আমার নেতা…

আবদুর রহিম হারমাছি
Published : 13 March 2019, 07:42 AM
Updated : 13 March 2019, 07:42 AM

১৩ মার্চ ১৯৯২। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের টিএসসি; চলছে প্রতিদিনের আড্ডা । সন্ধ্যা নেমেছে মাত্র। হঠাৎ গোলাগুলি। ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের মধ্যে। সে সময়ে ক্যাম্পাসের নিত্যদিনের ঘটনা…! সেই সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে গিয়েই ঝরেছিল একটি তাজা প্রাণ।

আমি নিশ্চিত করে বলছি, সেদিন খুব কেঁদেছিল ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়েছিল একজন মেধাবী ছাত্রকে। বাংলাদেশ হারিয়েছিল ছটফটে তরুণকে। আর আমি হারিয়েছিলাম আমার নেতাকে; বড় ভাইকে।

শুধু কি তাই? কাঁদিয়েছিল কবি শামসুর রাহমানকে। তাইতো তিনি আমার নেতাকে নিয়ে লিখেছিলেন 'পুরাণের পাখি' শিরোনামে কবিতা। যা আলোড়ন তুলেছিল সে সময়; নাড়া দিয়েছিল সবাইকে।

বলছি আমার নেতা মঈন হোসেন রাজুর কথা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই- রাজু ভাইয়ের কথা। বলছি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতার কথা।

ক্যাম্পাসে রাজু ভাই আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। রাজু ভাই পড়তেন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে। আর আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে। রাজু ভাইয়ের হল ছিল শহীদুল্লাহ; আমার ফজলুল হক। রাজু ভাই হলে থাকতেন না। পরীক্ষার আগে মাঝে-মধ্যে হলে আসতেন। প্রথম বর্ষে আমার হলে সিট না পাওয়ায় রাজু ভাইয়ের ১২২ নম্বর রুমে আমি অনেক দিন থেকেছি। আর তার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের শুরু। শ্যামলীর বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসতেন, ক্লাস করতেন, মিছিল করতেন; আড্ডা দিতেন…আমাদের দিক-নির্দেশনা দিতেন।

রাজু ভাই ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সন্ত্রাসী-পাষণ্ডরা তাকে চলে যেতে বাধ্য না করলে তিনি যে আরও বড় নেতা হতেন সেটাও আমি নিশ্চিত করে বলছি। আমাদের মধ্যে যারা ওই সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন- নেতা ছিলেন, তারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন নিশ্চয়।

কী হয়েছিল ২৭ বছর আগে এই দিনে টিএসসিতে? কারা কেড়ে নিয়েছিল আমার প্রিয় নেতাকে? দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার পরও কখনও কিছু লিখিনি এই দিনটি নিয়ে; রাজু ভাইকে নিয়ে। লিখিনি বললে ভুল হবে; লিখতে পারিনি। দম বন্ধ হয়ে আসত…। আজও আসছে…! তাও লিখছি।

আমার জীবনে খুব কষ্টের দিন ১৩ মার্চ। ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়ার পর কখনও-কোথাও লিখিনি আমি ওই মিছিলে ছিলাম বা স্লোগান ধরেছিলাম। রাজু ভাই, আপনি আমার কাছে কী ছিলেন- তা কখনও বলতে পারিনি; আজ বলছি! নিশ্চয় শুনছেন। মনে আছে নিশ্চয় রাজু ভাই আমি যখন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম- তখন প্রতিদিন সকালে খালাম্মার বানানো নাস্তা আমাকে খাইয়ে তারপর ক্যাম্পাসে যেতেন। কতো রাত আমি রাজু ভাইয়ের সিটে (শহীদুল্লাহ হল-১২২) ঘুমিয়েছি! এখনও চোখের সামনে ভাসছে সবকিছু…!

রাজু ভাই মনে পড়ছে কি আপনার, আপনি, আমি, মাহমুদ ভাই, চিরদা, ইনু ভাইসহ অনেকেই টিএসসিতে আড্ডা (অবশ্যই রাজনৈতিক আড্ডা) দিচ্ছি। হঠাৎ ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের গোলাগুলি। আমরা সবাই টিএসসি'র ভেতরে ঢুকলাম। গোলাগুলি থেমে গেল। আমরা বেরিয়ে এসে স্বপন মামার চায়ের দোকানে জড়ো হয়েছি… হঠাৎ আপনি আমার পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বললেন, রহিম শ্লোগান ধর- মিছিল করবো, সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল…।

আপনার নির্দেশে আমি শ্লোগান শুরু করলাম। 'সন্ত্রাস-শিক্ষা একসঙ্গে চলবে না, আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের ঠাঁই নাই।' প্রথমে মিছিলে খুব বেশি ছাত্র ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট মিছিল বড়তে পরিণত হল। আমি শ্লোগান ধরিয়ে দিচ্ছি…মিছিল বড় হচ্ছে। নিউটন ভাইও শ্লোগান ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। মিছিলটি শামসুন্নাহার হলের গেইট হয়ে ডাস এর সামনে দিয়ে রোকেয়া হলের গেইটের দিকে এগোচ্ছিল। আবার গুলি…. রাজু ভাই আপনিসহ আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম…। পাশেই দেখলাম, আপনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন…। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল আপনাকে…!

আমি, চিরদা, নিউটন ভাই, শিলু আপা, সুমন ভাই, চঞ্চল ভাইসহ হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র যারা ছাত্র ইউনিয়ন করত না তারাও আপনাকে রক্ত দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে! সবাই চেষ্টা করেও আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না, চলে গেলেন- রাজু ভাই! আমার মতো অনেককে কাঁদিয়ে চলে গেলেন।

জানেন রাজু ভাই মাঝে-মধ্যে মনে হয়, সেদিন যদি আপনার নির্দেশ অমান্য করে আমি শ্লোগান শুরু না করতাম তাহলে হয়ত এমনটি হত না। কিন্তু সেটা কী করে করি? আপনি যে আমার নেতা…। তখনও…এখনও…সবসময়!

জানেন রাজু ভাই- আপনাকে নিয়ে ভাস্কর্য করেছি আমরা একটা…আপনার প্রিয় টিএসসিতে। নাম দিয়েছি 'সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য'। যখন আপনার দিকে তাকাই তখনই মনে হয়, 'আপনি বলছেন, রহিম শ্লোগান ধর….।'

আর আমি বলছি…

"যে তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্ণতায়, সে নও তুমি।

প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু করে আজও নতুন সভ্যতার আকর্ষণে,

হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,

তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে নিঃশঙ্ক মুদ্রায়,

ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,

তুমি বারবার আগুন থেকে বেড়িয়ে আসবে পুরাণের পাখি।"