করোনার অভিঘাত: আমরা কি সুস্থ আছি?

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 10 Nov 2021, 10:20 AM
Updated : 10 Nov 2021, 10:20 AM

১.

মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতো পাঁচ মিলিয়ন পেরিয়ে গেছে। তবে অনেকে দাবি করেন এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ প্রায় প্রতিটি সরকারই মহামারীতে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান কখনো দেয়নি। যেমন, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান, সেখানে মাত্র সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে চীন দাবি করেছিল এবং এই তথ্যটিই তারা প্রকাশ করেছিল। কিন্ত মহামারীর ভয়াবহতা এবং মৃত্যুহার দেখে চীন সরকারের সে তথ্য সঠিক ছিল বলে মনে করার প্রয়োজন নেই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সরাসরি মৃত্যুর সংখ্যা থেকে কোভিড পরবর্তী নানা জটিলতায় মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। এ ধরনের মৃত্যুর খবর সবসময় সরকারি হিসেবে দেখানো হয়নি।

সামনে কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে জানি না তবে বর্তমানে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে। এই মহামারী হয়ত নিয়ন্ত্রণে আসবে। একদিন সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে তবে এই মহামারীর অভিঘাত রয়ে যাবে মানুষের জীবনে। এই অভিঘাত সবচেয়ে বেশি লেগেছে মানুষের মনোজগতে। শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে করোনায় মানসিক অসুস্থতার সংখ্যা কম নয়। উন্নত বিশ্বের অধিবাসীরা স্বাভাবিক সময়েও মনোবিদ বা মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতেন। এটি তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার অংশই ছিল। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসাসেবাই যেখানে সীমিত সেখানে মানসিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা নেওয়া দূরে থাক মানসিক চিকিৎসারও দরকার এটাই অনুধাবন করে খুব অল্প সংখ্যক লোক। মানসিকরোগ বা সমস্যাকে এখনো জিন-ভূতের আছর বলে মনে করা হয়। তাদের চিকিৎসাও করা হয় অত্যন্ত নির্মম-নির্দয়ভাবে। যে কারণে রোগী মৃত্যুবরণও করে থাকে।

আমার একট অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা তখন ছোট। অনেক কিছুই ভালো করে বুঝতে শিখিনি। স্কুলের ছুটি বা নানা উপলক্ষে মাঝেমধ্যে গ্রামে যেতাম। বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ায় আমরা স্থায়ীভাবে গ্রামে ফিরে যাই। সে সময়ের কথা, গ্রামে করিম নামে এক লোক ছিলেন। লোকে ডাকত করিম পাগলা। মুখে দাড়ি, পরতেন লুঙ্গি ও কুর্তা। সে সময় গ্রামের মানুষের অভাব ছিল প্রকট। করিম চুরি করতেন তবে দামি কিছু নয়। করিম সুযোগ পেলে কারো ঘরের বাইরে শুকাতে দেওয়া শাড়ি, লুঙ্গি বা গামছা চুরি করতেন এবং কোথাও বেচে দিতেন। মাঝেমধ্যে কারো রান্নঘরে ঢুকে রাতে ভাত–তরকারি খেয়ে ফেলতেন। কখনো কখনো দুয়েকটি থালা–বাসন বা ডেকচিও চুরি করতেন এবং বেচে দিতেন। বেচে দিয়ে করিম যে ভালো দাম পেত তা-ও নয়। কারণ তার কাছ থেকে যারা কিনতেন তারা জানতেন এটা চুরি করা মাল ফলে তারাও করিমকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চুরি করা মাল একপ্রকার ছিনিয়ে নিতেন। গ্রামে কারো বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ পড়ত করিমের। তাকে বেঁধে আনা হতো এবং বেদম প্রহার করা হতো। করিমকে সেই সামান্য চুরির কারণে পেটানো হতো অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। তাকে রক্তাক্ত করে অর্ধমৃত করে ক্ষ্যান্ত দিত অভিযোগকারীরা।

আমরা ছোটরা দূর থেকে ওই নিষ্ঠুরতা দেখতাম। করিমকে মাটিতে, ধুলায় পড়ে থাকতে দেখতাম। আঘাতে চোখ ফোলা, ঠোঁট বেয়ে রক্তঝরা, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসা হতভম্ব, নির্বাক প্রতিবাদহীন করিমকে দেখতাম। আমাদের স্বজনদের, প্রতিবেশিদের এই নিষ্ঠুরতম কর্মযজ্ঞের পর নিস্তেজ, ভাবলেশহীন করিমের পাশে আমরা ছোটরা জটলা পাকাতাম। আমরা কেউ কেউ উহ! আহ! করতাম। আমাদের কেউ কেউ তার প্রতি হাত বাড়াতাম। করিম বিরক্তি প্রকাশ করতেন। করিম কাঁদতেন না। এত অত্যাচারের পরও তিনি বসে থাকতেন। উদাস হয়ে একদিকে তাকিয়ে থাকতেন। করিম কথা বলতেন না। শুধু বিড়বিড় করতেন। তিনি আমাদের মতো শিশুদের সাথেও কথা বলতেন না।

এমন ঘটনার পর সপ্তাহখানেক কিংবা মাসখানেক করিমকে দেখা যেত না। একদিন আবার ফিরে আসতেন গ্রামে। তারপর আবার কোথাও চুরি, আবার করিমকে বেঁধে আনা হতো। আবার সেই নির্মম নির্যাতন। আবার রক্তাক্ত হতেন করিম। করিম কারো সাথে কথা বলতেন না। আমার বাবা এই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করতেন। মা করিমকে ভাত খেতে দিয়ে জিজ্ঞাস করতেন, করিম তুই চুরি করিস কেন? করিম কোনো কথার জবাব দিতেন না। করিম শুধু বিড় বিড় করতেন। এক সময় আমি শহরে চলে আসি। করিমের কথা ভুলে যাই। কখন করিমের মৃত্যু ঘটে, কীভাবে ঘটে তার খবরও আমি রাখি না। গ্রামের কেউ তেমন খবর রাখেনি।

একটি সময় এসে আমার করিমের কথা খুব মনে পড়ে। তার ওপর নির্যাতনের দৃশ্যগুলো চোখে ভাসতে থাকে। করিমের জন্য আমার ভীষণ মায়া হয়। কোনো মানুষকে, কোনো পটেকমার বা চোরকে মারতে দেখলে আমার করিমের কথা মনে হয়। আমি রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত, নির্বাক করিমকে দেখতে পাই।

করিমের জন্য আমার মায়া হয় যখন জানতে পারি এই দেশে, এই সমাজে, এই বিশ্বে এমন কোটি কোটি করিম আছেন। এরা বিভিন্ন প্রকার মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। কিংবা মানসিক সমস্যা নিয়েই জন্ম নিয়েছেন। যে কারণে একজন সুস্থ মানুষের মতো কাজ করে খাওয়ার অবস্থা ছিল না করিমের। মানুষের যে শারীরিক সমস্যার মতো মানসিক সমস্যা থাকতে পারে তা মানুষ জেনেছে খুব বেশি আগে থেকে নয়। ফলে হাজার হাজার বছর ধরে করিমদের মতো লোকরা সমাজে নিগৃহীত হয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে, নিষ্পেষিত হয়েছে। তাদের বোঝার চেষ্টা করেনি অন্যরা। তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। তাদের অনেকে পাগল বলে আখ্যা দিয়েছে। আমাদের সমাজটা বড় নিষ্ঠুর। একটি পাগলের সাথে, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের সাথে তথাকথিত সুস্থ মানুষের আচরণের মধ্যে ফুটে ওঠে আমাদের সামাজিক নিষ্ঠুরতার চিত্রটি। আমাদের সমাজ করিমদের মতো অসহায় লোকদের জন্য নিরাপদ নয়। করিম সুস্থ ছিলেন না। কোনো না কোনোভাবে তিনি মানসিক অসুস্থ ছিলেন। হয়ত মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে কিংবা নিষ্ঠুরতার কারণে করিম ভালোভাবে বাঁচতে পারেননি।

২.

কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমাদের এলাকায় এক বয়স্ক নারীকে দেখা গেল। হাতে পিঠে তার অনেক বোঝা। মাথার চুল জট পাকানো। এক নজর দেখেই বোঝা যায় নারীটি মানসিক ভারসাম্যহীন। এ ধরনের মানুষের বেলায় যা ঘটে, স্থানীয় একটি এতিমখানার শিশুরা নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে নারীটিকে। এক সময় তা নির্যাতনের পর্যায়ে দাঁড়ায়। এদের অভিযোগ নারীটি ছেলেধরা। সেদিন কয়েকজন মানুষের হস্তক্ষেপে অসুস্থ মানুষটি রক্ষা পেলেও কয়েকদিন পর পাশের এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন নারীটিকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

এমন ঘটনা অবশ্য বাংলাদেশে নতুন ও সর্বশেষ নয়। এখনো দেশের অনেক স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে, ডাইনি সন্দেহে, চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারার মতো ঘটনা ঘটে। আমরা পাগল বলি, মানসিক ভারসাম্যহীন বলি, অটিজম বলি, স্পেশাল চাইল্ড যা–ই বলি না কেন এমন মানসিকভাবে পুরো সুস্থ না হওয়া মানুষ কিংবা শিশুদের প্রতি আমাদের সমাজ এখনো খুব বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা মাত্র কিছুদিন থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। এখন বিষয়টি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সমাজের সাধারণ স্তর পর্যন্ত আলোচিত হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম সচেতনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানোর ফলে তার নিজ দেশ বাংলাদেশেও বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। অটিজম বিষয়ে কাজ করে সায়মা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী সুনামও অর্জন করেছেন।

আমাদের মতো দেশে আমরা রোগ বলতে শারীরিক রোগকেই বুঝি। মানসিক রোগেরও যে চিকিৎসার দরকার সে প্রয়োজনটি আমরা অনেক সময় অনুধাবন করি না, গুরুত্ব প্রদান করি না। খুব সাধারণভাবে দেখলেও আমরা বুঝতে পারব, শারীরিক কোনো রোগের কারণে মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। কিংবা মানসিক সমস্যার কারণেও অনেক সময় শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আমাদের অনেক শারীরিক রোগের কারণ হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। অর্থাৎ মনের রোগে আমরা শারীরিক অসুস্থতায় পতিত হচ্ছি।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার নানা রূপ ও স্তর আছে। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মাত্রই কিন্তু পাগল নন। অনেককে দেখে এবং প্রাথমিকভাবে মেলামেশা করেও বোঝা যায় না তার মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি। বছর তিনেক আগে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর সেন্ট্রাল হেলথের (ডব্লিউএফএস এইচ) 'কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ কাজ হারান। এসব মানুষ অনুপস্থিতি কর্মদক্ষতা হ্রাস, কাজে কম মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং ভুলে যাওয়া সমস্যায় ভোগেন।

বেশ কয়েক বছর আগে একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল 'বিষণ্নতা একটি রোগ'। তখন অনেকেই বিষয়টি কোম্পানির ওষুধ বিক্রির কৌশল হিসেবে সমালোচনা করেছিলেন। অথচ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কাজে মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ভুলে যাওয়া সমস্যায় ভোগেন। এতে একজনের গড়ে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়। ডব্লিউএফএসএইচ বলছে 'মানসিক চাপের কারণে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উপস্থিতি ও কর্মদক্ষতা কমে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাপী কর্মীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে নানা নীতি গ্রহণ করা হলেও তাতে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব পায় না। উন্নত বিশ্বে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। কিন্তু এদের ৫০ শতাংশই চিকিৎসাসেবা নেন না।

বাংলাদেশে ঢাকা–চট্টগ্রামের মতো কিছু শহরে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুবিধা পাওয়া গেলেও অন্যান্য স্থানে বা প্রত্যন্ত এলাকায় এই সুবিধা অত্যন্ত সীমিত। অর্থাৎ বিশাল জনগোষ্ঠী এই সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বরঞ্চ এসব ক্ষেত্রে পূর্ব সংস্কার, কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা এই সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে। অনেকে এজন্য ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি, তাবিজ, পানিপড়া, তেলপড়া ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। দেশের অনেক রোগী বা তাদের স্বজনরা ধর্মীয় ও সনাতন পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে গ্রাম্য বৈদ্য বা মোল্লারা অনেকের মৃত্যুর কারণও হয়েছেন।

