ছাত্রনেতা থেকে ৩৫ বছর বয়সে চিলির প্রেসিডেন্ট

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 8 Jan 2022, 11:45 AM
Updated : 8 Jan 2022, 11:45 AM

চিলি। প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত লম্বা আকৃতির দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ। সম্ভবত দেশটির মানচিত্র লম্বা বাঁকানো মরিচের মতো বলে দেশটির নাম হয়েছে 'চিলি'। ইংরেজি চিলি মানে আমাদের কাছে মরিচ। এই মরিচাকৃতির দেশটিতে সম্প্রতি নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ৩৫ বছর বয়সী গ্যাব্রিয়েল বরিক। বরিক বামপন্থি। ছাত্র রাজনীতি থেকে এসেছেন জাতীয় রাজনীতিতে। বিশ্বব্যাপী বাম রাজনীতির যখন চরম দুঃসময় চলছে, তখন বিপুল ভোটে বরিকের মতো তরুণের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়াটা আলোড়ন তুলেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট অতি দক্ষিণপন্থী নেতা হোসে আন্তোনিও কাস্তকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েই তিনি বলেছেন, 'যদি চিলি নব্যউদারবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে থাকে, তবে তার সমাধিও হবে এখানেই।' তার এই বার্তা ইতিমধ্যেই ভাঁজ ফেলেছে আমেরিকার কপালে।

চিলির জনগণ সত্যিই বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। 'তুমি সমস্ত গাছ কেটে ফেলতে পারো, তাতে কি বসন্ত আসবে না?' পাবলো নেরুদার এই বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি এতদিন চিলির নাগরিকরা ব্যবহার করতেন সামরিক শাসক আগুস্তো পিনোশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দিনগুলোকে স্মরণ করে। এই কথাগুলিকেই আবার তারা প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন ৩৫ বছরের যুবক গাব্রিয়েল বরিককে নির্বাচিত করে।

মাত্র ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের বাস চিলিতে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে, ২০০০ সালেও এ দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ শতাংশ, যা বর্তমানে নেমে এসেছে ৬.৪ শতাংশে। তামা ও ব্যাটারি তৈরির উপকরণ লিথিয়ামসমৃদ্ধ দেশটি জাতিসংঘের মানবাধিকার সূচকের নিরিখে দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষে। কাগজে-কলমে আর্থিক বিকাশও হচ্ছে বেশ দ্রুত। কিন্তু সেখানে তৈরি হয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। চিলিতে মাত্র ১ শতাংশ নাগরিকের হাতে রয়েছে সে দেশের ২৫ শতাংশ সম্পদের মালিকানা। যাবতীয় আর্থিক বিকাশের সুবিধা মূলত তারাই পেয়েছেন। সব উন্নত মানের পরিসেবা (প্রায় পুরোটাই বেসরকারি) তাদের হস্তগত। গত তিন দশক ধরে আর্থিক উদারীকরণের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পেনশন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ হয়েছে। অভিযোগ, তামার খনি, অন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার, এমনকি পানির উৎসও বিদেশি লগ্নিকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গত ত্রিশ বছরে লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের ফলে এখানে বেশিরভাগ কাজই এখন চুক্তিভিত্তিক। চুক্তিতে কাজ মেলে বছরে বড় জোর মাসদশেকের জন্য। অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, দেনায় ডুবে থাকেন তারা।

নির্বাচনী প্রচারে এই অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বরিক। আর তাতেই তিনি বাজিমাৎ করেছেন। ১০ বছর আগে তিনি ছিলেন চিলির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদী মুখ। শরীরে ট্যাটু, দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিনি গায়িকা টেলর সুইফটের ভক্ত গাব্রিয়েল বরিক হয়ে উঠেছেন চিলির তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, যোগ্য প্রতিনিধি।

