স্বাধীনতার ৫০ বছর: মুঠোভরে দিয়ে আলো-আশাহীন বক্সার মোশাররফ

নাজমুল হক তপন
Published : 23 March 2021, 10:06 AM
Updated : 23 March 2021, 10:06 AM

"খবরে দেখি, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কত মানুষ কত সাহায্য পায়। আমার চলার শক্তি নাই। আর্থিক সংগতিও নাই। প্রতিদিন ফিজিওথেরাপি নিতে হয় দুইবেলা। ঢাকায় থেকে যদি সিআরপিতে চিকিৎসা সেবাটুকুও নিতে পারতাম, তাহলে মনে হয় শরীরের কিছুটা উন্নতি হত। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত আমার এই দুর্দশার খবর পৌছালে অবশ্যই সাহায্য পেতাম।"

এগুলো স্রেফ হতাশা-আক্ষেপ নয়; আর্তনাদের চেয়েও বেশি কিছু। যিনি বললেন, তিনি আর কেউ নন, এশিয়ান গেমসের ইতিহাসে দেশকে প্রথম পদক এনে দেওয়ার কীর্তি গড়া বক্সার মোশাররফ হোসেনের। দেশকে মুঠোভরে দিয়ে আজ যিনি আলোহীন, রিক্ত!

১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম পদক জয়ের কৃতিত্ব দেখান মোশাররফ। এরপর গত সাড়ে তিন দশকে এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের আসরে ব্যাক্তিগত ইভেন্টে পদক জিততে পারেনি বাংলাদেশের কোন ক্রীড়াবিদ। পদক যা এসেছে, তার সবই দলগত খেলায়। 

এশিয়ান গেমসে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্জন ১২টি পদক। এর মধ্যে একমাত্র স্বর্ণ, ক্রিকেট থেকে। ২০১০ সালে গুয়াংজু গেমসে সোনা জেতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এছাড়াও দুটো রুপা আর একটি ব্রোঞ্জ এসেছে ক্রিকেট থেকে। কাবাডি থেকে এসেছে তিনটি রূপা ও চারটি ব্রোঞ্জ। এশিয়ান গেমসে গত সাড়ে তিন দশকের খেরোখাতায় মোশাররফের পদকটিই ব্যক্তিগত ইভেন্টে পাওয়া একমাত্র অর্জন! ১৯৮৬ সালে ওই সিউল আসরেই ব্রোঞ্জ জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন স্প্রিন্টার মিলজার হোসেন। ৮০০ মিটার স্প্রিন্টে হয়েছিলেন পঞ্চম।

আন্তর্জাতিক আঙিনায় যারা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন, একটা জায়গায় সবার বক্তব্যই এক। এশিয়ান গেমস ভীষণ কঠিন। প্রায় অলিম্পিকের কাছাকাছি প্রতিযোগিতা এখানে। সাফ গেমস তো বটেই, কমনওয়েলথ গেমসের চেয়েও এশিয়ান গেমসের চ্যালেঞ্জ অনেক কঠিন। অলিম্পিকের প্রতিষ্ঠিত শক্তি চীন, কোরিয়া, জাপান, ইরান, ভারতের সেরা অ্যাথলিটরা অংশ নিয়ে থাকেন এশিয়ান গেমসে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে মোশাররফের ব্রোঞ্জ পদক জেতাটা বিশেষ ঘটনা বৈ-কি।

সিউল গেমসে লাইট হেভিওয়েট বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক জয়ের পথে মাত্র ৩৮ সেকেন্ডেই নেপালের প্রতিযোগীকে নক আউট করেছিলেন মোশাররফ। ঘরোয়া ও সাফ গেমসেও ধারবাহিকভাবে সাফল্য পেয়েছেন এই বক্সার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তার প্রিয় ইভেন্ট লাইট হেভিওয়েটে শিরোপা জেতেন টানা সাত ( ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮) বছর। ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে হেভিওয়েট বিভাগে অংশ নিয়ে জেতেন সেরার মুকুট।

সিউল থেকে ফেরার পর বাবা হন মোশাররফ। সিউলের আবেগের সঙ্গে মিশিয়ে প্রথম সন্তানের নাম রাখেন সিউল। সন্তানের পুরো নাম মাহবুব হোসেন সিউল। সেনাবাহিনীর চাকরী, বক্সিং, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার সবছিুই চলছিল স্বাভাবিক পথেই। হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাত! ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হল ছেলে। এই দুঃসময়ে ছেলের পাশে থাকতে পারেননি। সেসময় বক্সিংয়ের জন্য ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছিল মোশাররফের। ছেলেকে নিয়ে একাই ডাক্তার-হাসপাতাল ছোটাছুটি করেন মা হনুফা হোসেন। যখন ফিরলেন, ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। দিনকে দিনই সিউলের পায়ের জোর কমে যেতে থাকে। এখন তার জীবন হুইলচেয়ার বন্দি। তারপরও জীবন চলছিল জীবনের নিয়মেই।

