নোবেল এবং গানবাণিজ্যের বলির পাঁঠারা

সারেগামাপা প্রতিযোগিতার গোড়াতে বিনয়ী ভদ্র ছেলেটি অনেক সময় যখন অকারণ আনুকূল্য পাচ্ছিলেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল গান-বেনিয়াদের এই রাজনীতি ছেলেটির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 22 May 2023, 11:37 AM
Updated : 22 May 2023, 11:37 AM

তখন আমরা তরুণ। আমাদের দেশের শিশু সাহিত্যের মূল আশ্রয় তখন দৈনিক পত্রিকার শিশু পাতা। সে এক তুমুল প্রতিযোগিতার সময়। একদিকে  সংবাদের খেলাঘর, অন্যদিকে  ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর। মাঝখানে পূর্বদেশ পত্রিকার চাঁদের হাটও আছে।

কচিকাঁচার আসরের দায়িত্বে ছিলেন শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান। যাঁর পোশাকী নামটা আমাদের বেশির ভাগেরই জানা ছিল না। আমাদের কাছে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল দাদাভাই। আসরের পরিচালক দাদাভাই ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তি রোকনুজ্জামান খানকে।

দাদাভাই চিঠি নামে তিনি প্রতি হপ্তায় কচিকাঁচার আসরে যে চিঠিটি লিখতেন তার অবদান অসামান্য। গৎবাঁধা কোনো চিঠির পরিবর্তে সে চিঠি ছিল তথ্য আর নতুন ধারণায় ঠাসা। তেমনি এক চিঠিতে প্রথম জেনেছিলাম সুবীর নন্দীর কথা। গায়ক সুবীর নন্দীও তখন তরুণ। সিলেট ভ্রমণকালে দাদাভাইয়ের সফরসঙ্গী তরুণ সুবীর নন্দী তাঁকে সারা রাস্তা গান শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর গানে মুগ্ধ দাদাভাই সেদিন লিখেছিলেন এই তরুণের মধ্যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অপার সম্ভাবনা। এই ছেলে যে একদিন গান গেয়ে দেশ মজাবে সে বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল কুণ্ঠাহীন। বলাবাহুল্য সে আগামবাণী সত্য হয়েছিল।

সুবীর নন্দী বাংলাদেশে শুধু বিখ্যাত গায়ক হননি বাংলা গানেও তাঁর গায়কী আর সুরের খেলার জন্য বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন। আজ দাদাভাই ও সুবীর নন্দী কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু ইতিহাস রয়ে গেছে। রয়ে গেছে গান ও সাহিত্যের সেই শিল্পবন্ধন।

এরপরের ইতিহাস বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর  আগমনের ইতিহাস। গান বাংলা বাঙালির প্রাণ। আমরা এমন এক জাতি যারা জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব বিষয়ে গান চর্চা করি। বিয়ের আসরে যেমন গান অপরিহার্য তেমনি সামান্য ছাদ ঢালাইয়ের কাজেও আমাদের দেশের মানুষ গানের এস্তেমাল করে। গানের এমন বহুবৈচিত্র্যের কথা বাণিজ্যকর্তাদের অজানা কিছু নয়। তারা যখন থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্য করতে মন দিলো তখন কোনো বিষয়ই আর বাণিজ্যের বাইরে থাকলো না। সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-বাজনা সব চলে গেলো তাদের দখলে। কী দেখলাম  আমরা?

আগে গানের চর্চা হতো বাড়িতে। ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম আর গানের গলায় মূর্ত হয়ে উঠতো বাঙালির সন্ধ্যা-সকাল। সে গান একলাফে ঘর বারান্দা পাড়া-মহল্লার মঞ্চ ছাড়িয়ে চলে গেলো বোকাবাক্সে। শুরু হয়ে গেলো প্রতিযোগিতার নামে শিল্পী ধরে এনে তাদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা। প্রতিযোগিতা খারাপ কিছু নয়। বরং সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়। আমরা বোকা-সোকা আমজনতা। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তেমন কিছুই হতে চলেছে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগলো না। চ্যানেলে চ্যানেলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গানের প্রতিযোগিতা পরিণত হলো যুদ্ধে। সবকিছুর মতো হুজুগে বাঙালি গানের বেলায় পিছিয়ে থাকবে কোন দুঃখে? প্রায় প্রতিটি চ্যানেল যখন এমন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ, তখন সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বীর যেমন, বিচারকেরও অভাব তো থাকবেই। সে অভাব পূরণের জন্য, বলা ভালো শূন্যস্থান পূরণের জন্য অশিল্পী, অগায়ক, অবিবেচক বিচারক, গান বিষয়ে ধারণাহীন মানুষদের ধরে এনে শুরু হলো নয়া কাণ্ড।

সবাই জানেন টিভির ব্যবসা নির্ভর করে বিজ্ঞাপন আর টিআরপির ওপর। বিজ্ঞাপনদাতাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি টিআরপি বাড়াতে শুরু হয়ে গিয়েছিল অপকৌশল।

শুধু বাংলাদেশ নয়, এই ধারা, এই প্রবাহ চলল ওপার বাংলায়। এখন আমাদের বাংলাদেশে গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোর হিড়িক কমেছে। কারণ সর্বনাশ যা করার তা করে দিয়ে গেছে অপপ্রক্রিয়া। সাধনা ও মনযোগের জায়গা থেকে গান এসে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন এক জায়গায়। যেখানে সন্‌জীদা খাতুন দূরের কথা অদিতি মহসিনেরও দরকার পড়ে না। যন্ত্র আর যন্ত্রী থাকলেই হয়। সঙ্গে জুটেছে ডিজিটাল ভূতের আর্শীবাদ। সে ভূত না কি এখন কণ্ঠও ঠিক করে দেয়। কিছুদিন আগে প্রিয় গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তির একটা আলোচনা দেখছিলাম।

