ইউক্রেইনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ ও পরিবর্তমান পৃথিবী

সাইফ তারিক
Published : 12 April 2022, 01:13 PM
Updated : 12 April 2022, 01:13 PM

একটা পৌরাণিক যুদ্ধ চলছে 'কিয়েভান রাস'- এ। কিইভের রুশদের মধ্যে (রুশ মহাজাতির তিন ভাইয়ের মধ্যে)। এখন তারা তিন নামে পরিচিত–ইউক্রেইনি, শ্বেত রুশ ও রুশ। উপমার দিক থেকে দেখলে মনে হবে এ যেন ভারতীয় কোনো পৌরাণিক যুদ্ধ। আর্য-অনার্যের আবহমান লড়াই। এ লড়াই সমস্ত পাশ্চাত্য আর্য তথা এরিয়ান পরিচয়ধারীর স্মারক, কারণ তারা নব্যনাৎসিদের (আজভ ব্যাটালিয়ন, রাইট সেক্টর প্রভৃতি) পক্ষে আর রাশিয়া অনার্য দস্যু (রাক্ষসও বলা যায়), যারা যখন-তখন যেখানে-সেখানে গুলতি মেরে বেড়ায়; সে গুলতির নাম কখনো কিনজাল, কখনো ভ্রাম্যমাণ ক্ষেপণাস্ত্র 'ক্যালিবার' (ক্রুজ মিসাইল); কখনো গুলতির নাম ইস্কান্দর। শোনা যায় জিরকন নামের অভেদ্য ব্রহ্মাস্ত্রও তাদের ঝোলায় আছে। আরও কত কী আছে!

দুনিয়াটা বদলাচ্ছে, সত্যি সত্যি বদলে যাচ্ছে। কারো না কারো পক্ষ থেকে এর জন্য একটা আঘাত দরকার ছিল। সে আঘাত হয়তো মর্মঘাতী এবং বেদনাদায়ক– কিন্তু তা দরকার ছিল। এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের বদলে বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের প্রয়োজন। দুনিয়াতে মাতব্বর একজন নয়, একাধিক থাকা দরকার, নাহলে ভারসাম্য থাকে না। একজনের হাতে অর্থাৎ একক শক্তির হাতে ঘটনাচক্রে মাতব্বরির দায়িত্ব পড়েছিল, বেদনাদায়কভাবে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা দুনিয়াটাকে জমিদারির তল্লাট বানিয়েছে। দুনিয়ায় 'সত্য' জিনিসটাই লোপাট হয়ে গিয়েছে, এখন তারা যা-কিছু ভূষিমাল গছাবে তাকেই সত্য বলতে হবে– আপনি মানুন আর না-ই মানুন।

ঘটনাটা রাশিয়া ঘটাল– ইউক্রেইনে। ঘটনাটা ফ্রান্সও ঘটাতে পারতো, অন্য কোথাও– এমন কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্র শক্তিধর অন্য কোনো রাষ্ট্রের 'পোতা'র নিচে দাঁড়িয়ে অহেতুক বীরত্ব দেখায়। এমন ঘটনা ঘটার দরকার ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং পাশ্চাত্য নামের জাত্যাভিমানী ও বর্ণবাদী সত্তার বিরুদ্ধে এমন আচরণের প্রয়োজন ছিল। পূর্ববর্তী স্নায়ুযুদ্ধের প্রসঙ্গ নাহয় বাদই রাখলাম, সেটাকে সেয়ানায় সেয়ানায় লড়াই বলে মেনে নিলাম; কিন্তু সারাবিশ্বে গত তিরিশ বছরের পরিক্রমায় যে 'ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি' দশা তৈরি হয়েছে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার দরকার ছিল। সেটার সূচনা হয়েছে বলা যায়; এবং তা শুরু হয়েছে আপাত 'অপ্রিয়' শক্তির হাতে। কী ঘটল তাতে?

