ইউক্রেইন: মিথ্যার সত্য, সত্যের মিথ্যা

শাহাব আহমেদশাহাব আহমেদ
Published : 29 March 2022, 11:52 AM
Updated : 29 March 2022, 11:52 AM

"রাশিয়া একটি ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্র, আমার বিশ্বাস রাষ্ট্র হিসেবে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।"– রাশিয়ার প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ভ্লাদিমির বুরকভ মৃত্যুর বছরখানেক আগে আমাকে বলেছিলেন ২০১৮ সালে। অনেকগুলো যুক্তিও দিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস হয়নি। যদিও আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি দেখেছি সেই দেশে বসে, কিন্তু সেটা ছিল একটা কৃত্রিম রাষ্ট্র কাঠামো, রাশিয়া তো একটি প্রাচীন দেশ, রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগে তাকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তার বিলুপ্তির কথা একটি অস্বস্তিকর অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছিল। তবে যিনি বলছিলেন, তার চোখে ছিল নিরীক্ষার বাস্তব বিষণ্ণতা। কে চায় পৃথিবীর মানচিত্র থেকে তার দেশ মুছে যাক? খুব মনে আছে গর্বাচভের পেরেস্ত্রোইকার সময়টির কথা, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটার পর একটা রিপাবলিক স্বাধীনতার দাবি তুলছিলো। তখন শুধু আমারই নয়, কারোই মনে হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন, নষ্ট স্বৈরতান্ত্রিক উটপাখিরাও তা ভেবেছে কিনা সন্দেহ। স্বৈরতন্ত্র অন্ধ, নিজের ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু দেখে না।

ঠিক এমনি একটি পরিস্থিতি শুরু হয়েছিল রাশিয়ায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই, যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন কিন্তু দেশ চালাচ্ছিল তার বিশ্বস্তরা, হার্ভাড, ন্যাটো ও সিআইর উপদেষ্টাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে।

সেই সময়ে রাশিয়ায় সংকট উত্তরণের 'মহান উদ্দেশ্য' নিয়ে খুব উঁচু বেতন নিয়ে আসা পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের ভিড় ছিল কেঁচো-কৃমির মতোই। শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিরাষ্ট্রিয়করণে সাহায্য করার জন্যই এসেছিল ২০০ জনের বেশি হেভিওয়েট স্পেশালিস্ট। এদের মধ্যে হার্ভার্ডের জেফরি স্যাকস, আন্দ্রেই শ্লেইফার, বার্নার্ডসহ ঝানু অর্থনীতিবিদরাই কেবল ছিলেন না, ছিলেন সিআইএ এবং যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণাদাতা বয়েল, ক্রিস্টোফার, শারোবেল, অ্যাকেরমেন, ফিশার, ওয়াইম্যান, কামিনস্কি, উইলসন, ইত্যাদি। জোনাথান হেই-কে বিদেশ বিষয়ক ডিরেক্টর নিয়োগ করেন রুশ প্রাইভেটাইজেশনের 'অমনিপটেন্ট' গড আনাতোলি চুভাইস। পরবর্তীতে আমেরিকান এইডের তহবিল তসরুপ ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, শ্লেইফার ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে যুক্তরাষ্ট্র গভর্নমেন্ট। এবং হার্ভাড ৩১ মিলিয়ন ডলার পে করে সেই মামলায় রফা করে।

অন্যান্য মহৎ মুসাফিরদের অনেকেই কোটি কোটি টাকা 'কামাই' করে দেশে এসে মামলায় পড়ে, জরিমানা দেয়, কেউ কেউ জেলেও যায়। মানব জাতির ইতিহাসে 'শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার জটিল প্রক্রিয়া' বা 'নৌ খাউ (know how এর রুশ উচ্চারণ) ট্রানস্ফার' এর এটি ছিল এক দৃষ্টান্তহীন দৃষ্টান্ত। রাশিয়ার ভবিষ্যতের ফাউন্ডেশন গড়ছিল রাশিয়ার চিরকালীন শত্রু আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা। তাও বিনা পয়সায় নয়, জনগণের মুখের অন্নকাড়া টাকায় বেতন নিয়ে।

তাদের কাজের ফলাফল দেখা দিতে শুরু করে অচিরেই। প্রায় সারা দেশের মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয় এবং রাশিয়ার সম্পদ কুক্ষিগত করে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী অলিগার্খ গোষ্ঠি, যারা দেশের সম্পদ পাচার করতে থাকে বাধাহীনভাবে। কিন্তু তা-ও ততটা খারাপ ছিল না, যতটা খারাপ হয় অন্য দিকটি। চেচনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই ঘোষণা আসে তাতারস্থান থেকে, সাইবেরিয়ার ছোট্ট একটি রিপাবলিকও গর্জন করে এবং জাপানের প্রতিবেশি রাশিয়ার ফার ইস্টও পিছিয়ে থাকে না। অবিকল সেই একই উপসর্গসমূহ, যা আমরা দেখেছি পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনে চলা গর্বাচভের পেরেস্ত্রোইকার সময়ে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির একটু আগে।

রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোশ্লাভিয়ার মতো ভেঙ্গে ফেলার ন্যাড়াকে দ্বিতীয়বার বেল তলায় নেবার প্রক্রিয়ার সভাপতিত্ব করছেন বরিস ইয়েলৎসিন, তার পেটুক আমাত্যগণ, এবং শুভাকাঙ্ক্ষী সিআইএ ও ন্যাটোর উপদেষ্টারা। তারা হয়তো দূরে কোথাও ক্যাভিয়ার, শ্যামন, সালাদ ও স্টেইকের টেবিল সাজিয়ে, সারি সারি শ্যাম্পেনের বোতল প্রস্তুত করে, বসতে যাচ্ছিলেন রাশিয়ার কুলখানি উৎসব করার জন্য।

কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় এসে বাঁধ সাধেন।

রাশিয়ার প্রতিটা ক্রান্তিকালে কেউ না কেউ এভাবে উঠে এসেছে এবং দশকে রক্ষা করেছে। পুতিন ন্যায়-অন্যায়ের গাঁজায় মগ্ন না হয়ে চেচনিয়াকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন এবং রাশিয়ার বিভিন্ন রিপাবলিকের স্বাধীনতার মার্চ ও রাশিয়া ভেঙে দিয়ে জনগণকে 'মুক্ত' করার আমেরিকান মহান স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দেন। হাত থেকে শিকার ফসকে গেলে বাঘ আর যাই হোক খুশি হয় না এবং যে সেই শিকার কেড়ে নেয়, তাকে ক্ষমাও করে না। সুতরাং পুতিনকে ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না, পশ্চিমের কাছে পুতিন শত্রু নাম্বার ওয়ান।

এবং তারা ঠিক।

তবে পুতিন যে ভালো নয় এটাও ঠিক। সে রাশিয়াকে চুষে ছোবড়া করে দেওয়া দস্যু অলিগার্খদের বিশ্বস্ত বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। নিন্দুকে বলে সে নিজেও তাদের একজন। রাশিয়ার পতন থামাতে পেরে তার দৃষ্টি খুলেছে, তার বন্ধুরা তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, সে মহান, তার সমকক্ষ আর কেউ নেই, তাকে ছাড়া রাশিয়া এতিম, নিঃস্ব ও ন্যাংটো। এবং সবচেয়ে 'সৌন্দর্যময়' ঘটনা হলো, তিনিও অমোঘ সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, তিনি মহান, তার সমকক্ষ আর কেউ নেই, তাকে ছাড়া রাশিয়া এতিম, নিঃস্ব ও ন্যাংটো। সুতরাং তিনি যা-ই করেন, তা-ই রাশিয়ার জন্য ভালো। এর চেয়ে ভালো কিছু করার আর কেউ নেই। এই বোধিপ্রাপ্তরা সচরাচর আরও একটি সত্য জেনে যায় আপনা আপনিই- রক্ত হোক, মূত্র হোক যা-ই সে পান করুক না কেন তার কোনোদিন মৃত্যু হবে না। এবং মৃত্যু যেহেতু তাদের পরিকল্পনায় নেই, তারা কখনও তার পরবর্তী নেতা তৈরি করে না।

পুতিন এর ব্যতিক্রম নন।

স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য তা-ই। এবং স্বৈরতন্ত্র যত দীর্ঘায়িত হয়, জনগণের জন্য ততই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, অসন্তোষ ও প্রতিবাদ বাড়ে, এবং শাসকদের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। তখন তাদের পথ খুঁজতে হয় জনপ্রিয়তা বাড়ানোর। সবচেয়ে ফলদায়ক পথের একটি হলো দেশের ভেতরে কোনো সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করার মাধ্যমে সারাদেশকে সর্বজনীন প্যানিকে নিমজ্জিত করে, তার থেকে সফলভাবে উত্তরণ ঘটানো। অন্যটি হলো যুদ্ধ বাঁধানো। আমেরিকায় বসে আমরা এর চর্চা হতে দেখি সবচেয়ে বেশি, যদিও অফিশিয়ালি আমেরিকা অটোক্র্যাটিক দেশ নয়, তার বাবা।

