কেনিয়ায় বঙ্গবন্ধু

আনিসুর রহমান
Published : 11 Nov 2021, 06:19 PM
Updated : 11 Nov 2021, 06:19 PM

আমাদের জাতি পরিচয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বহুল সমাদৃত দুই মহান বাঙালির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকায় যাননি, আর বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে কেবল একবার ছায়াবৃত আফ্রিকা মহাদেশের আলজেরিয়ায় ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতাধিক বছর পূর্বে নোবেল পুরস্কার পেয়ে জগৎবিখ্যাত। আফ্রিকা মহাদেশের লেখালেখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে কারো কারো কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেকটা পরিচিত হলেও জনমানুষের কাছে সেই অর্থে তার নামটি ততটা আপনার নয়, যতটা আপনার বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী।

উপনিবেশকালীন বা উপনিবেশ পূর্ব ইতিহাসে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধী নানাভাবে ব্যাপক প্রাসঙ্গিক। উপনিবেশ উত্তর রাজনীতিতে যে গুটিকয়েক রাজনীতিবিদ বিশ্বদরবারে আশা জাগানিয়া আলো ফেলেছিলেন তাদের মধ্যে এশিয়া মহাদেশের বঙ্গবন্ধু, আফ্রিকা মহাদেশের নেলসন ম্যান্ডেলা এবং দক্ষিণ আমেরিকার সালভাদর আলেন্দে অন্যতম। বর্তমান আফ্রিকা মহাদেশের উপনিবেশ উত্তর জাতিরাষ্ট্রের বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু দিন দিন আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। এর পেছনের গূঢ় তাৎপর্য কী?

উপরের প্রশ্নের সুরাহা করবার আগে কবিগুরুর 'আফ্রিকা' শীর্ষক কবিতা নিয়ে দুয়েকটি কথা বলতে চাই। রবীন্দ্রনাথ তার গোটা জীবনে ৩৩টি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করলেও আফ্রিকা মহাদেশের কোনো দেশ এই তালিকায় নাই। কবিগুরু কেন আফ্রিকা মহাদেশের জমিনে পা ফেলার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারলেন না? এই প্রশ্ন আমার মাথায়, যার উত্তর অজানা। কিন্তু তিনি আফ্রিকার মাটিতে পা না ফেলে তার 'আফ্রিকা' কবিতায় যে চিত্রকল্প এঁকেছেন, আফ্রিকার যে গল্প বলে গেছেন, আফ্রিকার সুন্দরের যে ভাষা নির্মাণ করেছেন, রহস্যের যে কুলকিনারা করেছেন, দুনিয়াকে, দুনিয়ার স্রষ্টাকে যে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন তা চিরন্তনা দ্ৰুপদী।

কথিত আছে কবি অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ 'আফ্রিকা' কবিতাটি লেখেন ১৯৩৭ সালে। এই কবিতায় ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত বেলজিয়ামের দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা কঙ্গো রাজ্যে চালিত বর্বর নির্যাতন আর ইতালির ফ্যাসিবাদী একনায়ক মুসোলিনীর দ্বারা আবিসিনিয়ায় সংগঠিত বর্বরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই 'আফ্রিকা' কবিতায় তার ক্ষোভ ঝেড়েছেন। যদিও মুসোলিনী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু, মুসোলিনীর আমন্ত্রণে তিনি ইতালি সফর পর্যন্ত করেছেন।

এই পর্যায়ে 'আফ্রিকা' কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করতে চাই-

হায় ছায়াবৃতা,

কালো ঘোমটার নীচে

অপরিচিত ছিল তোমার মানব রূপ

উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।

এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,

নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,

এল মানুষ ধরার দল

গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ‍্যের চেয়ে

সভ‍্যের বর্বর লোভ

নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।

তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ‍্যপথে

পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,

দস‍্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়

বীভৎস কাদার পিন্ড

চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।

 

সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়

মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘন্টা

সকালে সন্ধ‍্যায় দয়াময় দেবতার নামে;

শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;

কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল

সুন্দরের আরাধনা।।

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করার আগে ও পরে জগতের নানা প্রান্তে ছুটেছেন, বক্তৃতা করেছেন, লিখেছেন নানা দেশ, সভ্যতা আর সংস্কৃতি নিয়ে। কিন্তু আফ্রিকার জমিন ছিল তার আয়ত্তের বাইরে।

এবার বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা নয় আফ্রিকার উপনিবেশ উত্তর উদীয়মান জাতিরাষ্ট্রের প্রায় সকলেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রজন্মের। শুধু ম্যান্ডেলা নন, তাদের প্রায় সকলেই সয়েছেন জেল-জুলুম আর অত্যাচার। যেমনটা কারাভাগ্য বরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু।

