বরিশালের পর নতুন কী?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 26 August 2021, 01:54 PM
Updated : 26 August 2021, 01:54 PM

দেশে রাজনৈতিক ডামাডোল তেমন না থাকলেও একের পর এক উত্তেজনাকর খবর ঠিকই তৈরি হচ্ছে। করোনাভাইরাস গত প্রায় দেড় বছর ধরে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে। সরকার কোভিড মোকাবিলা করছে সরকারের মতো করেই। মানুষের মধ্যে খুব সন্তুষ্টি না থাকলেও সরকার মোটামুটি করোনা নিয়ে  অসন্তুষ্ট নয় বলেই মনে হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং তার মন্ত্রণালয় নিয়ে বিস্তর অভিযোগ-অনুযোগ থাকলেও দিব্যি সব কিছু চলে যাচ্ছে। কোভিড প্রতিরোধের জন্য টিকা নিয়েও কেচ্ছা-কাহিনী কম নয়। টিকার জন্য ভারত-নির্ভরতার অপবাদ দূর করে চীন-নির্ভরতা বেড়েছে। 

তাতে একটা লাভ হয়েছে। টিকা নিয়ে চীনের সঙ্গে কিছু সমস্যা হলেও সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে হয়তো পড়বে না। কারণ আমাদের দেশে যেমন অকারণ ভারতভীতি আছে, আর আছে যুক্তিহীন চীনপ্রীতি। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, বিপদের দিনে সহায় ছিল আর চীন ছিল বিরুদ্ধে আমাদের শত্রুর মিত্র হয়েছিল। কিন্তু সেসব এখন অতীত। অতীতমুখী না হয়ে আমরা এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে পড়েছি। যার কাছ থেকে আমরা বেশি পাবো, তার সঙ্গেই আমাদের দহরমমহরম বেশি হবে। ভারতের চেয়ে এখন চীনের দেওয়ার ক্ষমতা বেশি।

যাক আজকের আলোচনার বিষয় করোনাও নয়, ভারত কিংবা চীনও নয়। আজ একটু বরিশালের দিকে নজর রাখব। এক সময় শুনতাম 'আইতে শাল, যাইতে শাল – তার নাম বরিশাল'। কেন বরিশাল নিয়ে এমন  বাক্য তৈরি হয়েছিল, তা আমার জানা নেই। তবে অতি সম্প্রতি রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বরিশাল সারাদেশে আলোচনার শীর্ষে এসেছে। কয়দিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন অভিনেত্রী পরীমনি। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য যে বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল, যেভাবে র‌্যাবের মতো একটি এলিট বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য পরীমনির বাসভবন ঘেরাও করেছিল, তাতে মনে হয়েছিল পরীমনির বাসায় বুঝি আরেকটি হলি আার্টিজানকাণ্ড ঘটতে চলেছে। চার ঘণ্টার অভিযানে পাওয়া গেছে মদের বোতল এবং আরও কিছু নেশাদ্রব্য। মদ খাওয়া, মজুদ করার অপরাধে পরীমনিকে আটক করে তিন তিনবার রিমান্ডে নেওয়া, জামিন না দেওয়া এবং বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তার সম্পর্কে নিন্দা-কুৎসা ছড়িয়ে তাকে 'নষ্ট' নারী এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধী, সমাজবিরোধী হিসেবে প্রমাণের উদ্দেশ্যমূলক অপচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে তার কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে। পরীমনিকে হেনস্তার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিজের হাতে তুলে নিয়েছে বলে বিশিষ্টজনেরাও মনে করছেন। ঘটনার পেছনের ঘটনা কী তা অবশ্যই অজানাই রয়েছে। পরীমনিকাণ্ডে বাড়াবাড়ির জন্য সরকার অস্বস্তি বোধ না করলেও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে বরিশালকাণ্ড।