বিশেষ সামরিক অভিযানে এপ্রিলের ৬ তারিখ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেইনের ১২৫টি যুদ্ধবিমান, ৯৩টি হেলিকপ্টার, ৪০৮টি ড্রোন, ২২৭টি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, ১৯৮৭টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যুদ্ধযান, ২১৬টি রকেট লঞ্চার, ৮৬২টি ফিল্ড আর্টিলারি ও মর্টার, ১৮৮৮টি স্পেশাল মিলিটারি ভেহিকল ধ্বংস করেছে এবং ইউক্রেইনি নেভির কমান্ড শিপসহ ১৪টি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করেছে বা আটক করে নিয়ে গিয়েছে। এ দাবি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। রাশিয়ার সামরিক শক্তির কৌশলগত ও কারিগরি দিক বিবেচনা করলে এ দাবিতে তেমন কোনো অসত্য নেই। ইউক্রেইন কিছু প্রতিরোধ করছে বটে কিন্তু তাদের দাবির পক্ষে পশ্চিমা প্রেস্টিটিউট যে খবর দিচ্ছে তাতে ভরসা করার কোনো উপায় নেই। পশ্চিমা মিডিয়া ইউক্রেইনে 'ভল্লুক ঢুকেছে' বলে চিৎকার করছে। তাদের চিৎকারই সার।

ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড মাল্টিপোলার হচ্ছে। পরিবর্তমান দুনিয়ায় একাধিক কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হবে দুটি– রুশ ফেডারেশন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। যুক্তরাষ্ট্রের কী হবে! তার একক কর্তৃত্ব তো যাবেই, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও লোপ পাবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এর মধ্যে বলতে শুরু করেছেন, 'আমেরিকা লুকস লাইক আ থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি।' তিনি একথা বলছেন সাপ্লাই চেইন ইস্যুতে। ইউক্রেইনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। দোকানে রুটি নেই, জুয়েলারির দোকানে অলঙ্কার নেই, অফিস-আদালতের জন্য অর্ডার দিয়েও ফার্নিচার পাওয়া যাচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

"We're like a third-world country. They don't have things. You go to buy something at Tiffany's, you go to buy something at a hardware store – high, low – they don't have product. … . The system is broken. We are going into socialism and we are going into communism."

মার্কিনিরা সমাজতন্ত্র, কমিউনিজমের কথা (যদিও একটা কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে আছে) একেবারেই শুনতে পারে না। কমিউনিজমের কথা শুনলে তাদের ড্রাকুলার মতো হলি ওয়াটারের ছিটা লাগার দশা হয়, গায়ে কাঁপুনি ধরে। তারপরও ট্রাম্প একথা বলেছেন। প্রথমবারের মতো যে একথা বলেছেন তা কিন্তু নয়; ২০২০ সালে নির্বাচনের ফলাফল প্রসঙ্গে এবং ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামো সমস্যা প্রসঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। ২০০৮- এর বিশ্বমন্দার কারণে তাদের 'সোশ্যালিজম'- এর আশ্রয় নিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থাকে বেইল-আউট করতে হয়েছিল। তার কথা বানোয়াট নয়, কিছু সারবত্তা আছে। অতিসম্প্রতি জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জোসেফ বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের চেয়ে (তাদের যেকোনো একজন প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হলে) বেশ ব্যবধানে (৬-৯ পার্সেন্ট) এগিয়ে আছেন ট্রাম্প।

বিশ্ব-বাস্তবতার পরিবর্তনের আরো অনেক আলামত বিশিষ্টজনদের কথায়, বিশেষজ্ঞদের কথায় স্পষ্ট। কাশ্মীরি রাজনীতিক নাঈম আখতারের অভিমত, রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের ফলে রাশিয়া এবং চীন অথবা দুই দেশই একসঙ্গে পরিবর্তমান বিশ্বের নেতৃত্বের কেন্দ্রে চলে আসতে পারে। তারা মিত্র হিসেবেও আসতে পারে বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা এ বিশ্ব-বাস্তবতার হুমকি অনুভব করছে। ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি- এর রাষ্ট্রীয় নীতির কারণেই (পশ্চিমাদের পরামর্শ অনুযায়ী) এ পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।

এর অভিঘাত পড়েছে মার্কিন রাজনীতিতেও। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বলেছেন, তারা রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন (রেজিম চেঞ্জ) চান না। পুরোপুরি উল্টো সুর! গত কিছুদিন ধরে তার 'বস' জো বাইডেন যে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন তার নেতিবাচক প্রভাব কাটাতেই বাইডেনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করলেন না তিনি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ছাড়া বাইডেনের রেজিম চেঞ্জের বক্তব্য ইউরোপের আর কেউ সমর্থন করেনি, যদিও ন্যাটোর তালে তালে রুশবিরোধী পাল্টা সামরিক অভিযানের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তারা, ইউক্রেইনে সামরিক সহায়তা পাঠানোর কথা বলছে।

