ট্রাম্পের ধারাবাহিকতা নাকি বাইডেনের নতুন ইনিংস?

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 9 Sept 2020, 07:42 AM
Updated : 9 Sept 2020, 07:42 AM

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ডনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের মধ্যে এমন এক নির্বাচন এবার হচ্ছে, যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎই নয়, অন্য অনেক বিষয়ের মতো বিশ্বের ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করবে। ইতোমধ্যে দেশটিতে ডেমোক্রেটিক কনভেনশনের পরের সপ্তাহে রিপাবলিকান কনভেনশনেও দলীয় প্রার্থীতা নিশ্চিত করা হয়েছে। দলের প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বাইডেনকেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। যদিও ১৯৮৮ ও ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়েও সাফল্যের দেখা পাননি তিনি। এর পাশাপাশি, তার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবার উদ্যোগ লজ্জাজনক ঘটনার কারণে হোঁচট খাওয়ার ইতিহাসও রয়েছে। অন্যের লেখা চুরি ও অসততার অভিযোগে প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে। তবে সেসব এখন অতীত। এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ট্রাম্প কি আবারও জয়লাভ করতে পারবেন নাকি হোয়াইট হাউসে জো বাইডেন নতুন ইনিংস শুরু করবেন?

কট্টরপন্থী ট্রাম্প মার্কিন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে আস্থার জায়গা হারিয়েছেন বহু আগেই। দেশে-বিদেশে তার নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড জনমনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। এর প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায়। প্রতিটি সমীক্ষাতেই ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছেন৷ তবে ভোটারদের মতিগতি বুঝতে এমন সমীক্ষা যে নির্ভরযোগ্য নয়, চার বছর আগের নির্বাচনে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ যে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের হিলারি ক্লিনটন আপাতদৃষ্টিতে এগিয়ে থেকেও নির্বাচনে হেরে যান বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে৷

ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবার মনোনয়ন দিয়েছে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল জো বাইডেনকে। যিনি তার পূর্বসুরীদের মতো সহজাত উদ্দীপনাময় ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নন। তবে ট্রাম্প-উত্তর আমেরিকাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা তার রয়েছে। যদিও ট্রাম্পকে পরাজিত করতে কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে। কারণ, শারীরিক ভাবে বাইডেন কিছুটা দুর্বল। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়েছে দুইবার। ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনদের অকালমৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন একাধিকবার। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনে যখনই উপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করেছেন, সেগুলো ভেঙে পড়েছে বারবার। এছাড়া বাকপটু হওয়ার জন্যও অনেক খাটতে হয়েছে বাইডেনকে। উল্টোপাল্টা ও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা একসময় তার প্রকট ছিল, এজন্য ব্যঙ্গবিদ্রূপও সহ্য করতে হয়েছে অনেক। এসব ঘটনায় বিপর্যস্ত বাইডেন রাজনীতিতে এতদূর যে আসতে পারবেন এমনটিই ভাবেননি অনেকে।

এবারের নির্বাচনে বর্ণবাদ, কোভিড-১৯ রোধে ব্যর্থতা, বেকারত্ব, সুপ্রিমেসি, উৎপাদন খাতে ধস, ব্যাপক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি, দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এসব নানা ইস্যু সামনে চলে এসেছে। এ নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন ট্রাম্প। এসব ছাড়াও জলবায়ু ফান্ডে অর্থায়ন, অভিবাসী ইস্যু প্রভৃতি বিষয়ে একের পর এক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন।

গণমাধ্যমের সঙ্গেও সাপে-নেউলে সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। সাংবাদিকদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছেন বারবার। ফলে ফক্স নিউজ ছাড়া মূলধারার প্রতিটি গণমাধ্যমই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর পাশাপাশি নারী কেলেঙ্কারি নিয়েও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম খবর প্রকাশিত হয়েছে মিডিয়ায়। এমনকি যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই সময়ও লেখিকা ও কলামিস্ট ই জেন ক্যারল তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। অবশ্য যৌন হেনস্থার অভিযোগ রয়েছে বাইডেনের বিরুদ্ধেও। দুই দশক আগে সিনেটর থাকাকালীন সময়ে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে টারা রীড নামে একজন নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