পুতিনের জন্য যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় ২০১৪ সালে। যদিও তা দানা বাঁধতে শুরু করে ২০০৪ সালে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইউনুকোভিচ ভোটে জেতে, কিন্তু ভিক্টর ইউশেঙ্ককোর সমর্থক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সরাসরি অর্থ সাহায্যে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে বিপুল গণবিক্ষোভ, অসহযোগিতা ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে (কথিত অরেঞ্জ বিপ্লব) সরকারকে বাধ্য করে নতুন করে নির্বাচন দিতে। তাতে ভিক্টর ইউশেঙ্ককো জয়ী হয়, সাথে জয়ী হয় পশ্চিম ইউক্রেইনের রুশোফোবিক উগ্রজাতীয়তাবাদ, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সুদূরপ্রসারী স্বার্থ ও পশ্চিমের অর্কেস্ট্রেড প্রপাগান্ডা। পরাজিত হয় প্রাচীন 'কিইভান রুছ' রাষ্ট্রের নাগরিক, দুই শ্লাভ জাতির হাজার বছরের অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্ববোধ। পরাজিত হয় ইউক্রেইন। সে পায় অবিরল অ্যান্টিরুশ প্রপাগান্ডা চালানোর সরকারি ফান্ড ও প্লাটফর্ম। যুবপ্রজন্মের মধ্যে রুশবিরোধী মনোভাব ছড়াতে থাকে প্লেগের মত। এবং সব পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি তারাই।

সোভিয়েত রাষ্ট্রের ডিজাইন ছিল, এক রিপাবলিকে কোনো শিল্পপণ্য তৈরি করে অন্য রিপাবলিকগুলোতে সাপ্লাই দেবে। সেই কারণে ইউক্রেইনের শিল্পগুলো ও কৃষি প্রোডাক্টের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল রাশিয়া। এ কথা কারো অজানা নয় যে, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো প্রোডাক্টই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রির মানসম্পন্ন ছিল না এবং তাদের বাজারে এদের প্রবেশও ছিল না। রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক বন্ধন ছিল ইউক্রেইনের জীয়নকাঠির মতো। রাশিয়ার তেল ও গ্যাস ছাড়া তাদের একদিনও চলে না, তদুপরি তাদের দেশের ওপর দিয়ে তেলের পাইপ যাবার কারণে রাশিয়া কোটি কোটি ডলার পে করে ট্রানজিট ফি হিসেবে, ক্রিমিয়ায় রুশ নৌবাহিনীর অবস্থানের লিজ পে করে আরও কোটি কোটি ডলার।

এককালের সমৃদ্ধ ইউক্রেইন ১৯৯১ সালের পর থেকে রাশিয়ার মতোই পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের 'মহৎ' পরামর্শ মেনে দুর্নীতি, মাফিয়া ও অলিগার্খদের খপ্পরে পড়ে একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হচ্ছিল দিন দিন। এখন পশ্চিমারা ইউক্রেইনের শিল্প ও কৃষিকে ধ্বংস করে রাশিয়ার থেকে মুখফিরিয়ে তাদের ওপরে নির্ভরতার নীতি প্রয়োগ করছিল। ওবামা প্রশাসনের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন ইউক্রেইনে ক্ষমতাসীনদের সাথে লিয়াজোঁ রক্ষা করে রাতারাতি বিশাল অর্থকড়ির মালিক হয়ে এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। ইউক্রেইন হলো এখন জো বাইডেনের বাপের জমিদারি, তাকে তার ন্যাটোতে চাই-ই।

২০০৪ সালে উগ্রবাদীদের কাঁধে চড়ে ক্ষমতার আসা এককালের কমিউনিস্ট নেতা ভিক্টর ইউশেঙ্ককো প্রাক্তন নাৎসি কোলাবরেটর স্তেপান বান্দেরাকে কবর থেকে তুলে এনে জাতীয় বীর আখ্যা দেয় এবং তার স্মারক ডাক টিকেট বের করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্তেপান বান্দেরার 'ইউক্রাইনিয়ান ন্যাশনালিস্ট অর্গানাইজেশন'-কে বলা হয়ে থাকে, পশ্চিম ইউক্রেইনে কয়েক হাজার নয়, কয়েক লাখ ইহুদি, পোলিশ, ইউক্রেইনিয়ান ও রাশিয়ানকে হত্যা করে। ইউক্রেইনের দোরোহোবিচ শহরের যেখানে বান্দেরা-র বিশাল ব্রোঞ্জ স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়, তা ছিল ১৫ হাজার ইহুদীর হত্যাক্ষেত্র, অবশ্যই সে কথা সেখানে অনুচ্চারিত। বিবেকবান যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ন্যাটোভুক্ত ইউরোপ সারা পৃথিবীব্যাপী নাৎসিদের শিকার করে বেড়ায় কিন্তু 'কোল্ড ওয়ারে'র সক্রিয় পশ্চিমা প্রপোনেন্ট বান্দেরা বিচার এড়িয়ে জার্মানিতে বেঁচে থাকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত। অবশেষে মিউনিখে কেজিবি তাকে হত্যা করে।

ইউক্রেইনে নাজি আছে?

