বিদ্যাসাগর: দ্বিশতবর্ষে পাঠ-পুনর্পাঠ

সৌমিত জয়দ্বীপসৌমিত জয়দ্বীপ
Published : 26 Sept 2020, 10:05 AM
Updated : 26 Sept 2020, 10:05 AM

প্রশ্নটা যখন সমাজ সংস্কারের, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আসলে রাজা রামমোহন রায়ের উত্তরাধিকার। রামমোহন যেখানে থেমেছেন, বিদ্যাসাগর ঠিক সেখান থেকেই শুরু করেছেন। শুরুই করেননি শুধু, যেন একটা প্রক্রিয়ার পূর্ণতা এনেছেন।

রামমোহন সতীদাহপ্রথা বিলোপের আন্দোলন করলেন। ফলে, বিধবারা প্রাণে রক্ষা পেলেন, সহমরণে পুড়তে হলো না স্বামীর চিতায়। কিন্তু, জীবনটাই শুধু বাঁচল। কোনভাবে বেঁচে থাকাটাই কি তবে ইহজাগতিক স্বার্থকতা?

একজন বিদ্যাসাগর তেমনটা মনে করতেন না। মেনেও নিতে পারেননি। বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব পর্যন্ত তাই অপেক্ষা করতে হলো বিধবাদের, নতুন দাম্পত্য স্বীকৃতির জন্য। বিদ্যাসাগর একটি নয়, দু'টি আন্দোলন করলেন একাধারে। দু'টিই পরস্পরের পরিপূরক। বিধবাবিবাহ আইন ও বহুবিবাহরোধ আইন প্রচলন। ১৮৫৬ সালে সরকার আইনসিদ্ধ করল বিধবাবিবাহকে। নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্তও স্থাপন করলেন। সঙ্গে ছিলেন প্রবল বাল্যবিবাহবিরোধী।

এতগুলো ফ্রন্টে একক লড়াই চালানো পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০-২৯ জুলাই ১৮৯১) দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ করলেন! সমগ্র বাংলার জন্য এ নিশ্চয়ই বড় গৌরবের ক্ষণ!

২.

লড়া একটা দিক। গড়া আরেকটা দিক। বিদ্যাসাগর লড়েছেন যেমন, তেমনি, গড়েছেনও। ১৮৫৭ সাল ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঐতিহাসিক নানা কারণেই। সিপাহী বিদ্রোহের কারণে, প্রথম তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার কারণেও। ঠিক এ সালেই বিদ্যাসাগর ভারতবর্ষের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতায়, নাম হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়, যা বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। বিদ্যাসাগরের এই উদ্যোগের পর বাংলায় আরও অনেক নারীবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তিনি নিজেই এর নেতৃত্ব দেন। ১৮৬৪ সালের মধ্যে বাংলায় ২৮৮টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এ পরিসংখ্যানটি নিছকই হেলাফেলার ব্যাপার নয়।

আজকের দিনে এসব কাজ খুব সহজেই সম্পন্ন করা যেতে পারে বলে ভাবতে পারেন সুশীল সমাজ, এনজিও ও নারীবাদীরা। কিন্তু, প্রায় দেড়শ-দু'শ বছর আগে, রীতিমতো এসবের জন্য নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলতে হয়েছে। রক্ষণশীল সমাজ এসব মানেনি। মানতে চায়নি। বিদ্যাসাগর তবুও প্রাবল্যে ছুটেছেন। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তার মূখ্য ভূমিকাটি মূলতই নারী জাগরণের এবং নারীর জন্য এক প্রতিরোধ-অধ্যায় রচনার।