রাশিয়ার সঙ্গেও প্রথম দিককার সেই সুসম্পর্ক ট্রাম্পের নেই। বিভিন্ন বিষয় নিয়েই দেশ দুটির মাঝে মতভিন্নতা দেখা গেছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধও চরম তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। শুল্ক এবং পাল্টা শুল্কারোপের ভেতর দিয়ে গেছে গত বছরের পুরোটা সময়। এতে যে কোনো পক্ষেরই মঙ্গল হয়নি তা ইতোমধ্যে প্রতীয়মান হয়েছে। বরং বিশ্বের এই বড় দুই পরাশক্তির বাণিজ্যযুদ্ধে পরোক্ষভাবে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি করেছিল।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সমালোচনা কখনোই পিছু ছাড়েনি ট্রাম্পের। গত নির্বাচনের আগে অবৈধ অভিবাসী রুখতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার ধারাবাহিকতা রক্ষায় মেয়াদের পুরোটা সময়ই কাজ করে গেছেন তিনি। এরমাঝেই গত ২৫ মে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড পুলিশ কর্তৃক নিহত হওয়ার পর সারা যুক্তরাষ্ট্রে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ ঘটনা থেকে প্রেসিডেন্ট ফায়দা লুটতে চাইছেন। তিনি বর্ণবিদ্বেষকে উস্কে দিয়ে সাদাদের একজোট করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন, যেন সহজেই নির্বাচিত হতে পারেন। অন্যদিকে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' ব্যানারে বর্ণবাদবিরোধী যে আন্দোলন চলছে, এর সুবিধা নিতে চাইছেন জো বাইডেনও। এরই অংশ হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে তিনি জ্যামাইকান-ইন্ডিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ, ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটের কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের কথা ঘোষণা করেছেন। বাবা কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে কমলা নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। যদিও তার আগে দুজন সাদা রিপাবলিকান সারা পলিন ও ডেমোক্র্যাট জেরাল্ডিন ফেরারো ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন পেয়েও জয়ী হননি।

তবে বর্ণবাদ ইস্যুতে নিজ দলের ভেতরে বাঁধার মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছেন অনেক শীর্ষ নেতা। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, ২০১২ সালের নির্বাচনে বারাক ওবামার কাছে পরাজিত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনি, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল তাকে সমর্থন করছেন না। আসছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে নয়, বরং ডেমোক্রেট মনোনীত প্রার্থী জো বাইডেনকে ভোট দেবেন বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল। স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত কলিন পাওয়েল ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগেও বলেছিলেন, দলের হলেও ট্রাম্পকে তিনি ভোট দেবেন না। এ বছরের ৭ জুন আবার তিনি একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এবারে আরও নাজুক। এছাড়া ২০০৮ সালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইন বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো ট্রাম্পের বিরোধিতা করতেন, কারণ তার সম্পর্কেও অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন ট্রাম্প। কাকে যে আঘাত করেনি ট্রাম্প, সেটা ভেবে দেখার বিষয়!

কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের হত্যাকে ঘিরে সমগ্র আমেরিকায় যে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাতে প্রাক্তন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা সমর্থন জানিয়েছেন। শুধু তারাই নন প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনি সংগ্রামরত মানুষদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। মিট রমনি তো রাস্তায় নেমে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনকারীদের মিছিলে অংশ নিয়েছেন। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাক্তন রিপাবলিকান আর নব্য রিপাবলিকানদের বিরোধও প্রকাশ্যে চলে আসছে।

তবে অনেকেই মনে করছে কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণার মধ্যে দিয়ে জো বাইডেন রাজনৈতিকভাবে ঐতিহাসিক ভুল করেছেন। তাকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে বাইডেন পরাজয়কেই ত্বরান্বিত করেছেন। কারণ, বাইডেনের বর্তমান বয়স ৭৭। জয়ী হলে তিনি ক্ষমতা নেবেন ৭৮ বছর বয়সে। কিছু হয়ে গেলে কমলা হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বাইডেনের স্বাস্থ্য খারাপ নয়, তবে খুব যে একটা ভালো তাও নয়! তাই দ্বিতীয় টার্মে তিনি নির্বাচন করবেন বা করতে পারবেন, সেটি অনেকটা অনিশ্চিত। সেক্ষেত্রে কমলা হ্যারিস হবেন ফেভারিট প্রার্থী। আমেরিকানরা কি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারবে? যদি তা না পারে, তাহলে ট্রাম্পের জন্য জয়লাভ করা সহজ হবে। সেক্ষেত্রে বাইডেনকে আল গোরের পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। আল গোর ইহুদী সিনেটর জো লিবারম্যানকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়ে হেরেছিলেন। ইহুদী বিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী তখন তাকে ভোট দেয়নি।

কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করে বাইডেন হয়তো ভারত বা দক্ষিণ এশিয়াকে বার্তা দিতে চেয়েছে যে, তারা তাদের সঙ্গে আছে! তবে ভারতীয় মার্কিনীরা এতে ধরা দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, কমলা তো আর হিন্দু নন। তার মা মাদ্রাজের হিন্দু, বাবা জ্যামাইকান খ্রিস্টান। স্বামী ইহুদী। তাছাড়া কমলা হ্যারিস বর্ণগত ভাবে আমেরিকার দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সাথে নিজের পরিচতি তুলে ধরতে রাজনৈতিক ভাবেও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে বাইডেন কমলাকে রানিংমেট হিসেবে বেছে নিলেন কেন? কোন কৃষ্ণাঙ্গ নারী এর আগে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হননি। এর কারণ হচ্ছে, জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকে ঘিরে উত্তপ্ত আমেরিকায় বাইডেন এবার কালোদের ভোট চাইছেন। কমলাকে সাথে নিয়ে বাইডেন জানান দিতে চাচ্ছেন, বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে কাজ করতে তিনিই বর্তমানে সবচেয়ে যোগ্য। আরও ইক্যুয়েশন হচ্ছে, ট্রাম্পের কাছে কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে বলার মতো তেমন কিছু এখনও নেই। তবে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধে প্রভাবিত মার্কিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনো কোন নারীকে প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্য মনে করেনি।

ভোটের ইক্যুয়েশনে কৃষ্ণাঙ্গ ভোট যদি বাইডেনের ব্যালটে যায় তবে ভারতীয় আমেরিকানদের ভোটের সিংহভাগই পাবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কারণ, ভারত-আমেরিকা বা মোদী-ট্রাম্প সম্পর্ক এখন সর্বকালের সবচেয়ে ভালো সময় অতিক্রম করছে। উপমহাদেশের অন্য অংশের হিন্দুত্ববাদীদের ভোটও ট্রাম্প পাবেন। এর মূল কারণ হচ্ছে কাশ্মীর, চীন ইত্যাদি ইস্যুতে ট্রাম্প শক্তভাবে মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। অপরদিকে কাশ্মীর, নাগরিকত্ব আইন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে তারা হিন্দুত্ববাদের জন্য বিপদজনক মনে করে। তাছাড়া ভারতীয়রা এখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রেখে প্রভাবশালী শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে পারঙ্গম।

এর পাশাপাশি কারণটি হচ্ছে, ভারতীয়দের বড় অংশটি শ্বেতাঙ্গদের নিজেদের পরম মিত্র ভাবতে পছন্দ করে। যদিও ভারতীয় ভোট মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি, কিন্তু যে কয়টি অঙ্গরাজ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সে সমস্ত রাজ্যে ভারতীয় আমেরিকানদের বড় অংশটি বাস করে। ফলে তাদের ভোট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। বাইডেন হয়তো কৃষ্ণাঙ্গ ভোট ব্যাংকের পাশাপাশি ভারতীয় আমেরিকানদের এ ভোট ব্যাংককেও এবার টার্গেট করতে চাইছেন। তবে হিন্দুত্ববাদীদের বিপরীতে সবরকম ইসলামপন্থীদের ভোট বাইডেনের ব্যালটেই যাবে। বারাক ওবামার শাসনামলে ইসলামপন্থীরা আমেরিকার যে আনুকূল্য পেয়ে আসছিল ট্রাম্প ক্ষমতায় আসাতে তা খর্ব হয়েছে।

গত নির্বাচনে মূলত শ্বেতাঙ্গদের ভোটেই নির্বাচিত হন ট্রাম্প। তবে এবার বেশ কয়েকটি কারণে তাকে ভুগতে হচ্ছে। প্রথমত, তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তীব্র সমালোচনা করতে পছন্দ করেন। গত নির্বাচনে তিনি হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে কাজটি সফলভাবে করতে সক্ষম হলেও একই কৌশলে এবারে এখন পর্যন্ত সফল হননি। তবে প্রতিনিয়ত কৌশলে পরিবর্তন আনছেন তিনি বাইডেনকে বাক্যবাণে ধরাশায়ী করতে, আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন। বাইডেনের অতীতের কিছু লজ্জাজনক ব্যাপার এক্ষেত্রে তার পক্ষে যেতে পারে। তবে মহামারী ব্যবস্থাপনায় ট্রাম্পের বিভিন্ন ব্যর্থতার কারণে সুযোগ বাইডেনও নিয়েছেন। গত নির্বাচনে ট্রাম্পের 'ট্রাম্পকার্ড' বয়স্ক ভোটাররা এবার আর পাশে নেই। ইউগভের তথ্যানুসারে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ভোটাররা এবার বাইডেনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। গত নির্বাচনে হিলারি এই অংশের সমর্থন পাননি। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে যারা ট্রাম্পের জন্য দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন অভিজাত নয় এমন শ্বেতাঙ্গ ভোটাররাও অনেক জায়গায় প্রেসিডেন্টের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিচ্ছেন।