আছে।

অরেঞ্জ বিপ্লবের এত জনপ্রিয় নেতা ভিক্টর ইউশেঙ্ককো মাত্র এক টার্ম ক্ষমতায় থাকে। ২০১৪ সালে জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে আসে চার বছর আগে জেতা কিন্তু ক্ষমতায় না আসতে দেয়া ভিক্টর ইউনুকোভিচ। তিনি চেষ্টা করেন পূব ও পশ্চিমের মধ্যে ব্যালান্স করে চলতে কিন্তু পার্লামেন্টে ও পথে বিরোধীদলগুলো তাকে প্রতিনিয়ত বাধা দিতে থাকে। তা সত্ত্বেও ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে সে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে অ্যাসোসিয়েট চুক্তি স্বাক্ষর না করে রাশিয়া, বেলারুশ ও কাজাখস্থানের অর্থনৈতিক জোটে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। বিনিময়ে রাশিয়া ১৫ বিলিয়ন ডলার শর্তহীন ঋণ ( পশ্চিমা প্রস্তাব ছিল মাত্র ৮৩৮ মিলিয়ন শর্ত সাপেক্ষ ঋণ) ও স্বল্পমূল্যে তেল ও গ্যাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয়।

কিন্তু ২০০৪ সালে রিহার্সাল দেওয়া 'অরেঞ্জ বিপ্লবে'র কুশীলবরা আবার মাঠে নামে। এবার এরা আরও শক্তিশালী, সংহত ও হিংস্র। কূটনীতির নিয়ম ভঙ্গ করে আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা 'ইউরোমাইদানে' অবস্থানরত প্রতিবাদীদের চা, খাদ্য ও কম্বল বিলায়, কোটি কোটি ক্যাশ ডলার ছড়ায়। ইউরোপও পিছিয়ে থাকে না। তারপরে সশস্ত্র উগ্রজাতীয়তাবাদি স্নাইপাররা বিভিন্ন ভবনে লুকিয়ে থেকে প্রতিবাদী কিছু মানুষকে হত্যা করে সরকারি বাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে সোস্যাল ও পশ্চিমা মিডিয়ায় এক বিশাল শোরগোল তুলে জনগণকে খেপিয়ে তোলে। শুরু হয় স্ট্রিট যুদ্ধ, প্রতিবাদী ও পুলিশ মিলিয়ে প্রায় ১১৩ জনের জীবনহানী ঘটে।

এই মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দয়ালু পশ্চিম ইউনুকোভিচের সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মধ্যস্থতার পদক্ষেপ নেয়। সরকার মেনে নেয়। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভিক্টর ইউনুকোভিচ ও বিরোধীদলগুলো ইউক্রেইনের পলিটিকাল ক্রাইসিস নিরুপনের চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু পশ্চিম যে গ্যারান্টি দেয় তা যে কতখানি ভঙ্গুর ও বিশ্বাসঘাতকতায় সমৃদ্ধ, তা প্রমাণিত হতে সময় নেয় একদিনেরও কম। সশস্ত্র উগ্রবাদীরা পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট ভবনে আক্রমণ চালায়, প্রেসিডেন্ট ও তার পক্ষের এমপিরা জীবন নিয়ে পালায়। পার্লামেন্ট ভোটাভুটি করে ইউনুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যূত করে।

পশ্চিমের গ্যারান্টির দাম কত?

যারা ওই গ্যারান্টির গুড় খেয়েছে, তারা জানে।

ক্ষমতায় আসে তিন পার্টির কোয়ালিশন। তাদের ২টি ন্যাটোমুখী জাতীয়তাবাদী ও কট্টর অ্যান্টিরুশ, তৃতীয়টি ফ্রিডম পার্টি নামের উগ্রজাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট পার্টি। তারা এথনিক রুশদের অধিকার খর্ব করার আইন পাশ করে রুশভাষাকে একটি আঞ্চলিক ও সংখ্যালঘু ভাষা ঘোষণা করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষার স্ট্যাটাস থেকে খারিজ করে দেয়। শুধু তাই নয় পূর্ব ইউক্রেইনের এথনিক রুশ জনগণ যেহেতু মাইদানে অংশগ্রহণ করে নাই, তারা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের শিকার হতে থাকে।

ওডেসায় ৪০ জন এথনিক রাশিয়ানকে একটি দালানে বন্দি করে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করে। দানেৎস্ক ও লুহানস্কের যুবকরা অস্ত্র হাতে নিয়ে স্ব স্ব এলাকায় স্বাধীনতা করে। পুতিন তাদের সমর্থন জানায় এবং ক্রিমিয়া দখল করে একটি রেফেরেন্ডামের আয়োজন করে। এবং রুশ মিডিয়ার দাবি অনুযায়ী ক্রিমিয়ার জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে সে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে। রাশিয়ার জনগণের মধ্য পুতিনের জনপ্রিয়তা আবার আকাশ ছুঁই ছুঁই হয়।