আমরা তো আজও দেখছি, সমাজ এতটাই রক্ষণশীল যে, নারীমুক্তির প্রশ্ন আসলেই, নানাভাবে গতিরোধক তৈরি হয়ে যায়। নারীরা আজও নানাভাবে পুরুষতান্ত্রিক উপনিবেশে ঔপনিবেশিত-বর্গ। বিদ্যাসাগরের লড়াইয়ের গভীরতাটা তাই বর্তমানে থেকেও বোধ করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতে, বিদ্যাসাগর বাংলার 'প্রথম আধুনিক মানুষ'। এ কথা সত্য যে, কবি মাইকেলের বিদ্যাসাগরের প্রতি অনেকানেক ঋণ। মাইকেলের দুর্দিনে বিদ্যাসাগর উদার না হলে, তাকে অথৈ সাগর পাড়ি দিতে হতো। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু, তাই বলে, বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে মাইকেলের কথাটি অত্যুক্তি তো নয়ই, বরং কথাটা সমাজ-সংস্কারক বিদ্যাসাগরের প্রেক্ষিতে অভ্রান্তই বলা যায়।

যদিও, এ কথাও আমরা জানি যে, শেষ পর্যন্ত তাকে সরকারি আইনের আশ্রয়ই নিতে হয়েছিল। সমাজে নারীর এই অবস্থান পরিবর্তনকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরের চেষ্টা তিনি করেননি, কিংবা পারেননি। আইনই হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতি!

৩.

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহীরুহই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'বিদ্যাসাগর চরিত' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, 'আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণজীবিত ছিলেন।'

৭১ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি। এই ৭১ বছরের মধ্যে যতদিন তিনি কর্মক্ষম ছিলেন, তার পুরোটা সময়ই তিনি ব্যয় করেছেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমৃদ্ধিতে। উনিশ শতকের মতো মহাসমুদ্রসম কালে বাংলাঞ্চল যেসব যুগপুরুষ সৃষ্টি করেছে, তর্কযোগ্যভাবে তিনি সর্বাগ্রে বিরাজ করেন। বাংলার ইতিহাস এই মহাপণ্ডিতের কৃতিত্বকে ব্যতিরেকে লেখা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের কথাটার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ঠিক এখানেই। তবুও, তার সীমাবদ্ধতাকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না।

বিদ্যাসাগরের প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল শ্রেণি। তিনি তার শ্রেণিবোধ থেকে কখনই নিজেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। অনেক পরে যেটা আমরা ড. ভিমরাও আম্বেদকরের মধ্যে পাব বিংশ শতকে। আম্বেদকর প্রচুর পড়ালেখা করে পণ্ডিত হয়েছেন যেমন, তেমনই শ্রেণিচ্যুতও হয়েছেন। ভারতবর্ষের অন্তঃজশ্রেণির 'অ্যাম্বেসেডর' হয়েছেন সে কারণেই। কিন্তু, বিদ্যাসাগর এত কিছু করার পরও, ওই শ্রেণি অবস্থানটিকে অতিক্রম করতে পারেননি। যদিও আমরা দেখি, তার উদ্যোগেই মূলত সংস্কৃত কলেজে ব্রাক্ষ্মণদের পাশাপাশি শূদ্রদেরও প্রবেশাধিকার ঘটে।

বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বৃহৎ পরিসরে যারা কাজ ও গবেষণা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম পুরোধা হলেন সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ। তিনি মূলত বিদ্যাসাগরের 'সামাজিক জীবনচরিত' রচনা করেছেন তার 'বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ' গ্রন্থটির মাধ্যমে। সেখানে তিনি বলেছেন, 'বিদ্যাসাগর নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের একজন আদর্শ পুরুষ… সততা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার দিক থেকে তার ব্যক্তিগত চরিত্র যেমন দুর্ভেদ্য, সামাজিক কর্মজীবনের লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতার দিক থেকেও তেমনি তিনি অদ্বিতীয়। কিন্তু যেহেতু তিনি সকল মানুষের মতো সামাজিক শ্রেণীবদ্ধ মানুষ এবং জীবনসংগ্রামে… মধ্যবিত্তশ্রেণীর এক স্তর থেকে অন্য স্তরে তার স্তরান্তর, … তাই মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত দ্বিধাদ্বন্দ্ব, চিন্তার অসংগতি এমনকি প্রত্যক্ষ সংগ্রামবিমুখতা তার জীবনের দীর্ঘ অপরাহ্নকাল ব্যর্থতা ও আত্মপরাজয়ের গ্লানিতে বিষণ্ন করে তুলেছে।' বিনয় ঘোষ অবশ্য এ ব্যর্থতার একক কারণ হিসেবে শুধু ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকেই দায়ী করেন না। তার মতে, 'ব্যর্থতার অন্যতম কারণ অবশ্য ঐতিহাসিক ও কালিক, ব্যক্তিগত বা চারিত্রিক নয়, যদিও মানুষের চারিত্রক দোষগুণের সংমিশ্রণও অনেকাংশে কালনির্ভর। সামাজিক সংগ্রামে বিদ্যাসাগরের ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো, স্বশ্রেণীর অর্থাৎ মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যে তার সংগ্রামক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা, এবং তাও মধ্যবিত্তের সর্বস্তরের মধ্যে নয়, শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে।'

