আমরা বাংলা নববর্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করছি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে জনগণের করের টাকায় বাংলা নববর্ষে বিশেষ ভাতা নিচ্ছি, তা ভুলে গিয়ে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে কুঠারঘাতও করছি! কী স্ববিরোধী আচরণ!
Published : 11 Aug 2023, 11:39 AM
আমরা আশ্চর্য হচ্ছি, ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি—বাংলাভাষাকে যেভাবে অবহেলায় টেনে নিয়ে দিনদিন বিভিন্ন অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি, ঠিক তেমনি বঙ্গাব্দ ও তারিখকে শুধু দূরে সরিয়ে দিচ্ছি না, এর অস্তিত্বকে একেবার নির্মূল করার জন্য জন্য উঠেপড়ে লেগেছি। বেদনা-বিহ্বল এক পরিস্থিতি এখন।
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী নয়, এখন থেকে জমির খাজনা আদায় হবে খ্রিস্টাব্দের অর্থবছর অনুযায়ী। এ সংক্রান্ত বিধান রেখে ভূমি উন্নয়ন কর আইন: ২০২২-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর গত ২৯ মার্চ দুপুরে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মাহমুদুল হোসাইন খান। খসড়ায় বলা হয়েছে, এখন থেকে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্রের পরিবর্তে খ্রিস্টাব্দের পয়লা জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত খাজনা আদায় করা হবে।
ব্রিটিশ আমলের আগে সেই মোঘল আমল থেকে বাংলার ঋতু-প্রকৃতিকে ভিত্তিমূল ধরে—ফসল ফলার মৌসুমকে গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গাব্দের হিসেব অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো। ব্রিটিশ আমলেও ওই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ থাকে, পাকিস্তান আমলেও তার নড়নচড়ন হয়নি, বাংলাদেশেও তা এতদিন প্রচলিত আছে! হঠাৎ করে আজ তা পরিবর্তন করা হচ্ছে কেন? বাঙালির জীবনে এতদিনের এক ধারাবাহিক ঐতিহ্যকে—এক সভায় বসে ক’জন ক্ষমতা পেয়ে আদ্যোপান্ত না ভেবে, কলমের খোঁচায় বাতিল করে দেবে? আমাদের চোখের আড়ালে, নীরবে, অসংকোচে—এমন ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির এক ভিত্তিমূল ধ্বংস করে দেবে? আমরা বাঙালি বলে তা মেনে নেব? সচকিত হব না? প্রতিবাদ করব না?
দেশের সকল তহসিল অফিসে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী বাৎসরিক খাজনা আদায়ের নিয়ম-ব্যবস্থা বহাল রয়েছে, যা খাজনা দেওয়ার ক্ষেত্রে বহুদিনের প্রথা ও অভ্যস্ততা নিয়ে চলমান। মানুষও তা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে এসেছে। এর সঙ্গে গণমানুষের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। এই একটি ক্ষেত্রে বঙ্গাব্দের সন ও তারিখ বহু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। আরেকটি দিন, পহেলা বৈশাখ বঙ্গাব্দের তারিখ অনুযায়ী ‘বাংলা নববর্ষ’ হিসেবে আমরা উদযাপন করে থাকি। আর কোনো বঙ্গাব্দের তারিখ ও দিন রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পর্যায়ে গুরত্বসহকারে ব্যবহার করা হয় না!
