২৭ বছরের অপেক্ষাকে কয়েক সেকেন্ডে নামানোর আনন্দ

তানভীর এ মিশুকতানভীর এ মিশুক
Published : 2 Jan 2021, 11:06 PM
Updated : 2 Jan 2021, 11:06 PM

একটা টেলিফোন সংযোগ পেতে ২৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে – এ খবরটি বিবিসিতে এসেছিল ২০০৩ সালের ২৩ জুন। ঘটনাটা আমাদের পুরনো ঢাকার। ১৯৭৬ সালের মে মাসে মোহাম্মদ ইসমাইল নামে একজন আবেদন করেছিলেন তখনকার একটি টিএন্ডটি ফোনের জন্য। সেটা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল একেবারে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। খবরটা আমাদের স্থানীয় সংবাদপত্রেও বেরিয়েছিল।

একটা সংযোগ পেতে গোটা একটা প্রজন্ম খরচ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা-আর কি!

এ প্রজন্মের কারও জন্য এটা বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন, অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। এখন ফোন সংযোগ পেতে তো বটেই, বরং তারচেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে অর্থ লেনদেনের সুবিধা পেতেও এখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। 

একটি ডায়ালই যথেষ্ট। অথবা অ্যাপ ডাউনলোড করে মোবাইল স্ক্রিনে কয়েবার প্রেস করলেই হল। 

অন্যদিকে আবার যারা ইন্টারনেটে সংযুক্ত নন, আমাদের দেশে তো এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি, তারা কিভাবে ইন্টারনেটের মতো দ্রুতগতিরই প্রযুক্তি সুবিধা পাবে?

অন্য কেউ ভাবার আগেই দেশের সেসব সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির কথা ডাক বিভাগের আর্থিক লেনদেন সেবা 'নগদ' সেটা চালু করে দিয়েছে। ডাকবিভাগের সেবা যেমন খুব সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে, 'নগদ'-কেও সেইরকম ভাবেই ভাবতে হয়েছে।

কাজেই ইন্টারনেট বঞ্চিত বা ব্যবহারে অনভ্যস্তদের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে *১৬৭# ডায়াল পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে 'নগদ' অ্যাকাউন্ট নেই এমন মোবাইল ফোন থেকে *১৬৭# ডায়াল করবেন তো অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়ার অনেকটাই হয়ে গেল আর কি! তারপর অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্যে নিজের ইচ্ছে মতো চার ডিজিটের পিন সেট করবেন তো প্রক্রিয়া শেষ। যাকে বলে 'চোখের পলকে' অ্যাকাউন্ট খোলা সম্পন্ন। এটি হল আর্থিক খাতের সর্বশেষ ডিজিটালাইজেশন। 

চলতি বছরের শুরুর দিকে সরকারের কাছ থেকে সকল অনুমোদন নিয়েই শুধু দেশকে নয়, আমি তো বলবো– গোটা বিশ্বকে আর্থিক খাতের নতুন এক উদ্ভাবন উপহার দিয়েছে আমাদের ছেলেরা। মাঝে গ্রাহক তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ কেউ হয়তো অহেতুক বিতর্ক তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উদ্ভাবনের মধ্যে যে বিতর্ক তোলার কিছু নেই সেই সার্টিফিকেট যথাযথ নিয়ন্ত্রক সংস্থাই দিয়েছেন। একের পর এক নতুন প্রযুক্তিগত সেবা নিয়ে হাজির হতে গিয়ে শুরু থেকেই আমরা বুঝে গিয়েছি যে– নতুন কিছু করতে গেলে বাঁধা আসবেই। সুতরাং বাঁধাকে 'বাধ্য' করে তবেই এগিয়ে যাওয়ার পণ নিয়ে কাজ করেছে ছেলেরা।

গত বছর ২৬শে মার্চ যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশের আর্থিক খাতে প্রথম ডিজিটাল কেওয়াইসি-র প্রচলন হয়। এখানে কোনো রকম কাগজের ব্যবহার নেই। কেবল জাতীয় পরিচয়পত্রের দুই দিকের ছবি তুলে, একটা সেল্ফি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে আপ করলেই হলো! সব মিলে কয়েক সেকেন্ডের মামলা। তখনো বহুমুখী বিতর্ক বাঁধা হিসেবে দাঁড়ালেও সেটি বেশিদিন থাকেনি।