বিনয় ঘোষের মন্তব্যটি যে ভ্রান্ত নয়, এ সত্যের প্রমাণ পাই আমরা খোদ বিদ্যাসাগরের লেখাতেই। ১৮৫৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর বাংলা সরকারকে লেখা এক চিঠিতে মন্তব্য করেছেন এমন: 'এক ধরনের ধারণা এখানে এবং ইংল্যান্ডে তৈরি হয়েছে যে, উচ্চবিত্তের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট করা হয়েছে এবং এখন সাধারণ মানুষের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু, এ ব্যাপারে তদন্ত করলে দেখা যাবে যে, বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের চিত্রটি আসলে সম্পূর্ণই ভিন্ন। আমার বিনীত মত, সরকারের উচিত নিজেকে উচ্চবিত্তের শিক্ষার ব্যাপারে ব্যাপকমাত্রায় সীমাবদ্ধ করে রাখা।' (ইংরেজি থেকে বর্তমান লেখককৃত অনুবাদ)

হ্যাঁ, কথাটা বিদ্যাসাগরেরই! বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, বিদ্যাসাগরের মতো দ্রোহী মানুষ এ কথা বলেছেন। হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞা ছিল যে মানুষের তিনি এমন একপাক্ষিক চিন্তাও করতে পারতেন। যে মানুষ নিজে অর্থনৈতিকভাবে নিম্নবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে এসে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ও পণ্ডিতে পরিণত হয়েছিলেন, যে মানুষ নিজে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে লেখাপড়া করেছেন বলে কথিত আছে, সেই তিনি শিক্ষাকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। বরং, তার প্রেসক্রিপশন ছিল শিক্ষাকে উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমিত করে রাখার পক্ষে। দেখা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগর এক্ষেত্রেও আধুনিক সময়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।

৪.

রাষ্ট্র বা সরকারের শিক্ষা সংকোচননীতি কোন নতুন ঘটনা নয়। এটা তার চরিত্রের মধ্যেই থাকে। কিন্তু, দেখা যায়, সিভিল সোসাইটির একটা অংশ সেই পালে হাওয়া দেয়। মানি আর না মানি, ডব্লিউ বি হান্টার কিংবা টিবি ম্যাকওলের ডাউনওয়ার্ড ফিল্টারেশন থিওরি বা নিম্নমুখী পরিস্রাবণ তত্ত্ব আজও বিরাজ করে নানাভাবে। বিদ্যাসাগর ম্যাকওলের স্কুলের ছাত্র বা শিক্ষক কোনদিনও ছিলেন না, কিন্তু, কোথাও না কোথাও তিনিও অঙ্গাঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া, ম্যাকওলের ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে 'শিক্ষার বাহন' বা 'ল্যাঙ্গুয়েজ অব ইনস্ট্রাকশন' করার যে ঔপনিবেশিক মনস্তাত্ত্বিক প্রেসক্রিপশন ছিল, সেটার পক্ষের লোক না হয়েও তো বিদ্যাসাগর ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের পক্ষেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বিদ্যাসাগরের অবস্থানটা ঔপনিবেশিক ছিল না, এটা সত্য। কিন্তু, তার মতো মানুষের অবস্থান কোন দিকে, সেটাও কিন্তু ক্ষমতাবানের রাজনীতির সুবিধা বা অসুবিধা নির্দিষ্ট করতে ভূমিকা পালন করে। বিদ্যাসাগরের এই জায়গায়টায় সীমাবদ্ধতা ছিল ব্যাপক যে, তিনি উপনিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেননি। সমাজ সংস্কার করেছেন বটে, কিন্তু উপনিবেশ যে একটি সমস্যা, সেটা তার মতো যুগপুরুষ সম্ভবত আমলেই আনতে চাননি!

