বিষয়টি গুরুতর, নাকি লোক দেখানো?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 13 Dec 2021, 07:04 AM
Updated : 13 Dec 2021, 07:04 AM

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন কোনো জটিলতা তৈরি হতে চলেছে। বাংলাদেশ কি চীনের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ছে? এই প্রশ্ন দুটি অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে দুটি ঘটনা থেকে। প্রথম ঘটনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গণতন্ত্র নিয়ে বৈশ্বিক শীর্ষ সম্মেলনে ১১০টি দেশকে আমন্ত্রণ জানালেও বাংলাদেশকে তা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশকে কেন ওই সম্মেলনে ডাকা হয়নি সে সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, 'ওই সম্মেলনে তারা সম্ভবত দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিরাজ করছে। এটি হচ্ছে স্বচ্ছ গণতন্ত্র। জনগণ সুষ্ঠু ও মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে।'

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হওয়ার মতো অনেকেই আছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র দুর্বল না সবল সে বিবেচনা থেকে নিশ্চয়ই বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন থেকে বাদ রাখা হয়নি। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের হয়তো আরও কিছু হিসাবনিকাশ আছে। গণতন্ত্র সম্মেলনের বিষয়টি শেষ হতে না হতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশ প্রধানসহ র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা আসে। এই ঘোষণা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নীরব তোলপাড় শুরু হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পেছনের 'রহস্য' কী তার তত্ত্বতালাশ চলছে।

এরমধ্যেই দ্বিতীয় আর একটি ঘটনা ঘটেছে। সেটি হলো, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক ভিডিও বার্তায় জো বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন।

প্রথম ঘটনায় সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি খুশি হয়ে বিবৃতি দিয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় নাখোশ হয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

বিএনপির এই অবস্থান দেখে একজন মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কি বিএনপির পক্ষে আর চীন কি বিএনপির বিপক্ষে গিয়েছে? অনেকেই সহজ হিসাবে অভ্যস্ত। কোন দল কিসে খুশি বা বেজার হয় তা দেখে সবসময় হয়তো ভেতরের অবস্থা বোঝা যায় না। তবে এগুলো কোনোই ইঙ্গিত বহন করে না, তা-ও নয়। সাদা চোখে যা দেখা যায়, তার বাইরে আর কি আছে সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলেও আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন যে বাংলাদেশকে একটু চাপে রাখতে চায়, সেটা বোধহয় অসত্য নয়। চীন-রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি আমেরিকা সুনজরে দেখার কথা নয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন দুই দেশই বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। ভারত-রাশিয়া ছিল বাংলাদেশের মিত্র। কিন্তু ৫০ বছর পরে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির হালহকিকত অনেক বদলেছে। বদলেছে ভারত এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নীতি-কৌশলও। কূটনৈতিক অবস্থাও এখন যতটা না আদর্শিক, তার চেয়ে অনেক বেশি বাণিজ্য বা ব্যবসানির্ভর। এখন দেশে দেশে সম্পর্ক নির্ধারিত হয় প্রধানত ব্যবসায়িক স্বার্থ বিবেচনায়। তাই কোন দেশে কখন কোন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, আবার কখন কে কাকে ল্যাঙ মারছে তা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়– নীতিতে বিশ্বাসী হলেও প্রকৃত অর্থে তো আর সবাইকে এক পাল্লায় মেপে চলা হয় না বা চলা যায় না। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গেই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে চলছেন বলেই দেশের বাইরে সরকারের শত্রুর চেয়ে মিত্র বেশি। অনেক সরকারপ্রধানের পক্ষেই এতটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলা সম্ভব হয় না। যার সঙ্গে যতটুকু মাখামাখি করা দরকার, তার বেশি করা হয় না। যদিও বিরোধীরা মনে কর, শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে অতিরিক্ত সখ্য গড়েই ক্ষমতায় টিকে আছেন। তবে যারা দেশ এবং দেশের বাইরের রাজনীতির হাঁড়ির খবর সামান্য হলেও রাখেন তারা জানেন যে, শেখ হাসিনা কোনো দেশকেই প্রয়োজনের বেশি পাত্তা দেন না। এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার নীতি নিয়ে তিনি চলেন না। কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনায় এক দেশ বিগলিত হলেও অন্য আরেক ঘটনায় হয়তো বুঝতে পারেন মিষ্টি মিশিয়ে আসলে তেতো বড়িই খেতে দেওয়া হয়েছে।

মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে অসন্তোষ জানিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে ১১ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও মার্কিন এ সিদ্ধান্তকে 'দুঃখজনক' বলে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশ ভূরাজনীতির শিকার কিনা, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'হতে পারে। কী হচ্ছে, আমরা একটু বিবেচনা করব।' এই ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, সেই প্রশ্নে মোমেন বলেছেন, 'সম্পর্কে প্রভাব পড়বে কিনা তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে। যে দেশগুলো উন্নতি করে, যে দেশের সরকার ভালো কাজ করে, অনেক সময়ে তাদের ওপর আক্রমণ হয়। বিভিন্ন দেশের নাম বলতে পারব, অনেক দেশ অনেক ভালো কাজ করছিল, তাদের বিভিন্ন অজুহাতে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।' কিছু এনজিও এবং মানবাধিকার সংস্থা র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ছয় লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। কীভাবে এত মানুষ নিখোঁজ হয় তা মার্কিন সরকার জানে না। আর প্রতিবছর মার্কিন পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনের সময় হাজারখানেক মানুষ মেরে ফেলে। আর বাংলাদেশে নাকি র‍্যাব ১০ বছরে ৬০০ জনকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু কাকে মেরেছে, তার তথ্য আমাদের কাছে নেই। মার্কিন সরকারের আরও সঠিক তথ্যনির্ভর হওয়া উচিত।' পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এক ঢং শুরু হলো, প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। এটি খুব দুঃখজনক এবং এগুলো লোক দেখানো। কারণ সব দেশেই কিছু মানুষ নিখোঁজ হয়।'

