প্রতিমা বনাম ভাস্কর্য: মুদ্রায় খলিফার মুখচ্ছবি

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 22 Dec 2020, 08:09 AM
Updated : 22 Dec 2020, 08:09 AM

দেশে এমনিতেই অজস্র সমস্যা, সাথে যোগ হয়েছে ভাস্কর্যের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক, হুংকার, তকমা, গালিগালাজ ইত্যাদি। শালীন আলোচনার মাধ্যমে এর সুরাহা হওয়া দরকার। যেকোনো আন্দোলনের অন্যতম শক্তি ১) হিকমা অর্থাৎ প্রজ্ঞা, ২) কল্যাণমুখী সুস্পষ্ট একটা তত্ত্ব, ৩) ইচ্ছেতরুর কল্পধেনু নয় বরং বাস্তব বান্ধবতা ও ৪) ব্যক্তিগত আবেগ। সেগুলোই দেখা যাক এবারে।

১. হিকমা অর্থাৎ প্রজ্ঞা

কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশের পেছনে হিকমা অর্থাৎ প্রজ্ঞা থাকতে হয়। কোভিড দুঃসময়ে সরকারি আদেশ "মাস্ক ছাড়া বাইরে গেলে জরিমানা"-এর পেছনে প্রজ্ঞা আছে। বর্তমানে ভাস্কর্য দেখে কোনো মুসলিমের ঈমান আকিদার ক্ষতি হয়নি, ধুপধুনো জ্বেলে তার আরাধনা শুরু করেনি কেউ। অর্থাৎ ভাস্কর্য মুসলিমের কোনোই ক্ষতি করছে না। তাই বিশ্বের অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞ বলেছেন বর্তমানে পূজার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু না থাকলে ভাস্কর্য এখন হারাম নয়। আমাদের ভাস্কর্যবিরোধীরা তাদের সাথে কথা বললেও তাদের যুক্তিগুলোকে দেখলে ভালো হয়।

২. তত্ত্ব

ভাস্কর্য-বিরোধী তত্ত্বটা এসেছে কোরান ও সহি হাদিস থেকে (সহি সিত্তা অর্থাৎ ছয়টি সহি হাদিস গ্রন্থ- সহি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী)। জীবনের দীর্ঘকাল আমি মধ্যপ্রাচ্যে কাটিয়েছি, আরবি ভাষার শব্দ-জটিলতা আমার কিছুটা জানা আছে। উপাসনার প্রতিমা অবৈধ করে কোরান-হাদিসে যে 'রিজস' ও সংশ্লিষ্ট শব্দাবলি আছে তার বাংলা তর্জমাতে "মূর্তি" শব্দটা ব্যবহার করার ফলে দুর্গামূর্তি গান্ধীমূর্তি, হনুমান-সাপ-ব্যাঙ-মানুষের ভাস্কর্য সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর সমাধান পাওয়া যাবে বিশ্ববিখ্যাত আলেমদের কোরান ও সহি হাদিসের ইংরেজি অনুবাদে কারণ ইংরেজিতে উপাসনার প্রতিমা (IDOL) ও সম্মানের/সৌন্দর্য্যের ভাস্কর্য (STATUE) আলাদা দুটো শব্দ। মতামত বিভাগের এ নিবন্ধে দেখানো হয়েছে কোরান ও সহি হাদিসের মোটামুটি ৩৪,৩৫০টি ইসলামি সূত্রে অবৈধ করা আছে IDOL অর্থাৎ আরাধনার প্রতিমা, আর ভাস্কর্য অর্থাৎ STATUE শব্দটা নিষিদ্ধ তো দূরের কথা উল্লেখই নেই মাত্র একটি হাদিস ছাড়া এবং সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।

