‘জাতীয় কবি কোথায়?’

আনিসুর রহমান
Published : 27 Oct 2021, 09:34 AM
Updated : 27 Oct 2021, 09:34 AM

'জাতীয় কবি' বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। শৈশবে পড়াশোনার শুরুতেই এই বিষয়টির সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন যদিও জানিনি আসলে জাতীয় কবির মানে কি। ভেবেছি জাতীয় ফল যেমন কাঁঠাল, জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল এরকম বুঝি একজন জাতীয় কবিও থাকতে হয়। এরকমটা মাথায় রেখেই দিন দিন বড় হয়ে উঠেছি।

একপর্যায়ে জানতে শুরু করলাম রাজা বাদশাদের দরবারে একসময় সভাকবি বা রাজকবি প্রথা চালু ছিল। আধুনিক গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় নানাদেশে 'পোয়েট লরিয়েট' বা কবিশ্রেষ্ঠ বা রাজকবি, আবাসিক কবি, রিডিং অ্যাম্বাসেডর বা পঠন দূত প্রথাও চালু আছে। আমাদের দেশে চালু আছে হরেক কিসিমের পুরস্কার অনেক ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক সঙ্গে করেও এসব বিষয় চালু আছে। সভাকবি, রাজকবি বা কবিশ্রেষ্ঠ প্রথা এখনো চালু হয়নি।

আমরা খুব করে জানি, যুক্তরাজ্যে চালু আছে পোয়েট লরিয়েট প্রথা, এই পদ সম্পর্কে প্রথম পরিচিত হই ইংরেজ কবি টেড হিউজেসের কবিতা পড়তে গিয়ে, যিনি ছিলেন ব্রিটেনের পোয়েট লরিয়েট। এই প্রথা চালু হয় সপ্তদস্য শতকের গোড়াতে। প্রথম দিকে পোয়েট লরিয়েটের ভূমিকার মধ্যে ছিল জাতীয় বিবিধ উপলক্ষে কবিতা রচনা করা। এখন এই সম্মননাসূচক পদ বা খেতাবধারী কবি দশ বছরের জন্যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রানী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং পঠন ও সাহিত্যের অগ্রগ্রতি সাধনে ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে ব্রিটেনের পোয়েট লরিয়েট ইংরেজ কবি সাইমন আর্মিটেজ। ব্রিটেন চারটি রাজ্যের সমন্বয়ে একটি যুক্তরাজ্য হলেও ইংরেজভাষী ইংল্যান্ডের করায়ত্বে থাকা বাকি তিন রাজ্যে পোয়েট লরিয়েটের ভূমিকা তেমনটা উল্লেখযোগ্য নয়।

তাই বলে ওয়েলস কি হাজার বছর ধরে দমে থাকবে? তাই এই শতকের শুরুর দিকে ওয়েলস জাতি বা ওয়েলস অঙ্গরাজ্য চালু করেছে 'জাতীয় কবি' প্রথা। আমরা অনেকেই ধারণা করে থাকব ইংরেজি বুঝি গোটা যুক্তরাজ্যেরই ভাষা। কিন্তু সত্যটি ভিন্ন। ওয়েলশ ভাষা ব্রিটিশ সেল্টিক গোত্রভুক্ত তা মানুষের মুখে মুখে ছিল রোমান দখলদারিত্বেরও আগে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। অন্যদিকে ইংরেজির ইতিহাস চৌদ্দ শত বছরের, যে ইংরেজির আধুনিক ভিত্তি চসার এর হাত ধরে। বর্তমানে ওয়েলস একটি দ্বিভাষিক রাজ্য বা সরকারি ভাষা দুটি ওয়েলস এবং ইংরেজি।

আত্মপরিচয়ের তাগিদ থেকে আর গণতান্ত্রিক বিকাশের অংশ হিসেবে এই শতকের শুরুর দিকে ওয়েলস জাতি চালু করেছে জাতীয় কবি প্রথা। ওয়েলস-এর জাতীয় সাহিত্য কর্তৃপক্ষ লিটারেচার ওয়েলস বা ওয়েলসের সাহিত্য দফতর প্রতি তিনবছরের জন্যে একজন প্রতিথযশা কবিকে এই পদের জন্যে নির্বাচিত করেন। একজন কবি পরপর কয়েকবার নির্বাচিত হতে পারেন। দেশটির বর্তমান জাতীয় কবি তার দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়েলস-এর জাতীয় কবির ভূমিকা ইংল্যান্ডের 'পোয়েট লরিয়েট' এর কাছাকাছি হলেও ওয়েলসে জাতীয় কবির তাৎপর্য অনেকটা সাংস্কৃতিক দূতের মতো। বিদেশের নানা উৎসব, মেলা বা সাহিত্য সংস্কৃতির মেলা ওয়েলসের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করা।