না, বরিশালে বালিশ, পর্দা বা গাছকাণ্ডের মতো কোনো কেনাকাটায় অনিয়ম বা দুর্নীতির ঘটনা থেকে তোলপাড় হয়নি। সেখানে সামান্য কয়েকটি ব্যানার সরানোকে কেন্দ্র করে যে মারমার কাটকাট অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা এক কথায় অভাবনীয়। একটি ছোট ঘটনা কী করে শুধু বড় নয়, অতিবড় হয়ে উঠতে পারে, বরিশালে তা দেখা গেছে। বরিশালে জেলা পরিষদ চত্বর ১৮ অগাস্ট রাতে ব্যানার সরাতে গিয়েছিল সিটি করপোরেশনের একটি টিম। বরিশাল সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিবুর রহমান নাকি রাতে না সরিয়ে পরের দিন সকালে ব্যানার সরাতে বলেছিলেন। এতে কিছু কথাকাটি-বচসা হয়। কিন্তু এর জের ধরে ইউএনওর বাসভবনে হামলা করেন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মীরা। হাতাহাতি ধস্তাধস্তির মধ্যে ঘটনা সীমাবদ্ধ থাকেনি, আনসার ও পুলিশের গুলি বর্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। সিটি মেয়র ঘটনাস্থলে গিয়ে মিটমাটের উদ্যোগ না দিয়ে নাকি আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করেন। বরিশাল শহরে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। সিটি মেয়রকে প্রধান আসামি করে ইউএনও এবং পুলিশ বাদি হয়ে দুটি মামলা করায় কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয় দ্রুততার সঙ্গে। পরে অবশ্য ইউএনও এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও পাল্টা মামলা হয়েছে।

প্রথম দিকে সিটি মেয়র এবং তার সমর্থক যারা ইউএনওর বাসভবনে হামলা করেছিলেন তাদের ওপর বেশি দায় চাপানোর একটি ঝোঁক লক্ষ করা গেলেও হাওয়া বদলে যেতে থাকে ঘটনা নিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সভা করে 'চটজলদি' অত্যন্ত  কড়া ভাষায় বিবৃতি দেওয়ায় পর। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সভাপতি, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবীর বিন আনোয়ার, তিনি ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন বলে শোনা যায়। বিবৃতিতে হামলাকারীদের 'রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত' বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সিটি মেয়র সম্পর্কেও এমন সব মন্তব্য করা হয় যা অনেকের কাছেই বিষোদগারমূলক ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। বিবৃতির ভাষা ব্যবহারকেও 'রাজনীতিসুলভ' মনে করেছেন প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। সচিবরাও এই বিবৃতির সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। 

তবে বাংলাদেশের মানুষ সব সময় ঘটনা এবং রটনাপ্রিয়। বরিশালে রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েও গালগল্প ছড়াতে সময় লাগেনি। কোন পক্ষ বাড়াবাড়ি করেছে, কার দোষ বেশি – আলোচনা থেকে এসবও বাদ যায়নি। সরকারের জন্য বরিশালের ঘটনা ছিল অস্বস্তিকর। সরকারি দল এবং সরকারি প্রশাসনের অবস্থান মুখোমুখি বা দ্বন্দ্বমূলক হলে সরকারের কাজকর্ম গতি হারায় এবং এতে সরকারেরই সুনামহানি হয়। দল এবং প্রশাসন পরষ্পর নির্ভরশীল। বরিশালের মেয়র যেমন সরকারি দলের নেতা এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, তেমনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও সরকারেরই প্রতিনিধি। উভয়ে মিলেমিশে কাজ না করলে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক। বরিশালে তাই হয়েছে।

বলা হচ্ছে, সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের দ্বন্দ্বের কারণে বরিশালে সরকারি প্রশাসনও কার মন জুগিয়ে চলবে তা অনেক সময় বুঝতে পারে না। উপজেলা পরিষদ চত্বরে যে ব্যানার টানানো ছিল সেগুলো ছিল সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থকদের। আর তা সরাতে গিয়ে যারা বিবাদে জড়ান তারা মেয়রের অনুসারী। এখন সরকারি দলের মধ্যে যদি এমন গ্রুপিং বা কোন্দল না থাকতো তাহলে হয়তো বরিশালে তিল থেকে তাল নাও হতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে শুধু বরিশালে নয়, দেশের প্রায় সব জায়গায়তেই আওয়ামী লীগ আর একটি ঐক্যবদ্ধ দল নেই। উপদলীয় কোন্দল-বিরোধে আওয়ামী লীগ জর্জরিত। এসব কোন্দলের বহির্প্রকাশ কোথাও কোথাও এমনভাবে ঘটছে যা সরকারের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটানোর ক্ষেত্রে দলের মধ্যে অজ্ঞাত কারণে যে নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়, তা আসলে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা ভাবার সময়ও বুঝি কারো নেই।

