কোভিড-১৯: যেভাবে আছি বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে

নুশরাত জাহান
Published : 28 April 2020, 03:51 PM
Updated : 28 April 2020, 03:51 PM

এবারের পহেলা বৈশাখে বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির বৈশাখী চত্বরটি ছিল সুনশান। এদিন রাত ১২টার পর হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ যেতেই মনে হলো, একটা বাচ্চা সাইকেল চালিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকেই আসছে। কৌতুহলী হয়ে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি ফারিস্তা, আমাদের এক সহকর্মীর ছয় বছর বয়সী মেয়ে। ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরে। তিন-চার মিনিট পরই চলে গেলেন উনারা। উৎসুখ মনে দরজা খুলে বের হয়েই আমি অবাক, বেশ বিস্মিতও! ফারিস্তা তার বন্ধুদের বাসার দরজায় চুপিসারে লাগিয়েছে নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা। মহামারী করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় ঘরবন্দি এসব শিশুদের অবাক করা কর্মকাণ্ড এমন দূর্দিনেও ভালোলাগায় মন ভরে যায়।

১২০ একরের সবুজেঘেরা আরডিএ কম্পাউন্ডে ফারিস্তা, অদ্রী, আয়রা, সামিরা, সাজিদ, সাবীর মত অন্য শিশুরাও লকডাউনে ঘরবন্দি। তাইতো পার্কের দোলনাগুলো আর দোলে না, বাচ্চারা দলবেঁধে সাইকেল নিয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দে মাতিয়ে রাখে না চারপাশ। এই সময়ে তারা বাসায় বসে ছবি আঁকা, ক্র্যাফটিং, রান্না শেখা, ঘরের কাজে বাবা-মাকে সাহায্য করা, বারান্দায় গাছের পরিচর্যা এবং এ্যাকুরিয়ামের মাছ আর খাঁচার পাখিদের যত্ন নিয়েই বেশ ব্যস্ত। আর মহামারীতে কীভাবে আরডিএকে নিরাপদ রাখা যায় সেই পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়নে ব্যস্ত বড়রা।

বাংলাদেশে কোডিভ-১৯ এর সংক্রমণের পর প্রথম দফার সরকারি ছুটি বা লাকডাউন ঘোষণার পরপরই আরডিএ মহাপরিচালক, অতিরিক্ত সচিব মো. আমিনুল ইসলাম এই ভাইরাসের ভয়াবহতা চিন্তা করেই দ্রুত পদক্ষেপ নেন। মিটিং করে করোনা প্রতিরোধ টিম বানিয়ে দায়িত্বও ভাগ করে দেন। বন্ধ হয়ে যায় একাডেমির প্রবেশ দ্বার। একাডেমি থেকে বের হয়ে আবার ফিরে আসার পথও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মাঠের কৃষক থেকে শুরু করে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা, চিকিৎসকদের মত শত শত প্রশিক্ষণার্থীর ক্লাস, ফার্মভিজিট বন্ধ হয়ে যায়; তারা ফিরে যান নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র বা পরিবারের কাছে। তালা পড়ে প্রশিক্ষণ কক্ষে, লম্বা করিডোরে সারিবদ্ধভাবে হাঁটার দৃশ্য আর দেখা যায় না। প্রশাসন ভবনের পুকুর পাড়ে নেই কোনো জটলা, সবাই ঘরে ঢুকে যাওয়ায় ক্যাফেটেরিয়া আর ইনডোর স্পোর্টস রুমেও নেই কোনো হৈ চৈ। রঙবেরঙের ফুলগুলোর সঙ্গে কেউ আর সেলফি তুলছে না বলে সেগুলোর মনও কি একটু খারাপ? এমন ক্যাম্পাসে ঝরাপাতার প্রতিটি শব্দই যেন এখন কানে আসে। এমন সুনশান, নির্জন, নির্জীব, প্রাণহীন আরডিএ ক্যাম্পাস সাত বছরের চাকরি জীবনে একদিনের জন্যও দেখিনি।

