ইমরান খানের পক্ষে কি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে? 

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 11 April 2022, 03:54 PM
Updated : 11 April 2022, 03:54 PM

পাকিস্তানে লিয়াকত আলি খান থেকে ইমরান খান—এ পর্যন্ত মোট প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২২ জন। এদের কেউই তাদের পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। দুনিয়ার কোন গণতান্ত্রিক দেশেই এমন নজির নেই। মেয়াদ পূর্ণ হবার দেড় বছর আগেই তাদের পূর্বসূরিদের মতো ইমরানকেও জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো। ইমরান হলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাকে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। এ লেখাটি যখন প্রকাশ হচ্ছে তখন অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের বিদায়ের পর পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে।

গণতন্ত্র এবং পাকিস্তান যেন দুটো বিপরীতার্থক শব্দ। পাকিস্তানের সাথে গণতন্ত্র প্রত্যয়টির যেন দ্বন্দ্ব রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ইমরানের বিদায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মনে হতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা এবং সে প্রস্তাবে হেরে গেলে তার বিদায় বা সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচন, গণতান্ত্রিক রীতিরই অংশ। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে, যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করতে পারেনি, সেখানে বিষয়টা এরকম সরলীকৃত নয়।

পাকিস্তানে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে- আমেরিকা, আর্মি এবং আলেম সমাজ—এ তিনটি ক্ষমতা কেন্দ্রের সাথে সমঝোতা করে থাকতে হয়। এর কোন একটির সাথে সমস্যা তৈরি হলে সেখানে ক্ষমতায় থাকা মুশকিল হয়ে উঠে। কাউকে ক্ষমতাসীন হতে হলে, সেখানে সেনাবাহিনীর সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা হলো কাউকে ক্ষমতাসীন করবার পর দ্রুত সেনাবাহিনী তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।   

এটা মনে করা হয় যে, ইমরানের ক্ষমতায় আসার পেছনে সেনাবাহিনীর আশির্বাদ ছিল। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাথে নানা বিষয়ে সেনাবাহিনীর সমস্যা তৈরি হচ্ছিলো। ফলে পানামা পেপার্সের সূত্র ধরে সুপ্রিম কোর্ট তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে আদালতের পক্ষে সব বিষয়ে স্বাধীনভাবে রায় দেওয়া মুশকিল। বাস্তবতা হল, এ ধরনের রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আদালত ক্ষমতাশীল মহলের দিকে তাকিয়েই সাধারণত রায় দেয়।

পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোয় সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রীড়ানক হচ্ছে সেনাবাহিনী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবার পর আস্তে আস্তে তারা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, যার থেকে পাকিস্তানের পক্ষে আর বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্যে দিয়ে এ নিয়ন্ত্রণ নেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বস্তুত সে সময় থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আস্তে আস্তে মিয়ানমারের মত সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যেখানে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া বেসামরিক কারো পক্ষে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হওয়া সম্ভব নয়। তবে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বড় দাগে পার্থক্য রয়েছে। 

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সব সময় ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্মের কার্ড ব্যবহার করে আসছে, দেশের ধর্মভীরু জনগোষ্ঠিকে বিভ্রান্ত করে, সমাজ এবং রাষ্ট্রে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখবার জন্য। অপরদিকে, ধর্ম কার্ড ব্যবহার না করেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছে। 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো বটেই, অনেক স্বৈরতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেও সেনাবাহিনী থাকে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে। ভারতের সাথে পাকিস্তানের বড় দাগে পার্থক্যের জায়গাটি হলো, ভারতে সেনাবাহিনী থাকে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পাকিস্তানে সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা থেকেছেন সেনবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যখনই সেনাবাহিনীর সাথে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের সমস্যা হয়েছে বা মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, তখনই সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। 

ইমরান ক্ষমতায় আসার পর আইএসআই এর প্রধান নিয়োগ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে সেনাবাহিনীর সাথে সমস্যা তৈরি হয়। সমস্যা তৈরি হয় আলেম সমাজ এবং 'ইসলামপন্থি' দলগুলোর সাথেও। 

ইমরানের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফের অফিসিয়ালি লক্ষ্য হলো, 'কল্যাণমূলক ইসলামী সমাজতন্ত্র' এবং 'সমতাভিত্তিক ইসলামি গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা। উপমহাদেশের অনেকের মতো তিনিও একই সাথে ইসলাম ও সমাজতন্ত্র, দুটোর প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছেন। এ দুটোর সমন্বয়ের মাঝেই পাকিস্তানের উন্নয়ন এবং বিকাশ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। ক্লাসিকাল 'ইসলামপন্থি'দের মতো সমাজতন্ত্রকে তিনি 'নাস্তিক্যবাদী' মতবাদ মনে করেন না। 

ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকার জন্য পাকিস্তানের অন্য রাজনীতিবিদদের মতো ইমরান ধর্মের ব্যবহার করলেও দুটো বিষয়ে 'ইসলামপন্থি' তথা আলেম সমাজের সাথে ইমরানের দূরত্ব তৈরি হয়। দুটো বিষয়ের একটি হলো তাত্ত্বিক এবং আরেকটি হলো প্রায়োগিক। তাত্ত্বিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি ইমরানের দুর্বলতা 'ইসলামপন্থি'রা ভালোভাবে নেয়নি। যেমন নিত না অখণ্ড পাকিস্তানের সময় মাওলানা ভাসানীর 'ইসলামী সমাজতন্ত্রে'র এর ধারণা জামায়াতসহ অন্য 'ইসলামপন্থিরা'।

পাকিস্তানকে ধর্ম সহিষ্ণু রাষ্ট্রে পরিণত করবার ইমরানের কিছু প্রায়োগিক উদ্যোগ 'ইসলামপন্থি'দের সাথে ইমরানের দূরত্ব তৈরি করে। ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মের প্রশ্নে অসহিষ্ণু। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘুরা—হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, আহমদিয়া জামায়াত (কাদিয়ানি)—এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তারা সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মতো সমান রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন না। সামাজিকভাবেও তারা নানা ভাবে নিগৃহীত।

সামাজিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার দেশটির শিয়া সম্প্রদায়ও, যদিও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্ত্রী নুসরাত ভুট্টোসহ পাকিস্তানের অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব শিয়া মুসলিম। ইরানের পরে পাকিস্তান হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া মুসলিমদের রাষ্ট্র। 

পাকিস্তান গঠিত হবার পর দেশটিতে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু এবং শিখ মন্দির ব্যাপক হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়। এর ফলে এদের অনেকগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ইমরান এর কতগুলি সংস্কার করে হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেন। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যলঘুদের পক্ষে যায় এমন কিছু বক্তব্য দেন এবং পদক্ষেপ নেন, যা 'ইসলামপন্থি'রা ভালোভাবে নেয়নি। 

এছাড়া নির্বাচনের সময় দেওয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি তার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে এত দ্রুত সেসব পূরণ করা সম্ভবও নয়। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি বেশ কয়েক বছর যাবত কেবলই পিছু হটছে। মাথা পিছু আয় এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে দেশটি। ইমরানের জনপ্রিয়তা থাকলেও এসব নিয়ে জন-অসন্তোষও রয়েছে। এর মাঝে শুরু হয় ইউক্রেইনের যুদ্ধ। 

ইমরান এতে প্রমাদ গোনেন। কেননা দেশটির গমের চাহিদার ৩৯ শতাংশই আসে ইউক্রেইন থেকে। এর বাইরে ৫-৬ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। দেশের মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা ইমরানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাজনীতির চেয়েও। কেননা, এ গম সরবরাহ বিঘ্নিত হলে দেশে প্রবল খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তাই তিনি ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর দিনই ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যান মস্কোতে। 

পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ইমরান বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেন। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের বিপরীতে পাকিস্তান ছিল মার্কিন ঘেঁষা। অপরদিকে, সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা দ্বারা প্রভাবিত নেহেরুর ভারত ছিল সোভিয়েত ঘেঁষা। এ ধারাবাহিকতায় ভারত আজও সোভিয়েতের উত্তরসূরি রাশিয়া ঘেঁষা—যদিও সম্প্রতি দেশটি আমেরিকার সাথেও সম্পর্ক জোরদার করেছে। 

ষাটের দশক থেকে আমেরিকার পাশাপাশি গণচীনের সাথে পাকিস্তান সম্পর্ক জোরদার করে। সময়ের পরিক্রমায় দেশটি পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য মিত্রে পরিণত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যতদিন টিকে ছিল চীনের সাথে পাকিস্তানের মিত্রতাকে আমেরিকা তার স্বার্থের অনুকূল হিসেবেই দেখে এসেছে। 

সোভিয়েত বিরোধিতা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বাধা সৃষ্টি করা, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সহায়তা করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিষয়ে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল একই। এছাড়াও বিশ্বের নানা দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে ভেঙে দেবার ক্ষেত্রে মাও সে তুঙ্গের ভূমিকাকে আমেরিকা সব সময় ইতিবাচক হিসাবে মূল্যায়ন করে এসেছে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর।

পুনুরুত্থিত রাশিয়া এবং সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে মাও আমলের চেয়ে শক্তিশালী চীনের মিত্রতা যুক্তরাষ্ট্রকে আশঙ্কিত করে তোলে। ফলে চীনের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা আমেরিকা নেতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করে। এটি পাকিস্তানের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মার্কিন-চীন দুই তরফের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরে জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে জড়ায়। কিন্তু এর জন্য পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হয়, যার জের দেশটি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। 

'ইসলাম ধর্ম নির্ভর' সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রবল আক্রমণের শিকারে পরিণত হয় দেশটির পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণ। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শেকড় বিস্তার লাভ করে সমাজের গভীরে। আফগান যুদ্ধ পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কৃতিকেই আমূল বদলে দেয়। পাকিস্তান মনে করে, মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে দেশটির এতো ত্যাগের কোন মূল্যায়ন আমেরিকা করেনি। তদুপরি, বর্তমানে তালেবান কর্তৃক কাবুল দখলের পর পাকিস্তান রয়েছে নানাবিধ মার্কিন চাপের মধ্যে। ইমরান এ অবস্থা থেকে পাকিস্তানের উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন।  

পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইমরান রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে একটা নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে চান। এর অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক, সামরিক, বাণিজ্যিকসহ নানা ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাথে সহযোগিতার মাত্রা বৃদ্ধি করেন। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক তিনি যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তার মাধ্যমে খুব সম্ভবত আমেরিকার সাথে সম্পর্কের দীর্ঘ ঐতিহ্য থেকে দেশকে বের করে এনে, রাশিয়ার সাথে গাটছাড়া বাঁধতে চাচ্ছিলেন ইমরান। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ামুখি ইমরানের পদক্ষেপকে দক্ষিণ এশিয়ায় তার স্বার্থের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে দেখে। আফগানিস্তানকে হারিয়ে তারা কোনওভাবেই পাকিস্তানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায় না। তালেবান সরকারের সাথে রাশিয়া, চীনের ঘনিষ্ঠতায় আমেরিকা উদ্বিগ্ন। এমতাবস্থায়, পাকিস্তান তাদের হাতছাড়া হয়ে গেলে, এ অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি হুমকির মুখে পড়বে। 

এসবসহ আরো নানাবিধ কারণে আমেরিকার সাথে ইমরানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। আমেরিকার সাথে সম্পর্ক অবনতির প্রেক্ষাপটে চীন এবং রাশিয়ার ওপর ইমরান নির্ভরতা বাড়ান। পাকিস্তানের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে রাশিয়াকে অংশীদার করার উদ্যোগ নেন এবং পুতিনকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানিয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলারের গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প উদ্বোধন করাবার উদ্যোগ নেন। পুতিন পাকিস্তান সফর করলে এটি হতো প্রথম কোন রুশ প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান সফর। এর কোন কিছুই আমেরিকা ভালোভাবে নেয়নি। 

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওমর জাভেদ বাজওয়া বিষয়টি বুঝতে পেরে ইউক্রেইন যুদ্ধের বিষয়ে সরকারকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন সমর্থনে বক্তব্য দিয়ে এ বিষয়টা স্পষ্ট করেন যে- সেনাবাহিনী ইমরান খানের সাথে নেই। 

ইমরানের বিরোধী দলগুলো এটা বুঝে ফেলে যে, পাকিস্তান রাজনীতির তিন ক্ষমতাকেন্দ্র—আমেরিকা, আর্মি, এবং আলেম সমাজ—এর কেউই ইমরানের সাথে নেই। ফলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার এটাই মোক্ষম সময়। রাজনীতির এ সমীকরণ বুঝতে পেরে ইমরান নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বড় শরীক দল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম) বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে ইমরানের পতন নিশ্চিত করে। 

ইমরান তার পায়ের নিচে মাটি নেই- এটা বুঝতে পেরে অপমানজনকভাবে বিদায় নেবার হাত থেকে বাঁচবার জন্য প্রেসিডেন্ট আরিফুর রেহমান আলভীর মাধ্যমে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেবার ব্যবস্থা করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা একটা স্বীকৃত পন্থা। একবার সংসদ ভেঙে দেবার পর নতুন নির্বাচন হবার কথা। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি খুব সম্ভবত সেনা এস্টাবলিস্টমেন্টও চাচ্ছিলো, ইমরানকে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে বিদায় করতে। 

এ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বানডিয়ালের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের এক বেঞ্চ সর্ব সম্মতিক্রমে জাতীয় পরিষদকে বহাল করবার রায় দেয়। এর মধ্য দিয়ে একটি পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয় যে, আগামীতে ইমরানকে আর জাতীয় পরিষদে দেখতে চায় না সেনা এস্টাবলিস্টমেন্ট। 

