আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই চার নায়ক স্বাধীনতার অহংকার। নয়মাস তাদের সংগ্রাম আর নেতৃত্ব না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ বা দেশ স্বাধীন হওয়াটা ছিল অসম্ভব।
Published : 02 Nov 2022, 08:27 PM
আজকাল মানুষ রাজনীতির যেমন কথা শুনতে চান না, তেমনি হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে রাজনৈতিক নেতাদের কথাও কেউ বিশ্বাস করেন না। বলতে গেলে সমাজ, বিশেষত তারুণ্য এখন রাজনৈতিক দল বিমুখ। এই যে বিমুখতা এর কারণ আমাদের অজানা নয়। অনেকেই বলতে পারে, পরিবর্তিত বিশ্বের প্রায় সবদেশেই রাজনীতি বিমুখতা বেড়েছে। এ কথা সত্যি, তবে সেসব দেশে এখনও আমাদের মতো নেতৃত্ব সংকট দেখা দেয়নি।
বাঙালির নেতৃত্ব সংকটের এই ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর, জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ সাল আমাদের জাতীয় জীবনের সে-ই অদ্ভুত আমাবশ্যার দিন। সেদিন ভোর রাতে আমাদের দেশকে নেতৃত্বশূন্য করার শেষ আঘাত হানা হয়েছিল।
কারাগার বন্দিদের নিরাপদ আশ্রয়। এমন কি যাবজ্জীন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকেও আইন বা বিচার ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না সেখানে। অথচ সেই কারাগারেরই আমাদের দেশের চার সূর্য সন্তানকে হত্যা করা হয়েছিল।
আমি তখন ষোল বছরের তরুণ। স্পষ্ট মনে পড়ে শ্যামা পূজা হচ্ছিল পাড়ায় পাড়ায়। মাত্র তিন মাস আগে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার পরিজনদের নির্মমভাবে হত্যা করায় মানুষের মনে ছিল ভয় আর অস্বস্তি। দালাল-রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ তখন দিক নির্দেশনাহীন। তাদের মনে শঙ্কা । সবাই ধারণা করে নিয়েছিল সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন আহমদরা কিছু না কিছু করবেন। বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদের ওপর প্রগতিশীল ও বাংলাদেশপ্রেমী মানুষের আস্থা ছিল আকাশচুম্বি। তারা দলে তার পরিণতি ও মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়া ভালো চোখে দেখেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের খুনি রূপ বেরিয়ে আসলে জনগণ আরও বেশি তাজ-নির্ভর হয়ে দিন গুণতে থাকে। হঠাৎ পাড়ায় পাড়ায় আতঙ্ক আর চাপা অস্থিরতা সেই রাতে আমাদের হতবিহ্বল করে ফেলে। তখন যোগাযোগের এতো উন্নতি হয়নি।
ঢাকার বাইরের শহর-বন্দরগুলো বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন। ঢাকার খবর চট্টগ্রাম পৌঁছাতে দিন পেরিয়ে যেতো। কিন্তু দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে। সে রাতে পূজা তড়িঘড়ি করে সেরে সবাই বাড়ি ঘরে চলে যান। পরদিন রটে যায় আমাদের দেশ আগের রাতে নেতাদের হারিয়ে সত্যিকারের এতিম হয়ে গেছে ।
কী ঘটেছিল সে রাতে? ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেই গাড়িতে কয়েকজন সেনা সদস্য ছিল। ঢাকা তখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা-অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার মি. রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বামদিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে ওঠে।
মি. রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।
২০১০ সালে ওই সাক্ষাৎকারে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মি. রহমান বলেন, “টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।”
বহু বছর পর এমন তথ্য বেরিয়ে এলেও সবাই জানেন এর আগে খন্দকার মোশতাক চার জাতীয় নেতাকে ফোন করে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বলেছিল। সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব তা বলিষ্ঠভাবে প্রত্যাখান করেছিলেন। আর তাজউদ্দীন আহমদ! মোশতাক হয়তো ধরে নিয়েছিল তাজউদ্দীন আহমদ দল ও মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে রাখা নেতা, ফলে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যকাণ্ডে বেখুশি নাও হতে পারেন! টোপ ফেলে মোশতাক তাকে প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখালে তাজ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, লিডারকে হত্যা করতে পারা খুনির সাথে কথা বলতেও ঘৃণা হচ্ছে তার। মোশতাককে তিনি এমন সবক দিয়েছিলেন যে ফোন রাখার সময় বেঈমান খন্দকার মোশতাক নাকি বলেছিল: ‘আমি আর আপনাদের বাঁচতে দিতে পারলাম না’।