প্রসঙ্গত নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরের কথা উল্লেখ করা যায়। ওই এলাকায় দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক-সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই কাদের মির্জা গত প্রায় এক বছর ধরে যা সব করছেন, যেসব কথা বলছেন তা আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের জন্য ক্ষতিকর হলেও কাদের মির্জাকে থামানোর কোনো উদ্যোগ- চেষ্টা বা গরজ  দেখা যায় না। 

গত ২১ অগাস্ট বিকেলে নোয়াখালীতে এক সমাবেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী  বলেছেন, "যে সমস্যার সৃষ্টি হইছে, ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো নয়। আমি ওবায়দুল কাদের সাহেবকে অনুরোধ করব, প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং করেন, বিএনপিকে দোষারোপ করে প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং করা খেমা দেন (বন্ধ করেন)। নিজের দলটাকে আগে ঠিক করেন। প্রত্যেক জেলা থেকে ২০ জন করে যদি আপনি ডাকেন,  আমাদের নোয়াখালী থেকে ২০ জনকে নেন, ওই এক দিনই একটা সমাধান করে দিতে পারেন। কিন্তু আপনি বসে  তামাশা দেখতেছেন।" 

নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রসঙ্গে খায়রুল আনম চৌধুরী বলেন, "শুধু জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ দিয়ে সত্য টিকে থাকবে না। সত্য টিকাতে হলে যারা আজকে ভুল বুঝে আছে অথবা আমরা ভুল বুঝে আছি, সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। কাদের ভাই, আপনি ডেইলি প্রেস ব্রিফিং করেন, আপনি কি একটা দিনও নোয়াখালীর খবর রেখেছেন? কেন নোয়াখালীতে তিন গ্রুপ? ১৫ আগস্ট তিন গ্রুপ হয়? ২১ অগাস্টে তিন গ্রুপ হয়?  খবর রেখেছেন? রাখেননি। প্রয়োজনও মনে করেন না। আপনাদের ক্ষমতা আছে, মন্ত্রিত্ব আছে, সব থাকবে।"

কারো কারো অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিদের এড়িয়ে সরকারের আমলা নির্ভরতা দৃষ্টকটূভাবে বেড়েছে। সরকারি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশাসন কখনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাইরে হতে পারে না। সব কিছুরই সীমা বা গণ্ডি আছে। আমলাদেরও আছে বিধিবিধান, এক্তিয়ার। কিন্তু ক্ষমতা চর্চায় আমলারা অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এমনকি জনপ্রতিনিধিদেরও প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন বা উঠতে দেওয়া হয়েছে। ফলে মাঠ প্রশাসনে মাঝেমধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেও বিরোধ তৈরি হয়। প্রশাসনের অতিরিক্ত ক্ষমতা চর্চায় রাজনীতিবিদদেরও যে বিরক্তি ও অস্বস্তি আছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সংসদে গত ২৮ জুন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজন সংসদ সদস্যদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে।

উপর মহলের চাপে হোক বা শুভ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে হোক, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতায় ২২ অগাস্ট গভীর রাতে একটি আপস-সমঝোতা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত বরিশালের ঘটনার উত্তাপ কমলেও এর পর দেশের অন্য কোথাও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সবাই যদি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন তাহলে অরাজক অবস্থা তৈরির আশঙ্কা থাকে। যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, তাদের মর্জি-মেজাজ নিয়ন্ত্রণ রাখার কৌশল রপ্ত করার উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে, তাদের আমলাদের সহযোগিতা লাগবে। আবার আমলাদেরও বুঝতে হবে রাজনীতিবিদরাই তাদের চালনা করবেন। তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ নন, পরষ্পর সহযোগী। সহযোগীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তাতে 'আলটিমেট' লাভ কারো হয় না। বুঝহ সুজন, যে জানো সন্ধান!