মার্কিন মিডিয়া-জগতেও তার ছাপ পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কনজারভেটিভ মিডিয়া ফক্স নিউজের হোস্ট (অনুষ্ঠান সঞ্চালক) শন হ্যানিটি বাইডেনকে বলেছেন, 'ওয়াকিং, টকিং লায়াবিলিটি' টু ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড টু দ্য ওয়ার্ল্ড। বাইডেনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাফরা তাকে নিয়মিত যে ব্রিফিং দেন তার বাইরে গিয়ে প্রচুর বেখাপ্পা কথা বলেন তিনি। এর জন্য বাইডেনের স্টাফদের পরে পাল্টা ভাষ্য দিতে হয়। নিজের পলিসির ব্যাপারে উল্টাপাল্টা কথা বলেন বাইডেন। হ্যানিটি বলেছেন, কেমন তালগোল পাকানো প্রেসিডেন্ট হলে এমন কথা বলা সম্ভব! কেমন প্রেসিডেন্ট হলে তার নোট দরকার হয়? তা-ও যদি ঠিকমত বলতে পারতেন। তিনি যে কখন কী বলেন তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। একবার পোল্যান্ডে গিয়ে বলেন, 'ইউএস সোলজার্স উইল সুন বি অন দ্য গ্রাউন্ড ইন ইউক্রেইন'; অন্যবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নাম ভুলে যান; আবার তিনি বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন 'ক্যান্ট রিমেইন ইন পাওয়ার'।

হ্যানিটি বলেছেন, "নির্বাচনের আগে আমি তার ব্যাপারে ঠিকই বলেছিলাম। জো বাইডেন সুস্থ নেই। তিনি কম্পিটেন্ট নন। তিনি চৈতন্যের (কগনিটিভলি) বিচারে একজন দুর্বল ব্যক্তি। তার স্টাফরা চেষ্টা করে যাচ্ছে, তিনি যেন স্ক্রিপ্টের বাইরে চলে না যান, কিন্তু তিনি চলে যাচ্ছেন। জো ইজ স্ট্রাগলিং ওয়ার্স দ্যান এভার। পটাস (প্রেসিডেন্ট অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) মোটেও ভাল নেই।"

ফক্স নিউজেরই আরেক অনুষ্ঠান সঞ্চালক (হোস্ট) টাকার কার্লসন বলেছেন, গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস কমপক্ষে পাঁচবার স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছে যে, প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সঠিক লাইনে নেই। অফিশিয়াল পজিশন থেকে তার বক্তব্য র‌্যাডিকেলি ভিন্ন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদ্দেশে তার বক্তব্য আলাদা কিছু নয়। কার্ল টাকার বাইডেনের কথারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, 'ফর গডস্ সেইক, দিস ম্যান (জো বাইডেন) ক্যান নট রিমেইন ইন পাওয়ার।' বাইডেন ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। সংবিধানের (সংশোধিত) আর্টিকেল পঁচিশ অনুযায়ী করে তাকে বিদায় দেওয়া হোক। তার কথা মাত্রাতিরিক্ত রকমের অসংলগ্ন, অপ্রাসঙ্গিক; তাকে সরানো দরকার। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাব্যতার কথাও বলেছেন। এটা হয় তার বয়সজনিত উদভ্রান্তির বিষয় নতুবা তিনি একেবারে নিঃশেষিত হয়ে গেছেন।

পরিবর্তমান বাস্তবতার সুর অন্যদের কথায়ও টের পাওয়া যাচ্ছে। চীন বলেছে, ইউক্রেইন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়ায় সমস্যার ভূত তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র (স্পেক্টর অব ট্রাবল ফর এশিয়া প্লটেড বাই ইউএস)। চীনের পরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং য়ি স্নায়ুযুদ্ধের কলাকৌশলের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ইউক্রেইন সংকটের ছুতা করে এশিয়াতেও অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ফলেই এমনটা হতে পারে। চীন বলেছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বা করিয়ে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হচ্ছে কিন্তু তার মিত্ররা এমনকি ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ইউক্রেইন সংকটের সমাধান ঘটাতে হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি বন্ধ করতে হবে। নাহলে সমাধান মিলবে না।