ইমরানকে আগামীতে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে কিনা- এটা বুঝতে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আর তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেলেও, তিনি বা তার দল যাতে জিতে আসতে না পারে, সে ব্যবস্থা যে করা হবে- সেটা অনেকটাই অনুমেয়। 

পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার পর ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনবার রেওয়াজ রয়েছে। ইমরানের পূর্বসুরি নওয়াজ শরীফই হচ্ছেন এর বড় উদাহারণ। পাকিস্তানের মত রাষ্ট্রে—যাদের দুর্নীতির দীর্ঘ ট্র্যাডিশন রয়েছে—কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনা খুব কঠিন কাজ নয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেরাই প্রবলভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা পাকিস্তানের নানা উন্নয়ন প্রকল্প এবং ব্যাবসা বাণিজ্যের সাথেও যুক্ত। 

দেশে দেশে সেনা শাসনের ইতিহাস বা যে সব দেশে সেনাবাহিনী পিছন থেকে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ায়, তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে আসে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন, ইমরান এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে এ দুর্নীতি কার্ড ব্যবহার করতে পারে, যাতে তারা সামনে নির্বাচন করতে না পারেন। ইতিমধ্যে, ইমরানের স্ত্রীর বান্ধবী ফারাহ খানের বিরুদ্ধে নিয়োগ বদলি ইত্যাদি কাজ পাইয়ে দেবার নামে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে বিরোধী দলের তরফ থেকে। ফলে তিনি তার স্বামীসহ দেশ ত্যাগ করেছেন।  

ইমরান খান তার ক্ষমতা হারাবার বিষয়টিকে দেখছেন আমেরিকার ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানের 'regime change' নীতির সাথে। ক্ষমতা হারাবার পর প্রথম এক টুইটার বার্তায় তিনি সেটাকে স্পষ্ট করেছেন এবং নতুন সরকারকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সরকার হিসেবে দেখছেন। এ দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ তিনি এখন পর্যন্ত দিতে না পারলেও, তিনি যে এ বক্তব্য নিয়ে মাঠে নামবেন, সেটা তিনি স্পষ্ট করেছেন।

আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের সময় থেকে পাকিস্তানে মার্কিন-বিরোধী মনোভাব প্রবল। প্রভাবশালী 'ইসলামপন্থি' এবং দুর্বল বামপন্থি—দুই তরফই মার্কিন বিরোধিতার রাজনীতি করে। ইমরান এখন এ মার্কিন-বিরোধী সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করেই রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাচ্ছেন। 

নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইমরান পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেশ জনপ্রিয়। এটাই এখন ইমরানের একমাত্র ভরসা। তবে এর ওপর নির্ভর করে পাকিস্তানের মতো সেনা নির্ভরশীল রাষ্ট্রে খুব বেশিদূর যেতে পারবেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। 

জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মেয়াদ পূর্ণ না করতে পারবার যে দুষ্টচক্র, তার হাত থেকে আগামীদিনের প্রধানমন্ত্রীরাও রক্ষা পাবে বলে মনে হয় না। রক্ষা না পাবার কারণ হলো, একটি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হবার যে দুটো মূল উপাদান, সে দুটোই পাকিস্তানে অনুপস্থিত। এর প্রথমটি হলো, সেক্যুলারিজম বা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। আর দ্বিতীয়টি হলো, ক্ষমতাসীন সরকার বা রাজনীতিবিদদের অধীনে সেনাবাহিনী পরিচালিত হওয়া। 

রাজনীতিবিদদের নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার অভাবের ফলে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একের বিরুদ্ধে অন্যে অগণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মুখ্য ভূমিকায় নিয়ে এসেছেন। রাজনীতিবিদদের মাঝে স্বার্থের প্রশ্নে বিভাজনই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর শক্তির উৎস। 

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতির মাধ্যমে ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেও, তিনি পাকিস্তানকে শরীয়া নির্ভর ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাননি। তিনি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মতো একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার এ উপলব্ধি হয় যে, একমাত্র সেক্যুলার- গণতন্ত্রের মাধ্যমেই পাকিস্তান সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

পাকিস্তানের বর্তমান রাজনীতিবিদরা যদি তাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার শেষ জীবনের উপলব্ধিকে ধারণ করে, রাষ্ট্রের সেক্যুলার–গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে পারেন, একমাত্র তাহলেই আগামী দিনগুলিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রীরা সেনা হস্তক্ষেপে অপমানজনক বিদায়ের দীর্ঘ রেওয়াজ থেকে রক্ষা পাবেন।