জাহানারা ইমাম: বিপ্লব স্পন্দিত বুকে

গৌতম রায়
Published : 26 June 2020, 03:42 PM
Updated : 26 June 2020, 03:42 PM

প্রত্যক্ষ রাজনীতি করা থেকে তিনি দূরে ছিলেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আর শিক্ষা জগতের ভিতরে থাকতেই মানুষটি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন। সে-ই মানুষটি যে একদিন স্বীয় দক্ষতায় দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়ে, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে গোটা বিশ্বের কাছে আইকনে পরিণত হতে পারেন- শহীদজননী জাহানারা ইমামকে দেখার আগে কেউ কখনো ভাবতেই পারেননি।

না পারাকে পারা-র নাম হলেন জাহানারা ইমাম। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভিতর দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের রচয়িতাকে ঘিরে একটা বড় অংশের মানুষেরই এ আন্দোলন শুরুর আগে ধারণা ছিল- ইনি একজন আলঙ্কারিক নেত্রী। মূল আন্দোলনের রাশ হয়তো থাকবে অন্যের হাতে। শহীদজননী থাকবেন সামনে। ব্যবহার করা হবে তার ভাবমূর্তিকে।

এ ভুল ভাবনাকে ভুল প্রতিপন্ন করা একটা বিস্ময়ের নাম হল জাহানারা ইমাম। মানুষের ভুল ধারণাকে নসাৎ করে দিয়ে জাহানারা ইমাম কেবল বাংলাদেশের নন, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম নেত্রী হয়ে উঠলেন, সেটা বোঝার জন্যে শহীদজননীর গোটা জীবন যুদ্ধের প্রেক্ষিত বোঝা দরকার।

বাংলাদেশে আপসহীন সংগ্রামী নারী হিসেবে কিংবদন্তী হলেন বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল। তার নামের সঙ্গেই আলোচিত হয় নীলিমা ইব্রাহিমের নাম। আর এ দুই মহীয়সীর সঙ্গেই বিশেষভাবে সংযোজিত দুই ব্যক্তিত্ব হলেন- জাহানারা ইমাম এবং সুলতানা কামাল। আজকের বাংলাদেশ তথা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, নারীর স্বাধিকার, বিশেষ করে সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে সুলতানা কামালের আপসহীন লড়াই হলো সুফিয়া, নীলিমা, জাহানারার-ই গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার।

দুই বাংলার জীবনশৈলীর রেখাচিত্রকে ধারণ করে, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার ভেতর দিয়ে ভালোবাসা আর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং ঘৃণা- এই সন্মিলিত স্রোতধারার নাম হল জাহানারা ইমাম।

অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদে ১৯২৯ সালের ৩ মে জাহানারার জন্ম। রাঢ় বাংলার অভিজাত বাঙালি মুসলমান সমাজের সবধরনের বৈশিষ্ট্যের ভিতর দিয়ে তার বড় হওয়া। রাঢ়ের আশরাফ মুসলমানের আয়মাদারিকে আত্মস্থ করে, সেই হাড়ের গরমকে কখনো আত্ম-অহংকারে জাহানারা পরিণত করেননি। সময়ের অদলবদলকে স্থিত করেছেন নিজের যাপনচিত্রের প্রবাহমান স্রোতধারাতে। রাঢ়ের মাটি থেকে শেকড় উপরে ভাটির দেশের মাটিতে সেই শেকড়কে কেবল স্থাপন করাই নয়, নতুন পোঁতা গাছটিকে পল্লবিত করে, সেই গাছকে কিভাবে ফুলে, ফলে, সুগন্ধে, সৌষ্ঠবে ভরিয়ে তুলতে হয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হল জাহানারা ইমামের গোটা জীবন ও কর্মকাণ্ড।