ভাস্কর্য-বিরোধীরা সূরা সাবা'র আয়াত ১৩-এ: "তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, কুয়ার মতো বৃহদাকার পানির পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত" – অনুসারে ভাস্কর্যের বৈধতা নাকচ করেন এই বলে যে ওটা অতীতের ব্যাপার, নবীজী (স.) আসার পরে ওটা বাতিল হয়ে গেছে। আল্লাহর বিধান কে, কেন, কবে, কোথায়, কী প্রেক্ষাপটে ও কোন অধিকারে বাতিল করল এবং বিশ্ব-মুসলিম সেটা মানতে বাধ্যই বা হবে কেন- সেটা কেউ জানালে ভালো হয়। ওদিকে তো দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত-তর্জনী সূরা আল-ফাতিহা আয়াত ২৩- "তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না"।

আল্লাহ-র বিধানের প্রজ্ঞা বাতিল করার ক্ষমতা বা অধিকার কারো নেই।

সূরা সাবা-র আয়াত ১৩-র ব্যাপারে কিছু ভাস্কর্য-বিরোধী এ-ও বলেন ওটা ছিল নিষ্প্রাণ কিছুর মূর্তি, প্রাণীর নয়। তারা কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে এটা পেলেন জানি না কিন্তু আমরা তো দেখছি আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে প্রাণীর ভাস্কর্যকেও বৈধতা দিয়েছেন: "যখন তুমি আমার আদেশে কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত" – মায়েদা ১১০।

অতএব কোরান মোতাবেক প্রাণীর ভাস্কর্যও বৈধ যা মুসলিম খলিফারাও মেনেছেন, মুদ্রায় সাসানিদ খলিফার মুখচ্ছবি দেখুন।

৩. বাস্তব

(ক) বাংলাদেশে বহুকাল থেকেই প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ অজস্র মানুষের ভাস্কর্য আছে তার প্রতিবাদ ভাস্কর্য-বিরোধীরা কখনো করেননি অথচ হঠাৎ কেন জাতির পিতার ভাস্কর্যের বিরোধিতা তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আমরা এখনো পাইনি। বরং মুসলিম ইতিহাসের বাস্তবে ভাস্কর্যের প্রমাণ আছে। (এক) কয়েনউইক ডটকম-এ "কয়েনেজ অব দ্য ফার্স্ট ক্যালিফেট"-এ খেলাফত আমলের মুদ্রাতে কোরানের কলমার সাথে খলিফার ভাস্কর্য খোদাই করা আছে।

(দুই) ডেভিড উড, জে. স্মিথদের মতো কট্টর ইসলাম-বিরোধীদের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি সংগ্রামরত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি স্কলার ড. ইয়াসির কাধি তার "লাইব্রেরি চ্যাট#" সিরিজের ১১ নম্বর ভিডিওতে ৫০ মিনিটের পর ক্যামেরায় সাসানিদ খলীফার মুদ্রা দেখিয়ে বলেছেন – "বিসমিল্লাহ খোদাই করা আছে ……ইউ সি দি এম্পরার হেয়ার (এখানে সম্রাটকে দেখুন)"। লিঙ্ক- https://www.youtube.com/watch?v=nJCbonlLQcI

(খ) এই কারণেই দুনিয়ায় প্রায় ১৬০ কোটি মুসলিমের আট ভাগের সাত ভাগ, বাংলাদেশের বাইরের বিশ্ব-আলেমরা কোনোদিন ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কোনো মিটিং মিছিল করেননি। তারা উপাসনা প্রতিমা ও সম্মানের ভাস্কর্যের পার্থক্য জানেন। আমাদের ভাস্কর্য-বিরোধীরা বলেন- "কোন দেশ কি করছে সেটা ধর্তব্য নয়।" কিন্তু ভাস্কর্য-সমর্থকরা তো বিশেষ কোনো দেশের কথা বলছেন না, তারা বলছেন, ওসব দেশের আলেমদের কথা। আশাকরি আমাদের আলেমরা ডক্টর ইয়াসির কাধি-র সাথে আলোচনা করে আমাদেরকে একটা মীমাংসা উপহার দেবেন, উনাকে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব এক নামে চেনে।