মানসিক বিষণ্নতা ছাড়াও মানসিক রোগের আরও প্রকারভেদ আছে। যেমন মানসিক প্রতিবন্ধী। মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ বিকাশের ফলে সৃষ্ট অবনমিত বুদ্ধিমত্তা। এতে শৈশবকাল থেকেই বুদ্ধিমত্তার অভাব, বেড়ে ওঠার সময়কালে স্বল্প ও মন্থর মানসিক বিকাশ, খর্বিত শিক্ষণক্ষমতা এবং দুর্বল আচরণগত ও সামাজিক অভিযোজ্যতা দেখা দিতে পারে। এটি একটি স্থায়ী প্রতিবন্ধীতা, কিন্তু কোনো রোগ নয়। মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাষাগত, দক্ষতা অত্যন্ত দুর্বল এবং বিচার বিবেচনার ক্ষমতায়ও বিকেশিত হয় না।

আরেকটি স্তর হচ্ছে সিজোফ্রোনিয়া। উদ্ভট চিন্তা, ভগ্নমনস্কতা, সামঞ্জস্যহীন আচরণ এবং আবেগ প্রবণতা ও বুদ্ধিমত্তার অবনতি এমন উপসর্গ প্রদর্শনকারী এক ধরনের মনোবিকার। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তিকৃত অধিকাংশ রোগীই সিজোফ্রোনিয়ায় আক্রান্ত। একটি সূত্রমতে, দেশের প্রায় তের লাখের বেশি লোক এই রোগে ভুগছে।

৩.

সম্প্রতি আত্মহত্যা প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। বেসরকারি এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীর মধ্যে ১১ শতাংশ কিশোর বয়সী। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ঘরে বন্দি থাকার বিশেষ প্রভাব পড়েছে শিশু-কিশোরদের ওপর। তার ওপর আছে সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন কারণ। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ যেখানে নিজের মনের খবরই রাখে না সেখানে সন্তান-সন্ততি বা স্বজনদের মনের খবর রাখবে কীভাবে? এদেশের অধিকাংশ মানুষ তো জানেই না শরীরের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনা মহামারী শুরুর পর ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত, সর্বমোট আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এর মধ্যে ৩২২টি কেস স্টাডিতে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যা বা রোগে ভুগছে।

মনে রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য রোগী নিজে দায়ী নয়। বিভিন্ন কারণে যে কোনো ব্যক্তি মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমার পাশের মানুষটির প্রতি খেয়াল রাখা। তার আচরণ লক্ষ করা এবং প্রয়োজনে তার দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। এমন পরিস্থিতিতে রোগী নিজে বুঝতে পারেন না তার সমস্যাগুলো। ফলে পরিবারের সদস্য, বাবা–মা, বন্ধু–স্বজন ও কর্মক্ষেত্রের সহযোগীদের উচিত এ বিষয়ে এবং এ সমস্যা উত্তরণে সাহায্য করা। অবহেলা কিংবা উপেক্ষা পরিস্থিতি জটিল করে তোলে।

কোভিড-১৯ মহামারী-উত্তর বিশ্বের অনেককিছু পাল্টে যাবে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জীবনযাপন, কাজের ধরন। মানুষ সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে হয়ত। কিন্তু এই মহামারী মানুষের মনোজগতের যে ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছে তা পূরণ হতে অনেক সময় লেগে যাবে। আমরা বুঝতেই পারছি না হয়ত আমি নিজেই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছি না কিংবা পাশের বা খুব কাছের মানুষটি কেন হঠাৎ অন্য আচরণ করছে।

মহামারীর শুরুতে ধারণা করেছিলাম, পৃথিবী বদলে যাবে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, ভালোবাসা, সহমর্মিতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। মহামারীকালে মানুষে মানুষে কলহ-বিভেদ বেড়েছে, হিংসা-ঘৃণা বেড়েছে। দেশে-দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, জাতিতে-জাতিতে হানাহানি বেড়েছে। বেড়েছে পারিবারিক অশান্তিও। বোঝা যাচ্ছে মহামারী মানুষের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলেছে বেশি। ফলে কোভিডোত্তর আগামী দিনগুলো খুব ভালো যাবে না, যদি না আমরা মানবিক ও শান্তিময় একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ না করি। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে সে উদ্যোগটি নেবে কে?