যে জাহানারা একদিন গণ্য হতেন 'ঢাকার সুচিত্রা সেন' হিসেবে, সেই জাহানারাই একদিন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস করবার শক্তি সঞ্চয় করতে গিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণের ক্ষমতা পর্যন্ত হারালেন। কেমো থেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় জিভের এমন কিছু সমস্যা তার তৈরি হল, যার ফলে উচ্চারণজনিত একটা অস্পষ্টতার ভেতরে তাকে পড়তে হল। এমন অবস্থাও এই সময়ে তার মাঝে মাঝে হয়েছে যে, খুব অন্তরঙ্গ মানুষ ছাড়া তার বলা কথাগুলো পর্যন্ত বাইরের লোকেরা ঠিক মত বুঝতে পারেনি। তবু হার মানেননি শহীদজননী। তবু পিছু হটেননি। অটুট থেকেছে তার মনোবল একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক দালালদের শাস্তির দাবিতে।

'একাত্তরের দিনগুলি'- মহাগ্রন্থটিকে একবাক্যে মুক্তিযুদ্ধের টেস্টামেন্ট বলা যেতে পারে। এ গ্রন্থের ভিতর দিয়ে বিদুষী জাহানারা ইমামকে আমজনতা চিনলেন। সেই গ্রন্থে বর্ণিত চালচিত্রে রুমি-জামির মা থেকে সর্বকালের সব লড়াই-যুদ্ধ-সংগ্রামে দেশের জন্যে আত্মনিবেদিত 'শহীদ' এর মা হিসেবে নিজেকে বিকশিত করলেন তিনি। এই অর্জনটি এক 'কঠিন কঠোর উদ্ধত অসহায়, যারা পায়, যাবা সবই থেকে কিছু নাহি পায়, কেন কিছু আছে বোঝানো, বোঝা যায়'-কে মেলাবার একটি চরম উপলব্ধি। এ উপলব্ধি কেবল বাঙালি নয়, গোটা মানবজাতিকে বুক বেঁধে দাঁড়াবার শক্তি জোগায়। ভেবে ভেবে মিছে হাতের লক্ষ্মীকে ঠেলে ফেলে বাঁচার নাম যে বাঁচা নয়। বাঁচা মানে যে, কান্নাকে দূরে সরিয়ে গলা ছেড়ে জীবনের জয়গান করা- এ বোধটিকে আজকের বাঙালি সমাজের বুকে খোদাই করে দেওয়া জাদুকরি শিল্পীর নাম জাহানারা ইমাম।

বিদুষী, আপাত উচ্চবিত্তের জাহানারা একাত্তরের সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতার দিনচর্চাতে প্রথমেই তুলে ধরেন অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীকে। সেইদিনের ইতিহাস রচনায় একজন নারীর ভূমিকা এবং অবদান যে বঙ্গবন্ধুর পুণ্য নামের সঙ্গে উচ্চারিত হওয়ার স্পর্ধা রাখে, জাহানারা তার 'একাত্তরের দিনগুলি'র শুরুতে তা জোরগলায় জানিয়ে দেন। এক নারীর অপর নারীর গৌরবে এই প্রাণখোলা স্বীকারোক্তি এবং উচ্ছ্বাস- এটাই প্রমাণ করে যে, ভাষা থেকে জাতি আর বর্ণ থেকে লিঙ্গ- কোনও কিছুকে ঘিরেই 'সঙ্কীর্ণতা' নামক শব্দটি জাহানারার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারে কাছে দিয়ে যায় না।

বঙ্গবন্ধুর মত বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তি এবং তার ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়া বক্তৃতা, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সবথেকে জোরালো কথা উঠে আসছে, সেই কথার সাথেই অগ্নিকন্যা মতিয়ার বক্তৃতার সমুচিত গুরুত্ব দেওয়া এভাবে জাহানারা ইমামের মতো কেউ তুলে ধরেননি। ৭ই মার্চকে ঘিরে বহু মানুষ, বহু আলোচনা করেছেন, কিন্তু এভাবে তার মতো ইতিহাস- সমাজমনষ্কতা আর তার সাথে লিঙ্গ সাম্যের বাস্তবানুগ প্রয়োগ- দেখা যায়নি বলা চলে।

