আমাদের শিশুকাল, আমাদের শিশু এবং কাহলিল জিবরানের কবিতা

অক্টোবরের ৪ তারিখ ছিল 'বিশ্ব শিশু দিবস'। প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়। ৪ অক্টোবর শুরু হয়ে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত চলে শিশু অধিকার সপ্তাহ। মঙ্গলবার পালন করা হয় জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 8 Oct 2022, 03:50 PM
Updated : 8 Oct 2022, 03:50 PM

চলতি অক্টোবরের ৪ তারিখ ছিল ছিল 'বিশ্ব শিশু দিবস'। প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়। মঙ্গলবার অর্থাৎ ৪ অক্টোবর শুরু হয়ে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত চলে শিশু অধিকার সপ্তাহ। মঙ্গলবার পালিত হয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।

এ দুটো দিবসকে উপলক্ষ করে প্রশ্ন করতে চাই, বাংলাদেশের শিশুরা কেমন আছে? তার উত্তর অবশ্য অজানা থাকার কথা নয় আমাদের। কোন সময়েই আমাদের শিশুরা ভালো ছিল না। শুধু বর্তমান নয়, আমদের শিশুকালও ভালো কাটেনি। আমাদের বাপদাদাদের শিশুকালও ভালো কাটেনি। তার কারণ হলো শিশুদের কীভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিত তা আমরা জানি না এবং আমাদের আগে-পরের প্রজন্মের বাবা-মায়েরাও জানেন তা-ও কিন্তু নয়।

২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে মহামারির শুরু। এরপর দীর্ঘ দু বছর শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি। মাঠে, পার্কে বা জনসমক্ষে যেতে পারেনি। ঘরবন্দি জীবনে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে নগরে বসবাসকারী শিশুদের পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। মহামারির এই দীর্ঘ সময়ে অনেক শিশু ঘরে মা-বাবা ও পরিবারের বড়দের দ্বারা শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকারও হয়েছে। লকডাউনে বড়রা নানাভাবে সময় কাটাতে পারলেও ছোটদের জন্য তেমন সুযোগ ছিলই না। ফলে এই দু বছর শিশুদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যার প্রতিক্রিয়া শিশুদের বহুকাল বয়ে বেড়াতে হবে। শিশুদের যে মন আছে, তাদেরও ভালো-মন্দ আছে, আনন্দিত হওয়া বা বিষণ্ন হওয়ার মতো ঘটনা যে তাদের বেলায়ও ঘটে তা আমরা প্রায়শ মনে রাখি না। আমরা আমাদের ইচ্ছা,  আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা ওদের ওপর চাপিয়ে দিই। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের চিত্র একই। তারপরও স্বীকার করতে হবে পশ্চিমা বা উন্নত দেশগুলো এখন তাদের দেশের শিশুদের বিষয়ে অনেক অনেক সচেতন ও যত্নশীল।

 বাংলাদেশে ছেলেশিশুদের চেয়ে মেয়েশিশুদের অবস্থা আরও খারাপ। ঘরে-বাইরে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। প্রায় মেয়েশিশু বড় হয় তার জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক তিক্ত ও লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতা নিয়ে। মহামারির কালেও তাদের সে বিরূপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। এসময়েও বিপুল সংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। অনেকের লেখাপড়া মাঝপথেই থেমে গেছে পরিবারের কারণে।

এ তো গেল মহামারিকালের বাস্তবতার কথা। এর বাইরে অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়েও কি আমাদের শিশুরা উদার, মানবিক ও শিশুবান্ধব পরিবেশে বড় হচ্ছে? মনোবিদরা বলে থাকেন, একজন মানুষ পরিণত বয়সে গিয়ে কেমন হবেন তার ভিত্তি তৈরি হয় সে মানুষের জীবনের প্রথম দশ বছরে। অর্থাৎ জীবনের প্রথম দশ বছর একটি শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে পরিবার, পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। কোন পরিবারে, কী পরিবেশে শিশুটি বড় হলো তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতিবেশও কেমন ছিল তা-ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিশুটি যদি উদার, মানবিক, সহনশীল ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয় তাহলে পরবর্তী জীবনে সে তাই হবে। আর যদি রক্ষণশীল, অনুদার, কলহ-বিবাদপূর্ণ ও নিষ্ঠুর পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাহলে বড় হলে সে তেমন চরিত্রেরই হবে। পরিবারের মধ্যে যদি সততার চর্চা না থাকে, উদার ও মানবিক হওয়ার চর্চা না থাকে, মানুষকে ভালোবাসার চর্চা না থাকে তাহলে এই গুণগুলো শিশুটি অর্জন করবে কোথা থেকে। শিশু যদি নিষ্ঠুর পরিবেশের মধ্যে বড় হয়, দয়া-মায়াহীন পরিবেশে বড় হয় তাহলে এই দোষগুলো আপনা থেকেই তার চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাবে।

