চৌকস বিষয়টি মানুষের ভেতর থেকে গড়ে উঠতে হয়। স্মার্টফোন হাতে থাকলেই চৌকস হওয়া যায় না। আর চৌকস হওয়ার ভান করা মূর্খতার শামিল। এই সত্য যুবসমাজ যত দ্রুত অনুধাবন করে ততই মঙ্গল।
Published : 01 Nov 2023, 10:47 AM
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’— ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় লেখা এই কবিতাটিতে কবি হেলাল হাফিজ যৌবনের প্রাণস্পন্দন প্রকাশ করেছেন। অত্যাসন্ন যুদ্ধের কথাও ব্যক্ত করেছেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ বলে দিয়ে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি ছাত্র যুবকরাই প্রতিবাদ করেছে, মিছিল করেছে, শহীদ হয়েছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে এই ভূখণ্ডের যুবারাই যে সর্বোচ্চ অসাধ্য সাধন করেছে সে কথা সর্বজন স্বীকৃত।
যুবক বলতে কৈশোর উত্তীর্ণ পুরুষকে বোঝায়। যুবকের স্ত্রীবাচক যুবতী। একসঙ্গে যুব সমাজের কথা বলতে গেলে 'অর্ধেক তার নারী'। যুব বলতে একই সঙ্গে যুবক এবং যুবতী উভয়কেই বুঝায়। যুবক এবং যুব নারীর সাংবিধানিক অধিকার সমান হলেও এখনো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুবকদের তুলনায় যুব নারীদের চলার পথ অপেক্ষাকৃত কঠিন।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের নাগরিক যুব হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা এই বয়স সীমার মধ্যে ছিলেন তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। পরে কালক্রমে তাদের একটি বড় অংশ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করেছেন তারাও এখন যৌবন-উত্তীর্ণ, প্রায় প্রৌঢ়। এর পরের প্রজন্ম এখন যুব বয়স পার করছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশই তরুণ বা যুব বয়সের। সংখ্যায় সাড়ে চার কোটির বেশি যুব জনগোষ্ঠী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর। দেশের মোট জনসংখ্যায় যেহেতু নারীর সামান্য আধিক্য রয়েছে (৮ কোটি ১৭ লাখ পুরুষ আর ৮ কোটি ৩৩ লাখ নারী) কাজেই যুবকের তুলনায় যুবনারীর সংখ্যাও সামান্য বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এই সংখ্যায় বেশি পার্থক্য না থাকায় যুব নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান ধরা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে কেমন আছে আমাদের এই যুব সমাজের সাড়ে চার কোটি মানুষ, নারী এবং পুরুষ।
সবসময়ই পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী এই দুই প্রজন্মের মানুষের মধ্যে সর্বক্ষেত্রেই কিছু পার্থক্য বিদ্যমান থাকে এবং কিছু বিষয়ে উভয় প্রজন্মের মানুষই একে অন্যকে কিছু দোষারোপ করে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষের দৃষ্টিতে পরবর্তী প্রজন্ম যেমন আধুনিক সেই সঙ্গে অনেকটা অবুঝ, জেদি এবং আদব-কায়দার কিছু ঘাটতি তারা দেখে থাকেন তরুণ তরুণীর মাঝে। আর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষেরা যেমন পশ্চাৎপদ এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা মনে করে যে তাদের বোধের জায়গায় পূর্ববর্তীদের পৌঁছানো সম্ভব নয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে এই যে ফারাক যাকে ইংরেজিতে জেনারেশান গ্যাপ বলা হয় তা সর্বকালেই দৃশ্যমান হয়েছে। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে এই ব্যবধান আরো প্রকট। তবে অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ সময়ের সঙ্গে নিম্নগামী হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ১৮ বছর বয়স থেকে মানুষের মধ্যে উৎপাদনশীলতা শুরু হয়। ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠন হয়ে থাকে। মূলত ব্যক্তিত্বে যা কিছু মৌলিক পরিবর্তন তা এই বয়সের মধ্যে ঘটে থাকে। ৩২ বছর বয়সের পর বিশেষত পুরুষের ব্যক্তিত্বের মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটে না। নারীর ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা একটু বেশি ৩৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে আমাদের দেশের যুবদের উচ্চশিক্ষা, কর্মজীবনে প্রবেশ, বিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঘটে থাকে।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করে। কাজেই ৮০ভাগ যুবরও বাস গ্রামে। কেমন তাদের জীবনযাত্রা? আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এই অর্জনের পেছনে গ্রামের যুবদের বড় অংশগ্রহণ রয়েছে। তারা ফসল ফলানোর কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকে। গ্রামের অনেক যুবক নারী ও পুরুষ লেখাপড়ার পাশাপাশি মূলত কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে থাকে যেমন কৃষিকাজ, দিনমজুরের কাজ, নিরাপত্তা প্রহরী আবার অনেকে ছাত্র পড়ানোর কাজও করে থাকে। তাদের একটা বড় অংশ গ্রামে থাকাকালেই কলেজ পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যায়। কেউবা শহরে এসে হোস্টেলে-মেসে বা আত্মীয় বাড়িতে থেকে লেখাপড়া চালায়। এদের মধ্যে কিছু অদম্য মেধাবী দেখা যায় যারা সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে একদিন বড় মানুষ হয়। গ্রামের যুব সমাজের অনেকে আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে ওঠে। তাদের অর্জনেই বাংলাদেশ মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ স্থান লাভ করে। আর তাদের গড়ে তোলা খামার, পোল্ট্রি শিল্পের সুফল হিসেবে নিম্ন আয়ের এবং মধ্যবিত্ত মানুষ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা ব্রয়লার মুরগি দিয়ে পূরণ করে থাকে।
তবে আশঙ্কার কথা যে মাদকাসক্তি, অনলাইন জুয়া বা বাজি ধরার মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো শুধুমাত্র শহরের যুব সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাম-গ্রামান্তরেও তা ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে। যুব নারী-পুরুষই এই পোশাক শিল্পের চাকা ঘোরায়। যদিও ন্যায্য বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অনেক অসন্তোষ রয়েছে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের আরেকটি বড় খাত প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। মূলত যুবকরাই প্রবাসে নিদারুণ কষ্ট, পরিশ্রম করে অর্জিত যে বৈদেশিক মুদ্রা, ডলার দেশে পাঠায় তা দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে জমা হয়। দেশের অর্থনীতিতে তারা অনেক বড় ভূমিকা রেখে চলেছে।
যুব নারী তথা বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যুব নারী সরাসরি আয়বর্ধক কাজে এবং উৎপাদনে ভূমিকা রাখছেন। সরকারি বেসরকারি কার্যালয়,ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশই আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছে। গ্রামেগঞ্জেও আজকাল নারী সাইকেল, মোটরসাইকেল আরোহী চোখে পড়ে। একযুগ আগেও এমনটা দেখা যেত না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই নারীদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধর্মের দোহাই দিয়ে পোশাক-আশাকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিধিনিষেধ। দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুরুষের প্রায় সমহারে নারী শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে এবং ফলাফলের দিক থেকেও তারা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।
তরুণ যুব সমাজের একটা অংশ মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫ সালে দেশের ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসায় ১৪ লাক শিক্ষার্থীর কথা বলা হয়। কওমি মাদ্রাসা ছাড়াও হাফিজিয়া, আলিয়া, কামিল মাদ্রাসাও অনেক গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এই মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণকারীর অধিকাংশই ধর্ম জ্ঞানকে পুঁজি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
অনেকের মতে যুব সমাজের অবস্থা ভয়াবহ, তারুণ্য রীতিমতো বিপন্ন। তরুণদের একটা বড় অংশ রাতের পর রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন গেম, জুয়া, পর্নোগ্রাফি বা মুঠোফোনে অহেতুক আলাপচারিতায় বিপুল সময় নষ্ট করে। তারা সকালে ঘুমায় এবং অপরাহ্নে জাগে। ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তব জগতের বৈসাদৃশ্য তাদের অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ, রাগান্বিত করে তোলে এবং তারা পরিবার এবং সমাজে এই রাগ জেদের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি ভাঙচুর করে এবং বাইরে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গণ্ডগোল সৃষ্টি করে।
২০২২ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের এক বক্তব্যে উঠে আসে যে,দেশে ৮০ লক্ষ মাদকাসক্ত রয়েছে এবং তার শতকরা ৮০ ভাগই যুবক। ৮০ লক্ষের ৮০ ভাগ হিসেব করলে দাঁড়ায় ৬৪ লক্ষ অর্থাৎ সাড়ে ৪ কোটি যুব বয়সের মানুষের মধ্যে ৬৪ লক্ষ মাদকাসক্ত রয়েছে। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অধিক হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এই ১৪ হাজার আত্মহননকারীর একটি বড় অংশ তরুণ-তরুণী। আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে উঠে আসে যে চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।
যুব সমাজকে নিয়ে প্রবীণদের একটা গেল গেল হায় হায় রব সবসময় ছিল এবং এখনো আছে। তথাপি যুবসমাজ সবকিছু উপেক্ষা করে তাদের মতই চলছে। কি হলে বা কি করলে ভালো হতো তা বলা নিতান্তই বাহুল্য।
১ নভেম্বর জাতীয় যুব দিবস। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এই দিনটিকে জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এই অধিদপ্তর যুবদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, যুব ঋণ প্রদান, যুব সংগঠনগুলোর তদারকি, অনুদান প্রদান ইত্যাদি কাজ পরিচালনা করে থাকে। সাড়ে ৪ কোটি যুব সংখ্যার বিপরীতে এই অধিদপ্তরের কাজ যথেষ্ট নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। ২০২৩ সালে জাতীয় যুব দিবসের প্রতিপাদ্য 'স্মার্ট যুব, সমৃদ্ধ দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ '। ইংরেজি স্মার্ট (Smart) শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ চৌকস। এই চৌকস বিষয়টি মানুষের ভেতর থেকে গড়ে উঠতে হয়। স্মার্টফোন হাতে থাকলেই চৌকস হওয়া যায় না। আর চৌকস হওয়ার ভান করা মূর্খতার শামিল। এই সত্য যুবসমাজ যত দ্রুত অনুধাবন করে ততই মঙ্গল।