নিজের একান্ত ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে দেশের যন্ত্রণা, দশের যন্ত্রণাতে রূপান্তরিত করে দেওয়া দেখলে মনে হয় যেন জাহানারার কলমে কোনও জাদুস্পর্শ আছে। 'একাত্তরের দিনগুলি'-র ভিতর দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে একদম একটি স্পর্শ করার মতো পার্থিব-অপার্থিবের অরূপকথনের ভাবগাম্ভীর্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন জাহানারা। 

কেবল বাঙালি সমাজ নয়, গোটা মানব সমাজ যতদিন টিকে থাকবে , ততদিন মানুষ জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' নামক মোহনবাঁশির সুরে শুনতে পাবে- বন্দি নয় মাসের সেই কাহিনী। মৃত্যু পথযাত্রীকে এ লেখার ভিতর দিয়ে স্বান্তনা দিয়েছেন জাহানারা। আবার সেই জাহানারাই নতুন প্রেমে পড়া যুবক-যুবতী ও প্রেমকে 'যে অগ্নিতে দীপ্তগীতে' রূপান্তরিত করার স্পর্ধা জুগিয়েছেন।

একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষকে বিষণ্ণতা থেকে উত্তরণের মহৌষধ পৌঁছে দিয়েছেন তার এ টেস্টামেন্টের ভিতর দিয়ে। সুফিয়া কামালের 'একাত্তরের ডায়েরী'-তে বন্দি নয় মাসে সুফিয়ার তৈরি কাঁথার প্রতিটি ফোড়ে তার বুকের রক্তের মিশেল দেখতে পাই আমরা। জাহানারাও নিরবে-নিভৃতে এক টুকরো কাগজে ছেঁড়া খাতার কোনায় রেখে দেওয়া টুকরো টুকরো নোটের ভিত্তিতে যখন একদিন 'একাত্তরের দিনগুলি'র মত মেটারলিঙ্কের 'ব্লু বার্ড'-কে আমাদের সামনে বেহাগ রাগ পরিবেশনের মতো উপস্থাপন করেন, তখন রবীন্দ্রনাথের সব থেকে প্রিয় সেই রাগ যেন শহীদজননীর কান্নার আর আমার-আপনার-আমাদের সকলের চোখের পানির এক অপূর্ব ত্রিবেণী সঙ্গম রচনা করে দেয়।

এ সেতুবন্ধন মহান নভেম্বর বিপ্লবের মর্মকথার রচয়িতা জন রিডের 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন' এর মতই কালের কষ্টিপাথরে এক চিরস্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করে জাহানারা ইমামকে এবং তার সৃষ্টি 'একাত্তরের দিনগুলি'-কে। এ প্রতিষ্ঠার মেঘমন্দ্রিত ধ্বনির ভিতর দিয়েই আমরা বুঝে নিতে পারি বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের নবপ্রোথিত সাম্রাজ্যবাদের মূল উৎপাটনে ঐতিহাসিক একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটির ঐতিহাসিক পটভূমিকা এবং অবদানকে।

 ১৭৮৯ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কালের টিকা নির্মাণ করেছিল মহান ফরাসি বিপ্লব। সাম্য-মৈত্রী আর স্বাধীনতার বাণীর প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে অন্ধকারের আবর্ত ভেদ করে আলোকে প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়েছিল মহান ফরাসি বিপ্লবের ভিতর দিয়ে। সেই কালের ইতিকথা নির্মাণ করে একদা বিপ্লবকে 'রাক্ষসী জননী' বলে গভীর যন্ত্রণাবিদ্ধ মন নিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন কার্ললাইল।

মহান মুক্তিযুদ্ধেও বিপ্লব ঘিরে কার্ললাইলের সেই স্বগোতক্তির করুণ অথচ কঠিন, আবার কোমল দ্যোতনার উদ্ধত পুনোরুচ্চারণ কি আমরা শুনেছিলাম? কার্ললাইল বিপ্লবকে তুলনা করেছিলেন যে রক্তস্নাত অভিবচনে, সেই অভিশ্রুতির যেন এক যন্ত্রণা ক্লিন্ন রূপ জাহানারার সৃষ্টিতেও আমরা খুব নিপুণভাবে ফুটে উঠতে দেখি। 