১৭৭৪ সালে রাশিয়ার ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটের সেনারা তুরস্ককে পরাজিত করে ক্রিমিয়া দখল করেছিল এবং ১৮৮৩ সালে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে তা রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বহু যুদ্ধ ও রুশরক্তের অর্জন ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়া ইউক্রেইনের নয়। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রের নেতা নিকিতা ক্রু্শ্চেভ, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের চিরস্থায়িত্বে বিশ্বাস করতেন, অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ সুবিধার কথা চিন্তা করে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইউক্রেইনের সাথে যুক্ত করেন। ইউক্রেইনকে ক্রিমিয়া দান করার ম্যান্ডেট কেউ তাকে দেয় নাই। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন সেই চিরস্থায়ী দেশটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, ক্রিমিয়া ইউক্রেইনেই রয়ে যায়। তিন প্রাক্তন কমরেড- রাশিয়ার ইয়েলৎসিন, ইউক্রেইনের ক্রাভচুক ও বেলারুশের শুশকেভিচ গর্বাচভের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে স্ব স্ব দেশে জার বা প্রিন্স হয়ে বসার স্বপ্নে এতই বিভোর ছিলেন যে, দেশ ও জনগণ-বিষয়ক বহু জটিল বিষয়ই 'পরে দেখা যাবে' বলে তারা পেছনে ঠেলে দেন। কৃষ্ণসাগর যে রাশিয়ার জন্য বাঁচা মরার প্রশ্নের সাথে জড়িত, ক্রিমিয়া যে রাশিয়ার নৌবাহিনীর মূল ঘাঁটি, সে কথাটিও ভদকায় প্লাবিত প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের মগজে তলিয়ে যায়। তার কাছে ক্ষমতা ছিল সবার আগে।

শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালে তারা কৃষ্ণসাগরে নৌবহর ভাগাভাগি করে নেয়ার সময়ে চুক্তিতে আসে যে, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে ক্রিমিয়া ও সেভাস্তোপোল লিজ নেবে। লিজ নবায়নের সময় ঘনিয়ে আসে ২০১০ সালে। ভিক্টর ইউশেঙ্কোর সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা লিজের চুক্তি নবায়ন করবে না। এ ছিল পুতিনকে দারুণ হেনস্তা করা।

যদিও ভিক্টর ইউনুকোভিচ ক্ষমতায় এসে তা নবায়ন করে কিন্তু পুতিন তা ভোলে না।

সে বুঝতে পারে বাড়তে দিলে পশ্চিমমুখী ইউক্রেইন তার মাটিতে শুধু রাশিয়ামুখী ন্যাটোর মিসাইলই বসাবে না, রাশিয়াকে ক্রিমিয়া থেকে বহিস্কার করে সেখানে ন্যাটোর নৌভিত্তি করবে। সুতরাং যে কোনো শক্তিশালী দেশ যা করতো পুতিন তাই করে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া সে রাশিয়ায় ফেরত আনে।

অন্যায়? অবশ্যই। নির্ভর করে কার চোখ দিয়ে দেখা।

ফিরে যাই প্রাচীন 'কিইভান রুছে'।

নরওয়ের ভাইকিং কিং রিউরিক ৮৬২ সালে রাশিয়ার আদি শহর শ্লাভিয়ানস্কে এসে স্থানীয়দের পরাজিত করে রিউরিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তৈরি করেন নভগরদ শহর। কিন্তু শিশুপুত্র ইগরকে তারই বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ওলেগের হাতে রেখে মারা যান। ওলেগ শুনতে পান দক্ষিণে ইউরোপমুখী বিভিন্ন রাস্তার মিলনস্থলের এক সমৃদ্ধ নগর রাজ্য, কিইভের কথা। তিনি ইগরসহ সৈন্যসামন্ত নিয়ে নদীপথে পৌঁছে কিইভ দখল করেন। এর ভৌগলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তাকে মুগ্ধ করে এবং তিনি নভগরদ থেকে রাজধানি স্থানান্তিরত করে ঘোষণা দেন,

"কিইভ হোক রাশিয়ার সব শহরের জননী।"

তিনি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে এবং বিশাল একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। তারপরে ইগর এবং ইগরের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ওলগার শাসনামলে রুশ আরও বিস্তীর্ণ এবং আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ওলগার নাতি ভ্লাদিমির 'কিইভান রুছ' দেশটির সীমানা তাতারস্থান থেকে বাল্টিক সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ করেন। তিনি কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী ক্রিমিয়ার খেরসন শহর দখল করেন এবং এখানেই ৯৮৮ সালে বাইজাইন্টাইন সম্রাটের বোনের পাণিগ্রহণের পাশাপাশি 'রুছ' রাষ্ট্রকে গ্রিক খ্রিস্টান (প্রাভাশ্লাভনি বা অর্থোডক্স) ধর্মে দীক্ষিত করেন, যা সমস্ত রাশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, বর্তমানে ভৌগলিকভাবে ইউক্রেইন ও বেলারুশ যেখানে অবস্থিত, তারাও 'কিইভ রুছে'র অন্তর্গত ছিল, কোনো আলাদা জাতি গোষ্ঠি হিসেবে পরিচিত ছিল না, যেমনটা ছিল 'কিইভ রুছ' এর প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের বার বার আক্রমণ করা খাজার বা পেচেনেগরা, বা পরের দিকে লিথুনিয়ান, পোলিশ বা মঙ্গোলরা। 'কিইভ রুছে'র রিউরিক বংশের রাজাদের সন্তান সন্ততি চাচা ভাতিজারাই এই এলাকাগুলো শাসন করতো কখনও কিইভের বশ্যতা মেনে, কখনও স্বাধীনভাবে।

