ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 28 Nov 2020, 11:51 PM
Updated : 28 Nov 2020, 11:51 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য অপসারণের হুমকি দিয়েছে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে 'মূর্তি' উল্লেখ করে 'তা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার' কথা প্রথমে বলেন মামুনুল হক নামের হেফাজতের নতুন যুগ্মমহাসচিব। তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদও করেছে অন্য কয়েকটি ইসলামী সংগঠন এবং কয়েকটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। ছোটখাটো দুএকটি প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে। প্রতিবাদকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভাস্কর্যকে মূর্তির সঙ্গে তুলনা করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে গুজব রটিয়ে নিরীহ মানুষকে রাজপথে নামিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টার কথাও উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের হুমকি দিয়ে দেশে বিদ্যমান আইনের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হয়েছে। জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতার এটা চরম ব্যত্যয় এবং অপরাধের শামিল।

কিন্তু সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শুরুতে এক ধরনের নীরবতা পালন করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয় এবং কিছু প্রশ্নও দেখা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রথমে মুখ খোলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুর রহমান চৌধুরী নওফেল। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এরপর চট্টগ্রামে জঙ্গিবাদবিরোধী ছাত্র-যুব ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মামুনুল হককে হাটজারীর একটি মাহফিলে উপস্থিত হতে বাধা দেওয়া হয়। ওই মাহফিলে মামুনুল হকের প্রধান অতিথির বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল গত ২৭ নভেম্বর। আগের দিন তাকে চট্টগ্রামে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে প্রতিহত করার কর্মসূচি দেয় 'জঙ্গিবাদবিরোধী ছা্ত্র-যুব ঐক্য পরিষদ'। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন বিক্ষোভ-প্রতিবাদের কারণে মামুনুল হক মাহফিলে উপস্থিত হননি বা হতে পারেননি।

তবে হেফাজতের নতুন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী মাহফিলে মামুনুল হকের আগের কথার প্রতিধ্বনি করে ভাস্কর্য তৈরি হলে তা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। ভাস্কর্যবিরোধীদের এই আস্ফালনে সম্ভবত একটু দেরিতে হলেও সরকারের টনক নড়েছে। ২৭ নভেম্বর জুমার নামাজের পর  বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেইট থেকে কিছু মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ভাস্কর্যবিরোধী একটি মিছিল বের করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তিনগরে তাদের গতি রোধ করে এবং ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে।

 এরপর দিন ২৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবনে এক ব্রিফিং এ  বলেন, "বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে অনাহুত বিতর্কের সৃষ্টি করছে তার ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ধর্মকে রাজনৈতিক ইস্যুতে ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'ভাস্কর্য নিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের সংস্কৃতির প্রতি চ্যালেঞ্জ। দেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান এবং রাষ্ট্রবিরোধী যে কোনও বক্তব্য বরদাশত করা হবে না। ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে ধর্মীয় সহনশীলতা বিনষ্টের যে কোনও অপচেষ্টা সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে। সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। জনগণের শান্তি বিনষ্টের কোনও অপচেষ্টা করলে জনগণই রুখে দাঁড়াবে।"

তিনি আরও বলেন, "স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা স্মরণ করে কাদের বলেন, 'স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা, চর্চা এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারে মাদ্রাসা বোর্ড পুনর্গঠনসহ ইসলাম প্রচারে তাবলিগ জামাতকে জমি প্রদান করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পবিত্র ধর্মের একজন নিবেদিত প্রাণ ও অনুসারী হিসেবে ইসলামের সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের সমন্বয় করে প্রকৃত ইসলামের চর্চা এগিয়ে নিতে জনমানুষের ধর্মানুরাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের প্রতিটি উপজেলায় নির্মাণ করেছেন মডেল মসজিদ কমপ্লেক্স।"

ওবায়দুল কাদের বলেন, "একজন ধর্মপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্বে তখন এদেশে ইসলামবিরোধী কোনও কার্যক্রম হবে, তা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।"

তিনি বলেন, "ভাস্কর্যকে যারা মূর্তি বলে অপপ্রচারে নেমেছে তারা নিজেরাই ভ্রান্তিতে আছে। দেশের আলেম সমাজ এবং বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই বারবার বলেছেন, মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়।"

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, "ইসলাম আমাদের ধর্ম। এ ধর্মের বিধিবিধানে ধর্মীয় ইস্যুতে বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই। নিরুৎসাহিত করা হয়েছে ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্ক করতে, নিষেধ করা হয়েছে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিতে।"

ওবায়দুল কাদের বলেন, "বাংলাদেশের স্থপতির ভাস্কর্য টেনে হিঁচড়ে নামাবে বলে কোনও কোনও ধর্মীয় নেতা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন। তাদের এমন রুচি এবং ভাষা ব্যবহার দেখে তাদের ধর্মচর্চা ও ইসলামি রুচিবোধ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।"