কার্লাইল বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক দিক থেকে থেমে গেছেন অভিব্যক্তির অভিশ্রুতনে। আর জাহানারা সেই সমাপ্তি থেকেই খুঁজেছেন ব্যাপ্তিকে। শেষের মাঝে শুরুর এই প্রত্যয়কে কেবল খোঁজাই নয়, সেই আত্মানুসন্ধানের ভিতর দিয়ে সত্যের উজানে তরণী বাওয়া- জাহানারার মত এইরকম কর্মপ্রণালী বিশ্বের কোনো বিদ্রোহ-বিপ্লবের টেস্টামেন্টের স্রষ্টার ভিতরে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। 

সমস্যাকে নিরূপিত করছেন কার্লাইল। তার আগেও রোমান সাম্রাজ্যকে ঘিরে করেছেন গিবন। তাদের সেই অনবদ্য মূল্যায়নে বিষয়কেন্দ্রিক গভীরতার মাঝেই আছে বিষয়জনিত দুর্বলতাও; কিন্তু নেই সে-ই দুর্বলতার সাগর পাড়ি দেওয়ার কোনও প্রত্যয়। জাহানারা আপন স্বামী , সন্তানকে অর্পণ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। বুকের কান্নাকে গলায় আটকে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সংগৃহীত চাল ভাগ করে দিয়েছেন স্বামীর কুলখানির জন্য। তারই মাঝে আশায় বুক বেঁধেছেন পুত্র রুমির জন্যে। সেই বুক বাঁধার শেষ আশাটুকুও নি:শেষ হয়ে যাবার পর নিজেকে বৈরাগ্য সাধনে মুক্তির পথে ঠেলে দেননি।

নিজের বন্ধন মাঝে মুক্তির যে স্বাদের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তাকে পরিপূর্ণতা দিতে রাক্ষসী থাবার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন প্রিয় স্বদেশকে। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ের ভিতরে যে আগুনমুখী একটা মানুষ থাকতে পারে- দূরের মানুষ তো দূরেরই কথা, জাহানারার খুব কাছের মানুষও যা কখনো সেভাবে অনুভব করতে পারেননি। একাত্তরের ঘাতক দালালদের সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরিত মানুষদের মনে একরাশ ঘৃণার ধারাবাহিকতা সঞ্চারের ভিতর দিয়ে যে কাজ তিনি করে গিয়েছেন তার তুলনা চলে রুশ বিপ্লবের লেনিন বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাজের সঙ্গেই।

বিশ্বের ইতিহাসে স্রষ্টাকে কর্মযোগী হয়ে উঠতে খুব একটা দেখা যায় না। এদিক থেকে তলস্তয়কে বিচার করলে তার সৃষ্টির কাছে আমাদের নতজানু হতে হয়। তার সৃষ্টির সৌরভ গান্ধীর কর্মযোগের বাগানে শতফুল বিকশিত করেছিল। আর সৃষ্টির সঙ্গে কর্মযোগকে মেলাবার চিরকালীন এক কর্মযোগী হিসেবে আমাদের সামনে উঠে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার মত বিপুল সৃষ্টির অধিকারী না হলেও একটি জাতির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার টেস্টামেন্ট রচয়িত্রী পুনর্পরাধীনতার অভিমুখকে রুখে দেওয়ার সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাতে সৃষ্টি আর কর্ণযোগের যৌথ ধারা প্রবাহের সন্মিলনী হিসেবে কাজের ক্ষেত্রে প্রেক্ষিত জনিত ফারাক থাকলেও , সৃষ্টি আর কর্মযোগের এ মিলিত স্রোতের ধারাতে জাহানারা ইমামকে নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে চিহ্নিত করতেই হয়।

