‘ডিজিটাল আইনে মামলা করে দেবো’

মোজাম্মেল হোসেনমোজাম্মেল হোসেন
Published : 26 Feb 2021, 07:34 PM
Updated : 26 Feb 2021, 07:34 PM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী ১৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে কিছু অভিযোগ জানিয়ে একটি পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। পরিবেশিত খবর থেকে তার বক্তব্য জেনে বিস্ময়ে এমন হতবাক হই যে- আকাশ থেকে পড়েছি বলা যায়। প্রতিষ্ঠানের ওপর বাইরে থেকে কতখানি চাপ এলে প্রধান সম্পাদক নিজে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য প্রকাশ করেন, তা-ই ভাবছি। তিনি দেশের সকল সংবাদমাধ্যমকে কাজের স্বাধীন পরিবেশ রক্ষায় দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করতে চেয়েছেন।

ঘটনা হলো, এ অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রায় দেড় দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কিছু খবর আর্কাইভ থেকে মুছে ফেলতে একজন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে অভাবিত চাপ সৃষ্টি। প্রথমে অনুরোধ জানানো হয়। পরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একই ভাষায় ডজন ডজন উকিল নোটিশ পাঠানো হয় পুরনো খবরগুলো মুছে না ফেললে মানহানির মামলা করা হবে বলে। খবরগুলো ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওই ব্যবসায়ী ও তার পরিবারের আরও তিন সদস্যের অর্থ-সম্পত্তি বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা ও সেসবের বিচারিক কার্যক্রমের বিবরণ সংক্রান্ত, যেগুলোকে আমরা কোর্ট নিউজ বলি। সব সংবাদ মাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হয়। এগুলো ওয়ান-ইলেভেন বলে পরিচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ঘটনা এবং পরে উচ্চ আদালতে মামলাগুলো কোয়াশ-আউট হয়েছে। সেই খবরও যথারীতি প্রকাশিত। কিন্তু মামলার পুরনো খবরগুলো নিউজ আর্কাইভে থেকে গেলে লিংকে যে-কেউ পড়তে পারেন বলে 'উক্ত ব্যবসায়ীর মানহানি হচ্ছে'। তাই ইতিহাস মুছে ফেলতে হবে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে, না মুছলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হবে। খবরগুলো ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঘটনার, আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়েছে ২০১৮ সালে। ভূতাপেক্ষ আইন প্রয়োগের হুমকি অগ্রাহ্য করে প্রধান সম্পাদক জানিয়েছেন, গবেষণা ও আর্কাইভ মূল্যসংবলিত পুরনো খবর তিনি চাপের মুখে মুছবেন না। পুরনো খবর নষ্ট করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রয়োজনে আইনি মোকাবেলা করবেন। সম্পাদকের অবস্থানে তিনি যথার্থ।

সাংবাদিকতায় অনেক রকম চাপের সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষমতাসীন সরকার, রাজনৈতিক দল ও নিছক কোনও স্বার্থান্বেষী মহল, সন্ত্রাসী, অপরাধী মাফিয়াচক্র থেকেও চাপ আসে। কিন্তু অনেক বছর আগের ঘটনার, এমনকি আদালতের খবর মুছে ফেলার জন্য চাপের সম্মুখীন হওয়ার কোনও ঘটনা আমাদের জানা ছিল না। আর সারা দেশে সংগঠিতভাবে ৪০/৫০টি মামলার হুমকি দিয়ে সম্পাদক হয়রানি আমরা সম্প্রতি দেখছি।

দেখা যাচ্ছে, স্বার্থান্বেষী মহলের চাপ সম্প্রসারিত হচ্ছে। অতীতের ঘটনাও যদি এখন পছন্দ না হয়, তাহলে ওটাও মুছে ফেলতে হবে, এমনই আবদার তাদের। এটা কীভাবে হলো?

পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক ও কেন্দ্রীয় শাসকরা নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন আইন ও বিধি-নিষেধ জারি করেছিল। জননিরাপত্তা আইন, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন প্রভৃতি প্রয়োগ করেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আমাদের পূর্বসূরিরা অনেক গৌরবজনক সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা মুক্ত সাংবাদিকতার অধিকার এনে দেয়। সংবিধান নিশ্চয়তা দেয় সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এবং মৌলিক অধিকারের বিধানগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিলের।

স্বাধীনতার অল্প পরে ধ্বংসাত্মক অপরাধমূলক তৎপরতা দমনের জন্য করা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে সংবাদপত্র বন্ধ করার সুযোগ ছিল। তবে পরে ওই আইন পরিমার্জন করা হয়।

অর্থাৎ, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার আইনি বাধা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছিলাম ও আইনি রক্ষাকবচ পেয়েছিলাম। কিন্তু এই সুখ আমাদের বেশিদিন সয়নি। প্রথম দিকে চোরাকারবারি ও সংঘবদ্ধ অপরাধীদের তরফ হতে সংবাদ প্রকাশ স্তব্ধ করার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে চাপ আসত। তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব যুক্ত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশে অনেক ওলট-পালট, সামরিক শাসন, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সংঘাতের ভেতর দিয়ে আমাদের সামাজিক বিকাশটা এমনভাবে হতে থাকল যে, অপরাধীরা আইনের বাইরে গিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করল। ১৯৯০-এর দশক ও চলতি শতকের প্রথম দশকের কয়েক বছরে খুলনা ও যশোর অঞ্চলের চরমপন্থি দলগুলো ১৩ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। ২০২০ পর্যন্ত মোট নিহতের সংখ্যা ২২ হবে। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে সরকারের দমন-পীড়নের সম্পর্ক নেই। তবে রজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়া অপরাধী, দখলবাজ, ব্যাংক লুটেরা ও অন্যদিকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের থেকে চাপ ও হুমকি, হত্যা প্রভৃতি চলমান রয়েছে। তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘ বিলম্ব, অনিষ্পন্ন মামলা এবং কার্যত বিচারহীনতা এর পরিপূরক চিত্র। সরাসরি রাষ্ট্র ও সরকারের তরফে দমনমূলক আইন হাতে নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে চাপে রাখা সাম্প্রতিক অতীত পর্যন্ত হয়নি। দুঃখজনকভাবে সেটাই ফিরে এলো ২০১৩ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং ২০১৮ সালে সেটির বিকল্প ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে।