কিছু কিছু ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের 'চান্দি' গরম হয়ে গেছে। ইউক্রেইনে বায়োল্যাবের আলামত ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মস্কো (রাশিয়ার বাহিনী) জুনিয়র বাইডেনের অর্থাৎ হান্টার বাইডেনের অনেক ই-মেইল পেয়েছে। তাতে হোয়াইট হাউসে প্যানিক তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে গ্রিসের রেলওয়ে শ্রমিকরা ইউক্রেইনের উদ্দেশ্যে ন্যাটোর ট্যাংকবহর পরিবহনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নরওয়ের গোয়েন্দা প্রধান বলেছেন, লাগাতার নিষেধাজ্ঞার কারণে পুতিন সাময়িক কিছু সমস্যায় পড়বেন বটে। কিন্ত রাশিয়ার জন্য তার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। রাশিয়ায় পুতিনের মতো একজন দৃঢ়চেতা নেতার দরকার আছে। রাশিয়ার ট্র্যাডিশন সেকথাই বলে। আইএমএফ প্রধান বলেছেন, আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউরোপই বরং বিপদে পড়বে। নিষেধাজ্ঞা এবং ব্ল্যাকলিস্টিংয়ের পাল্টাপাল্টি চলছে। ইউ-নেতৃত্বকে কালোতালিকাভুক্ত করেছে রাশিয়া।

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ায় ফরেইন ক্যাশ ফ্লো রেকর্ড পরিমাণে ঢুকবে বলে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন। ওয়াশিংটন ডিসি'র দ্য ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স (আইআইএফ) মনে করে, রাশিয়ার কারেন্ট একাউন্ট সারপ্লাস এ বছরের মধ্যেই ২০০-২৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। মস্কোর ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নির্ধারিত হয় জ্বালানির ও কাঁচামালের রপ্তানিতে এবং বিভিন্ন দ্রব্যের আমদানিতে। রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বর্তমান সংকটের মধ্যে সবচেয়ে বড় উইনার হবে চীনের কারেন্সি ইউয়ান।

ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মাল্টিপোলার ওয়ার্ল্ড জায়মান। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আর কাজ করছে না। বরং পাশ্চাত্যের ওপরই তা বুমেরাং হয়ে ফিরছে। ডলার ও ইউরোর ভোরের কুয়াশার মতো উবে যাওয়ার দশা হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার প্রাধান্যের দিন আসন্ন। পশ্চিমকে এখন নতুন ফিনান্সিয়াল অর্ডারের সাথে দর কষাকষি করতে হবে। নতুন ব্যবস্থায় তাদের কথারই জোর থাকবে যাদের অর্থনীতি পোক্ত এবং প্রাগ্রসর থাকবে; যাদের অর্থনীতি স্বাস্থ্যবান থাকবে এবং যাদের মনিটারি সিস্টেম ভরসাযোগ্য হবে। পুতিন বলেছেন, রুবলেই তেল-গ্যাস কিনতে হবে। জি-৭ সমস্বরে বলেছে, তারা রুবলে গ্যাস কিনবে না। বোঝা যাচ্ছে, তাদের উপর মার্কিনীদের মাতব্বরি এখনো চলছে। এদের মধ্যে চার দেশের রাশিয়ার তেল-গ্যাসের উপর নির্ভরতা তেমন নেই; কিন্তু তিন দেশ খুব বাজে অবস্থায় পড়বে– জার্মানি, ইতালি ও জাপান। তারা কার্যত 'অকুপাইড' টেরিটরি, তাদের স্বাধীন 'সত্তা' বলতে গেলে নেই। ইতিহাসের মাঝে মাঝে বেচাল দেওয়ার অভ্যাস আছে। জার্মানি ও জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কপাল!