'একাত্তরের দিনগুলি' সৃষ্টির অনেক আগে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু করেছিলেন জাহানারা ইমাম। লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের অনুবাদের ভিতর দিয়ে তিনি অনুবাদ সাহিত্যকে একটা ভিন্ন মাত্রায় এনে দিতে সক্ষম হলেন। কবীর চৌধুরীর বিভিন্ন অনুবাদ বা শামসুর রাহমানের করা শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' এর অনুবাদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে রাখার উপযোগী অনুবাদ সাহিত্যে জাহানারা ইমামের সংযোজনগুলি সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যের এক চিরকালীন সম্পদ হয়ে আছে।

এই অনুবাদ সাহিত্যের মাঝেই জাহানারা সৃষ্টি করলেন ছোটদের জন্যে 'গজকচ্ছপ' আর ' সাতটি তারার ঝিকিমিকি'। 

এই লেখাগুলি কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের রচয়িতা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মননলোক, হৃদয়বত্তা, স্নেহ অন্ত:সলিলা ফল্গুধারা উপলব্ধি করার জন্য এক একটি মাইল ফলক। শিশুকে না বুঝলে একটি দেশের, জাতির আগামীদিনের স্বপ্ন সঠিকভাবে দেখা যায় না- এ বোধ যেন জাহানারাকে সমস্ত কর্মব্যস্ততার ভিতরেও একটা দীপ্ত প্রত্যয়ে স্থিত করে রাখত। নিজের সেই শিশুমনের পরিচয় তিনি রেখেছিলেন তার সামগ্রিক চর্চার ভিতরে। রেখেছিলেন চর্যার প্রত্যেকটি ধাপেও। তাই রোগজীর্ণ শরীরেও নিজের বাড়ি 'কাকলী'-তে পোষা ময়না পাখিটির কাছে একটু দাঁড়ালেই যেন তিনি ভুলে যেতেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সব তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাকেও।

ছোটদের জন্য এ বইগুলো লেখার ফাঁকেই তিনি মনটাকে স্থির করেছিলেন 'একাত্তরের দিনগুলি' নামক মহান মুক্তিযুদ্ধের টেস্টামেন্ট লিখতে। এই বই যখন তিনি লিখতে শুরু করেন, পঁচাত্তর উত্তর সেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিহীন সে বাংলাদেশ- তখন ক্রমশ হয়ে উঠছে অতীতের হানাদার পাকিস্থানের ছায়া উপনিবেশ। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখন নানাভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়। হানাদার পাক বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস- সমস্ত যুদ্ধাপরাধীরাই তখন বাংলাদেশটাকে কার্যত আবার পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে ইতিহাসের রথচক্রকে উল্টোদিকে ঘোরাতে সবরকমভাবে তৎপর।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সমস্ত মানুষই তখন রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমানের রক্ষচক্ষুর টার্গেট। সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফি, শামসুর রাহমান- কেউই তখন শারীরিকভাবে পর্যন্ত নিরাপদ নন। একাত্তরের বন্দি নয়মাসের কালো চাদরটা আবার ছেয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশের মুক্ত আকাশে। ধর্মনিরপেক্ষতা, যেটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান আদর্শ, সেটিকে তখন যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা পরিচালিত সরকার একটি অপরাধমূলক শব্দের দ্যোতনা দিয়েছে। সম্প্রীতির আদর্শকে পদদলিত করতে গোটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র তখন সমস্ত স্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা, গণতন্ত্রের প্রতি কাকুতি- এগুলিকে তখন রাজাকার পুনর্বাসনকারী বাংলাদেশ সরকার কার্যত দেশদ্রোহিতার নামান্তরে পর্যবসিত করেছে। অকুতোভয় সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমানদের মতো মানুষকে তবুও শায়েস্তা করতে পারছে না রাষ্ট্রযন্ত্র। এইরকম একটি রাজনৈতিক-সামাজিক পটভূমিকার ভিতরে জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি'- র প্রকাশই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পরই খুনি মেজর চক্র এবং খোন্দকার মোশতাকে মূল লক্ষ্য ছিল- বাঙালির মন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে অত্যন্ত সূক্ষভাবে এই কাজ করতে শুরু করে। একাত্তরের ঘৃণ্য ঘাতক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই ঘৃণ্য জীবটিকে কেবল বাংলাদেশে ফিরে আসারই অনুমতি দেয়নি রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়া, তাকে পাক হানাদারদের চরম সমর্থক, ঘোরতর মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক জামায়াতে ইসলামীর আমির হওয়ার বিষয়টি পর্যন্ত নীরবে সহ্য করেছেন তিনি।