তখনও মস্কো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ভ্লাদিমিরিরের মৃত্যুর পরে তার পুত্রদের মধ্যে 'রুছ' বিভক্ত হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ শুরু হয়। পরে ইরোশ্লাভ দ্য ওয়াইজ আবার রুশ ঐক্যবদ্ধ করেন এবং সম্ভবত তার সময়েই 'কিইভ রুছ' তার সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়। ১০৫৪ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার বংশধরদের মধ্যে 'রুছ' ভাগ করে দেন এবং আবার শুরু হয় দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। 'রুছ' দুর্বল হতে শুরু করে। এসময়ে লিথুনিয়া শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তার রাজা পোল্যান্ড দখল করে, সেই দেশের রাজকন্যাকে বিয়ে করে লিথুনিয়ান-পোলিশ রাষ্ট্র 'রেচ পাসপালিতা' গড়ে তোলে। কিইভ পুনঃ পুনঃ তাদের আক্রমণের শিকার হয়। পশ্চিমের অনেক জমি ও বেলারুশ 'রেচ পাসপালিতা'র দখলে যায়। কিইভ থেকে ক্ষমতার কেন্দ্র বর্তমান রাশিয়ার ভ্লাদিমির-সুজদাল প্রিন্সিপালিটি সুজদালে প্রথমে, পরে ভ্লাদিমির শহরে সরে আসে। ভ্লাদিমিরের প্রিন্স দোলগোরুকি মস্কো নদীর তীরে নিরিবিলি কিছু গ্রাম নিয়ে মস্কো শহর প্রতিষ্ঠা করেন ১১৪৭ সালে।

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে আসে ১৩২৫ সালে। ততদিনে রুশ অর্থডক্স চার্চের মূল কেন্দ্রও কিইভ থেকে এখানে সরে এসেছে এবং কিইভসহ প্রায় সমস্ত 'রুছ' মঙ্গোলদের পদানত হয়েছে। ইউক্রেইনের পশ্চিমাংশ রেস পাসপালিতায়ার অধীনে থাকে দীর্ঘদিন ( তারাই সবচেয়ে বেশি রুশ বিরোধী), পূর্বাংশ থাকে রাশিয়ার সাথে (তারা রুশ ভাষাভাষী এথনিক রাশিয়ান)।

মঙ্গোলদের পরাজিত করে এবং সাইবেরিয়া দখল করে রাশিয়াকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়দেশে পরিণত করে আইভান দি টেরিবল ১৫৮৪ সালে মারা যান। তার ছেলে ১৫৯৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারী না থাকার কারণে রিউরিক বংশ শেষ হয়ে যায়। সেই থেকে ১৬১৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় অস্থিরতা চলতে থাকে, পোলিশরা রাশিয়া আক্রমণ করে মস্কো দখল করে নেয় কিন্তু স্বাধীনতাকামী জনগণ তাদের বিতারিত করে ১৬১৩ সালে মিখাইল রমানভকে জার হিসাবে নির্বাচিত করে এবং নতুন রমানভ বংশের যাত্রা শুরু হয়।

অর্থোডক্স ধর্মালম্বী ইউক্রেইনের মেজরিটি কৃষক ও কসাকরা ছিল পোলিশদের দ্বারা নিগৃহীত।

তাদের বর্ণবাদ, ঘৃণা ও শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ জনগণ মুক্তির পথ খুঁজছিল। তারা স্বাধীনচেতা বোগদান খ্মেলনিৎস্কি'কে, যার ১০ বছরের ছেলেকে পোলিশ সৈন্যরা পেট ফেঁড়ে হত্যা করেছিল তার চোখের সামনে, তাদের আতামান নির্বাচিত করেন। তিনি রেস পাসপালিতায়ার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেন, কিন্তু পোলিশদের থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে বিধ্বস্ত অবস্থায় রমানভ রাজবংশের দ্বিতীয় জার, আলেক্সেই মিখাইলোভিচের কাছে ইউক্রেইনকে রাশিয়ার প্রোটেকশনের অধীনে নেয়ার অনুরোধ করেন। ২ বছর চিন্তাভাবনা সম্পন্ন করে ১৬৫৪ সালে জার ইউক্রেইনকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, এথনোজেনেসিস বা জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় কিইভান রুশের শ্লাভ জাতিসমূহ- রাশিয়ান, ইউক্রেইনিয়ান, বেলারুশিয়ান এবং আরও কিছু, পশ্চিম ইউরোপের জাতিসমূহের তুলনায় একহাজার বছর পিছিয়ে। তারা গড়ে উঠেছে একসাথে, পাশাপাশি বা জড়াজড়ি করে, তাই তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম অত্যন্ত কাছাকাছি। সুতরাং কে রাশিয়ান, কে ইউক্রেইনিয়ান, কে বেলারুশিয়ান বলা মুশকিল।

এভাবে ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে ইউক্রেইন নামে বা অন্য নামে 'কিইভান রুছ' বা পোল্যান্ডের অধিনতার বাইরে কোনোদিনই স্বাধীন কোনো দেশ ছিলো না। বিপ্লবের পরে, ১৯২২ সালেই প্রথমবারের রাষ্ট্রের কাঠামো অর্জন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়।

কোনো দেশ ছিল না, বা 'কিইভ রুছ' অংশ ছিল বলেই আজ তাকে গ্রাস করতে হবে?