তবে এই নির্বাচনে বরিকের জয়ের পেছনে কাজ করেছে দীর্ঘদিনের অপশাসনের বিরুদ্ধে চিলির জনগণের লড়াইয়ের ইতিহাস। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে চিলির নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে জেনারেল আগুস্তো পিনোশের স্বৈরাচারী শাসন শুরু হয়েছিল। সেই সময় চিলির প্রেসিডেন্ট ছিলেন বামপন্থি সালভাদর আলেন্দে। আমেরিকার মদতে চিলিতে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছিল, তাতে হত্যা করা হয়েছিল দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও নানা শ্রেণির মানুষজনকে। এর পরের চিলির ইতিহাস শুধু হিংসা, প্রতিহিংসা ও নানা ধরনের অত্যাচারের। এই সময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মিল্টন ফ্রিডম্যান, যিনি উদারনৈতিক পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা ছিলেন, তার নেতৃত্বে 'শিকাগো বয়েজ়'-এর তত্ত্বাবধানে চিলি হয়ে ওঠে নয়া উদারনীতির ল্যাবরেটরি। ১৯৮০ সালে এক বিতর্কিত গণভোটে পাশ হয় নতুন সংবিধান। দেশ চালানোর মূলনীতি হয় বেসরকারিকরণ ও মুক্ত বাজারের সমন্বয়শক্তি, যার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রায় কোনও হাতই থাকে না। শুরু হয় অবাধ বেসরকারিকরণ, মানুষের অধিকার কেড়ে নিতে দমন-পীড়নমূলক নীতির প্রবর্তন। এই কাজে পিনোশের ডান হাত ছিলেন উপদেষ্টা হাইমে গুজমান। পশ্চিমি দুনিয়ার মদতপুষ্ট পিনোশে অবশ্য ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এরপর চিলির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটলেও ১৯৮০ সালে রচিত কুখ্যাত সংবিধানটি এখনও রয়ে গিয়েছে। তবু জনগণ লড়াই চালিয়ে যান। গত বছর মেট্রোরেলের অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে যে প্রবল বিক্ষোভ হয়, তাতে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়। চিলির বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরা গণভোটে রাজি হন। চিলির ৭৮ শতাংশ নাগরিক সংবিধান বদলানোর পক্ষে রায় দিয়েছেন।

এক দশক আগে মানসম্মত শিক্ষা ও লেখাপড়ার খরচ কমানোর দাবিতে ২০১১ সালে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন বরিক। সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৪ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সেই আইনপ্রণেতা হিসেবে চিলির সংসদের নিম্নকক্ষে যোগ দেন। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়ন পেতে তাকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ৩৫ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়। বরিক সেটি করার পাশাপাশি পরাজিত করেন স্যান্টিয়াগো অঞ্চলের জনপ্রিয় মেয়র ড্যানিয়েল জাদুকে। এরপরই বামপন্থি জোটের নেতৃত্ব পান তিনি।

ল্যাটিন আমেরিকার রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার সঙ্গে বামপন্থার সংঘাত বহু পুরনো। মার্কিনি মদতে অজস্র সামরিক অভ্যুত্থান আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের রমরমা গোটা দুনিয়া দেখেছে। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় ভর করে জিতে আসা নতুন প্রেসিডেন্টের এ-কথা বলার জন্য ধক লাগে বৈকি। টেলিভিশনে বিশ্ব যখন সেই দৃশ্য দেখেছে, তখন জেনে গিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে এক নতুন তারকার আর্বিভাব ঘটেছে, যিনি আদতেই 'স্ট্রিট ফাইটার'।

উল্লেখ্য, ল্যাটিন আমেরিকার রাজনীতিতে গত কয়েক দশক ধরেই 'ব্লু টাইড' আর 'পিঙ্ক টাইড' দুটো খুব পরিচিত আর প্রতিস্পর্ধী শব্দ। বরিকের জয়কে ওই মহাদেশে 'পিঙ্ক টাইড'-এর ফিরে আসার চিহ্ন বলে মনে করা হচ্ছে। 'ব্লু' মানে দক্ষিণপন্থা বা দক্ষিণপন্থী দলগুলির শাসন। যখন ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে দক্ষিণপন্থী দলগুলি জেতে, তখন বলা হয় 'ব্লু টাইড' বা 'নীল ঢেউ' চলছে। আর, 'পিঙ্ক' মানে মেশানো লাল, অর্থাৎ যে দল বা রাজনৈতিক শক্তিগুলির একটা কমিউনিস্ট অতীত বা বামপন্থি ঝোঁক আছে। কিউবা বা ভেনেজুয়েলার মতো সরাসরি কমিউনিস্ট সরকারকে বাদ দিলে ল্যাটিন আমেরিকার অন্য দেশগুলিতে যখন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী দলগুলো জিততে থাকে, তখন বলা হয় 'পিঙ্ক টাইড' এসেছে। পতাকার রং হয়তো লাল নয়, কিন্তু দিনবদলের এই পৃথিবীতে যারা নিজেদের 'সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট' বলে পরিচয় দেন, তাদের জয়কে 'পিঙ্ক টাইড'-ই বলা হয়।