এবার জাতীয় কবি সম্পর্কে আরো বিশদ কিছু বলবার আগে ওয়েলস এবং ওয়েলশ ভাষা সাহিত্য নিয়ে এত কথা বলবার কারণটা একটু বলে নিতে চাই। গতমাসে সামাজিক পঠন উন্নয়ন ও সাহিত্য বিষয়ক উদ্যোগ, Word4Word কোম্পানি এবং ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে এক সপ্তাহের জন্যে আবাসিক লেখক হিসেবে গোটা ওয়েলসের জাতীয় সাহিত্য পরিকাঠামো সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করার সুযোগ আমার হয়েছিল।

এই সফরের উদ্দেশ্য সুইডেন, বাংলাদেশ আর ওয়েলসের সঙ্গে ত্রিদেশীয় সাহিত্য বিনিময়ের চলমান কর্মযজ্ঞকে বেগবান করা। সেই নিমিত্তে কেনিয়াকে সংযুক্ত করে এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপের সংযোগে ত্রিমহাদেশীয় সাহিত্য বিনিময়ে উদ্যোগী হওয়া। তারই অংশ হিসেবে সাতদিনের ঠাসা কর্মসূচির মধ্যে ছিল:

কামার্থেন নগরীর আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে অংশ নেওয়া, ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত নাট্যকলা বিভাগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এপিক মনোলগ 'আমি শেখ মুজিব'-এর নিরীক্ষামূলক প্রযোজনা নিয়ে ফলিত নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক আলি ফ্রাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক, ওয়েলস পেন এর সভাপতি কবি ও অনুবাদক মেনা এলফিনের সঙ্গে এপিক মনোলগের ওয়েলশ ভাষায় অনুবাদ বিষয়ে ধারণা বিনিময়। যিনি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ওয়েলশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন, যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল লেখালেখির শিক্ষক এবং Word4Word কোম্পানির পরিচালক ডমিনিক উইলিয়ামসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, কবি মেলানি পেরির সঙ্গে মতবিনিময়, ওয়েলশ কবি ডিলান থমাস জাদুঘর পরিদর্শন, ব্রিটিশ কাউন্সিল ওয়েলস-এর কলা বিভাগের প্রধান নাতাশা নিকোলসের সঙ্গে এপিক মনোলগে 'আমি শেখ মুজিব' নিয়ে ঢাকা ও ওয়েলসকে যুক্ত করে যৌথ প্রযোজনা বিষয়ে আলোচনা, ভারতীয় বংশোদ্ভুত লেখক গ্লেন পিটার, কবি মার্ক লিন্ডেন, কবি জ্যাকি বিগস, আর বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ব্যবসায়ী মাহবুব নূরের সঙ্গে মতবিনিময় অন্যতম।

শেষদিনের প্রথমভাগে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ওয়েলশ এবং সেল্টিক বিদ্যার অধ্যাপক সাহিত্য বিনিময় দফতরের পরিচালক এলিন জোন্স-এর সঙ্গে বাংলা ও ওয়েলশ ভাষায় পারস্পরিক অনুবাদ প্রকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে অলোচনা, জাতীয় আর্কাইভ পরিদর্শন করে কবি ডমিনিক আর আমি যাত্রা করি জাতীয় কবির সঙ্গে দেখা করতে।

এখানে উল্লেখ্য জাতীয় কবি বাস করেন উত্তরের এমন এক শহরে যা রাজধানী কার্ডিফ থেকে প্রায় পাঁচঘন্টার গাড়ির পথ। শহরটির নাম কায়েনারফোন।

জাতীয় কবি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কবি হেড উইন (Hedd Wyn) জাদুঘরে। এখানে কবি হেড উইন প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নিতে চাই। তিনি ছিলেন একজন সৈনিক কবি। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৭ সালে ওয়েলসের উত্তরাঞ্চলের মালভূমিতে কৃষক পরিবারে। তিনি ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেলজিয়ামে আহত হয়ে মৃত্যবরণ করেন। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। ওইসময় ব্রিটেনের আইন ছিল পরিবারে কোনো ছেলেসন্তান থাকলে কমপক্ষে একজনকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেই হবে, যুদ্ধে যেতে হবে। দেশটির আইন অনুযায়ী তাদের ভাইদের একজনকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেই হতো। প্রত্যাশিত ছিল তার ছোট ভাই যুদ্ধে যাবেন, এটা প্রায় ঠিক হয়েই ছিল। হেড উইন চৌদ্দ বছর বয়সে স্কুল ছাড়লেও কবিতা লেখা চালিয়ে যান, মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন কবি– অনেকটাই স্বশিক্ষিত স্বভাব কবি। কিন্তু তিনি মন থেকে এটা মানতে পারছিলেন না, বড় ভাই হিসেবে তিনি বাড়িতে থাকবেন আর ছোট ভাই যুদ্ধে যাবে। তাই স্থির করলেন তিনিই যুদ্ধে যাবেন, ছোট ভাই বাড়িতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। যুদ্ধে যাবার একবছরের মাথায় তিনি অকালে প্রাণ হারালেন।