অস্বীকার করে বেশিদিন থাকা যায় না। সম্ভবত প্রথম ব্যত্যয় ঘটাবে জার্মানি। তাদেরকে নতুন চুক্তিতে আসতে হবে। রাশিয়ার এখনকার নীতি হচ্ছে: 'নো রুবল নো গ্যাস'। একপাক্ষিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার কাছে ডলার এবং ইউরোকে অপাঙক্তেয় করে তুলেছে। রুবলকে অস্বীকার করলে চেইন রিঅ্যাকশনে বৈশ্বিক ক্রেডিট লাইনই ধসে পড়বে, দেউলিয়া হয়ে যাবে। অন্যান্য দ্রব্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে; যেমন তেল, ধাতু, টিম্বার, গম প্রভৃতি। আনাতোলি চুবাইস ভেগেছেন, এটা ভাল খবর। নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার অলিগার্করা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এসবের ফলে রাশিয়া রাষ্ট্র হিসেবে আরও উপকৃত হবে, রাশিয়ার সমাজ আরো সংহত হবে। সাবধানে এগোনোর যে পরিকল্পনা পুতিন নিয়েছেন তাতে পাশ্চাত্যের কোমর ভেঙে যাবে। ভারতের সাথে রুপি-রুবল সম্পর্ক, সৌদি আরবের সাথে পেট্রো-ইউয়ান সম্পর্ক, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর মির-ইউনিপে কার্ড ইস্যু করা, রাশিয়া-ইরানের সুইফটের বিকল্প খোঁজা, ইএইইউ-চীনের স্বাধীন মনিটারি/ফিনান্সিয়াল সিস্টেম তৈরির প্রকল্প– এসবের কথাও বাদ দেওয়া যায় না। রুবলের বিনিময়-মূল্য দিনে দিনে আরও বাড়বে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্বও বাড়বে। নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায় একক কোনো শক্তি নয়, একাধিক শক্তি ভূমিকা পালন করবে।

পেপি এস্কোবার তার 'রুবলগ্যাস': দ্য ওয়ার্ল্ডস নিউ রিসোর্স-বেইজড রিজার্ভ কারেন্সি; এপ্রিল ০২, ২০২২; (https://thesaker.is/) নিবন্ধে বলেছেন, সাদ্দাম চেষ্টা করেছেন, গাদ্দাফি চেষ্টা করেছেন, তারা পারেননি; ইরান চেষ্টা করেছে, ভেনেজুয়েলা চেষ্টা করেছে, পারেনি। পুতিন অন্য ধাতুতে গড়া, তাই রাশিয়া পারবে। বরং বলা ভালো পেরেছে। 'রুবল ফর গ্যাস'– এ নীতি দিয়েই তিনি খেলা বদলে দিয়েছেন। পাশ্চাত্য এ চাল বুঝতে ভুল করেছে। রাশিয়া বলেছে, গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধ করতে হবে; তবে সরাসরি নয়, পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার গাজপ্রম-ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে। পাশ্চাত্যের কোনো গাজপ্রম-ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নয়। অর্থাৎ ফরেইন কারেন্সি রাশিয়ায় পাঠাতে হবে, বিদেশি কোনো ব্যাংকে রুবল রাখলে হবে না। কারণ তা যেকোনো সময় জব্দ করা হতে পারে। রুশ আইনি-ব্যবস্থার আওতায় তা রাখতে হবে। ফলে পেমেন্টের ঝুঁকির অবসান হবে। কেউ তাতে ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না। গ্রাহকরা রাশিয়ার গাজপ্রম-ব্যাংকে অ‌্যাকাউন্ট খুলবে; ফরেইন কারেন্সিতে পেমেন্ট করা যাবে, যেমন ডলার বা ইউরো; তাকে রুবলে কনভার্ট করা হবে কারেন্ট এক্সচেঞ্জ রেটে এবং বিভিন্ন গাজপ্রম একাউন্টে ট্রান্সফার করা হবে। এ ব্যবস্থায় শতভাগ নিশ্চিত যে, গাজপ্রমকে অর্থ পরিশোধ করতেই হবে।

গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ বলেছেন, রাশিয়ার ফরেইন রিজার্ভ ফ্রিজ করার কারণে গ্রিন ব্যাংকের উপর আস্থা কমেছে। ফলে মার্কিন ডলারের ডমিন্যান্স ঝুঁকিতে রয়েছে। (www.rt.com) বলেছে –

"The US dollar is dealing with some of the same challenges that the British pound faced in the early 1900s, before it went into decline, Goldman Sachs said in a research note released on Thursday (4 April, 2022). The Wall Street bank warns that the greenback could lose its global dominance. … the move by Washington and its allies to freeze much of the Russian Central Bank's foreign currency reserves has raised concerns that countries could start moving away from the dollar. Analysts explained the risk as due to worries about the power the dollar grants the US."

যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো-মিত্রদের মিডিয়া-মিথ্যাচার সব ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে; তবু বলা যায়, রণাঙ্গণের চিত্রও স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। ইউক্রেইনের এক ব্লগার উদ্ধার পাওয়ার পর স্বীকার করেছেন, তাকে মারিউপোল হাসপাতালে (মাতৃসদন) রাশিয়ার এয়ারস্ট্রাইকের ব্যাপারে ফেইক নিউজ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। তার নাম মারিআন্না ভিশেমিরস্কায়া, মারিউপোলের বিউটি-ব্লগার। পশ্চিমা মিডিয়ায় তিনি রীতিমতো সেলিব্রিটি সিম্বলে পরিণত হয়েছেন। তার পোস্ট ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে যে, ৯ মার্চ রাশিয়ার অ্যারোস্পেস বাহিনী মারিউপোলের মাতৃসদনে বোমা হামলা চালিয়েছে। তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়ে সত্যিই কী ঘটেছে তা বলেছেন। তার নামও ভুল উচ্চারণে উল্লেখ করেছে পাশ্চাত্যের রিপোর্টাররা; তার নাম ভিশেমিরস্কায়া অথচ উল্লেখ করা হয়েছে ভিশেগিরস্কায়া। ভিশেমিরস্কায়া ইনস্টাগ্রাম পেইজে বলেছিলেন, মাতৃসদন বিমানের বোমা হামলায় নয়, সম্ভবত আর্টিলারি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলার পরই তার ও অন্যান্য নারীদের ছবি অনুমোদন ছাড়াই ব্যবহার করেছেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একজন রিপোর্টার (উর্দি ও হেলমেট পরিহিত); আর বলা হয়েছে, বিমান হামলায় (এয়ারস্ট্রাইক) তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে সামরিক অভিযান বা সামরিক হস্তক্ষেপের (ক্যু-চেষ্টা) সাথে জড়িত হয়েছে। চীনে ১৯৪৫-৪৬ সালে, সিরিয়ায় ১৯৪৯ সালে, কোরিয়ায় ১৯৫০ ও ১৯৫৩ সালে, ইরানে ১৯৫৩ সালে এবং ১৯৮৭/৮৮ সালে, গুয়েতেমালায় ১৯৫৪, ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে; তিব্বতে ১৯৫৫ সালে ও ১৯৭০-এর দশকে, ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৫৮ সালে, জায়ারেতে ১৯৬০ ও ১৯৬৫ সালে, ভিয়েতনামে ১৯৬৫-১৯৭৩ সময়কালে, কিউবায় ১৯৬১ সালে, ডমিনিকান রিপাবলিকে ১৯৬১, ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে; ডেমোক্রেটিক কঙ্গোতে ১৯৬৪ সালে, লাওসে ১৯৬৪ ও ১৯৭৩ সালে, পেরুতে ১৯৬৫ সালে, গ্রীসে ১৯৬৭ সালে, কম্বোডিয়ায় ১৯৬৯/৭০ সালে এবং ১৯৮০ ও ১৯৯৫ সালে, চিলিতে ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কয়েকবার, আর্জেন্টিনায় ১৯৭৬ সালে, অ্যাঙ্গোলায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ সালে কয়েকবার, এল-সালভাদরে ১৯৮১ ও ১৯৯২ সালে, নিকারাগুয়ায় ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অনেকবার, লেবাননে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত লাগাতার, গ্রানাডায় ১৯৮৩ সালে, লিবিয়ায় ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কয়েকবার, ফিলিপাইনে ১৯৮৯ সালে, পানামায় ১৯৮৯ সালে, ইরাকে ১৯৯০/৯১ সালে ও ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অনেকবার এবং ১৯৯৮ সালে আবার ২০০৩ ও ২০১১ সালে, সোমালিয়ায় ১৯৯২-৯৮ সালে অনেকবার, বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ১৯৯৫/৯৬ সালে, সুদানে ১৯৯৮ সালে, সার্বিয়ায় ১৯৯৯ সালে, আফগানিস্তানে ২০০১ সালে ও ২০২১ সালে, পাকিস্তানে ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অনেকবার, সোমালিয়ায় আবার ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কয়েকবার, কেনিয়ায় ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কয়েকবার, উগান্ডায় ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েকবার, ইরাকে আবার ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত, সিরিয়ায় ২০১৪ থেকে এখন পর্যন্ত, ইয়েমেনে ২০১৫ থেকে এখন পর্যন্ত এবং ভেনেজুয়েলায় ২০১৯ সালে।

যুক্তরাষ্ট্রের 'পাপ'-এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এসব পাপ থেকে বিশ্ববাসীর রেহাই দরকার! যার হাত ধরেই আসুক, বিশ্বে পরিবর্তন আসুক।