তাই উপনিবেশ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু কতটা প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় তা বিবৃত করার জন্যে একটি ঘটনার শরণ নিতে চাই। কিসি বিশ্ববিদ্যালয় নামে কেনিয়ার রাষ্ট্রপরিচালিত একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের স্নাতক পর্যায়ে নাটক ও সাহিত্যের পাঠ্যসূচিতে আমার লেখা দুটি নাটক অন্তর্ভুক্ত করে। এর একটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আমার এপিক মনোলগ 'আমি শেখ মুজিব' আর অন্যটি বিশ বছর ধরে ইরিত্রিয়ার কারাগারে বন্দী ইরিত্রিও-সুইডিশ নাট্যকার ও সাংবাদিক দাবিত ইসাককে নিয়ে লেখা নাটক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিস্ট্রেক থিয়েটার ইন্টারন্যাশনাল, নাইরোবিতে সুইডিশ দূতাবাস আর সুইডিশ ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় নাটক দুটি প্রযোজনা করে। নাটক দুটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেনিয়ার বিভিন্ন নাট্যশালা আর আন্তর্জাতিক নানা নাট্য উৎসবে মঞ্চস্থ হবে সামনের শিক্ষাবর্ষগুলোতে।

অক্টোবর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে আমি আর সুইডিশ দূতাবাসের একটি প্রতিনিধিদল নাটক দুটির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে যোগ দিই। এরপর নাইরোবিতে মার্কিন দূতাবাস তাদের সূত্র মারফত নাটকটির নির্দেশক ও নাট্যকলার শিক্ষক ড. ক্রিস্টোফার ওকেমওয়ারের কাছে নাটক দুটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। মার্কিন দূতাবাসের উদ্দেশে ক্রিস্টোফারের জবাব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আফ্রিকার শিক্ষাপরিমণ্ডলে আর নাটকের জগতে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

ক্রিস্টোফারের উত্তরটি ছিল এরকম, "নাটক দুটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আদিবাসী ভাষার অধিকারের মতো বিষয়কে উপজীব্য করেছে।"

ক্রিস্টোফারের উত্তর থেকেই আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোতে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধু তার জীবন দিয়ে এই বিষয়গুলোর পক্ষে লড়ে গিয়েছেন নিজ দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, একই সঙ্গে বিশ্বদরবারে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাই আফ্রিকার জন্যে আজ বড় তাৎপর্যপূর্ণ।

এখানে উল্লেখ করতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার কাছে জানতে চেয়েছিল তারা নাটক দুটি ইংরেজি অথবা সুয়াহিলি ভাষায় প্রযোজনা করতে চায়। নাটক দুটির বিশেষ করে এপিক মনোলগ 'আমি শেখ মুজিব'-এর তাৎপর্য বিবেচনায় নিয়ে আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম, নাটক দুটি ইংরেজির পরিবর্তে সুয়াহিলি ভাষায় প্রযোজনা করতে। কেননা বঙ্গবন্ধু নিজে আদিবাসী ভাষার পক্ষে লড়ে গিয়েছেন। এমনকি জাতিসংঘে নিজে মাতৃভাষায় বক্তৃতা করেছেন। শেষতক নাটক দুটি সুয়াহিলি ভাষায় মঞ্চায়িত হয়।

গত প্রায় বছরখানেক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর শিক্ষকরা নাটক দুটি নিয়ে কাজ করেছেন, অনুবাদ করেছেন, মুখস্থ করেছেন, মহড়া করেছেন। সীমিত বাজেট আর সামর্থ্যে চমৎকার দুটি প্রযোজনা মঞ্চে এনেছেন। কেনিয়ার নিজস্ব সংগীত, নৃত্য, মঞ্চকৌশল, সেট নির্মাণ আর পোশাক পরিকল্পনা করেছেন।

শুরুর দিক থেকে নাটক দুটির সঙ্গে জড়িতরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছিলেন। দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দায়িত্বশীল পর্যায়ে নাটকসংশ্লিষ্টরা যোগাযোগ করেছিলেন। সহযোগিতাও প্রত্যাশিত ছিল স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো তরফ থেকেই অনুপ্রেরণামূলক কোনো নজির স্থাপন করা হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বিব্রতকর পরিস্থিতির অবতারণা করা হয়েছে। শেষপর্যায়ে এসে আয়োজকদের অবস্থাটা এতটাই বিব্রতকর হয়ে উঠেছিল, যা বহুল ব্যবহৃত এই প্রবাদের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, 'ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও।'

কেনিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি জুমো কেনিয়াত্তাও দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়তে গিয়ে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত একটানা কারাবন্দী ছিলেন। যিনি আফ্রিকা ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইতিহাসের এরকম যোগসূত্রও বঙ্গবন্ধুকে মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসে যখন তার জন্মশতবর্ষে দেশটিতে তাকে নিয়ে নাটক প্রযোজিত হয়। কাকতালীয়ভাবে এমন একটি সময় কন্যার বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক প্রযোজনা করছে যে সময় দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনিয়াত্তা দেশের স্থপতি জুমো কেনিয়াত্তার ছেলে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর দেশ বাংলাদেশের সরকারপ্রধান তার কন্যা শেখ হাসিনা।

কেনিয়া আফ্রিকার এমন একটি দেশ যেখানে বাংলাদেশের একটি দূতাবাস আছে, এমনকি কথিত আছে যেখানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর ডালিমের যাতায়াত রয়েছে। এহেন একটি দেশে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একটি নাটকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দূতাবাসের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে আর কবে হবে? এরকম একটি উপলক্ষ কি খুব সহজে আসে?