তালেবান, পশ্চিমাদের পাপ ও মৌলবাদের বিপদ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 1 Sept 2021, 11:30 AM
Updated : 1 Sept 2021, 11:30 AM

গত জুলাইয়ে কৌতুকশিল্পী নজর মোহাম্মদকে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তালেবানের বিরুদ্ধে। আর গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী ফাওয়াদ আন্দারাবিকে বাড়ি থেকে বের করে এনে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের বাঘনান প্রদেশের আন্দরাব জেলার কৃষ্ণাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানের পর থেকে প্রগতিশীল নারী শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, খেলোয়াড় কাবুল থেকে পালিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ পরিবারকে ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন— কতটা ভয়াবহ অবস্থা চলছে সেখানে। একেবারেই জংলি শাসন বলতে যা বোঝায়, তাই চলছে। কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। নারীদের প্রতি সবচেয়ে বৈরি আচরণ করা হচ্ছে। নারীরা ঘর থেকে বের হলেই কঠোর শাস্তি নেমে আসছে। তারা খেলতে পারবে না। বাইরে বের হতে পারবে না। আড্ডা দিতে পারবে না। চাকরি করতে পারবে না। সেখানে গান গাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খেলাধুলার ওপরও আরোপ করা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ।

গত ১৫ অগাস্ট তালেবান কর্তৃক আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর থেকেই বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছাড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু যারা বিমানে উঠছেন, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি মানুষ রয়ে যাচ্ছেন পেছনে। বিমানবন্দরের ভেতরে ছিলেন প্রায় সাত হাজার মার্কিন সেনা আর ন্যাটো বাহিনী। তারাই ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু বিমানবন্দরের বাইরে চলেছে চূড়ান্ত অরাজকতা। তালেবান রক্ষীরা ভিড় সামলানোর চেষ্টা করলেও বিশেষ সাফল্য মিলছে না। মাঝেমাঝে এই তালেবান রক্ষীরা ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে গুলি চালান। তাতে হুড়োহুড়ি আরও বেড়ে যায়। গত কয়েক দিনে এই বিমানবন্দরের বাইরে ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন অন্তত বিশ জন স্থানীয় আফগান। আর আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন প্রায় দুই শ মানুষ।

তালেবানের কাবুল দখলের পর থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তানে ফের শুরু হচ্ছে এক অন্ধকার অধ্যায়। শুরুতে শরিয়া আইন মেনে মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে দাবি করলেও অচিরেই স্পষ্ট হয়ে যায় তালেবানের উদ্দেশ্য। এই পরিস্থিতি দেখেই আফগানিস্তানের জনপ্রিয় পপ তারকা আরিয়ানা সাঈদ দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আফগানিস্তানে অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। একের পর এক ঘটনা প্রমাণ করে দিচ্ছে শিল্প-সংগীত থেকে শত যোজন দূরে অবস্থান করতে চলেছে তালেবান শাসিত আফগানিস্তান। এখন যারা পালাচ্ছেন, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন। আর যারা দেশে আছেন, তারা ভয়াবহ শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির দায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী যখন আফগানিস্তানে তাদের দখল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তখন তালেবান ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট। তখন চীনের অবস্থানও ছিল তালেবান-বিরোধী। ৩২ বছর পর ঠিক উল্টো চিত্র। আজকের তালেবান নামক সন্ত্রাসবাদীরা চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়ার মদদপুষ্ট। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসীদের আক্রমণে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের খোঁজে এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটোর সেনাবাহিনী প্রবেশের পর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তালেবানরা পিছু হটে। তালেবানমুক্ত আফগানিস্তানের অবকাঠামোর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রিটেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করেছে। এক ধরনের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরে মার্কিন সেনাবাহিনী আফগান সেনাবাহিনীর সদস্যদের আধুনিক অস্ত্রের জোগান ও তার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যত দিন পর্যন্ত মার্কিন সেনা আফগান সেনার পাশে ছিল, তত দিন তারা সাহসের সঙ্গে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ওই দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন তা কার্যকর করার পর থেকেই রকেটের গতিতে তালেবানের পুনরুত্থান ঘটেছে এবং তার সঙ্গে একের পর এক শহর ও প্রদেশ দখল করে নিয়েছে।