তিনি বলেন, "পবিত্র কোরআনের সুরা সাবা'র ১৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত 'তামাসিলা' এবং সূরা ইব্রাহিমের ৩৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত 'আসনাম' শব্দ দুটি এক নয়। কাজেই মুফাসসসিরগণ মনে করেন তামাসিলা মানে ভাস্কর্য আর আসনাম মানে প্রতিমা পূজা। এ দুটি শব্দকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।"

ওবায়দুল কাদের প্রকৃত ইসলাম চর্চার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে সবাই বিরত থাকি।" তিনি ধর্মকে রাজনৈতিক ইস্যুতে ব্যবহার না করারও আহ্বান জানান।

ওবায়দুল কাদের বলেন, 'সরকার প্রধান আগেই বলেছেন, দেশে কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনও আইন হবে না। তাই অন্য কোনও পথ না পেয়ে ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে ধর্মীয় সহনশীলতা বিনষ্টের যে কোনও অপচেষ্টা সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।'

যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, তাদের সবাই এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

এখন প্রশ্ন হলো, ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পর ভাস্কর্যবিরোধীরা কি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে? নাকি তারা সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রাখবে? শাপলা চত্বর থেকে হেফজতকে বিতাড়নের পর সরকারের সঙ্গে হেফাজতের একটি সমঝোতার কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত। হেফাজতের সাবেক আমির আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের সমঝতার ভিত্তিতে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তনসহ সরকার কিছু সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। সরকার হয়তো সব ফ্রন্টে একসঙ্গে না লড়ার কৌশল হিসেবেই হেফাজতকে ঠাণ্ডা রাখার পক্ষে গিয়েছিল। তাছাড়া হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামের বিরোধের বিষয়টিও হয়তো সরকার বিবেচনায় নিয়েছিল। বিএনপির চেয়ে হেফাজতকে কম ক্ষতিকর বলেও মনে করা হয়ে থাকতে পারে।

সরকারের এই কৌশল অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি ভালোভাবে মেনে নেয়নি, সমর্থনও করেনি। একসময় যে হেফাজত সরকারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে– এ আশঙ্কা অনেকেরই ছিল। ক্ষমতার রাজনীতির জটিল সমীকরণে সরকার এবং আওয়ামী লীগ, হেফাজতের 'হেফাজত' করে এসেছে। তবে এখন মনে হয় অবস্থা বদলেছে। হেফাজতেরও নেতৃত্ব বদল হয়েছে, শফী হুজুর মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পুত্র এবং অন্য অনুসারীরা হেফাজত থেকে বিতাড়িত। হেফাজতের নেতৃত্ব এখন জামায়াত এবং বিএনপিপন্থিদের দখলে। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের মধুচন্দ্রিমারও অবসান ঘটেছে বা ঘটছে বলে মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান নিয়ে হেফাজত তাদের পরিবর্তিত মনোভাবের জানান দিয়েছে।  সরকার কি তাদের মোকাবিলা করবে? সন্ত্রাস-সহিংসতা মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সাফল্য এবং সাহসিকতার নজির আছে।  বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের নমনীয়তা দেখানোর সুযোগ কম। বঙ্গবন্ধু মানে যেমন বাংলাদেশ, তেমনি বঙ্গবন্ধু মানেই আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকবে আর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য থাকবে না– এই দুরাশা যারা করেন, তারা আসলে আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। হেফাজত এবং তাদের অন্য মুরুব্বিরা শেখ হাসিনার কঠোরতার কথা ভুলে গেলে ভুল করবেন।

মুজিব বর্ষ চলছে। জীবিত শেখ মুজিব যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও সম্মুখযাত্রায়ও তিনিই নেতা। তবে আওয়ামী লীগকে দলগতভাবে, সাংগঠনিকভাবে এখন সব দোদুল্যমানতা, দুর্বলতা পরিহার করে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। মেঘ দেখে ভয় করলে চলবে না, আড়ালের সূর্যটাকে দেখতে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে। দলীয় অহমিকা পরিহার করে সব মুজিবপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তি ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ কিন্তু পক্ষের শক্তি নানা বিভেদ-বিভাজনে ক্ষতবিক্ষত।

সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চোরাপথে যেসব অপশক্তি অপচেষ্টা করছে তা মোকাবেলার জন্য ঐক্যবদ্ধ শক্তি দরকার। অতীতে রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তির মেলবন্ধন আমাদের  বিপদ উত্তরণে সাহায্য করেছে।  আজও নানা উছিলায় যারা দেশের মধ্যে উত্তেজনা, অস্থিরতা, নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে ঐক্যবদ্ধ হয়েই তাদের রুখতে হবে।