না।

পুতিন কি গ্রাস করার জন্য উশখুশ করছিল?

না।

কে তাকে ছাগল ছানার মত বাঘের থাবায় ঠেলে দিল?

একজন প্রেসিডেন্ট ইহুদি হলেও নাৎসি হতে পারে, আবার ব্যক্তিগতভাবে নাৎসি পার্টির সদস্য না হয়েও সে তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েও নাৎসি হতে পারে। জেলেনস্কিকে ক্ষমতায় এনেছে উগ্রবাদী নাৎসিরা। তারাই তাকে ঘিরে আছে, তারাই ঘৃণা ছড়াচ্ছে রুশদের এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। মারিউপুলের উগ্রপন্থি আজাভ রেজিমেন্টের নেতা, ২০১৪ সালে নির্বাচত ইউক্রেইনের পার্লামেন্টের সদস্য, বহু ইমিগ্রেন্ট, রুশভাষী ইউক্রেইনিয়ান ও সংখ্যালঘু মানুষের রক্তে রক্তাক্ত হাত আন্দ্রেই বিলেৎস্কির। তিনি তার সংগঠনের লক্ষ্য বর্ণনা করে খুব স্বচ্ছভাবে,

Ukraine's National purpose is to lead the world in a final crusade…against semite-led inferior races.

এটা হুবহু হিটলারের কথা।

এই এদের দ্বারা চারিদিক থেকে পরিবেষ্টিত ইউক্রেইনের তিন প্রেসিডেন্ট ইউশেঙ্কো, পারাশেঙ্কো এবং জেলেনস্কিরা যে নাৎসি নন, এ কথা কি আমাদের মানতেই হবে?

এই যুদ্ধের দায় কার? সারা বিশ্ব বলছে একা পুতিনের।

পরীক্ষা করে দেখা যাক। ১৯৯১ সালে দুই বার্লিনের মিলনের সময়ে শর্ত ছিল ন্যাটো পুবদিকে এক ইঞ্চিও পা বাড়াবে না, অর্থাৎ পূর্ব ইওরোপের কোনো দেশকে ন্যাটোতে নেওয়া হবে না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে পতনের পরে রাশিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিল ক্লিনটন প্রথম চুক্তি ভঙ্গ করে ১৯৯৯ সালে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ও হাঙ্গেরিকে ন্যাটোভুক্ত করে। তারপরে শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও ছোট বুশ ২০০৪ সালে এস্টোনিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও শ্লোভিনিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করে রাশিয়ার পেটের ভেতর ঢুকে যায়। ২০০৮ সালে ন্যাটোর বুখারেস্ট সম্মেলনে জর্জিয়া ও ইউক্রেইনকে ন্যাটোতে গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তাব পাশ হয়। ২০০৯ সালে ওবামা ক্রোয়েশিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করে। এরপরে ট্রাম্প ২০১৭ সালে মন্টেনেগ্রো এবং ২০২০ সালে উত্তর মেসেডোনিয়াকে ন্যাটোর সদস্য করে নেয়।

একচ্ছত্র মার্কিন দস্যুপনাকে ঠেকানোর ক্ষমতা রাশিয়ার আগে ছিলো না বলে চিরদিনই থাকবে না, তা ভাবার কারণ নেই। রাশিয়া এখন কিছুটা হলেও শক্তি অর্জন করেছে, অন্তত পুতিনের তাই মনে হয়েছে। সে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে জর্জিয়া ও ইউক্রেইনের ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি। আমেরিকার মনরো ডকট্রিন যেমন বলে, "বাইরের কোনো শক্তি পশ্চিম গোলার্ধে অর্থাৎ উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকায় এমন কিছু করতে পারবে না, যা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়", রাশিয়াও একই কথা বলেছে বার বার কিন্তু আমেরিকা ও ন্যাটোর বধির কান। তারা মনে করে রাশিয়াকে তারা কোনঠাসা করতেই থাকবে কিন্তু রাশিয়া কিছু বলবে না, বা বলার সাধ্য তার নেই। বুদ্ধিমান ও অতিলোভীরাও ভুল করে।

