বাংলাদেশের মুকুটে যতগুলো পালক শোভিত, তার সবচেয়ে সুদৃশ্যটি সম্ভবত 'পোশাকশিল্প'। কিন্তু বলার কথাটি হলো, পাখির স্বেচ্ছায় ত্যাগ না করা পালকে যেমন রক্তের দাগ থাকে, তেমনি প্রতীকী অর্থ বহনকারী পালকেও পাওয়া যেতে পারে রক্তের গন্ধ। যে অর্জনের পেছনে শোষণ-পীড়নের জাঁতাকল সক্রিয়, তা রক্ত শুষে নেওয়ার চেয়ে কম অমানবিকতার ইঙ্গিতবাহী নয়। তাই পালকখচিত মুকুট যত গৌরবেরই হোক, তার পেছনে থাকতে পারে পাখিবধের কাহিনি!
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ান বাংলাদেশের তেমন একটি পুরনো গল্প নতুন করে শুনিয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় তৈরি একটি টি-শার্ট পশ্চিমা বাজারে বিকোয় ১৯ দশমিক ৬০ পাউন্ডে। তবে বাংলাদেশি যে নারী শ্রমিক টি-শার্টটি তৈরি করেন, ঘণ্টাপ্রতি তার পারিশ্রমিক সবমিলিয়ে ৩৫ পেনি। দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ থেকে ১৬ ধরলে পশ্চিমা বাজারদরের একটি টি-শার্টের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে এই শ্রমিককে সেলাই করতে হয় অন্তত ৭ হাজার টি-শার্ট। হোয়াট আ সরল অঙ্ক!
এই সরল অঙ্কের সরলতম পথ ধরে তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পোশাকশিল্প। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছে 'সুনাম', অর্থনীতির জন্য সমৃদ্ধি। আন্ডারলাইন সহযোগে বোল্ড ও ইটালিকে লেখা এই 'অর্জন'কে আমরা আদর করে 'পালক' বলে ডাকি।
মোটাদাগে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের ভাষ্যটি হলো— বাংলাদেশের সস্তায় কেনা শ্রমিকের শ্রম-ঘামের (পড়ুন রক্ত!) ইনপুটে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের স্ফিত আউটপুটের ব্যবস্থার নাম 'তৈরি পোশাক খাত'। আড়ে-বহরে সমৃদ্ধির এই খাতের সস্তা কাঁচামাল স্বয়ং পোশাককর্মী!
সরকার মহাশয়ও অর্থনীতির স্থূল গতরের প্রেমে মশগুল। রাষ্ট্রিক টেন্ডারে কারখানার মালিকদের হাতে তাই তুলে দেওয়া হয় শ্রমশোষণের ঠিকাদারি, ডলার কামানোর কারবারি! না হলে ন্যূনতম হাজার আটেক টাকা মজুরির জন্য শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়? নেমেও বিপদের শেষ নেই; ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, উসকানির গন্ধ, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা— কত কিছুরই না হদিস পান মালিক-সরকার-প্রশাসন!
মালিকমাত্রেই যেখানে তাদের 'ফার্স্ট হোম' কানাডা ইত্যাদি পশ্চিমা উন্নত দেশ, শ্রমিকদের তিন বেলার খাবারের নিশ্চয়তা তখনও দূর অস্ত, এই ২০১৯ সালেও; চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদির কথা না হয় অনুচ্চারিতই থাক।
তবু মালিকি পরিভাষায়, শ্রমিকদের 'সম্মানজনক' জীবনের জন্য আট হাজার টাকাই যথেষ্ট! নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নের পর তারা বলছেন, খরচ বেড়েছে ১৮ থেকে ২০ সেন্ট, অথচ ক্রেতারা বাড়িয়েছেন মাত্র ৬ সেন্ট। সুতরাং টিকে থাকার ঝুঁকিতে পড়েছেন স্বয়ং মালিকেরাই!
এই যে কাগজে-কলমের হিসাব তুলে ধরা হয়, অথচ এর বিপরীতে আমরা দেখি, দেশের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু খাতটির নাম তৈরি পোশাক। একজন মালিকের একটা কারখানা কয়েক বছর না গড়াতেই দু'-তিনটিতে পরিণত হয়। সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশে 'পদোন্নতি' পাওয়া এ বঙ্গভূঁয়ে যে জীবনযাপন করেন মালিকেরা, তা বিশ্ববিচারের মানদণ্ডে 'পশ'; তাদের চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়া— সবই উন্নত বিশ্বে, এমনকী তাদের পারিবারিক কেনাকাটাও হয় বৈদেশে! তবু তারা নাখোশ! সুযোগ পেলেই সভা-সেমিনারসহ গণমাধ্যমে আর্থিক অনটনের কথা বলেন পরিসংখ্যানের ভাষায়। আর সরকারের কাছ থেকে আদায় করেন করপোরেট কর ও উৎসে কর হ্রাস, ভ্যাট অব্যাহতিসহ হরেক সুযোগ, হাজার সুবিধা।
'ভারসাম্যে'র নয়া এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আধপেটা খাওয়া লাখো নারী-পুরুষের শ্রমের ভিতে দাঁড়িয়ে থাকে আস্ত পোশাক খাত; দেশের গৌরব, অর্থনীতির অহঙ্কার— আমাদের নতুন 'শ্রমদাস শিল্প'। শ্রমের চেয়েও সস্তা এখানে শ্রমিকের জীবন! 'শ্রমিকহত্যা'র দায়মুক্তির ইন্তেজামও এখানে হান্ড্রেড পারসেন্ট পাক্কা!
ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্ক স্টাডি (২০১৭) বলছে, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিকরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে কাজ করেন। এই 'সবচেয়ে' বিশেষণটি তাদের মজুরির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, সবচেয়ে কম।
গত এক যুগে কর্মক্ষেত্রে দুই হাজারের বেশি পোশাকশ্রমিকের বেঘোরে মারা পড়া স্রেফ দুর্ঘটনা? সংশোধিত শ্রম আইন কি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছে? জাতীয় শ্রমনীতি সংশোধন এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করার ইশতেহারি ওয়াদা শিকেয় তোলা।
অবশ্য সরকার মহাশয় বুক ফুলিয়ে বলছেন, জিডিপি বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। যদিও কিছু 'বেয়াড়া' প্রতিষ্ঠান বলছে ভিন্ন কথা। যেমন সিপিডির এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে গত ৬ বছরে জিডিপি বাড়ার দিনগুলোয় বেহদ ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে গরিবির তলানিতে থাকা গরিবস্য গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১ হাজার ৫৮ টাকা।
তবু কী এক মন্ত্রবলে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ে! কী সেই মন্ত্র? সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ বা হল-মার্ক, এমনকি শেয়ারবাজার লুটেরাদের সম্পদকেও আর দশজনের গড় সম্পদ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। এই 'সমাজতান্ত্রিক' ব্যবস্থায় হকার থেকে রিকশাচালক, শ্রমিক থেকে পোশাক কারখানার মালিক— সবাই মধ্যবিত্ত! কী চমৎকার গোয়েবলসীয় প্রচারণা!
অর্থাৎ 'সরকারি প্রযোজনা'য় পশ্চিমের ঠান্ডা দেশগুলোর 'ঠান্ডা' মাথার বিশ্ববেনিয়াদের প্রফিটের হিসাবের সঙ্গে আমাদের মতো গরমের দেশের 'গরম গরম' লাভের নিকাশের মিলিত যোগফল তৈরি পোশাক খাত। এক হাতে মানবতার ঝাণ্ডা তুলে অন্য হাতে মানুষের গলা চেপে ধরতে ওস্তাদ লোক পশ্চিমারা! শ্রমিক অধিকারের সমর্থনে তারা 'বজ্রকণ্ঠ'; একইসঙ্গে নাম-কা-ওয়াস্তে মজুরির বিনিময়ে কাজের 'অর্ডার' দিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। আর বাংলার 'অর্থ' চেনা ও 'নীতি' বোঝা বেনিয়ারাও সেই 'অর্ডার' করিয়ে দেন পানির দরে। ফলে শ্রমিকের রক্ত জল হয়, মালিকের লাভের পানি হয় সাগরসমান!
শ্রমশোষণের জাঁতাকলের একটি অংশ 'বিজিএমইএ' হলে আরেক অংশ কি পশ্চিমারা নয়? সেই কলের এক নম্বর তেলের যোগানদার সরকার। তাই স্পেকট্রার্ম, কেটিএসএ, হামীম, তাজরীন ইত্যাদি 'হত্যাকাণ্ডে'র পরও পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্যের রমরমায় ভাটা পড়ে না। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন সরকার মহাশয়ও। রানা প্লাজার 'আহূত গণহত্যা'র পরও এই ত্রয়ীর বন্ধন অটুট।
রাষ্ট্র যখন 'ধারণা', তখন তা মানুষের ভরসাস্থল হয় না; কেবল শরীরীরূপে থাকলেও তা কেবল ভূখণ্ডই। রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার 'সপ্রাণ' সত্ত্বা সরকার। তাই রাষ্ট্রযন্ত্র যতটা যান্ত্রিক, সরকারকে হতে হয় ততোধিক মানবিক। এই মানবিক সরকারের কাছেই মানুষের চাওয়া। দাবিও সেই সরকারের কাছে, যার কারবার আদি ও অন্তে মানুষ নিয়ে।
ও সেলাই দিদিমণিরা, আপনারা কি শুধুই 'শ্রমিক'?