বরং সুপার এই প্রযুক্তির বিষয়ে যারা সমালোচনার অবস্থানে ছিলেন একটা পর্যায়ে তারাও ডিজিটাল কেওয়াইসি চালু করলেন – এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ কমিয়ে আনতে পারলেন। ব্যাংকগুলো যেখানে অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে একটু বেশি রক্ষণশীল এবং আট-দশ পৃষ্ঠার ফর্ম পূরণ না করে অ্যাকাউন্ট খোলে না, তারাও এখন একই পদ্ধতিতে ডিজিটাল কেওয়াইসি ব্যবহার করে মুহূর্তে অ্যাকাউন্ট খুলছেন। পুরো বিষয়টি আমরা দেখছি খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে। আমরা বিশ্বাস করি আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশন ছাড়া প্রকৃত ডিজিটালাইজেশন হবে না। তাছাড়া সামগ্রিক উন্নতির জন্যেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি কেবল ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। সুতরাং আমরা পথ সৃস্টি করলেও সেটি শুধু আমাদের জন্যে করিনি। বরং সে পথে আরো অজস্র, অজুত, নিযুত পথিক চলে উপকার নেবেন সেটিই আমাদের চাওয়া।

পুরো প্রক্রিয়ায় আমাদের জন্যে সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হল, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নীতিনির্ধারণকরা শুরু থেকেই আমাদের উদ্ভাবন সম্পর্কে সহনশীল ছিলেন। যার কারণে বিতর্কটা বেশি দূর এগোতে পারেনি। 

ওই যে ডিজিটাল কেওয়াইসি'র এমন জয়যাত্রা – ওটাতেই ঢেঁকুর তোলার অনুভূতি হয়নি, বরং ডিজিটাল কেওয়াইসি নিয়ে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। আমরা ভেবে দেখলাম যারা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন কেবল তারাই কেবল এ প্রক্রিয়ায় মুহূর্তে অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধাটা নিতে পারছেন। কিন্তু যারা এখনো ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধার মধ্যে আসেনি, স্মার্টফোন কেনার সামর্থ নেই, তাদের কি তাহলে ফর্মপূরণের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে গিয়ে তবেই ডিজিটাল আর্থিক সেবা নিতে হবে? এতে তো ডিজিটাল ডিভাইড আরো বেড়ে যেতে পারে! সুতরাং প্রযুক্তি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসতে হল। আর সেই চিন্তা থেকেই জন্ম হল *১৬৭# এর।

গত ফেব্রুয়ারিতেই রবি-এয়ারটেল এবং তারও আগে টেলিটকের গ্রাহকদের জন্যে সুবিধাটা চালু হয়। তারপর থেকে প্রতি মাসেই কয়েক লাখ করে গ্রাহক কেবল *১৬৭# ডায়াল করে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। 

কয়েক মাস পরীক্ষার পর এই তো বিজয় দিবসের দিন গ্রামীণফোনের সকল গ্রাহকদের জন্যে উন্মুক্ত হল সেবাটি। ফলে গ্রামীণফোনের যে পৌণে আট কোটির বেশি গ্রাহক আছে তাদের প্রত্যেকের জন্যে আর্থিকভাবে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার রাস্তাটা হয়ে গেল আরো প্রশস্ত। অবস্থাটা এমন যে কেবল গ্রাহকরা চাইলেই হবে – যখন খুশি, যেখান থেকে খুশি 'নগদ' এর অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন শুরু করতে পারবেন। এটিকে আমরা বলছি – দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থিক অন্তর্ভূক্তির উদ্যোগ।

সত্যি বলতে কি আমার বিচেনায়– আর্থিকখাতের জন্যে ডিজিটাল কেওয়াইসি যেমন একটা বড় উদ্ভাবন ছিল, তার চেয়েও অনেক বড় উদ্ভাবন হল *১৬৭#। কারণ ডিজিটাল কেওয়াইসি'র সুবিধা নিতে পারতো কেবল একটি পর্যায়ের মানুষ যারা ইন্টারনেটে যুক্ত। আর *১৬৭# এর সুবিধা নিতে ইন্টারনেটও লাগছে না সুতরাং আমার মতে এটি সার্বজনীন এক উদ্ভাবন। আমরা তো খেয়াল করছি যারা ইন্টারনেট যুক্ত তারাও আর অ্যাকাউন্ট খুলতে ডিজিটাল কেওয়াইসি'র দিকে যাচ্ছেন না, বরং *১৬৭# ডায়াল করে অ্যাকাউন্ট খুলছেন। 

আমরা যতোদূর জানি, গোটা দুনিয়ায় আর্থিকখাতের জন্যে এমন কুশলী পদ্ধতি এর আগে কখনোই উদ্ভাবন হয়নি। আর এ প্রযুক্তির ওপরে দাঁড়িয়েই আমরা স্বপ্ন দেখছি– আমাদের দেশের আর্থিকভাবে অন্তর্ভূক্ত মানুষের সংখ্যা যতো দ্রুত বাড়ছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়বে। ফলে অতি অল্প সময়ে সবাইকে আর্থিক অন্তর্ভূক্তির ছাতার নিচে আনা সম্ভব হবে। তখন হয়তো একজন ভিক্ষুকের একটি টাকার আয়ও দেশের উন্নয়নে হিসেব মেপে কাজে লাগবে।