হুমায়ূন আহমেদ: শুধুই কি জনপ্রিয়?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 20 July 2021, 02:24 PM
Updated : 20 July 2021, 02:24 PM
দেখতে দেখতে  ৯ বছর চলে গেল হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত নেই । তিনি ২০১২ সালের ১৯ জুলাই আমেরিকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৩ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে অগণিত মানুষের মধ্যে তুমুল দুঃখ ও বেদনাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি অবশ্য তার লেখা উপন্যাস, গল্প, নাটক, সিনেমার মধ্যে পাঠক, দর্শক-শ্রোতা তথা ভক্ত-অনুরাগীদের মনে চিরঞ্জীব থাকবেন বহু বছর, বহু যুগ।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় যতটুকু ছিল সেটা উল্লেখ করার মতো নয়। দু-একবার পেশাগত কারণে তার বাসা ধানমণ্ডির 'দক্ষিণ হাওয়া'য় গিয়েছি। কথা হয়েছে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই। ফোনেও যোগাযোগ হয়েছে বার কয়েক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তার 'নন্দিত নরকে' এবং 'শঙ্খনীল কারাগার' পড়ে যথেষ্ট মুগ্ধ ও উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। তার সম্পর্কে তখন বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সেটা অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। তবে তার কয়েকটি টিভি নাটক- এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই – আগ্রহ নিয়ে এবং মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। বলা যায়, তার নাটক দেখতে গিয়েই আমার টিভি দেখার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। তবে আমার পাঠাভ্যাস তাকে কেন্দ্র করে নয়। তার নির্মিত চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা দেখেছি এবং ভালো লেগেছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'জোছনা ও জননীর গল্প', '১৯৭১' পড়েছি উৎসাহ নিয়েই।
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, হুমায়ূন আহমেদ একজিন জনপ্রিয় লেখক। বড় ধরনের সেলিব্রেটি। ফলে তার ঘরের খবর থেকে শুরু করে তার বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের খবর, তাকে নিয়ে নানা কথা-কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, পাঠকরা তা পড়েছেন। তিনি যে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বইমুখী করেছেন অর্থাৎ একটি বড় পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছেন, দেশের প্রকাশনা শিল্প যে তার হাত ধরে নতুন মাত্রা পেয়েছে, পাঠকদের কলকাতা-নির্ভরতা কমাতেও যে তার বড় অবদান, টেলিভিশন নাটককে জনপ্রিয় করা, মধ্যবিত্ত ও রুচিবান দর্শকদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী করে তোলা- এসব ক্ষেত্রে তিনি একাই পালন করেছেন অনেকের ভূমিকা। তিনি যে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন, বন্ধুদের আড্ডায় তিনিই যে থাকতেন মধ্যমণি, অনেক সিরিয়াস কথাও যে তিনি খুব সহজভাবে মজা করে বলতে পারতেন, তাকে দেখে বাইরে থেকে যতটা গম্ভীর মনে হতো আদতে তিনি যে তেমন ছিলেন না, ছিলেন কৌতুক প্রিয় এবং কিছুটা খেয়ালি স্বভাবের – এসব কথাও এখন আর কারো অজানা নয়। তার সৃষ্ট অসাধারণ চরিত্র মিসির আলী কিংবা হিমুর কথা কার না জানা! কিছু মানুষের এমন জাদুকরী প্রভাব থাকে যা অন্যকে ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ করে, কাছে টানে, ইচ্ছে করলেও তাদের এড়িয়ে যাওয়া যায় না। হুমায়ূন আহমেদও সম্ভবত সে রকমই একজন।