এ বিষয়গুলো আমরা খুব বেশি খেয়াল করি না। আমরা শিশুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি, তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করি। তাদের সামনে অবলীলায় মিথ্যা বলি। ঘরে থেকে শিশুর সামনে মোবাইলে অন্যকে বলি, আমি বাসায় নাই। মোবাইল ফোন মিথ্যা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। আছি ঘর ফোন বলছি, অফিসে। ঘরে-বাইরে শিশুসন্তানের সামনে অহরহ মিথ্যা বলছি, গালাগাল করছি, দুর্বল বা গরিবদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছি। স্কুল কামাই হলে শিশুকে শিখিয়ে দিই, টিচারকে বলবে তোমার জ্বর ছিল। এভাবেই শিশুরাও একদিন মিথ্যা বলা শিখে যায়। এবং মিথ্যা বলা যে একটি গর্হিত কাজ তা সে মনে করে না কারণ সে দেখছে বড়রা তা অবলীলায় বলে। ফলে তার ভেতর অনুশোচনাও তৈরি হয় না। শিশুরা বড়দেরই অনুসরণ করে।

আমাদের অধিকাংশ পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুবান্ধব নয়। তবে সরকারের কড়াকড়ির কারণে মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন কম হয় তবে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, মানবিক ও সর্বজনীন শিক্ষা প্রদানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা আছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করে মাদরাসা বিশেষ করে বেসরকারি মাদরাসা, হেফজখানা ও এতিমখানাগুলোতে। সেখানে শিশুরা দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে সে ধরনের সংবাদ প্রকাশ হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা নিরসনে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। শিশুকালে নিষ্ঠুরতার শিকার এমন মানুষই সমাজে নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ করে থাকে। এক্ষেত্রে মা-বাবা বা অভিভাবকদের গুরু দায়িত্ব থাকলেও তা তারা পালন করেন না। অনেক মুসলিম পরিবারে মনে করা হয় অন্তত একটি সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ালে বা হেফজখানায় রেখে কোরআন মুখস্ত করালে আখেরাতে মা-বাবার বেহেশতে যাওয়ার পথ সুগম হবে। বাবা-মায়ের পরকালের শান্তির আশায় কত কত শিশুর ইহকাল বিনষ্ট হয়েছে, অশান্তিময় হয়ে উঠেছে তার হিসাব কে রাখে!

অন্যদিকে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা-বাবার ইচ্ছার তোড়ে ভেসে যায় অনেক সম্ভাবনাময় শিশুর জীবন। সন্তানকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে 'ফার্স্ট' বানাতে গিয়ে এরা সন্তানকে একটি যন্ত্রে পরিণত করেন। এতে ওই সন্তান কোনো একদিন ফার্স্ট হয় বটে কিন্তু মানবিক ও মানসিকভাবে সন্তানটি থার্ড ক্লাসেরই রয়ে যায়।

পড়ার চাপে, পাঠ্যপুস্তকের চাপে আমাদের সন্তানেরা শিক্ষার্থী না হয়ে পরীক্ষার্থীতে পরিণত হচ্ছে। পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি বদলে যাওয়ার কারণে এখন শিক্ষার্থীরা টেক্সট পড়ে না। হ্যাঁ-না ধরনের কিছু তথ্য মনে রেখে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে। এরফলে প্রকৃত শিক্ষাটি তার হচ্ছে না। অমুক কবিতা বা প্রবন্ধটি কে লিখেছিলেন তা চারজনের তালিকা থেকে সে বাছাই করতে পারছে বটে কিন্তু সে কবিতা বা প্রবন্ধটিতে কী লেখা আছে তা হয়ত সে জানেই না। কারণ তা পড়ারও প্রয়োজন পড়েনি।

আমাদের সন্তান কী পড়বে, জীবনে সে কী হতে চায় তা আমরাই স্থির করে দিই। অমুকের সন্তান ডাক্তারি পড়ছে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে তোমাকেও পড়তে হবে। অমুকের সন্তান বিসিএস দিয়ে সরকারি বড় অফিসার হয়েছে, তোমাকেও তাই হতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সফল হতে হবে। কোনোভাবেই ব্যর্থ হওয়া যাবে না। কিন্তু সবাই যদি সফল হয় তাহলে ব্যর্থ হবে কারা? সমাজে কি সব সফল! মানুষই থাকবে? সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস অফিসার হলে সমাজ চলবে কীভাবে? সমাজে তো এর বাইরে আরও অনেককে লাগবে। কবি লাগবে, ঔপন্যাসিক লাগবে, শিল্পী লাগবে, গীতিকার লাগবে, চলচ্চিত্রকার লাগবে, সমাজসেবী লাগবে, মিস্ত্রি লাগবে, সবজিবিক্রেতা লাগবে, ঝাড়ুদারও লাগবে। শুধু শুধু কয়েক লাখ সাহেব দিয়ে তো সাড়ে ষোল কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ চলবে না। একজন ইঞ্জিনিয়ার যেমন লাগবে তেমনি করে লাগবে একজন ঝাড়ুদারকেও। কারও ভূমিকা বা কাজ ছোট নয়। আর লাগবে অসংখ্য পাগল যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। সমাজে এমন পাগলের সংখ্যা কমে গেছে বলে সমাজটা আজ স্থবির, স্বার্থপর, ঠক, বাটপারে ভরে গেছে। আমরা সন্তানদের শুধু নিজের কথা ভাববার কুমন্ত্রণা দিচ্ছি। শুধু 'আমি' ও 'আমার' শেখাচ্ছি। 'আমরা' 'আমাদের' শেখাচ্ছি না। ফলে একট স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম গড়ে তুলছি। আমাদের ভাবনায় ভুল, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ভুল, আমাদের সামাজিকতায় ভুল, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভুল। এই ভুলের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে আমরা একই আচরণ আমাদের সন্তানদের সঙ্গে করছি। ওরাও এই পরিবেশে বড় হয়ে চিন্তাভাবনায় একই থেকে যাবে।