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাই হয়তো লিখেছেন, 'বিদ্যাসাগরকে সমাজ-সংস্কারক বলা হয়। নিজেকে তিনি সেভাবেই দেখতেন। কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর অনেক বড় সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগরের তুলনায়। তার বিদ্রোহটা ছিল সাংস্কৃতিক। সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তার যে রুখে দাঁড়ানো তারই প্রকাশ ঘটেছে সমাজসংস্কারে ও সাহিত্যসাধনায়।'

৫.

বাংলা গদ্যের আধুনিকতার পথিকৃৎ ও বিরামচিহ্ন প্রবর্তনের জনক বলা হয় বিদ্যাসাগরকে। এ কৃতিত্বে তিনি বরাবর ভূষিত। সঙ্গে, সাহিত্যিক হিসেবে তিনি দু' হাতে যেমন লিখেছেন, তেমনি বহু গ্রন্থ তিনি অনুবাদও করেছেন। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত তার শিশুতোষ 'বর্ণপরিচয়' পুস্তিকাটি আজও এক মাস্টারপিস। বাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে 'বর্ণপরিচয়' পড়ানো হয় কি না জানি না, তবে মাত্র ২০ বছরের মধ্যে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিতে ভূষিত এই পণ্ডিতপ্রবরের দুর্দান্ত এই সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় হওয়াটা অনিবার্যই হওয়া উচিত।

বিদ্যাসাগরের যে জায়গাটা তার সবচেয়ে বড় কীর্তির, সেটা হলো মাতৃভাষা চর্চা; এটা রবীন্দ্রনাথও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। ইংরেজির প্রতি তার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল, সেটা আমরা বলেছি পূর্বেই। কিন্তু, সেটা বাংলার প্রতি দুর্বলতাকে ছাপিয়ে যায়নি। সংস্কৃতি ভাষার এক মহাপণ্ডিত ছিলেন তিনি। সংস্কৃত থেকে তিনি যেসব গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, সেসবের মূলেও ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার অভিপ্রায়।

ম্যাকওলে যে 'ব্লান্ডার'টা বাংলা ভাষার করেছিলেন ১৮৩৫ সালে তার কুখ্যাত 'মেমোরান্ডাম অব ইন্ডিয়ান এডুকেশনে', সে সময় বাংলার প্রথিতযশা একজনকেও পাওয়া যায় না, যিনি এটার বিরোধিতা করবেন। বিদ্যাসাগরও করেননি। কিন্তু, তার অন্তত 'বোধোদয়' হয়েছিল, সেটাও ১৮৫২ সালে, ১৭ বছর পর! তবুও তো হয়েছিল! এবং বিদ্যাসাগর সওয়াল করেছিলেন মাতৃভাষার শিক্ষার পক্ষে। অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম লিখেছেন, 'বাংলার দুর্ভাগ্য, … মাতৃভাষার পক্ষে কথা বলার মানুষ বাঙালিদের মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বড় একটা দেখা যায়নি। ১৮৫২ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত নোটে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও সমৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছিলেন।'