পরবর্তীতে এরশাদ, খালেদা জিয়া- সকলেই এক পথেই হেঁটেছে। নানাভাবে তারা পদদলিত করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধুর সুউচ্চ আদর্শ। দেশে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল এবং যুদ্ধাপরাধীদের। খালেদা তার মন্ত্রিসভার শরিক করেছে জামায়াতকে। একাত্তরে বরিশালের শান্তি কমিটির প্রধান কুখ্যাত ঘাতক-দালাল আবদুর রহমান বিশ্বাসকে দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত করেছে।

এমন একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভিতরে জাহানারা তার 'একাত্তরের দিনগুলি' প্রকাশ করেন। দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র যখন মহান মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় চেতনা জাতির বুক থেকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে সবরকমভাবে তৎপর, তখন সেই জাতির বুকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে, গণতন্ত্রের ভাবধারাকে খোদাই করে দিতে- একজন প্রথম সারির ভাস্করের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন শহীদ জননী।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পরে একটা সময়ে যখন বাংলাদেশের বুকে শেখ মুজিবের নামোচ্চারণ করতে দিত না জান্তব রাষ্ট্রশক্তি, তখন মানুষ বাংলাদেশের বুকে গহীনে প্রোথিত করেছিল অন্নদাশঙ্করের অমর সৃষ্টি- 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান।' 

এই রকম মূর্চ্ছনাতেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবলুপ্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়েছিল 'একাত্তরের দিনগুলি'। একটি বই যে কিভাবে একটি জাতিকে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে একটি বিশেষ রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে, মানবসভ্যতার বুকে সেটি প্রমাণ করেছে শহীদজননীর গ্রন্থটি। এ বই প্রকাশ না হলে যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক দালালদের বিচারের প্রশ্নটি নতুন করে আপামর বাংলাদেশের মানুষের কাছে কবে নবোদ্যমে জেগে উঠতো কে জানে! 

এ বইটি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় রচনা করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি, সর্বোপরি ধর্মনিরপেক্ষতায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনবার লড়াইকে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত করে, তাকে এতো অল্প সময়ের ভিতর ফলপ্রসূ করে তুলতে পারত কিনা- এই বিতর্ক থেকেই যায়।

আজ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে এসেছে, গণতন্ত্র ফিরে এসেছে , তার সার্বিক প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছিল সুফিয়া কামালের নেতৃত্বাধীন 'গণতদন্ত কমিশন'। সেই পটভূমির উপর দাঁড়িয়ে কুখ্যাত ঘাতক-দালাল গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালের ২৬ শে মার্চ ঐতিহাসিক গণ আদালত অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। এই গোটা প্রেক্ষিতটাই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে রচিত হতে পারত না।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় নির্মাণের প্রেক্ষিতে সুফিয়া কামাল এবং গোটা কর্মকাণ্ডে শহীদ জননীর সব থেকে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী সৈয়দ হাসান ইমামের কথা বলা খুব জরুরী। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কাছাকাছি আসার একটা প্রবণতা একাংশের বুদ্ধিজীবীদের ভিতরে দেখা যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বা বঙ্গবন্ধুর আমলে একাংশের বামপন্থিরা এমন কিছু ভূমিকা নেয়, যাকে বামপন্থা তো বলাই যায় না। পাকিস্তানের কাছে পিকিংপন্থিদের পাকিস্তান রক্ষার জন্যে অস্ত্র চাওয়ার মত ঘটনাও ঘটে, যা সার্বিকভাবে বামপন্থার কপালে একটা কলঙ্কটিকা এঁটে দেয়।