তিনি যুদ্ধে যাবার আগে কবি হিসেবে অনেক নাম করেছিলেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় 'কবিচেয়ার' জিতেছেন বেশ কয়েকবার। মূলত রোমান্টিক ধারার কবিতা লিখেছেন তিনি। যুদ্ধে গিয়ে কিছু যুদ্ধবিষয়ক কবিতা লিখেছেন যেগুলো মূলত যুদ্ধবিরোধী কবিতা। যুদ্ধে হানাহানি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। সেই না মানা মন নিয়েই তাকে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। সেই রক্তক্ষরণ থেকেই তিনি লিখেছেন যুদ্ধ বিষয়ে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো কিছু কবিতা।

এই সৈনিক কবির জন্ম যে জনপদে সেই জনপদেরই আরেক কবি আজ ওয়েলসের জাতীয় কবি। তিনি কবি হেড উইনের ও্পর একটা প্রামাণ্যচিত্রও বানিয়েছেন। সৈনিক কবি হেড উইনের প্রতি তার অপার আগ্রহের কারণে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন হেড উইনের জন্মভিটা ওয়েলসের মালভূমির এক গ্রামে। হেড উইনের বাড়িটি ব্রিটেনের জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষের অধীনে একটা জাদুঘর। এখানেই দেখা হলো ওয়েলসের জাতীয় কবির সঙ্গে। জাতীয় কবির বয়ান থেকে দেখা হলো, জানা হলো পরলোকগত কবি হেড উইনকেও। জাতীয় কবি আমাদের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখালেন, বিশদ বলে গেলেন।

ওয়েলসের জাতীয় কবির সঙ্গে আমার আরো কিছু গল্প বলবার আগে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নিতে চাই। ওয়েলসের উত্তরাঞ্চলের আরেকটি জনপদ টি নিউইদ, যেখানে রয়েছে ওয়েলস থেকে ব্রিটেনের ইতিহাসে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ-এর বাড়ি। তার বাড়িটি ওয়েলস জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠানকে দান করা হয়েছে। এটি এখন জাতীয় লেখক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমার সফরের শেষ রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর বাড়িটিতে। প্রধানমন্ত্রীর নিজের ব্যবহৃত ঘরটি ছিল আমার শয়নকক্ষ, যেটির নাম দেয়া হয়েছে লয়েড জর্জ কক্ষ আর ডমিনিক ঘুমিয়েছিলেন জর্জের সহধর্মিনী মার্গারেটের কক্ষে।

জর্জ ১৯১৬ সাল থেকে ১৯২২ পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন জাতীয় ইস্তেদফো (National Eisteddfo) পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে সৈনিক কবি হেড উইনের ছদ্মনাম ফ্লেউর দে লিসা (Fleur de Lys) ঘোষণা করছিলেন তখনও রাষ্ট্র হয়নি যে, এই কবি আর ইহজগতে নেই। তিনবার নাম ঘোষণার পর যাজকের বরাতে জানানো হয় এই কবি ছয় সপ্তাহ আগেই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তারপর কবির জন্য নির্ধারিত চেয়ার কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। যাজকের পক্ষ থেকে কবির সম্মানে উচ্চারণ করা হয়, 'উৎসব চোখের জলে এবং কবি তার কবরে' ("the festival in tears and the poet in his grave"). এখানে উল্লেখ্য যে, যাজক ইভান রিস ডিফেদ (Evan Rees Dyfed) নিজেও একজন কবি ছিলেন।

এবার জাতীয় কবি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। জাতীয় কবির সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে যাত্রাপথে ডমিনিক জানাল জাতীয় কবি আমাকে ওয়েলসে স্বাগত জানিয়ে আমার একটা কবিতা ওয়েলশ ভাষায় অনুবাদ করে ডমিনিককে মেইল করেছেন। আমাদের গাড়ি হেড উইন জাদুঘর প্রাঙ্গনের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে। পার্কিং করে গাড়ি থেকে বের হতেই হৃষ্টপুষ্ট এক ভদ্রলোক আমাদের উদ্দেশে বললেন, স্বাগতম, আপনি কেমন আছেন। আমি তো পুরাই অবাক। আমি বললাম, ধন্যবাদ। এরপর ডমিনিক আস্তে করে বলল, উনি বাংলা শিখলেন কীভাবে? আমি বললাম, উনি কখনো হয়তো বাংলাদেশে বা কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারেন। ওই ভদ্রলোককে অনুসরণ করে জাদুঘরের কফি হাউসে বসে চা কফি খেতে খেতে আলাপচারিতা চালাচ্ছিলাম আর আমি মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম কখন জাতীয় কবির সঙ্গে আমাদের দেখা হবে।

ভদ্রলোক আমাদের টেবিল থেকে কোনো একটা প্রয়োজনে একটু দূরে যেতেই ডমিনিককে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, জাতীয় কবি কোথায়? ডমিনিক জানাল, আমরা যার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি ইনিই ওয়েলসের জাতীয় কবি ইফোর আপ গ্ল্যান (Ifor Ap Glyn)। এই কবি একবার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রয়োজনে ব্রাকের আমন্ত্রণে বছর কয়েক আগে বাংলাদেশে ঘুরে গিয়েছেন।