বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে অবস্থান

অপর্ণা হাওলাদারঅপর্ণা হাওলাদার
Published : 20 August 2021, 01:34 PM
Updated : 20 August 2021, 01:34 PM

বাংলাদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে এবং কানাডা/আমেরিকার কিছু উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা এবং গবেষণার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু প্রস্তাবের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। গত কয়েকদিনে, অন্য বছরগুলোর মতোই বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো অবস্থান না থাকা নিয়ে হাহাকার চলছে। শিক্ষার সাথে জড়িত অনেকেই এ নিয়ে মন্তব্য করেছে, অনলাইনে সাধারণ মানুষের হরদম কৌতুকও চলছে। চলাটাই যদিও স্বাভাবিক, এই তুলনা আমাদের কাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং তা নিয়ে সচেতনতার প্রয়োজন বোধ করি আমিও। পত্রপত্রিকায় অনেকেই দেশ বিদেশ থেকে র‍্যাংকিংয়ে কীভাবে ওপরে ওঠানো যাবে তা নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাইদের জন্য একটি অনলাইন লিস্ট তৈরি করার চেষ্টা করছে বাইরে যারা থাকেন, তাদের বর্তমান অ্যাফিলিয়েশনসহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনে করছে এমন একটি লিস্ট তাদেরকে বাইরের র‍্যাংকিংয়ে ওপরে উঠতে সাহায্য করবে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাইরের জার্নালে লেখা বা গবেষণা প্রকাশ করার জন্য শিক্ষকদের প্রণোদনার কথাও কিছু বলছে। ২০০০ ডলার পর্যন্ত দেওয়ার ঘোষণার কথাও শুনেছি।

এ প্রেক্ষিতে আমার প্রস্তাবনা প্রকাশ করছি। সংক্ষেপে, আমার মূল বক্তব্য দুইটি

১. বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল সমস্যাটি বাইরের র‍্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান নয়, আমাদের সমস্যা আরও গভীরএবং গোড়ার গলদ না মিটিয়ে বাইরে বিশ্বর‍্যাংকিংয়ে নিজেদের অবস্থান ওপরে উঠানোর চেষ্টা করাটা দূরদর্শী মনে করি না।

২. বাইরের র‍্যাংকিংয়ে ওপরে ওঠানোর পন্থা যদি এই হয় যে আমরা দেখাব আমাদের অ্যালামনাইদের অ্যাফিলিয়েশন, সেটা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার ও গবেষণার মান বাড়াবে না। আমাদের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বাইরে আছেন বহু বছর ধরে, তাদের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে অ্যাফিলিয়েশনও আছে। এগুলো মূলত ব্যক্তিগত অর্জন, এর ভিত্তিতে আমাদের প্রতিষ্ঠানের মান বিচার করা যায় না।

প্রথমে, কথা বলা যাক, বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষার মান কেমন। এই লেখার পেছনে আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের সাহায্য নিয়েছি। দেশের উচ্চশিক্ষার সিলেবাস কয়েক দশকে একবারও বদলানো হয় না। টেক্সটবইগুলো দেশের সমস্যার প্রেক্ষিতে লেখা নয় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিভাগে পড়েছি, তার পড়ানোর স্টাইলে বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা নিয়ে কথা মোটামুটি অনুপস্থিত ছিল। পরীক্ষার ধরন মুখস্থভিত্তিক এবং প্রশ্নপত্র প্রাগৈতিহাসিক। শিক্ষকদের বাইরে একজন এক্সটার্নাল অনেকটা ক্ষমতা রাখেন ফলাফল বিবেচনায়। আবার, পরীক্ষার্থী হিসেবে খাতা দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। তুলনায়,  আমেরিকায় আমার পিএইচডির প্রতিটি পরীক্ষার খাতা আমাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে হয়  গবেষণাভিত্তিক। গবেষণার সুযোগ তো পরের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারের ব্যবস্থাই নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক ব্রিটিশ আমলের, আধুনিকায়নের অনেক বাইরে। প্রশ্ন করাকে প্রবলভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়, পরীক্ষায় চিন্তাক্ষমতার বা ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের কোনোই প্রয়োজনীয়তা নেই।