উপমহাদেশের বিখ্যাত এই গায়িকা হিন্দি-বাংলাসহ রবীন্দ্রনাথের গানে সমান জনপ্রিয়। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন তাঁরা কত কষ্ট করে কতটা মেহনত করে গান শিখতেন। ভুলচুক হলে গুরু বা ওস্তাদেরা কতটা কঠিন হতেন। কারণ তখন সবার মনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করতো গান মানে একটি সাধনার জন্ম দেয়া। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি বলছিলেন এই যে গানের কণ্ঠ থেকে বিকৃতি রোধ বা উচ্চারণ সংশোধন সবকিছু যন্ত্রনির্ভর, এই নির্ভরতাই একদিন গানের বারোটা বাজাবে। 

কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কথা যে কতটা সত্যি, সেটা আমরা আমাদের দেশের চ্যানেলে বিজয়ী হওয়া এক তরুণ এবং ওপার বাংলার সারেগামাপা শোয়ে বিখ্যাত হয়ে আসা দেশের আরেক তরুণের পরিণতি দেখলেই বুঝতে পারব। প্রথমজন নোলক বাবু। টিভি চ্যানেলের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা নোলক বাবু সেলিব্রেটি হয়ে বেরুলেন বটে, কিন্তু গানের ভাঁড়ার বা শেখার জগৎ তো শূন্য। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। তারপর যা হয়, মাদক-টাদক মিলিয়ে অন্ধকার এক জগতে নির্বাসিত হলেন তিনি। সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ছিল। তা না হলে কি এতগুলো প্রতিযোগী ডিঙ্গিয়ে প্রথম হতে পারা তো সহজ কথা নয়। কিন্তু পরিচর্যা আর শেখার গাফিলতিতে সকলই গরল ভেল। আজ নোলক বাবুর নাম জানে না কেউ।

পরের জন মাইনুল আহসান নোবেল সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। নোবেল নামের ছেলেটি বেশ ভালোই গাইতেন। আমি বহুবার তার গান শুনেছি। জি বাংলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান সারেগামাপা। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। উভয় বাংলার নামে হলেও মূলত ওপার বাংলার  দর্শক শ্রোতা আর প্রতিযোগীদের জন্য এই অনুষ্ঠান। কিন্তু সওদাগরেররা ঠিক বোঝেন, বাণিজ্যের জন্য কোনটা করতে হবে আর কোনটা না। ওরা জানেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তাদের বস্তাবন্দি সিরিয়াল আর এই অনুষ্ঠানটি বিপুল জনপ্রিয়। অতএব তাদের ‘ওই বাংলা’ মানে আমাদের বাংলাদেশ থেকেও প্রতিযোগী রাখা দরকার, তাতে বাংলাদেশের দর্শকদের পাওয়া সহজ হবে। গড়ে উঠবে সস্তা জনমত। ভোট বা সমর্থনের নামে মোবাইল কোম্পানিগুলোর টু-পাইস কামানোর পাশাপাশি টিআরপিও চড়বে শীর্ষে।

নোবেল গেলেন বাংলাদেশ থেকে। সারেগামাপা প্রতিযোগিতার গোড়াতে বিনয়ী ভদ্র ছেলেটি অনেকসময় যখন অকারণ আনুকূল্য পাচ্ছিলেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল গান-বেনিয়াদের এই রাজনীতি ছেলেটির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। যারা বানিজ্যের নামে তারুণ্যের প্রতিভাকে হয় অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করে তাদের এসবে কিছু যায় আসে না, মাশুল দেয় তরুণ-তরুণীরা, ওরা হয় বলির পাঁঠা। এর বেলায়ও তাই হয়েছে। লাই পেয়ে মাথায় ওঠা নোবেল প্রথমেই কলকাতার ওপর একহাত নিয়েছেন। তারপর এমন অবস্থা, আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর ব্যাপারেও বালখিল্য মত দিয়ে কোটি মানুষকে আহত করেছেন। সবশেষে মদ খেয়ে গানের আসরে দর্শকশ্রোতাদের হাতে অপমানিত হয়েছেন। ছেলেটির এখন ঘোর বিপদ। খবরে দেখলাম রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাকে। এখন আবার জানলাম জামিনও হয়েছে।

বিষয়টা নোবেল বা যুব সমাজ না ভেবে আপনি যদি সত্যিকারের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করেন, দেখবেন এরা নিজের উচ্চাভিলাষের শিকার। শিকার বেনিয়াদেরও। যারা আমাদের দেশের গান বাজনা সংস্কৃতির বারোটা বাজায় তারাই বছর বছর এমন নোলক-নোবেল পয়দা করে। যারা গান গাইবার আগেই প্রচারের জোরে গায়ক। শিল্পী হয়ে ওঠার আগেই কারাগারে কিংবা সমাজচ্যুত। এই ভয়াবহ বাস্তবতা অন্যান্য অভিভাবকদের শঙ্কিত করে। তারা তাদের সন্তানদের গানের জগতে পাঠাতে ভাববেন বা চিন্তা করবেন এটাই স্বাভাবিক ।

দেশের গান, বাঙালির গান, সংস্কৃতি বাঁচাতে এসব অপপ্রতিযোগিতা ও ফাস্ট সেকেন্ড বাণিজ্য বন্ধ করা জরুরি। সংস্কৃতি জীবনভর বইয়ে চলা এক বিষয়। এটা একশ মিটার দৌড় না যে দড়ি ছুঁলেই কেল্লা ফতে। সাধনা সময় ও ধৈর্যের ভেতর দিয়ে আবার কি গড়ে উঠবে সুসহ ভুবন? আমরা সে প্রত্যাশায় থাকলাম।