(গ) গত কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহে সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়েছে যে মুসলিম-বিশ্ব মানবাধিকারের পক্ষেই বিবর্তিত হচ্ছে। উদাহরণ অজস্র। (এক) আদি ইমামেরা যে কোনো কিছুর ওপরে যে কোনো ছবি আঁকার এতই বিরুদ্ধে ছিলেন যে শারিয়া আইনে কাপড়, চামড়া, দেয়াল বা যে কোনো কিছুর ওপরে প্রাণী অপ্রাণী সবকিছুরই ছবি আঁকা অবৈধ করা হয়েছিল – আল আজহার বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প স্বাক্ষরে সত্যায়িত শারিয়া কেতাব "উমদাত আল সালিক", আইন নং w.50 সিরিজ। ধীরে ধীরে বিশ্ব মুসলিম তা থেকে বেরিয়ে এসেছে। (দুই) কয়েক দশক আগেও অনেক আলেম ক্যামেরার ছবি, টিভিতে ছবি, ছবি আঁকা ইত্যাদির দারুণ বিপক্ষে ছিলেন, তারাও কোরান হাদিসেরই সূত্র দিতেন। বিশ্ব মুসলিম তা থেকেও অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। (তিন) বাংলার মুসলিম মানসে কয়েক দশক ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছে 'মকসুদুল মুমেনীন' কেতাব, আজ ইমামেরাই বলেন এ বই না পড়তে। অর্থাৎ মুসলিম সমাজ প্রকৃতির অমোঘ বিধানেই বিবর্তিত হচ্ছে। আশা করা যায় কয়েক দশক পরে ভাস্কর্যের বৈধতা নিয়েও কোনো বিতর্ক থাকবে না।

(ঘ) এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম মালিককে (র.) খলিফা হারুনর রশীদ প্রস্তাব করেছিলেন রাষ্ট্রীয়ভাবে খেলাফত জুড়ে ইমামের শারিয়া আইন প্রয়োগ করবেন এবং সেটা কাবার গায়ে ঝুলিয়ে দেবেন। কোনো মুসলমানের পক্ষে এর চেয়ে সম্মানের আর কি হতে পারে! কিন্তু প্রাজ্ঞ ইমাম সম্মতি দেননি বরং বলেছিলেন তিনি মদীনার ইমাম, অন্যান্য জায়গায় মুসলিমদের জন্য তাদের নিজস্ব ইমাম আছে – (মুহাম্মদ আবু জাহরা'র বিখ্যাত কেতাব "দি ফোর ইমামস" পৃষ্ঠা ৭২-৭৩)। ইমামের এই কথার মধ্যে গভীর প্রজ্ঞা আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গার পরিস্থিতি ভিন্ন, সেই সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সেখানকার ইমামেরা মুসলিমদেরকে কোরান ও রাসূল (স.) মোতাবেক এমনভাবে হেদায়েত করবেন যাতে সমাজের কল্যাণ হয়। এটাই ইজতিহাদ, ইসলামের এক অনন্য পদ্ধতি অথচ যার প্রয়োগ বেশি দেখা যায় না। এই পদ্ধতি আলেমদেরকে যেমন অধিকার দেয় তেমনি দায়িত্বও দেয়। কিন্তু সে দায়িত্বটা ওই হেদায়েত পর্যন্তই, জোর করে চাপিয়ে দেয়া নয়। বলাই বাহুল্য, হেদায়েতের মধ্যে হুংকারের জায়গা নেই।

সম্প্রতি রাজনীতি ও ধর্মনীতির অঙ্গনে ভাষা প্রয়োগে তুমুল অবক্ষয় ঘটেছে, হুংকার ছাড়া কথাই নেই। নবীজীর (স.) অপূর্ব উপদেশটা সবাইকে মেনে চলার অনুরোধ করছি, তার শানে রচিত এটা এখন বাংলা ভাষায় "স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি"-তে ২২ লাখ ভিউজ ও চৌষট্টি হাজার শেয়ার নিয়ে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়। ইন্টারনেটে "জিহ্বা কবিতা" সার্চ করলেই পাওয়া যাবে।