জাতি হিসেবে আমরা খুবই আবেগ ও উচ্ছ্বাসপ্রবণ। আতিশয্য বাঙালির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কারো নিন্দার ক্ষেত্রে যেমন আমরা নিষ্ঠুর, তেমনি প্রশংসার ক্ষেত্রেও কখনো কখনো অকৃপণ। বিশেষত কেউ মারা গেলে তাকে নিয়ে আমাদের মাতামাতির শেষ থাকে না। হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি যেহেতু অসম্ভব জনপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন, যেহেতু দেশে-বিদেশে বাঙালি সমাজে রয়েছে তার বিরাট ভক্তকুল- সেহেতু তার মৃত্যুতে বড় ধরনের আলোড়ন, মাতম হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। হয়েওছিল তা। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর পেয়ে পশ্চিমবাংলার খ্যাতিমান সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'আমি তো তাকে বলতাম, শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তাকেও হার মানিয়েছো'।
সুনীলের এই মূল্যায়ন কারো কাছে অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে। তবে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা যে অনেক আগেই ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা  স্বীকার না করে উপায় নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য কতটা কালোত্তীর্ণ সেটা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তার সাহিত্য কতটা উচচমানের সেটা নিয়ে বিদগ্ধ মহলে চলতে পারে বিতণ্ডা। কিন্তু তার লেখা যে বিপুল সংখ্যক পাঠকের মনে বিপুল নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে তা নিয়ে তো সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবেন না। মৃত্যুর এত বছরও পরেও তার বইয়ের বিক্রি কমেনি। 
কোন কোন উপন্যাস বা অন্য কোন সৃষ্টি কর্মের জন্য হুমায়ূন আহমেদ পাঠকদের কাছে দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা হয়তো কঠিন। তবে তার একাধিক উপন্যাস, ছোট গল্প, সায়েন্স ফিকশন যে পাঠকদের বর্তমান সময় থেকে আরো অনেক সময় পরেও একইভাবে টানবে, নাড়া দেবে সেটা বলা যায় নিশ্চিত করেই। উপন্যাসের জন্য, নাকি নাটকের জন্য, নাকি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সময় এখনই নয়।
আমাদের একটি জাত-বৈশিষ্ট হচ্ছে, কেউ সুনাম কুড়ালে তার গায়ে একটু দুর্নামের কালি লেপে দেওয়ার সুযোগ খোঁজা। ভাবটা এই রকম, ও আমাকে ছাড়িয়ে যাবে, দেখি না ওকে একটু হারিয়ে দিতে পারি কি-না! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তার সময়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার লোকের অভাব ছিল না। এগুলো যে রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেনি তাও নয়। কারণ যত যাই হোক তিনি তো রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন। আঘাত দিলে ব্যথা পায় না এমন শরীরী মানুষ পাওয়া যাবে কোথায়? হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও হাসি-তামাশা করার লোকের অভাব না থাকারই কথা। 
প্রসঙ্গত একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আশির দশকের কোনো এক সময়ের কথা। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা তখন এখনকার মতো আকাশচুম্বী হয়ে ওঠেনি। তবে পাঠকপ্রিয়তা তিনি অর্জন করতে শুরু করেছেন এবং প্রকাশকের কাছ থেকে গাড়ি উপহার পেয়েছেন। সে সময় একদিন নবাবপুর রোডের একটি প্রেসে হুমায়ূন আহমেদ এবং বাংলা সাহিত্যের আরেক ক্ষমতাধর লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ নিজ নিজ গ্রন্থের প্রুফ সংশোধনের কাজ করছিলেন। আমিও ওই প্রেসে গিয়েছি একুশে সংকলন বা অন্য কোনো কিছু ছাপানোর কাজে। হুমায়ুন আজাদ বা হুমায়ূন আহমেদ কারো সঙ্গেই তখন আমার তেমন ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না । তবে চিনতাম দু'জনকেই। তারা দু'জন দুই টেবিলে বসে প্রুফ দেখছিলেন। আমি আরেকটি টেবিলে বসে আমার কাজ করছি। হুমায়ুন আজাদ হঠাৎ কিছুটা উচ্চস্বরে যেন আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যই বললেন, আমাদের দেশে যে একজন 'অপন্যাসিক' জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেটা জানেন? আমি তার দিকে চোখ ফেরালাম কিন্তু আমার মুখে অজ্ঞতার ছাপ লক্ষ করে তিনি একটু দূরে বসে নীরবে পাণ্ডুলিপি সংশোধনে ব্যস্ত হুমায়ূন আহমেদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, বালকরাই নাবালকদের জন্য লেখে! 