কামাল লোহানীর মত বামপন্থি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্পকলা একাদেমির সভাপতির দায়িত্ব পান। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে শরীক করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার তৈরি করার পরও কিন্তু তৎক্ষণাৎ লোহানী পদত্যাগ করেন না। সরকারের সঙ্গে সংঘাত তৈরির পর তিনি পদত্যাগ করেন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে কুখ্যাত গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পায় আদালতের নির্দেশে। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ঘিরেও ওঠে প্রবল প্রশ্ন। এই অবস্থায় সৈয়দ হাসান ইমাম, শাহরিয়ার কবীরের মত মানুষেরা সিদ্ধান্তে আসেন- আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। তারা যান সুফিয়া কামালের কাছে। তাকে অনুরোধ করেন , যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে।

সুফিয়া কামাল নেতৃত্বের রাশ তুলে দেন জাহানারা ইমামের হাতে। বলেন- বয়সের ভারে আমার এখন বেশি ছুটোছুটি করা মুশকিল। জাহানারা ক্যান্সার আক্রান্ত হলেও ওর চলাফেরার ক্ষমতা এখন আমার থেকে বেশি। ওর সঙ্গে আমি আছি।

ভারতীয় উপমহাদেশে মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে সুফিয়া কামাল কিংবদন্তী। এমন ক্ষণজন্মা মানুষের এটাই বোধহয় সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, জাগতিক যেকোনও বিষয়ে সন্তের মত নির্লিপ্তির ধারাবাহিকতায়, নেতৃত্বজনিত নির্লিপ্তি তাদের একটা অন্য ভুবনে প্রতিষ্ঠিত করে। সুফিয়া কামাল নিজের মাটির সঙ্গে সম্পর্কের গুণে বুঝেছিলেন, একটি আদর্শপূরণের প্রশ্নে পারষ্পরিক কোনও সংঘাত, ব্যক্তিত্বের লড়াইকে এতটুকু আমল না দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্প্রতিষ্ঠায় দেশব্যাপী গণজাগরণ আনতে পারার মত যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন জাহানারা ইমাম।

আর জাহানারাও বুঝেছিলেন, এ কাজে সুফিয়া কামালের মত মানুষ মাথার উপরে থাকলেও , তার পাশে সব থেকে যোগ্য মানুষটি হলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধ্রুবতারা প্রতিম সৈয়দ হাসান ইমাম। যে বদরুদ্দীন উমর একদা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনার সঙ্গে নিজেকে কোনও অবস্থাতেই সম্পৃক্ত করতে পারেননি, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা যার কাছে কার্যত মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই মানুষটিকেও জাহানারা ইমামের আন্দোলনে শেখ হাসিনার সঙ্গে একমঞ্চে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। 

সুফিয়া কামাল নেতৃত্বের 'ব্যাটন'-টি জাহানারা ইমামের মতো যোগ্যতম ব্যক্তিত্বের হাতে না দিলে যেমন গণ আদালতের সার্বিক পর্যায়টি তৈরি হতো না। সুফিয়া কামাল, শেখ হাসিনা, কলিম শরাফি, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, গাজিউল হক, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অনুপম সেন, পান্না কায়সার, আহমদ শরীফ প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের সেই আন্দোলনে শামিল করে তার পূর্ণাঙ্গতা প্রদানের কাজটি অসমাপ্ত থেকে যেত সৈয়দ হাসান ইমামের মত মানুষ যদি শহিদ জননীর পাশে না থাকতেন। শহীদ জননীর প্রয়াণ দিবসে (২৬ জুন, ১৯৯৪) এই সার্বিক প্রেক্ষাপটকে মনে রেখেই কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের শপথ বাক্য উচ্চারণ করতে হবে।