মানুষের সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে দেওয়া ইন্টারনেট প্রযুক্তি কিছু দুর্বৃত্ত অপব্যহার করে নারীদের হয়রানিসহ নানারকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অপরাধ করছে। এজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দরকার হলো। তবে এর কিছু ধারা সংবাদমাধ্যম ও নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করছে। শুরুতেই এ আশংকা করে সাংবাদিক সমাজ আইনটি সংশোধনের জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে। সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মন্ত্রিসভায় তুলবেন ও আলাপ-আলোচনা করে একটা সমাধানে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। এখন আইনটি যে কোনও খবর ও অনলাইনে নাগরিক মতামত সরকারের শাসকদলের অপছন্দ হলেই গ্রেপ্তার ও হয়রানির সুযোগ দিচ্ছে। আইনটির অত্যন্ত খারাপ দিক এই যে, বিচারিক প্রক্রিয়া যা-ই হোক, দ্রুত গ্রেপ্তার ও জামিন না দিয়ে জেলে রেখে হয়রানি করা যাচ্ছে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর্টিকেল নাইন্টিন নামক নজরদারি সংস্থা তথ্য দিয়েছে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৪১টি মামলায় ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। সদ্য বিদায়ী বছরটিতে এই আইনে মোট ১৯৮টি মামলায় আসামি ৪৫৭ জন।

আমরা দেখছি, তুচ্ছ ও আমল-অযোগ্য অপরাধে নিরীহ প্রকৃতির ব্যক্তি নির্যাতন ভোগ করছেন। অভিযোগগুলো স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না। অতিসম্প্রতি সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ও বাউল গায়ক শরিয়ত সরকারের নিগ্রহ তেমনই ঘটনা। আর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গাজীপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি অবস্থায় লেখক ও দেশের প্রথম কুমির খামারি মুশতাক আহমেদের মৃত্যু সমাজে ট্রমার সৃষ্টি করেছে।

পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হওয়ার চার দশক পরে সরকার আবার সরাসরি সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গুরুতরভাবে নিয়ন্ত্রণের আইনি হাতিয়ার তৈরি করায় সরকারের বাইরের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালী মহল উৎসাহিত হয়েছে এবং এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওপর অভাবিত নতুন চাপ তা-ই বলে। সাংবাদিকদের জন্য পেশা দুরূহ হয়ে পড়েছে। মাঠে-ময়দানে আমাদের সাংবাদিকদের 'ডিজিটাল আইনে মামলা করে দেবো' বলে হুমকি শুনতে হচ্ছে।

দলীয় রাজনৈতিক ভিত্তিতে সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি এখন সাংবাদিকদের নিজেদের একটি প্রতিকূল উপাদান। এ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সাংবাদিকদের অন্য কেউ সাহায্য করতে পারবে না।

বিডিনিউজ টেয়েন্টিফোর ডটকমের ওপর যে চাপটা এলো, তাদের লিংক বা ইউআরএল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য- কোনও একদিন এটা অন্য গণমাধ্যমগুলোর ওপরেও যেতে পারে। কোনও কোনও মিডিয়া ইতোমধ্যে লিংক বন্ধ করার চাপটা মেনে নিয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু বিষয়টি আমার কাছে নিশ্চিত জানা নেই বিধায় সেটা নিয়ে মতামত দিচ্ছি না। ভবিষ্যতে এ ধরনের চাপ যেন আর না আসে সেজন্য সব গণমাধ্যমকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখনই বিষয়টি প্রতিহত করা উচিত।

মূলধারার কোনও মিডিয়া যদি এ ধরনের আপসমূলক অবস্থানে যায়, বা অন্যায় দাবির সঙ্গে সমঝোতা করে- সেটা কাম্য হবে না। একজনের আচরণ অন্যদেরকেও দুর্বল করে দেবে। সার্বিকভাবে সংবাদমাধ্যমকে দুর্বল করে দেবে। কোনও স্বাধীন মিডিয়ার এটা করা উচিত হবে না।

একবারেই সবটা আশা করা যায় না। এখনই এ চাপ বন্ধ হয়ে যাবে সেটা ধরে নেওয়া ভুল। তবে আমি ভালো কিছু লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন ইতোমধ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছে, জানাচ্ছে। অন্যান্য সংবাদমাধ্যম, সংগঠন, সংস্থা যারা আছে- তারা প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকবেন, এটাই আশা করি।

সংবাদ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলির বিলুপ্তি বা সংশোধনের জন্য সদিচ্ছা নিয়ে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। সকল সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিককে দলমত নির্বিশেষে পেশাগত অবস্থান নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই দাবির পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। আর প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর অন্যায় চাপ প্রতিহত করে সাংবাদিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ রক্ষায় সরকারি প্রশাসনের যথাযথ আইনি ভূমিকা পালন জরুরি।

এ সংক্রান্ত আরও পড়ুন-