দুর্নীতিগ্রস্ত আফগান প্রশাসনের কর্মকর্তারা অর্থ তছরুপের উদ্দেশ্যেই এত দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিল। যার ফলে, তালেবানের সঙ্গে আফগান সেনাবাহিনী যুদ্ধে কখনও পেরে ওঠেনি। মুখে যা-ই বলুক, তালেবান আফগানিস্তান জুড়ে ইতোমধ্যেই জঙ্গলের শাসন শুরু করে দিয়েছে। নারীদের বোরখা পরতে বাধ্য করা, কর্মস্থলে যেতে নিষেধ করার মতো নানাবিধ ফতোয়া জারি শুরু হয়ে গিয়েছে। নারীরা ভয়ে-আতঙ্কে ঘরের ভেতর দুঃসহ সময় কাটাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, তালেবান, আইএসসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে পশ্চিমা শক্তির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। আল কায়েদা, তালেবানের মতো জঙ্গিসংগঠনগুলো প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সহযোগিতায় গড়ে ওঠে। আফগানিস্তানে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে খর্ব করতেই এই জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সৃষ্ট সেই জঙ্গিরা ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটায়। এরপরই যেন বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থা তছনছ হয়ে যায়। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে এই ঘটনার একটা ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এই আক্রমণের রেশ টেনে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পশ্চিমারা প্রথমে আফগানিস্তান পরে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছে। তালেবানদের আশ্রয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে কেনিয়া ও তানজানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে হামলার অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালায়। কিন্তু এর পেছনে এদের একটা বৃহৎ স্বার্থ কাজ করেছে, মধ্য এশিয়ার মুসলিম বিশ্বের খনিজ সম্পদ তথা তেল সম্পদের ওপর তাদের আধিপত্য কায়েম করা।

আর এরই প্রেক্ষিতে 'বুশ-সাম্রাজ্যবাদ' এর বিরোধিতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে 'আল্লাহর আইন' কার্যকর করার জন্য পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে, ইহুদি-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। জিহাদের অংশ হিসেবে চলে সন্ত্রাসবাদ, বোমা হামলা, নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। আর এরাই সমাজে জঙ্গি বলে স্বীকৃতি পায়।

৯/১১-এর জঙ্গি হামলার জের যেন এখনও থেকে গেছে। বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটে চলেছে একের পর এক হামলা। তা সে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক-সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ, নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বোকো হারাম মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য, বাংলাদেশের জেএমবি, জামায়াত, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ নানা নামের সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী, ভারত-পাকিস্তানে লস্কর-ই তৈয়ব, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন কিংবা আফগানিস্তানের তালেবান অথবা আইএস-এর হামলা।

মৌলবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাম্রাজ্যবাদী এবং ফ্যাসিস্টরাই মৌলবাদকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদকে যারা সমর্থন বা প্রশ্রয় দেয়, সেই দেশের পরিণাম কী হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতেও বিশ্বের অমিত শক্তিধর দেশগুলো নীরব। তালেবানের কাঁধে বন্দুক রেখে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা কায়েম করতে চাইছে। অথচ এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা নাকি যার একমাত্র উদ্দেশ্য, সেও ভূমিকাহীন। উল্টে সারা বিশ্বের যত জঙ্গি সংগঠন, সবাই আফগানিস্তানে এসেছে। একজোট হয়েছে। বৃহৎ কোনো লক্ষ্য নিয়ে তারা কোনো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক জঙ্গি কার্যকলাপের পরিকল্পনা করবে, এ আশঙ্কা থেকেই যায়। কট্টর ধর্মব্যবস্থা সর্বদাই প্রগতিকে রুখতে চায়। সে তার প্রাগৈতিহাসিক সৃষ্টির সময় থেকেই যা রপ্ত করেছে, যা কিছু অর্জন করেছে, সেটাকেই চিরকালীন ব্যবস্থা বলে মনে করতে চায়। তাই সে যুক্তিকে অস্বীকার করে। বিজ্ঞান চেতনাকে তার পথে বাধা মনে করে। বিরুদ্ধ মত সে সহ্য করে না। এ ভাবেই তৈরি হয় ধর্মীয় মৌলবাদ। পৃথিবীতে সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য এক— নারী স্বাধীনতার বিরোধিতা, পুরুষদের বহুবিবাহ, নারীদের বাল্যবিবাহ, জাতিগত বিভাজন। নানাবিধ সংস্কারে সব ধর্মই আক্রান্ত। ধর্মীয় মৌলবাদ সব সময় আমাদের পেছনের দিকে টানছে, মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করছে, আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে একটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা দিয়ে বেঁধে রেখেছে।

আফগানিস্তানের তালেবান উত্থান মানব সভ্যতার জন্য কোনো সুসংবাদ নয়। এখন আমাদেরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এ রকম একটা উদাহরণ সামনে আসার পর আমাদের দেশের মানুষ, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠনকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশ ধর্মীয় মৌলবাদের উর্বর ভূমি। ধর্মীয় উন্মাদনার প্রসার ঘটানো আমাদের দেশে খুব সহজ। আফগানিস্তানের মতো পরিণতি আমাদের দেশেও হতে পারে। এখানে তালেবানের মতো সশস্ত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী নেই-বলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। পাশের ঘরে আগুন লাগলে তার আঁচ নিজের ঘরেও লাগতে বাধ্য।