 ২০০৪ সালে অবসরের পর রাজশাহী শহর সংলগ্ন তালাইমারিতে বাবার বাড়িতে স্থায়ী হন মোশাররফ। স্ত্রী, ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে টিকে থাকেন সংসারযুদ্ধে। এরই মধ্যে বড় মেয়ে মাহমুদা হোসেন এমবিবিএস পাশ করেন। এরপর সর্বনাশটা ঘটে যায় ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। যুব বক্সিং ম্যাচ পরিচালনার জন্য ঢাকায় আসেন ৯ মার্চ। পরদিন রাতে আক্রান্ত হন হৃদরোগে। দ্রুতই তাকে ভর্তি করা হয় সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল)। আট দিন থাকতে হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের বাঁ দিকটা পুরোপুরি অসাড় হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলেন চলার শক্তি।

এরপর এই চ্যাম্পিয়ন বক্সারকে দেখতে হল জীবনের কঠিন সত্যকে। যা ছিল তার কল্পনারও অতীত। একে একে মুখ ফিরিয়ে নিল সবাই। তাদের মধ্যে চেনা মুখের ছড়াছড়ি। এমনকি সিএমএইচ থেকে ফেরার সময়ও কোন সহযোগিতা পাননি বক্সিং ফেডারেশনের কাছ থেকে। ভারী হয়ে ওঠা কণ্ঠে বললেন, "আমি তো ফেডারেশনের কাজেই ঢাকা গিয়েছিলাম। চিকিৎসা শেষে আমাকে বাড়ি ফেরার একটা ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম ফেডারেশন কর্মকর্তাদের। আশ্বাসও দিয়েছিল তারা। কিন্তু সাহায্য আর পাইনি।  শেষ পর্যন্ত আমার পরিবারের লোকজন বাসে করেই আমাকে রাজশাহী নিয়ে আসে।"

বক্সিং রিং থেকে বাংলাদেশকে সর্ব্বোচ্চ সাফল্য এনে দেওয়া মোশাররফ দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। দুইবেলা নিতে হয় ফিজিওথেরাপি। একবার বাসায় আর একবার স্থানীয় কমফোর্ট ফিজিওথেরাপি নামের প্রতিষ্ঠানে। একদিকে শারীরিকভাবে অচল, অন্যদিকে তীব্র আর্থিক অনটন, এক কথায় বেহাল দশা পরিবারের। মোশাররফের কথায়, "দুই বেলায় ফিজিওথেরাপিতেই আমার দৈনিক খরচ ৪০০ টাকা করে ৮০০ টাকা। আমি পেনশন পাই ২৭৪৪ টাকা। কিভাবে যে সংসার চলছে বলে বোঝাতে পারব না! মেয়ে-জামাই দুজনই ডাক্তার, বলতে পারেন, তাদের সাহায্য নিয়েই কোন রকম বেঁচে আছি।"ৱ

কিন্তু এভাবে যে বেশিদিন চলবে না, সেটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছেন মোশাররফ। সবচেয়ে বড় দুঃশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসা খরচ। সাহায্য তো দূরে থাক, কেউ খোঁজ-খবরও করে না। দিনে দিনে আত্মবিশ্বাসও কমে আসছে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সাবেক এই চ্যাম্পিয়ন বক্সার বললেন, "সিউল অলিম্পিকে পদক জেতার সময় কতজন কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই পাইনি। আমাকে নিয়ে তো লেখালেখিও হল অনেক। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। জানি না কপালে কি আছে?"