পুতিন বলে বসেছে, তোমরা যুদ্ধ চাও? এই নাও যুদ্ধ।

ইউক্রেইন ধ্বংস হচ্ছে।

আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। বিশ্বব্যাপী চলছে মিথ্যার দাপট। সত্য বিশ্লেষণ করার মানুষ নেই, তা নিয়ে কথা বলার সাহস নেই। আসলে মিথ্যার নখের সমান শক্তিও নেই সত্যের। মানুষ কোনো আদর্শ সমাজে বাস করে না, বাস করে মুনাফা, লোভ, খল ও চাতুর্যের দুনিয়ায়, যেখানে ন্যায় বলে কিছু নেই, অন্যায় বলে কিছু নেই, আছে শুধু ক্ষমতার দাপট। ক্ষমতাই ন্যায়, বাকি সব কিছু নির্বোধ, দুর্বল ও স্বপ্নচারীর দর্শনচর্চা।

কোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষই যুদ্ধ শুরু করে না, যুদ্ধ মানে হত্যা কিন্তু সক্ষম সব বিবেকসম্পন্ন মানুষই আক্রান্ত হলে রুখে দাঁড়ায়। ইউক্রেইনের জনগণ তাই করেছে। হ্যাঁ ফ্যাসিস্টরা আছে তাদের সাথে, কিন্তু তারা এখন একাত্ম। ভালো ও মন্দ একসাথে চলে না, ভাবুক বলে। কিন্তু বাস্তবে তো খুব চলে।

পুতিনের ঠাণ্ডা মাথা ঠাণ্ডা রাখলেই ভালো হতো। কারণ প্রায় ৪ সপ্তাহের যুদ্ধে রাশিয়ার অর্জন কী?

সর্বজনীন ঘৃণা।

মানুষ মরছে রাশিয়ান সৈন্যদের হাতেই এবং কচি, প্রশিক্ষণহীন, নির্দোষ সৈন্যরাও মরছে।

অর্থনৈতিক স্যাংকশন, যা রাশিয়ার স্বল্পজীবী মানুষের জীবনকে দুঃসহ করে তুলে রাশিয়ার বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

কিন্তু যে দর কষাকষির জন্য যুদ্ধ, তা অর্জন হয় নাই। তারা কিইভ দখল করতে পারে নাই, পারে নাই ক্রিমিয়ায় পৌঁছানোর করিডোর তৈরি করতে বা পূর্ব ইউক্রেইনের পরিধি বাড়াতে।

কেউ কেউ বলবে, ওদের রসদ, অস্ত্র ও সামরিক বেইজগুলো ধ্বংস করতে পেরেছে।

এটা কি কোনো অর্জন হলো?

রাশিয়াকে যদি ওখান থেকে নাকে খত দিয়ে বের হয়ে আসতে হয়, আমেরিকা ও ন্যাটো দুইদিনে তারচেয়ে পঞ্চাশ গুণ অস্ত্র সেখানে নিয়ে আসবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নকে কিন্তু নাকে খত দিয়ে আফগানিস্তান থেকে ফিরতে হয়েছিল এবং মাত্র দুই বছর পরে পৃথিবীর মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। রাশিয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদ ভ্লাদিমির বুরকভের কথা কি সত্য হতে যাচ্ছে?

পুতিনের সাপোর্টার অনেককেই বলতে শুনি, রাশিয়া তার ট্যাংক নিয়ে ধীর গতিতে আগাচ্ছে কারণ তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে চায় না, আমেরিকান যুদ্ধ ট্যাকটিসের তুলনায় তারা অনেক মানবিক। কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধই, যুদ্ধের কোনো মানবিকতা নেই। যুদ্ধে জয় করতে হয় যত দ্রুত সম্ভব, তাতে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমে। জীবিতেরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। আহতেরা চিকিৎসা পায়। ক্ষুধার্তরা পায় খাদ্য।

আমরা সভ্যতার হাতে বন্দি, মিথ্যার সত্যে, সত্যের মিথ্যায় কর্দমাক্ত। গণহত্যার যারা প্রকৌশলী তাদেরই প্রপাগান্ডার কুমিরের অশ্রু-সিক্ত হয়ে আমাদের কখনও বলতে হয়, 'আমরা গণহত্যাকে সাপোর্ট করি না', কিন্তু গণহত্যা কি থামে?

তা শুধু দেশ বদলায়।

যুদ্ধের প্রকৌশলিরা চিরঞ্জীব, আমরা তাদের নিক্তি দিয়েই বিবেকের পরিমাপ করে যাবো চিরকাল।

মার্চ ২১, ২০২২

তথ্যসূত্র 

1.From Rus to Russia- Leonid Gumileov (Russian)

2.History of Russia for children- A. Ishimova (Russian)

3.Secrets of Russian history-M.B.Smolin (Russian)

4.Riddles of Russian History- Nikolai Nipomnyasshi (Russian)

5.World History, the face of Russia-Vladimir Butromiev ( Russian)

6.Russian Tsars- B.Antonov (Russian)

7.Romanovs-Tsars and Emperors- A. Barchatova and T. Burkova (Russian)

8.How Harvard Lost Russia by David McClintick

9.The Harvard Boys Do Russia by Janine R. Wedel