বিদ্যাসাগরের ওই নোটের ঠিক একশ বছর পর, ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবিতে যে আন্দোলন তীব্রতর হয়েছিল, সেই আন্দোলনের গুরুত্বের জায়গা এটা যে, বাংলা ভাষার বহু বছরের বঞ্চনার জবাব হয়ে উঠেছিল এই আন্দোলন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা খাজা নাজিমুদ্দিনের যে উর্দুর বাইনারি হিসেবে বাংলা ভাষা বিরোধী অবস্থান, সেটি হঠাৎ করে হয়েছে মনে করলে ভ্রম হবে। এর উৎস ওই 'ম্যাকওলে মিনিটস' ও তার পরবর্তী ঘটনাবলী, যেখানে শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলার ক্রমাগত মুখ থুবড়ে পড়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে কোন শক্তিশালী প্রত্যাঘাতই নেই। জিন্নাহরা এই প্রত্যাঘাতহীনতার ইতিহাস জেনেই বাংলাকে ব্রাত্য করে উর্দুকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়ে থাকতে পারেন। ফলে, একশ বছর পরে হলেও, বিদ্যাসাগর বাংলার মহান ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছেন।

অন্যদিকে, তিনি যে গদ্যভাষা সৃষ্টি করেছেন, সেখানেও শ্রেণির প্রশ্নটি থেকেই গেছে। না, তার গদ্য 'আলালি ভাষা'র মতো ফার্সিবহুল নয়, আবার 'হুতোমি ভাষা'র মতো চটুলভাষাও নয়। তবে, তার ভাষাও সাধারণ্যে লোকপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। আজ থেকে দু'শ বছর আগের বাংলা গদ্য কতটা সর্বজনীন হতে পারত সেটা তর্ক-বিতর্কের বিষয়, তবে বিদ্যাসাগরের ভাষা তখন তো নয়ই, আজ অবধি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাপিয়ে জনসভার ভাষার প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। কথাটার অর্থ এই যে, তিনি যে গদ্যটি রেখে গিয়েছিলেন, সে গদ্য তার সময়ে আধুনিক হলেও সেটার মধ্যে সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য এত বেশি ছিল যে, গণমানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে সে গদ্যের তখনও তফাত ছিল, আজও তফাতই আছে। ফলে, সাহিত্যিক হিসেবে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যে উচ্ছ্বাস, তা নিয়েও সংশয়বাদী হওয়ার সুযোগ আছে। যদিও, আধুনিক বাংলা গদ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের গদ্যের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।

৬.

বিশাল ব্যক্তিত্ব, সময়ের চেয়ে প্রাগসর চিন্তাভাবনার মানুষ হওয়ার পরও, বিদ্যাসাগর যে ভিনগ্রহের অতিমানব ছিলেন না এবং তারও যে সীমাপরিসীমা ছিল এবং তিনিও যে সমালোচনার উর্ধ্বে নন, এ লেখায় সেটারই বোঝাপড়া করা হয়েছে। বিদ্যাসাগরের এ সীমাবদ্ধতা তার একক সৃষ্টিও নয়। বড় মানুষদের ক্ষেত্রে যদিও ব্যক্তির সীমাবদ্ধতাই সবচেয়ে বেশি নজরে আসে, তবুও, তার সমাজবাস্তবতাকেও আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

ওই সময়েই তিনি ইহজাগতিক ভাবধারায় বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গণ্য হতেন। উনিশ শতকের মাপকাঠিতে কথাটা একদমই লঘু নয়। প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক তো তিনি ছিলেনই। সেটা সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে চিন্তা করলেও সত্য, সাহিত্য সৃষ্টির কথা চিন্তা করলেও সত্য। এবং, তিনি যে শ্রেণির ছিলেন, সে শ্রেণিটির সীমাও যে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি, এটাও সত্য। কিন্তু, বাংলার ইতিহাসে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজনই এবং আজকে দ্বিশতবর্ষের জন্মজয়ন্তীর কালেও তিনি প্রাসঙ্গিক, এ সত্যটিই তাকে কালজয়ী মানুষ হিসেবে অনাদিকাল বাঁচিয়ে রাখবে!

পাঠসূত্র:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'চারিত্রপূজা', রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্থ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৯৫৭ মার্চ সংস্করণ।

বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান প্রাইভেট লিমিটেড, প্রথম ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান অখণ্ড সংস্করণ ২০১১।

বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, পঞ্চম মুদ্রণ মার্চ ২০০১।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ ২০১১।

শহিদুল ইসলাম, প্রসঙ্গ : শিক্ষা, শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০২।