেখতে না চেয়ে এ দুটি দেশের জনগণ কেন সেটি শুধু ভারতেই দেখতে চায়।

ভারতের মুসলমানদের মাঝে সেক্যুলারিজম এবং বামপন্থার প্রভাব পাশ্চাত্যের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর সে ধারণাকে খারিজ করে দেয়, যারা বলতে চান মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই রক্ষণশীল। তাদের মাঝে সেক্যুলার এবং বাম ধারার রাজনীতি জনপ্রিয় হবে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, শুধু ভারতে নয়, সুকর্ণ এর সময় ইন্দোনেশিয়া, শাহের আমলে ইরান এবং সত্তর দশকে আফগানিস্তানে মুসলমানদের মাঝে সেক্যুলার বাম ধারা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু সেই পাশ্চাত্যকেই আমারা দেখেছি, এ সমস্ত দেশের বামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রক্রিয়াকে হয় সমর্থন দিতে, নয়ত চুপ থাকতে।

ভারতের নাগরিকত্ব আইন বিরোধী বিক্ষোভে বাম ধারার দলগুলো ছাড়া আর যেসব দল জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে তাদের সবারই মতাদর্শ হচ্ছে সেক্যুলারিজম। তবে সেক্যুলার বলে দাবিদার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রসের ভূমিকা এ আন্দোলনে যেন অনেকটাই দায়সারা গোছের। অংশগ্রহণ করতে হয় বলেই যেন করা; যদিও তাদের বেশ কিছু নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং আহত হয়েছেন। অবশ্য বিষয়টা এমনও হতে পারে সারা ভারতের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আজকে দলটি হারিয়েছে। এছাড়া এটা ভুলে গেলেও চলবে না যে, অতীতে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে তারাও ব্যাবহার করেছে।

নরেন্দ্র মোদীর বিদ্বেষের শিকার মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে কিছু হিন্দুত্ববাদী বাদে পুরো ভারতবাসী আজ এক হয়ে পথে নেমেছে। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দলমত এবং ধর্ম নির্বিশেষে এ বিক্ষোভ, হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার সত্ত্বেও, ভারতের জনগণের একটা বড় অংশ যে সেক্যুলার এবং উচ্চ মানবিক মুল্যবোধ ধারণ করেন, সে বিষয়টা তুলে ধরে।

মুসলমানদের অধিকার প্রশ্নে এ আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ধর্ম নির্বিশেষে ২৫ জন প্রাণ দিয়েছেন। এর মধ্যে দিয়ে তারা প্রমাণ করেছেন, মননগতভাবেই ভারতের জনগণের বড় অংশ অসাম্প্রদায়িক। সংখ্যালঘুদের স্বার্থে এ ধরণের আত্মত্যাগ পাকিস্তানী জনগণের কল্পনারও অতীত। মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে ভারতের এ আন্দোলনের চরিত্র গুণগতভাবে সেক্যুলার। এটি শুধু সেক্যুলার রাষ্ট্রের পুনরুদ্ধারের আন্দোলন নয়। কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে ভারতকে সত্যিকার সেক্যুলার রাষ্ট্রে রূপান্তরের আন্দোলনও।

এ আন্দোলন সফল হবে কিনা তা এখনই বলা মুশকিল। সফল না হলে এটি যে আরো দীর্ঘদিন ধরে চলবে সেটি স্পষ্ট। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব যে আগামী নির্বাচনে পড়বে তার আলামত ঝাড়খন্ড নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে।

এ আন্দোলনের প্রভাব যে শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়। সংখ্যালঘু মুসলমানের অধিকাররের প্রশ্নে ভারতীয় জনগণের আত্মত্যাগ এবং আন্দোলন প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বামপন্থী সেক্যুলার রাজনীতিতে গতি সঞ্চার করবে।

বাংলাদেশে অনেকে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে এ আন্দোলনকে সমর্থন দেবার প্রশ্নে দ্বিধান্বিত। তারা মনে করছেন ১৯৭১ সালে ভারত যেহেতু আমাদেরকে সাহায্য করেছে, তাই এ আন্দোলনকে সমর্থন করার মানে হচ্ছে ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া। কিন্তু যে বিষয়টা তারা ভুলে যাচ্ছেন সেটা হল, ১৯৭১ সালে হিন্দুত্ববাদীরা নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।

১৯৭১ সালে এ হিন্দুত্ববাদীরা মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করেনি। সেদিন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআইসহ অন্য সেক্যুলার দলগুলো। বামপন্থী দলগুলোর অফিস এবং কর্মীদের বাসা সেদিন হয়ে উঠেছিল অনেক বাংলাদশী মুক্তি সংগ্রামীর আশ্রয়স্থল।

আজ তারা হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা আক্রান্ত। আজকে বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের সময় এসেছে ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবার। আর আমরা সেটা করতে পারি তাদের আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করে।