কাহলিল জিবরান আরব-আমেরিকান কবি। বিশ্বে বহুল পঠিত গ্রন্থের মধ্যে তার 'দ্য প্রফেট' অন্যতম। জিবরান (১৮৮৩-১৯৩১) একাধারে চিত্রশিল্পী, লেখক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ২৬টি অতিন্দ্রীয়বাদী গদ্য-কবিতার সংকলন 'দ্য প্রফেট' প্রকাশিত হলে তিনি রাতারাতি সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে শেক্সপিয়ার ও চীনা কবি লাওজির পর জিবরান তৃতীয় বহুল বিক্রিত বইয়ের লেখক। বইটি এখন পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

এই বইয়ে একটি অংশে বলা হয়েছে শিশুদের নিয়ে। ‘সন্তানদের নিয়ে’ শিরোনামের সে কবিতাটি তুলে ধরছি পাঠকদের উদ্দেশে-

'তোমার সন্তানেরা আদতে তোমার সন্তান না।

তারা মহাজীবনের আকুল আকাঙ্ক্ষার সন্তান।

তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে বটে,

কিন্তু তোমাদের থেকে আসে না।

আর তোমাদের সঙ্গে থাকলেও তোমরা তাদের ত্রাণকর্তা নও।

তোমরা তাদেরকে তোমাদের ভালোবাসা দিতে পারো,

কিন্তু তোমাদের চিন্তা আরোপ করে দিতে পারো না।

কারণ তাদের নিজস্ব ভাবনা আছে।

তাদের শরীরকে তোমরা ঘরে রাখতে পারো,

কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়,

কারণ তাদের আত্মারা বসত করে ভবিষ্যতের ঘরে,

যে ঘরের খোঁজ তোমরা স্বপ্নেও পাও না।

তোমরা তাদের মতো হবার সাধনা করতে পারো,

তবে তাদেরকে তোমাদের মতো করতে চেয়ো না।

কারণ জীবন পশ্চাৎমুখী চলে না,

ফেলে আসা দিনের জন্য অপেক্ষাও করে না।

যে ধনুক থেকে তোমার সন্তানদের তীরের মতো

সামনের দিকে ছোঁড়া হয়,

তোমরা হলে সেই ধনুক।

পরম ধনুর্ধর অসীমে নিশানা স্থির করে তার অপার শক্তিতে তোমাদের আনত করে,

যাতে তোমরা তীরগুলোকে অতি দূরান্তে ক্ষিপ্রগতিতে নিক্ষেপ করতে পারো।

সেই ধনুর্ধরের হাতে তোমাদের প্রণতি হোক পরমানন্দের;

কারণ সুদূরগামী তীর যেমন তার পছন্দ, তেমনি তার পছন্দ একটা দৃঢ় ধনুকও।’

 আমরা যেন এ কথাটি ভুলে না যাই।

শিশুদের সামনে সত্য বলুন। অকপট থাকুন। আপনি আমি সবাই চাই আমার সন্তান যেন ভালো মানুষ হয়। তাহলে তাদের ভাল মানুষ, মহৎ মানুষের জীবনী শোনান, তাদের গল্প শোনান। শিশুদের সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহিত করুন। শিশুকে বইমুখী করুন। পরীক্ষামূলকভাবে আপনার শিশুকে কয়েকটি ভালো বই পড়তে দিন (অবশ্যই শিশুপাঠ উপযোগী)। পড়ার আগে আর পড়ার পরে শিশুটির পরিবর্তনটুকু দেখুন। আমি নিশ্চিত আপনি অবাক হবেন। শিশুদের বিকাশে বাবা-মা বা অভিভাবকদের ভূমিকাই মূখ্য। তারা যদি সঠিকভাবে বেড়ে না ওঠে তার দায়ভার নিতে হবে বড়দের অবশ্যই।