১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসের প্রতিটি ঘটনা এখনো মোশারফের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। গেমসে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে উড়াল দেওয়ার আগে পুরো স্কোয়াডকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ। দিয়েছিলেন, পদক  জিততে পারলে বড় পুরস্কার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। পদক জিতে সিউল থেকে ঢাকা বিমানবন্দরেও পা রাখলেন রাজার বেশে। সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভিড়। ফেডারেশনের বেশ কিছু কর্মকর্তাও গিয়েছিলেন বিমানবন্দরে। একের পর এক ফুলের মালা উঠল গলায়। মোশাররফের মনে হল, জীবনের মানে কত সুন্দর! এর পরের অধ্যায়টি ভাবতে পারেননি এই চ্যাম্পিয়ন বক্সার।

অসহযোগিতা আর প্রতিশ্রুতিভঙ্গই হয়েছে তার জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি!  মোশাররফের ভাষায়, "স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বড় পুরস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন, এটা আমাদের জন্য, বিশেষ করে আমার জন্য ছিল খুব বড় প্রেরণা। বড় কিছু পাব এমন প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে কিছুই কপালে জোটেনি। প্রেসিডেন্টের কাছে পর্যন্ত পৌঁছানোর সামর্থ্য আমার ছিল না। ফেডারেশন থেকে চেষ্টা করলে হয়ত একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ফেডারেশনে বারবার ধরনা দিয়েও তেমন কোন লাভ হয়নি। বড় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সমর্থন সহযোগিতা মেলেনি একটুও।"

চলার শক্তি হারানোর পর এই অসহযোগিতা আরও বেড়েছে। এখন তো একরকম খরচের খাতায় চলে গেছেন, নিজেকে এভাবেই দেখেন মোশাররফ। অলিম্পিক এসোসিয়েশন ( বিওএ), জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি), বক্সিং ফেডারেশন- এই চেনা জগতটা হয়ে গেল পুরোপুরিই অচেনা। মোশাররফ বলেন, "আমার তো চলাফেরার শক্তি নাই। তারপরও আত্মীয় স্বজন ও সাংবাদিকদের সাহায্য নিয়ে আমার দুঃরাবস্থার কথা এনএসসি ও ফেডারেশনকে জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।"

বিছানায় শুয়ে ঘরে থরে থরে সাজানো ট্রফির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন মোশাররফ। রিংয়ে দেশকে সাফল্য এনে দেওয়ার মুহূর্তগুলো মাঝে মধ্যেই তার চোখে ভেসে ওঠে। মনের অজান্তেই ফিরে যান তারুণ্যের সেই সোনালী দিনগুলোতে। সাফ গেমসে স্বর্ণ জেতার পর তাকে ঘিরে দর্শকদের সেই উল্লাস আর উচ্ছ্বাসের ধ্বনি এখনও শুনতে পান মোশাররফ। ঘোর কাটে অটোয়ালা কিংবা অন্য কারো ডাকে। অটোতে করেই ফিজিওথেরাপি নিতে যান। ফিজিওথেরাপি সেন্টারে যাওয়াটাও কম ঝক্কির নয়! তার কথায়, "আমার শরীর যথেষ্টই বড়-সড়। আমার অটোতে উঠতে ২/৩ জন লোকের সাহায্য নিতে হয়। বাড়ি থেকে শহর দুই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এছাড়া আর উপায়ই বা কি?" 

অন্য সবকিছুর মত শরীরও অসহযোগিতা করছে। টেলিফোনে কথা বলতেও কষ্ট হয়। তারপরও প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা টানা কথা বললেন। আমি বারবার থামতে চাই, কিন্তু মোশাররফকে যেন কথায় পেয়ে বসল। পরিবারের বাইরে তার কথা শোনার লোকও যে নাই, তা অনুধাবন করতে পারি। মোশাররফ বলতে থাকেন অনর্গল, আমি শুনতে থাকি। 

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে নিজের চাওয়া সম্পর্কে মোশাররফের কথাগুলো শোনাল আর্তনাদের মত, "স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে কাউকে যেন আমার মত ভুক্তভোগী হতে না হয়। কোন ক্রীড়াবিদকে যেন আমার পরিণতি ভোগ করতে না হয়। খুব বড় বিশ্বাস নিয়ে দেশের জন্য সর্ব্বোচ্চ সাফল্য নিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। আমার দিক থেকে চেষ্টা কিংবা আন্তরিকতার কোন ঘাটতি কখনোই ছিল না। কিন্তু আমার চরম বিপদের সময় ক্রীড়াঙ্গনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে আন্তরিকতার ছিটেঁফোটাও পাইনি।"

এত প্রতিশ্রুতিভঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও একটা বিশ্বাস কিন্তু এখনও আছে মোশাররফের। তার দুরাবস্থার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি একটিবার জানতে পারেন, তাহলে ঢাকায় থেকেই সুচিকিৎসা পাবেন, এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে আজও বেঁচে আছেন এই চ্যাম্পিয়ন বক্সার। লড়ে চলেছেন নিজের সঙ্গে। আহারে জীবন! আহারে মোশাররফ! দেশকে মুঠোভরে দিয়ে আজ নিজেই বিবর্ণ, মলিন, আলো-আশাহীন!