আজীবন এক দলে এক নেতার অধীনে কাজ করা সহকর্মীদের গুলি করার আদেশ দিতে কণ্ঠ কাঁপেনি খুনি মোশতাকের। জেলার আমিনুর রহমান পরে বলেছিলেন কিভাবে ঠাণ্ডা গলায় গুলি করার জন্য ফটক খুলে দিতে এবং চার জাতীয় নেতাকে এক কাতারে দাঁড় করানোর আদেশ দিয়েছিল খুনি মোশতাক।
শ্রুত যে সৈ্য়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এক কক্ষে। মধ্যরাতে কারাগারে পাগলাঘণ্টা শুনেও ঘাবড়ে যাননি তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি পবিত্র কোরান শরীফ পাঠ করছিলেন। সৈয়দ নজরুলক অথবা কামরুজ্জামানকে শান্ত গলায় বলেছিলেন, “ভয় পাবেন না । নামাজটা সেরে নিন।” তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা তাকে বলে দিয়েছিল কী ঘটতে যাচ্ছে ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই চার নায়ক স্বাধীনতার অহংকার। নয়মাস তাদের সংগ্রাম আর নেতৃত্ব না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ বা দেশ স্বাধীন হওয়াটা ছিল অসম্ভব। আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই জানবেন, ভারতের সাথে লিয়াজোঁ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা কতটা কষ্টসাধ্য ছিল। এক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী, তাজউদ্দীন আহমদ ব্যতীত কাউকেই বিশ্বাস করতেন না।
আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আগাগোড়া চাপের মুখে। খোদ দলের ভেতরের অনেকেই তাকে শান্তিতে কাজ করতে দেয়নি। এই মানুষটি যুদ্ধের নয় মাস পরিবারের সাথে ছিলেন না। এমন কি তার একমাত্র শিশুপুত্র সোহেল তাজ তখন গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও তিনি স্ত্রী জোহরা তাজকে বলেছিলেন, “ওকে দেখার জন্য তো তুমি আছো। কিন্তু আমার মুক্তিযোদ্ধাদের দেখার জন্য তো আমি ছাড়া কেউ নাই। আমাকে মাফ করে দিও।”
গল্পর চেয়েও আকর্ষণীয় এবং ঈর্ষণীয় সব ইতিহাসের জনক এই চার নেতা। তাদের হত্যা করা মানে কোনও মানুষকে স্রেফ নিশ্চিহ্ন করা ছিল না। বরং বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসের পরিচ্ছেদ হুট করে শেষ করে দেওয়াই ছিল খুনিদের প্রধান লক্ষ্য।
মনে রাখতে হবে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী আত্মস্বীকৃত খুনিরা ততদিনে প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল। ব্যর্থ হলেও খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান এবং মোশতাককে চপেটাঘাতের কথা তখন সবাই জেনে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে মানুষজন ও বুঝতে শুরু করেছিল খুনিদের আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
ঠিক তখনই দেশত্যাগের আগে খুনিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে নেতাহীন ও অভিভাবকহীন করার জন্য জেলখানায় গিয়ে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার সিদ্বান্ত নেয়।
এ কারণেই আমরা যারা ষাট পেরিয়ে গেছি বারবার বলি, ১৯৭৫ সালের কোনও হত্যাকাণ্ডই অপরিকল্পিত কিছু নয়। এগুলোর পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পাকিস্থানি ও তাদের তাঁবেদারদের মদদ রয়েছে। রয়েছে সুপার পাওয়ার হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলোরও ষড়যন্ত্র।
৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড স্মরণ করে ‘জেল হত্যা দিবস’ পালন করে সরকারী দল। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? আজ দেশ-সমাজে-ইতিহাসে কোথাও এদের আদর্শ নিয়ে কতটুকু কথা হয়? যে নয়মাসের রক্তগর্ভ থেকে জাতীয় চার নেতারা আমাদের একটি দেশ উপহার দিলেন, কোথায় তার স্বীকৃতি! কেন তাদের আড়ালে রাখা? কিসের ভয়?
আজকের মাথা উঁচু করা বাংলাদেশ, শহরের আকাশ-সমান অট্টালিকা, বড় বড় উন্নয়ন কাঠামো, বাণিজ্য- এ সবই কি তাদের কাছে ঋণী নয়? ৩ নভেম্বর কারাগারের মতো নিরাপদ স্থানে প্রাণ হারানো চার জাতীয় নেতাদের প্রতি যথাযথ সম্মান আর শ্রদ্ধাতেই রাজনীতির মুক্তি। সরকারি বা সরকারবিরোধী যেকোনও রাজনৈতিক দল যদি সেই শ্রদ্ধার জায়গাটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে, তাহলে নেতৃত্বের সংকট কখনো দূর হবে না।
রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে একটু পরিবর্তিত করে বলতে চাই- মরণ সাগর পাড়ে যারা অমর তাদের জানাই প্রণাম।
সিডনি