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী বাৎসরিক খাজনা আদায়ের নিয়ম-ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে আরও গভীরভাবে জনবিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হলো! রাষ্ট্র, সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের যে সম্পর্ক ছিল তা সমূলে উৎপাটন করা হলো, অবসান ঘটানো হলো! অথচ বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে আরও গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনীন করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা জরুরি কর্তব্য হয়ে উঠেছে, এই সময়ে।
আমরা বাংলা নববর্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করছি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে জনগণের করের টাকায় বাংলা নববর্ষে বিশেষ ভাতা নিচ্ছি, তা ভুলে গিয়ে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে কুঠারঘাতও করছি! কী স্ববিরোধী আচরণ! দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। তাদের নিত্যদিনের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে বাংলা সন ও তারিখ জীবন্ত। বিশেষত কৃষিজীবীরা বাংলা সন ও তারিখ নিজেদের ভেবে সারাবছর ব্যবহার করে থাকেন। দিনপঞ্জি না দেখেও বাংলা তারিখ ও মাসের হিসেব রাখেন গ্রাম-বাংলার কৃষিনির্ভর ও খেটে খাওয়া মানুষেরা, কারণ বাংলা সন ও তারিখ তাদের হৃদয়জাত সংস্কৃতিরই অংশ। বাংলা সন ও তারিখ যুগ যুগ ধরে এদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে আছে। সেই সন ও তারিখকে বাঙালির জীবনের অনেক ক্ষেত্রে গৌরবের সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি আমরা, যদিও বাঙালি হিসেবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি—তারও পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হতে চলল। রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবনের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য সংহত করার সুযোগ পাওয়ার পরও আমরা অনেক ক্ষেত্রে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। সে-কারণে বেশিরভাগ বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকার কথা থাকলেও, বাংলা সন ও তারিখ আজও সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত নয়। বাংলা সন-তারিখ অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনও বাজেট প্রণয়ন, অর্থবছর, শিক্ষাবর্ষ, অনুষ্ঠান-সভা-দিবস ইত্যাদি নির্ধারিত হয় না। আজ অর্থবছরের দোহাই দিয়ে ‘খাজনা আদায়’-এর সময় পরিবর্তন করা হচ্ছে, অথচ স্কুল-কলেজের শিক্ষাবর্ষ কি অর্থ বছর অনুযায়ী শুরু হয়? হয় না! অনেক কিছুই অর্থ বছরের হিসেবে শুরু না হলেও অর্থ বছরের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে। খাজনা আদায়ের সময় পরিবর্তন না করে মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের ৫০ বছরের অধিককাল চলে গেল, কোনো অসুবিধা হলো না! আজ কী এমন অসুবিধা হলো যে, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ‘বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী বাৎসরিক খাজনা আদায়ের নিয়ম-ব্যবস্থা’ বাতিল করতে হবে? আমরা যেখানে দাবি করে আসছি, আমাদের প্রচলিত অর্থবছর পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র (১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল) পর্যন্ত নির্ধারণ করা হোক। এখন রয়েছে পহেলা জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত, যা পরিবর্তনযোগ্য। পাকিস্তান ছাড়া আমাদের অতিপরিচিত আর কোনো দেশেই আমাদের নির্ধারিত সময়ের মতো অর্থবছর বিবেচিত হয় না। যেমন, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অর্থবছর হলো পহেলা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ, মালদ্বীপ ও ভুটানে পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর, নেপালে ২১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রে পহেলা অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপানে পহেলা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। আমেরিকা অর্থবছর পরিবর্তন করেছে তাদের প্রাকৃতিক ও অন্যান্য বিষয়ে বিবেচনা করে, অন্যান্য দেশেও তাই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্ধারিত অর্থবছরের সময়সীমা আমরা এখনও বহন করে চলেছি। পাকিস্তানের ঋতু ও কালের সঙ্গে তাল রেখে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী অর্থবছরের এ-সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল—যা বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। বাঙালি সংস্কৃতির কোনো উপাদান এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের ঋতু, আবহাওয়া, কৃষিব্যবস্থা, ফসল তোলার সময়, দীর্ঘকালের গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার হিসাবনিকাশ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী কৃষকের নিজস্ব বাংলা সন-তারিখ, সর্বোপরি বাংলা নববর্ষে বাঙালির জেগে ওঠার যে আত্মশক্তির উদ্বোধন হচ্ছে, সেসব বিবেচনায় আনা হয়নি কখনও।
আজ আমাদের ভাষা, বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক বিশ্বায়নের কবলে পড়ে কাতরাচ্ছে। এরকম মুহূর্তে আমরা নিজেরাও উদার উদাসীন থেকে তা আরও বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি। আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য থাকার পরও কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করছি না! আমাদের জাতিগত ভিত্তিমূল শক্ত থাকার পরও আমরা সংগঠিত হয়ে আমাদের শক্তির পরিচয় মেলে ধরতে পারছি না। তাহলে কি বলব, আমাদের এই সময়, এই সরকার, এই প্রশাসন, এই সংসদ, এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব—সকলেই বাঙালি সংস্কৃতির শত্রু, ঘরের শত্রু? তা না হলে আজ ‘বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী বাৎসরিক খাজনা আদায়ের নিয়ম-ব্যবস্থা বাতিল’ করার মতো ঘটনাটি কেন ঘটে? আজ নীতিনির্ধারক হিসেবে আছে কারা? তারা পরবশ হয়ে বাঙালি জাতির বিকাশকে রুদ্ধ করতে চাইছে? নাকি চোরাগোপ্তা পথের কোনো গুপ্তঘাতক রয়েছে তাদের মধ্যে? তা না হলে কুটকুট করে বাঙালির ঐতিহ্যের শেকড় কাটার এতটা দুঃসাহস ও স্পর্ধা কীভাবে পায়? আজ প্রতিবাদ হোক—সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মী থেকে, কবি-লেখক-শিল্পী থেকে, গণমাধ্যম থেকে, রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে! আমরা বাংলা সন ও তারিখের অপমৃত্যৃ চাই না—রাষ্ট্র, সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে।