চারণ দার্শনিক সৈয়দ আবুল মকসুদ

আনিসুর রহমান
Published : 11 March 2021, 02:14 PM
Updated : 11 March 2021, 02:14 PM

সৈয়দ আবুল মকসুদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার ঘটে ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাশাপাশি একটি ইংরেজি দৈনিকের সাময়িকীতে কাজ করি। সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশে সংবাদ সংস্থার বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। এর বাইরে তিনি দৃশ্যত এবং অদৃশ্যত একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লেখক, গবেষক, সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত তার লেখাজোকার আমি একজন মনোযোগী পাঠক।

পত্রিকায় আমার কাজের সূত্রেই তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ করার সৌভাগ্য হয়। তার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় দুই দিন দীর্ঘ আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম দিন তার সঙ্গে রীতিমত দীর্ঘ এক আড্ডা। আড্ডা মানে- উনি বলেন, আমরা শুনি। এ আলাপচারিতায় সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান, আমাদের বদরুল ভাইও ছিলেন। সঙ্গে আরও দুই একজন ছিলেন। স্পষ্ট মনে পড়ছে না, সম্ভবত সৈয়দ আবুল মকসুদের ছেলে সৈয়দ নাসিফ মকসুদও ছিলেন।

আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের নানা রকম খাবারদাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এ আলাপচারিতায় বদরুল ভাই একের পর প্রশ্ন করেন, ইতিহাসের নানা ঘটনা ও ব্যক্তির সূত্র উল্লেখ করে। আর মকসুদ ভাই বলে চলেন একেবারে ঘরের মানুষের গল্প করার মত করে। বাকি আমরা কেবলই মন্ত্রমুগ্ধের শ্রোতা। কখনো সখনো আমরা দুই একটি সম্পূরক প্রশ্ন জুড়ে দিই। আলাপচারিতায় উঠে আসে বরীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, বুদ্ধদেব বসুর জীবন ও কর্মের নানা দিক। তবে ওইদিনের আলাপে বেশিরভাগ জুড়ে ছিল মাওলানা ভাসানীর গল্প। কেননা সদ্যই প্রকাশিত হয়েছিল তার লেখা ভাসানীর জীবন ও কর্মের উপর বড় কলেবরের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ এক গ্রন্থ।

এরপরে আরো একবার আমি তার বাসায় গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী আলোকচিত্রী আব্দুল্লাহ আল বাপ্পী। এদিনও দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। দুইদিনের আলাপচারিতায় তার কিছু কথা বা গল্প বা পর্যবেক্ষণ আমার মনে সম্মোহনী প্রভাব ফেলে। সেই সব আলাপের দুই দশকের অধিক সময় পরে এস মনে পড়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের সাংবাদিকতা জগতে, লেখালেখির দেউড়িতে, গবেষণার পরিমণ্ডলে অনন্য এক দৃষ্টান্ত বা বিরল এক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সহজিয়া মানুষ। আর এর ছাপ তিনি রেখেছেন তার সত্যাগ্রহে, জীবনাচরণে, লেখাজোকায়, আলোচনায়, বক্তৃতা বা বিবৃতিতে।

শেষের বছরগুলোতে তিনি গোলটেবিল আলোচনায় সরব উপস্থিত থেকেছেন। সেখানেও তিনি তার ব্যক্তিত্বের অনন্য অবস্থান থেকে সরে আসেননি। আমার মনে হয়েছে এ আনুষ্ঠানিকতাও ছিল তার সহজিয়া জীবন ও দর্শন আর তার চর্চাকে তুলে ধরার একটা ন্যূনতম সুযোগ। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররা টাকা পদ পদবী আরো নানা অদৃশ্য মোহের পেছনে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা আর পাঠদানকে উপেক্ষা করে তৈলপাত্র আর ধান্দাবাজির তল্পি নিয়ে ছোটেন, সেখানে সৈয়দ আবুল মকসুদের মত সহজিয়া চারণ দার্শনিক আবুল মকসুদের খবর তাদের অধরা। অথবা জানার পরও উপেক্ষা তারা করে যান সৈয়দ আবুল মকসুদকে।

তার জীবনযাপন ছিল সরল সহজ। তিনি রপ্ত করেছিলেন সহজিয়া জীবনদর্শন। তিনি যে জীবনদর্শনে অভ্যস্থ হয়েছিলেন তা লালন-রবীন্দ্রনাথ-মহাত্মা গান্ধী-ভাসানীর জীবনদর্শনের নির্যাস নিঙড়ে গড়েছিলেন। তাকে কাছ থেকে- দূর থেকে দেখে, তার কথা শুনে, তার লেখা পড়ে আমার এমনটা মনে হয়েছে। যে দর্শনকে বলা যায় সৈয়দ আবুল মকসুদ দর্শন।

তিনি মাঠের প্রতিবেদন লেখা থেকে দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ, বই-পুস্তক আর্কাইভ ঘেঁটে গবেষণা কিংবা সরেজমিনে ঘটনা বা নিদর্শন দেখে যে বক্তৃতা বা বিবৃতি বা গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ নিবন্ধ বা পর্যবেক্ষণ দাঁড় করাতেন তা ছিল সত্যের এক নির্যাস। তিনি সত্যকে কেন্দ্রে রেখে মানবতাকে উপরে রেখে, মানবিক বোধকে বুকে আগলে আর দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদাকে শিরোধার্য করেছেন গোটা জীবন।

তিনি যে শুভ্রবেশ নিয়েছিলেন তা কেবল পোশাকি মডেল ছিল না। তা ছিল তার ভেতরের অন্তর্দর্শন। তা ছিল এ কর্পোরেট বেনিয়া "টাই স্যুট কোট আঁটসাট সাহেবি স্মার্ট ফিটফাট লুটপাট জিন্দাবাদ" সময়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রকাশ। তার সমগ্র কাজে তিনি ছিলেন চারণ গবেষক, চারণ সাংবাদিক, চারণ  দার্শনিক। তার গবেষণা যেমন ছিল না কেবল গ্রন্থাগার বা আর্কাইভ কেন্দ্রিক, তেমনি ছিল না তার সংবাদ প্রতিবেদন প্রবন্ধ নিবন্ধ বা এমন কি বক্তৃতা বিবৃতিও। তিনি যেকোনও ঘটনা বা বিষয়ে প্রত্যক্ষ এবং স্বচক্ষে দেখার বা বিচার করার ব্রত নিয়েছিলেন। চারণ মানুষের মত দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে পথে পথে নগরে গঞ্জে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের আনাচে কানাচে। এ কথাগুলো তিনি আমার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা দীর্ঘ আলাপে বলেছিলেন।

তার লেখালেখি, গবেষণা- কেবল বইপুস্তক নির্ভর ছিল না। তিনি কোন বিষয়ে কলাম বা প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে হাতের কাছে প্রাপ্ত, যা চোখের সামনে সহজলভ্য বিষয়ে সহজে লিখেই সহজিয়া চর্চা করেননি। একটু খোলাসা করে বলি, তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে পত্রিকায় বা দূরদর্শনের খবর পড়ে ঘরে বসে তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে ক্ষান্ত হতেন না, চটপট লেখা দাঁড় করাতেন না। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে কয়েকটা বাজারে নিজে যাবেন। দোকানদার এবং বাজারিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। তারপর নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবেন। একইভাবে গ্রামের কৃষিপণ্য নিয়ে বা বিপন্ন আদিবাসীদের নিয়ে ঢাকায় বসে বয়ান দিবেন না। তিনি আগে ছুটে যাবেন সেই সব জায়গায় সেই সব মানুষদের কাছে। তারপর মুখ খুলবেন, কলম ধরবেন। যে কারণে সৈয়দ আবুল মকসুদের বিকল্প তার জীবনদ্দাশাতে যেমন আমাদের চারপাশে ছিল না। ভবিষ্যতেও যে আসবে সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

তিনি এখনকার সাংবাদিকতার মান আর সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধান নিয়ে রীতিমত নাখোশ ছিলেন, শঙ্কিত ছিলেন। একজন প্রতিবেদক একটি দলের নিয়মিত খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সেই দলের কর্মী হয়ে যায়। পেশাদারি জায়গাটা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে না। সাংবাদিকদের পড়াশোনার ঘাটতি বা অনাগ্রহ নিয়ে তিনি হাহাকার করতেন। এ হাহাকার তার অন্তরের, তার পরের প্রজন্মের গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে।

তিনি ইতিহাসের বিশেষ করে ভারতবর্ষের ইতিহাসের এত খুঁটিনাটি বিষয় নখদর্পণে রাখতেন, তা ছিল এক বিস্ময়। তার কথা ও কাজে ফাঁকিঝুঁকি বা সংক্ষিপ্ত বা সস্তা চমকের কোন বিষয় ছিল না। তার মানের একজন ইতিহাসবিদ দক্ষিণ এশিয়ায় কয়জন আছে? আমাদের দেশে আর কেউ আছেন? আমি জানি না।

নামের আগে ডক্টর এবং পরে পিএইচডি লেখা সাইনবোর্ড সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক একশ্রেণির পণ্ডিতদের গবেষণার নামে ফাঁকিবাজি আর পণ্ডিতি ফলাবার বহর তো আমরা হরহামেশাই দেখি। তা যেন প্রাণহীন শতশত পৃষ্ঠার অপ্রয়োগযোগ্য অফলিত প্রকাশনা সমগ্র। এর বিপরীতে সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণা ছিলা ফলিত গবেষণা। তার একটা প্রায়োগিক উদ্দেশ্য ছিল। এই সেদিন মহামারী শুরুর দিকে বঙ্গদেশের ইতিহাসের এমন গৌরব নিদর্শনের ফর্দ তুলে ধরেছেন, তা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। শতশত বছর আগে আমাদের বঙ্গভূমি পশ্চিমের আমেরিকা-ইউরোপের কোন্ দেশ-জাতিকে কোন্ সঙ্কট ও বিপদে ত্রাণসাহায্য পাঠিয়েছে- তার এক দীর্ঘ খতিয়ান তুলে ধরেছেন। এ খতিয়ানে ফ্রান্স এবং ইতালির মত দেশও ছিল।

তিনি ছিলেন অনুসন্ধিৎসু একজন মানুষ। ১৯৮৭ সালে এশীয় কবিতা উৎসবে যোগ দিতে ব্রিটিশ কবি টেউ হিউজেস ঢাকা এসেছিলেন। আয়োজনটা ছিল সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের। এ আয়োজন এদেশের প্রগতিশীল কবিরা বয়কট করেছিল। কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে পাল্টা উৎসব হয়েছিল 'জাতীয় কবিতা উৎসব' নামে। জন্ম হয়েছিল জাতীয় কবিতা পরিষদের। সৈয়দ আবুল মকসুদ তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক। তিনি সরকারি সংবাদ সংস্থায় কাজ করলেও এশীয় কবিতা উৎসবে যাননি। কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে জানার খুব আগ্রহ, ঢেউ হিউজেসকে জিজ্ঞেস করার খুব ইচ্ছে- তিনি কেন একজন সামরিক স্বৈরাচারের আমন্ত্রণে এরকম একটা উৎসবে এসেছিলেন। কিন্তু উপায় কী? উৎসব শেষে টেড হিউজেস যেদিন চলে যাবেন, সেদিন সৈয়দ আবুল মকসুদ ছুটে গিয়েছিলেন ঢেউ হিউজেস যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন, সেই হোটেলে। কবি তখন বিমানবন্দরে যাবার জন্যে বের হবেন। যাবার আগ মুহূর্তে কবি সৈয়দ আবুল মকসুদকে জানালেন, তার অস্বস্তি এবং বিপন্ন বোধের কথা। তিনি উৎসবে পড়ার জন্যে লিখিত যে ভাষণ বা প্রবন্ধ এনেছিলেন তা তিনি পড়েননি। সেই লেখাটি তিনি সৈয়দ আবুল মকসুদকে দিয়েছিলেন। সেই লেখায় বিশ্বপ্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন সঙ্কটের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই লেখা দুই দশকের মাথায় ঢাকার একটি ইংরেজি কাগজ সৈয়দ আবুল মকসুদের কল্যাণে ছেপেছিল।

২০০৪ সালে তিনি বাসসের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের একজন, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়। মৌলবাদীরা বড়ই বাড় বেড়েছে। আক্রমণ করেছে হুমায়ুন আজাদের উপর। সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখলেন এক ক্ষুরধার লেখা। সরকারের উপর মহল নড়েচড়ে বসল। বাসসের কর্তা সৈয়দ আবুল মকসুদকে এরকম লেখা আর না লেখার জন্যে সতর্ক করলেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ কথা না বাড়িয়ে বাসসের চাকরি ছেড়ে দিলেন। আপস করলেন না। এরপর তার আর হারাবার কিছু থাকল না। চাকরিটাও রাজার হস্তগত হয়ে গেল। তিনি তার চারণ জীবন উদযাপন করতে থাকলেন দেশের নানা প্রান্তে ছুটে ছুটে।

এ ছুটে চলা ছিল জীবনের খোঁজে সত্যের তালাশে। এ ছুটে চলা এই অনুসন্ধান ছিল নিরন্তর। তার কাজের ধরন ছিল এক একটা দৃষ্টান্ত। এরকম একটা উদাহরণ আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের জীবনীসাহিত্য রচনা। এখানেও তিনি অনন্য। তিনি অনবদ্য জীবনী রচনা করে গেলেন রবীন্দ্রনাথের, মহাত্মা গান্ধীর, বুদ্ধদেব বসুর, মাওলানা ভাসানীর এবং সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর। আমাদের দেশে হাল আমলে জীবনীসাহিত্য লেখার ভিত্তিটা সৈয়দ আবুল মকসুদের হাতেই গড়া। তার এসব চারণ লেখালেখি এবং গবেষণার প্রয়োজনে তিনি সুযোগ পেলে ছুটে গিয়েছেন ভারতবর্ষের নানা গ্রন্থাগর ও আর্কাইভে।

এরকম চারণ দার্শনিকের আবির্ভাব একটি জাতির জীবনে খুব বেশি ঘটে না। সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন এমন বিরল এক মানুষ। আমাদের দেশের জ্ঞানচর্চার আকাশের আলো বিলি করা বিরামহীন ক্লান্তিহীন নক্ষত্রটির নাম সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁকে ছাড়া আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার আকাশ বড় অপূর্ণ।