পড়ানোর ধরন, প্রশ্নপত্র, গবেষণার বাইরে দুইটি বিষয় আমি আরও উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণভাবে নারী অবান্ধব। পুরুষ সহপাঠীর যেভাবে শিক্ষকদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং মেন্টরিংয়ের সুযোগ থাকে, সেটা নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নেই। নারী শিক্ষকদের অপ্রতুলতা, প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের নারী শিক্ষার্থীরা অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য এবং দর্শন ছিল দেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা। এই একটি বিষয় আমি খুব গর্বের সাথে স্মরণ করি, কারণ আমি দেখেছি আমেরিকায় টিউশন ফি কত বেশি এবং কীভাবে নিম্নবিত্ত মানুষ উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আবার আমি এটাও দেখেছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শ্রেণি থেকে মানুষ আসলেও ভালো রেজাল্ট কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণিতে আবদ্ধ। খুব নিম্নমানের হলব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রেশার, নিম্নমানের লাইব্রেরি সুবিধার কারণে অনেক মফস্বল বা গ্রামের ছেলেমেয়ে এখানে পড়তে এসে আর ভালো করার সুযোগ পাচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষেও আমি দেখেছি শিক্ষকদের চকমক করে এমন কিছু ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কেবল দৃষ্টি দিতে। ভাষার আঞ্চলিকতা, পোষাকের ভিন্নতা এইসব বৈষম্য থেকে আমরা যদি "এডুকেটর" হিসেবে না উতরাতে পারি, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব না।

এই গেল বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং গবেষণার অনুপস্থিতি নিয়ে কথা। এখন, কথা বলা যাক, বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ের কারণ এবং এর প্রয়োগ নিয়ে। এই বিশ্বর‍্যাংকিংগুলো মূলত তৈরি হয় ছাত্রছাত্রী এবং ফান্ডিং এজেন্সিকে উৎসাহিত করার জন্য। এর পেছনে থাকে শিক্ষক ও গবেষকদের গবেষণার মান (সাইটেশন, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ইত্যাদি), শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার অপরচুনিটি, রিসার্চ ফান্ডিংয়ের সুবিধা এসব ইনডেক্স। এই র‍্যাংকিংয়ে ওপরে ওঠার জন্য আমরা কি আমাদের সীমিত সম্পদ শিক্ষকদের জার্নাল পাবলিকেশনের জন্য দেব নাকি সেই টাকা দিয়ে আমাদের জন্য গবেষণার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, শিক্ষার্থীদের জন্য লাইব্রেরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার পেছনে ব্যয় করব? আমার মতে, দ্বিতীয়টির পেছনে খরচ করলে প্রথমটি এমনিতেই হবে। আমাদের প্রয়োজন, নিজেদের জার্নালের মান বাড়ানো, প্রয়োজনে খোলনলচে বদলে আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল প্রকাশ করা। আমাদের প্রয়োজন দেশের মধ্যে গবেষণার মান এতটাই বাড়ানো যে রিসার্চ ফান্ডিং আসে, ভালো গবেষকরা আসতে আগ্রহী হয়। দেশের বাইরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকলে আমাদের র‍্যাংকিংয়ে মান তো বাড়বেই না, দেশের শিক্ষার মানও আরও নিচে নামবে।

বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক সার্ভিস। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত

১. আমাদের নিজেদের সিলেবাস যেন এমন হয় যেটা আমাদের সমাজ এবং আমাদের প্রয়োজনকে বোঝে। আমাদের টেক্সটবুক যেন আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে লেখা হয়, বাইরের টেক্সটবুকের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব চিন্তাধারার প্রয়োজন।

২. আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মতো করে গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করা।

৩. আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মান নিশ্চিত করা, বিভিন্ন বৈষম্য কমানো।

৪. আমাদের নিজেদের মানসম্পন্ন জার্নাল প্রকাশ করা।

বাইরের বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের দিকে চেয়ে হা-হুতাশ করে হঠাৎ কোনো পদক্ষেপ নেওয়াটা আমাদের হঠকারিতা হবে। গোড়ার গলদ না ঠিক করে বাইরের দিক চকচক দেখানোর মতো, এতে ভবিষ্যতে মঙ্গল হবে না বলে আমার বিশ্বাস।