এ ধরনের মন্তব্য আমার ভালো লাগেনি। পরে অবশ্য হুমায়ুন আজাদ পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রকাশ্যেই হুমায়ূন আহমেদকে 'অপন্যাসিক' বলে বিদ্রুপ করেছেন। হুমায়ুন আজাদ নিঃসন্দেহ প্রতিভাবন লেখক ছিলেন। তবে তিনি যেভাবে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিভা নিয়ে উপহাস করেছেন, সেটা কাম্য ছিল না। কেবল হুমায়ুন আজাদ কেন – নিজের রচনার সাহিত্যমান নিয়ে একই ধারার সমালোচনা হুমায়ূন আহমেদকে আরো অনেকের কাছ থেকেই শুনতে হয়েছে। এসব সমালোচনা তাকে ব্যথিত করেনি, এমন দাবি কেউ করলে সেটা যথার্থ হবে না। কারো কটাক্ষ কিংবা বিরূপ সমালোচনায় বিচলিত না হয়ে তিনি কলম সচল রাখতে পেরেছিলেন বলেই জনপ্রিয়তায় সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন। তাকে ছোট করতে চেয়ে কেউ কিন্তু তার থেকে বড় হতে পারেননি।
হুমায়ূন আহমেদ সৃজনশীলতার যে জায়গায় হাত দিয়েছেন সেখানেই বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি স্লোগানধর্মী রাজনৈতিক সাহিত্য রচনা করেননি বটে, কিন্তু তরুণ পাঠকদের মনোভূমিতে তিনি তার সহজাত সরসভঙ্গিতে চেতনার যে বীজ বপণ করে দিয়েছেন, তার মূল্য অপরিসীম। তিনি তার রচনায় অন্ধতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে যুক্তিবাদিতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের (রসায়ন) শিক্ষক ছিলেন। তাই বলে তার কোনো লেখায় পাঠকদের 'শিক্ষা' দেওয়ার মতো কোনো কিছুর প্রতিফলন লক্ষ করা যায়নি। তার লেখার ঢং সিরিয়াস নয়, কিন্তু তা বলে বক্তব্য হালকা নয়। আমার বিবেচনায় তার লেখা পড়েই নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠার শিক্ষা নিয়েছেন। তার লেখায় কদর্যতা নেই, নিষ্ঠুরতা নেই, আছে উদারতা, সরলতা, মানবিকতা। তিনি অনেককে, হাজার হাজার, লাখ লাখ পাঠককে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ চিনিয়েছেন, রাজাকারদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন।
যারা তাকে প্রবলভাবে, অন্ধভাবে ভালোবাসেন, তাদের প্রতি অনুরোধ: তার রচনাগুলো কেবল পড়তে ভালো লাগে, মজা লাগে বলে না পড়ে একটু সিরিয়াসলি পড়ুন। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভুলিয়ে দিতে চায়, দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে চায় তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করার মধ্য দিয়েই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হবে। কয়েকদিন তাকে নিয়ে মাতম করে, তিনি অমুক, তিনি তমুক ইত্যাদি বাগাড়ম্বর করে তারপর পাঠবিমুখ, যুক্তিবিমুখ হয়ে দিনযাপনের গতানুগতিকতায় চলতে থাকার মূঢ়তা যেন হুমায়ূনভক্তদের পেয়ে না বসে। আধুনিক ও পরিশীলিত মানুষ হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে পারলেই হুমায়ূন-পাঠ সার্থক হবে।