তার মানে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা নিয়ে খুব একটা বিচলিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় যা পারত, এখন যে আর তা পারে না সেটা কারো অজানা নয়। বিশ্বজুড়ে মোড়লগিরি করার একক সক্ষমতা তাদের কমে এসেছে। আফগানিস্তান থেকে একপ্রকার নাকে খত দিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোলচালও এখন খুব বেশি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে না। সৌদি আরবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বালাই না থাকলেও সৌদির সঙ্গে তাদের দোস্তিতে কোনো সমস্যা হয় না। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন আর একতরফা বিষয় নয়। অনেক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা-সমর্থন যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশকে 'হোস্টাইল' করার নীতি নিয়ে এখন তারা খুব সুবিধা করতে পারবে না। আগের মোড়লি মেজাজ দেখিয়ে বাংলাদেশকে চীন-রাশিয়ার দিকে ঠেলে দেওয়ার ভুল তাদের না করারই কথা। চীন যে যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে কাছে পাওয়ার চেষ্টায় আছে সেটা স্পষ্ট হয়েছে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে।

ঢাকায় চীনা দূতাবাসের ফেইসবুক পেইজে শুক্রবার দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, 'বেশ ধুমধাম করেই যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত 'তথাকথিত' গণতন্ত্র সম্মেলনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্ধেক মানুষ যখন এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তখন চীন অন্য একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। প্রকৃত গণতন্ত্র কী? যুক্তরাষ্ট্র কি গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করার যোগ্যতা রাখে? আর কীভাবে একটি গণতন্ত্রকে বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন করতে হবে?' তিনি বলেন, 'প্রায়ই ক্ষমতার পালাবদলের সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। তবে চীন বিশ্বাস করে, একটি দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, সেটা নির্ভর করে তার জনগণ সত্যিকার অর্থে সে দেশের মালিক কিনা, তার ওপর। জনগণকে শুধু ভোট দেওয়ার জন্য সক্রিয় করে তোলা হলো এবং প্রচারণার সময় নাচগান করার সুযোগ পেল কিন্তু ভোটের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল; নির্বাচনের পর তাদের কোনো মতামত থাকলেও তা উপেক্ষিত হলো, তবে এমন গণতন্ত্র অবশ্যই প্রকৃত গণতন্ত্র নয়।'

লি জিমিং বলেন, 'আমরা যদি গণতন্ত্র শব্দটির প্রাচীন গ্রিক মূল শব্দে ফিরে তাকাই, এর অর্থ পাই জনগণের শাসন। অতএব একটি দেশ গণতান্ত্রিক কিনা, সেটির বিচার করবে সে দেশের জনগণ। বাইরের কোনো বৈশিষ্ট্য দিয়ে তাকে বিচারের সুযোগ নেই।

একইভাবে বিশ্ব যেহেতু বৈচিত্র্যময়, একপেশে দৃষ্টিকোণ থেকে সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং মানবজাতির বিভিন্ন সভ্যতাকে বিচারের জন্য একই মানদণ্ড ব্যবহারের প্রক্রিয়াটিই অগণতান্ত্রিক। সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণের সমন্বিত প্রক্রিয়ায় জনগণের গণতন্ত্রের সামগ্রিক বিকাশে চীন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের গল্পটিও এক। দেশটি আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। যে দেশে একটি সরকারের যখন ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, তখন তা যদি গণতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃত না হয়, তাহলে হয়তো গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি পুনর্মূল্যায়ন করার অথবা এই সংজ্ঞার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।'

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিএনপিকে উজ্জীবিত করলেও চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে যে তারা হতাশ সেটা বিএনপি নেতারা স্পষ্ট করেছেন বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে। বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। তারা জনগণকে আন্দোলনমুখী করতে পারছে না, আবার বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও তেমন সহযোগিতা পাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারের পরিবর্তে বিএনপির তারেক রহমানের সরকার ক্ষমতায় দেখতে চায় মনে করলে বিএনপি ভুল হিসাবে আছে। এখন আর আমেরিকা অন্যের সুবিধার জন্য কোনো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে না। যতটুকু যা করে নিজের দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই। তবে চীন গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা সামনে আনছে তা কৌতুহলোদ্দীপক। যারা ভোটের গণতন্ত্র নিয়ে মাতামাতি করেন তাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বিএনপির মর্মপীড়ার কারণ হলেও বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনের গতিপ্রকৃতির কোনো খসড়া চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে কিনা, ভাবনার বিষয় বোধহয় সেটাই হওয়া উচিত।

দেখা যাক, হাওয়া কোন দিক থেকে কোন দিকে বয়।