বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া দুর্নীতিকে উসকে দেবে 

সাইফুল হোসেন
Published : 13 June 2020, 04:10 PM
Updated : 13 June 2020, 04:10 PM

বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নতুন কোনও বিষয় নয়। বরাবরের মত এবারও অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তবে যে প্রক্রিয়ায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এই সুযোগ রাখা হয়েছে তাতে দুর্নীতি আরও বাড়ার সুযোগ তৈরি হলে অবাক হবার তেমন কিছু থাকবে না। 

সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৩ কোটি টাকা। ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

অনেকেই যদিও এটাকে গতানুগতিক বাজেট হিসেবে দেখছেন, তবে এই বাজেট পূর্বের বাজেটের অনুরূপ নয়। বরং বেশ কিছু জায়গায় ভিন্নতা আছে। করোনাকালীন দারিদ্র্য বৃদ্ধিকে বিবেচনা করে সরকারী নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেটা কল্যাণমুখিতার একটা দিক। তবে বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে আশা (৮.২ শতাংশ) সেটা অর্জন সম্ভব হবে যদি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দুই এক মাসের মধ্যে বিদায় নেয় বা কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেটা অসম্ভব বলে মনে হয় আপাতত। তাছাড়া বাজেটে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা মাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচার করলে এবং করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে বাস্তবসম্মত নয়।

আমরা জানি বাজেট ঘাটতির টাকা সরকারকে প্রধানত দুইভাবে জোগাড় করতে হয়, বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে জনগণ থেকে ঋণ নেওয়া অন্যতম।    

মুলত আয়, বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে পূর্বের সরকারগুলোর মতই কালো টাকাকে সাদা করার উদ্যোগ অব্যাহত আছে নতুন ঘোষিত বাজেটে। আমরা আগে থেকে অনুমান করেছি যে এবারও এই সুযোগ অব্যাহত থাকবে, কারণ এই মহামারী আমাদের যে বিপদে ফেলেছে তাতে আর্থিক সংকট এমনিতেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না থাকলে টাকা পাচার আরও বেড়ে যাবে তাতে দেশে নগদ টাকার অভাব আরও প্রকট হবে।

সরকারের প্রচেষ্টা হচ্ছে যে করেই হোক দেশের টাকা দেশে থাকুক, বিপদ সামাল দিয়ে ওঠা যাক। কিন্তু এবার যে প্রক্রিয়ায় কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ থাকছে তাতে দেশে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার এবং অন্যায়কারীরা উৎসাহিত হবার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনে হয় অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার মত ঘটনা ঘটতে পারে। 

বাজেটে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করা যাবে বলা হয়েছে। বিনিয়োগ করা যাবে শেয়ারবাজার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ডিবেঞ্চার এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্যান্য সিকিউরিটিতে। তবে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে এক বছরের জন্য। এছাড়া ১০ শতাংশ কর দিয়ে ব্যাংকেও জমা রাখা যাবে এই টাকা। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে বলা হয়, নগদ, ব্যাংক জমা, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরনের স্কিমে এই টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। সবচেয়ে বড়ো যে সুবিধা হলো এই বিনিয়োগ নিয়ে কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রশ্ন করতে পারবে না দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। পূর্ববর্তী সময়ে এই সুযোগ রাখা হতনা। 

বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ কত তা নিয়ে সম্প্রতি কোনও গবেষণা নেই৷ বর্তমানে দেশে ৭ লাখ কোটির মত কালো টাকা আছে বলে ধারণা করছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। যদিও এটার কোন সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্ট আমাদের হাতে নেই। 

বিশ্বব্যাংক ২০০৫ সালের এক গবেষণায় বলছে, ২০০২-২০০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপি-র ৩৭ দশমিক সাত ভাগ৷  এদিকে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে৷ জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ ভাগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ৷ গবেষণায় আরো বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালো টাকার পরিমান ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ ভাগ৷ আর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কালো টাকার পরিমাণ ছিলো জিডিপির মাত্র ৭ ভাগ৷ বিশ্বব্যাংক অবৈধ আয়ের যে কালো টাকা, তার উৎস হিসেবে মাদক ব্যবসা, অবৈধ ব্যবসা, ঘুস ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছে৷

পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা আছে। কোথাও বেশি, কোথাও কম; অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই টাকার পরিমান বেশি।

নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, সভ্যতার গোড়া থেকে সাদা ও কালো পরষ্পর হাত ধরাধরি করে আসছে যা পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে। যেমন পশ্চিমা বিশ্ব, মধ্যম আয়ের দেশ লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে যেখানে অফশোর হিসাব বলে একটি কার্যক্রম প্রচলিত আছে যেখানে বিশেষায়িত অঞ্চলে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে কোন প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয় না- যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগের একটি বৃহৎ অংশ দখল করে রয়েছে। 

পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলে টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে বেশি লাভ হয়না। অল্প কিছু টাকা করপ্রদানপূর্বক সাদা হয় বৈকি কিন্তু সরকারের যে উদ্দেশ্য থাকে তা সফল হয় না কোনওবারই। তবু বারবার এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে মোট ১৭ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা হওয়ার একটা রেকর্ড আছে৷ তবে তার মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়৷ তাহলে পরিমাণটা মোটেই তেমন বেশি না৷ এই টাকা মূলত বাইরে পাচার হয়ে যায়। সিপিডি-র ধারণামতে বাংলদেশ থেকে প্রতিবছর ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মত পাচার হয়। 

তবে বর্তমান যে প্রক্রিয়া অনুসৃত হবে তাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কালো টাকা সাদা করার উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা যায়, যদি টাকা সাদা করার এই সুযোগ না নিলে পরবর্তীতে খুঁজে-পাওয়া কালো টাকার মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, (শুধু অর্থদণ্ড নয়) নিশ্চিত করা যায়।

সচেতন মহল মনে করেন, মূলত তিনটি কারণে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রথমত, কালো টাকার মালিকদের ভয় থাকে যে তাঁরা পরবর্তীতে প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন এবং কপাল খারাপ থাকলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, নিকট বা দূর অতীতে কালো টাকার মালিকদের আইনের আওতায় আনার কোন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নেই যাতে কালো টাকার মালিকেরা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি টাকা সাদা করার জন্য ছুটবেন এবং তৃতীয়ত, বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে কাউকে বাধ্য করা হয়নি বা এই ধরনের দৃশ্যমান কোন সরকারী উদ্যোগ চোখে পড়ে না যার দ্বারা কালো টাকার মালিকেরা বিদেশে টাকা পাচার করতে নিরুৎসাহিত হবেন।

যাহোক, অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাব কমাতে হবে না হলে সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে কালো টাকা যে অর্থনীতির জন্য শুধু ক্ষতি বয়ে আনে ব্যাপারটা তেমন নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তথা উন্নয়নে তার ভুমিকা আছে তবে সমাজের অসমতা, দুর্নীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধ, ঘুষ বাণিজ্য, অসততা- এগুলো জিইয়ে রাখা এবং বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কালো টাকার ভুমিকা অনেক। অন্যায়-অপরাধের মধ্যেই কালো টাকার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং অন্যায়-অপরাধকে তরান্বিত করাই আবার তার কাজ। 

কালো টাকা যেহেতু অর্থনীতিতে ঢুকে থাকে তাই এতে দুই ধরনের সমস্যা হয়। প্রথমত, সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় আর যারা সৎ বিনিয়োগকারী, তারা কালো টাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেন না৷ ফলে অর্থনীতিতে নষ্ট হয় ভারসাম্য। 

বর্তমান বাজেটে কালো টাকা সাদা করার এই উদ্যোগ নেওয়ার কারণে যদি উল্লেখযোগ্য পরিমান টাকা সাদা হয়ে দেশের এই ক্রান্তিকালে কাজে আসে তাহলে খারাপ নয়। তবে এই সুযোগে যারা টাকাকে সাদা করবে না, টাকা পাচার করবে, তাদের ধরে উল্লেখযোগ্য ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ব্যাপারটা অতীব কঠিন ও জটিল। যদি তা না পারা যায় তবে সমাজে অপরাধ, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য, জবাবহীনতা,সিন্ডিকেট বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি- মোটকথা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ বেড়ে যাবে, অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।