তবে ট্রাম্পের জন্য পজিটিভ দিক হলো, ১৯৯২ এর পর থেকে আর কোনো ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকেই পরাজিত করা যায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গত আঠাশ বছরে মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে দুই মেয়াদে কাজ করতে সুযোগ দেবার একটা ট্র্যাডিশন দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারীকে বাইডেনের রানিংমেট হিসাবে বেছে নেয়াটা মার্কিন সমাজের রক্ষণশীল এবং খ্রিস্টীয় মৌলবাদী অংশটি–যাদের বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে তারা পছন্দ করছে না। এই অংশটা প্রেসিডেন্টের দিকে ঝুঁকবে। এর পাশাপাশি এবার ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থীতার লড়াইয়ে থাকা বার্নি স্যান্ডার্সের অনুসারীদের ভোটও বাইডেনের বিপক্ষে যেতে পারে। তদুপরি, ট্রাম্পের সহযোগীদের ধারণা, সিদ্ধান্ত নেননি এমন ভোটারদের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের ঝুলিতেই শেষপর্যন্ত আসবে। আর গতবারের মতোই তাদের পক্ষে থাকতে পারে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটগুলোও।

ভারতে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগানের মতো ট্রাম্প 'আমেরিকা ফার্স্ট' বা 'মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন' স্লোগান দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের আবারও একবার একই ছাতার তলে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এই স্লোগান দিয়ে তিনি মহান আমেরিকা বলতে কলম্বাসের আবিষ্কৃত সেই আমেরিকাকেই বুঝিয়ে যাচ্ছেন; যা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যেরই নামান্তর। তবে কোভিড-১৯ ইস্যু, প্রায় দুই লক্ষ মৃত্যু নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্টকে ধরাশায়ী করতে চাইবেন। অর্থনীতির প্রশ্ন আসবে। তবে তেমন সুবিধা হবে না। কারণ, ট্রাম্প ব্যবসা ভালো বোঝেন। অর্থনীতির নানা সূচক ওঠানামা করছে ঠিকই কিন্তু খুব খারাপ পর্যায়ে যায়নি। ছয় মাস সবকিছু বন্ধ থাকলে হয়তো যেতে পারত। এ কৃতিত্ব ট্রাম্প নিশ্চয়ই নেবেন।

এছাড়াও গতবারের নির্বাচনের মতো এবারও কোন চমক ট্রাম্পের পক্ষে গেলে অবাক হওয়ায় কিছু থাকবে না। গতবার এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালক জেমস কমি ট্রাম্পের জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, এবারও তেমন কিছু ঘটে যেতে পারে। ভোটের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কমি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বহু ভোটারের মন ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তেমন কোনো চমক হয়তো থাকতে পারে।

বাস্তবতা হল বিভক্তির সূত্রকে মার্কিন সমাজে যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাম্প। সেই সূত্র প্রয়োগ করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ইদানীং মোটাদাগে অভিযোগ হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতি থেকে আমেরিকাকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়ে আসছেন, ফলে বিশ্বে আমেরিকার প্রভাব বজায় থাকবে কিনা, এ প্রশ্নে মার্কিন স্টাবলিশমেন্ট উদ্বিগ্ন। এতসব অভিযোগ নিয়ে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর দ্বিতীয় মেয়াদে জিতে আসার কথা না। তবে ট্রাম্পকে ঘিরে জয়ের স্বপ্ন দেখছে অনেকেই। এর কারণ হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সেই বাইডেনকে অনেকে ট্রাম্পের চেয়েও দুর্বল প্রার্থী হিসাবে মনে করছে। তবে ট্রাম্প যদি বর্তমান পরিস্থিতির মোড় ফেরাতে চান, তাহলে তাকে কোভিড-১৯ নিয়ে কাজ এবং অসংলগ্ন কথা—দুয়েই পরিবর্তন আনতে হবে, অর্থনীতিতেও গতি ফেরাতে হবে। এই অসম্ভবগুলো সম্ভব করার পর জরিপগুলোও হয়তো তার পক্ষে কথা বলতে শুরু করবে।