এর আগে পেরুতে ক্ষমতায় এসেছেন পেদ্রো কাস্টিলো আর হন্ডুরাসে সিওমারা কাস্ত্রো। দু'জনেই গণ আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতা, ঘোষিত বামপন্থি। ব্রাজিল আর কলম্বিয়ায় সামনের বছর নির্বাচন। সমস্ত 'ওপিনিয়ন পোল' বলছে, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতারা ক্ষমতায় আসবেন। ব্রাজিলের ঘটনাটি আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো, কারণ সেখানে ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভার, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে জেল খেটেছেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট লুলার ফিরে আসাটা চমকপ্রদ, কারণ আদালতের রায়েই তার নির্বাচনে লড়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, আবার ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের রায়েই তিনি নির্বাচনী দৌড়ে ফিরে এসেছেন। সব ওপিনিয়ন পোলে ব্রাজিলের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান বোলসেনেরোর থেকে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষের সমর্থনে এগিয়ে থাকা লুলা ক্ষমতায় এলে হয়তো দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসকে নতুন করে লিখবেন। চিলিতে বরিক, পরে ব্রাজিলে লুলা আর কলম্বিয়ায় গুস্তাভ পেত্রো জিতলে– দক্ষিণ আমেরিকায় 'গোলাপি ঢেউ'-এর প্রবল উপস্থিতি মেনে নিতেই হবে।

ফুটবলীয় শ্রেষ্ঠত্ব, সাহিত্য সৃজন (ম্যাজিক রিয়ালিজম) এবং সামাজিক অসাম্য থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতা, ল্যাটিন আমেরিকা মূলত তিনটি কারণে সুবিদিত। চে গুয়েভারা বা ফিদেল কাস্ত্রোর বামপন্থার অমোঘ রোমান্টিক আকর্ষণে বিশ্ব ভেসেছে বারবার। ধনতান্ত্রিক আমেরিকার নাকের ডগায় বসে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকা। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তামা পাওয়া যায় যে-দেশে, যে-দেশের গড় মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের থেকে প্রায় ৬ গুণ তো বটেই, চিনের থেকেও বেশি, বাজার অর্থনীতির সেই চ্যাম্পিয়ন চিলিতে একজন বামপন্থি নেতা সামাজিক অসাম্য দূর করার কথা বলে ভোটে জিতছেন, এই খবরে তো বিশ্ব কেঁপে উঠবেই। মনে রাখতে হবে, মার্কিন রাজনীতিও কিন্তু এখন আর আগের সেই জায়গায় নেই। বস্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে এখন মিশেল উ নামে এক অভিবাসী নারী মেয়র, দ্বিধাহীনভাবে নিজেকে যিনি 'বামপন্থী' বলেন।

বস্তুত, পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখন জীবিকার দাবিতে, আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে, গণতান্ত্রিক অধিকারের সন্ধানে নতুন সামাজিক লড়াই শুরু হয়েছে। ম্লান হতে থাকা বিশ্বায়নের এই মুহূর্তে ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য দূর করার দিকে নজর না দিলে, নতুন এই অসন্তোষের কথা না শুনলে নির্বাচিত শাসকেরাও যে শাসনের বৈধতা হারাতে পারেন, তেমন সঙ্কেত স্পষ্টতর।

আমাদের দেশেও এমন চাপা অসন্তোষ জন্ম নিচ্ছে কি?