দাপ্তরিক বেশিরভাগ কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও একাডেমির ৮০ একরের ফার্মে কোনো কাজই থেমে নেই। ২২ একর জমিতে চাষ হওয়া বোরো ধান কাটার কাজ চলছে পুরোদমে। বায়োটেকনোলজি ল্যাবের জারে বেড়ে ওঠা চারা থেকে উৎপাদিত আলু তোলা ও সংরক্ষণের কাজও হচ্ছে সময় মতই। ফার্মের ডেইরি ইউনিটের প্রতিদিন আড়াই শ লিটার দুধ বাসায় বাসায় পৌঁছানোর পরেও নিজস্ব এগ্রো প্রসেসিং অ্যান্ড মার্কেটিং ইউনিটে তৈরি হচ্ছে পুষ্টিকর দই। পোল্ট্রি ইউনিটের মুরগী আর ফার্মের অর্গানিক সবজি যেন এই দুঃসময়ে আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া। দিন হাজিরায় যারা আরডিএ'র মাঠে কাজ করতেন তারাও প্রায় একমাস বাড়িমুখো হননি; সবাই যে চায় প্রিয় মানুষগুলো নিরাপদে থাকুক। এই করোনাকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের চাহিদাপত্র জমা দিয়ে আরডিএ'র সমবায় বিপণী থেকে সংগ্রহের সুব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষতার সাথে প্রশাসন নিশ্চিত করছে আমাদের সব ধরনের চাহিদা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে করোনাভাইরাস সচেতনতার লিফলেট। জরুরী প্রয়োজনীয় ওষুধ, মোবাইল ফোনে টাকা ভরা বা অন্যান্য চাহিদার জন্য দেওয়া হয়েছে ফোন নম্বর। খুব প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া গাড়ির চালকদের জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই)। জরুরী স্বাস্থ্য সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছে আরডিএ মেডিকেল সেন্টারের অ্যাম্বুলেন্স। ক্যাম্পাসের প্রহরীসহ যারা মাঠে কাজ করছেন তাদের সবাইকে দেওয়া হয়েছে হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক আর বায়োটেকনোলজি ল্যাব ও এপিএম ইউনিটে প্রস্তুতকৃত হ্যান্ড স্যানিটাইজার। প্রতি সপ্তাহে ব্লিচিং পাউডার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে একাডেমির ভেতরের রাস্তাঘাট। এসবের পাশাপাশি সরকারের আদেশ মেনে জরুরি কাজগুলোও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষায় শুরু থেকেই সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় এখনো আমরা সবাই নিরাপদে আছি। ভবিষ্যতে কী হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে আক্ষরিক অর্থে লকডাউনের প্রতিটি বিধিনিষেধ মেনে চলছে আরডিএ।

রোজা শুরু হয়ে গেছে। এবার হয়তো আরডিএতে বসবাসকারী পরিবারগুলো অনেককে ছাড়াই নিজ নিজ ঘরে পালন করবে 'লকড ডাউন ঈদ'। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ফারিস্তা হয়তো চাঁদরাতে আবার তার বন্ধুদের বাসার দরজায় চুপিসারে সাঁটিয়ে দেবে ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড। কিন্তু এমন করে আর কতদিন? আমরা চাই- ফারিস্তারা নির্ভয়ে বন্ধুদের জড়িয়ে ধরুক অপার্থীব ভালোবাসায়, ওদের প্রাণচঞ্চল হাসিতে কেটে যাক করোনার স্তব্ধতা, পার্কের দোলনাগুলো আবার শূন্যে ভাসুক, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে বিকেলটা হোক আগের থেকেও বেশি প্রাণবন্ত, শহরের যান্ত্রিকতা ভুলে সবুজের মাঝে বুকভরে শ্বাস নিতে হাজারো মানুষ আবার আসুক এই প্রশিক্ষণ একাডেমিতে; স্থবিরতা কাটিয়ে প্রাণ ফিরে পাক প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি।