মোদীর ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’, তিস্তা ও শ্রিংলার ‘কোভিড কূটনীতি’

স্বদেশ রায়
Published : 22 August 2020, 05:39 PM
Updated : 22 August 2020, 05:39 PM

মোদীর 'বাংলাদেশ ফার্স্ট', তিস্তা ও শ্রিংলার 'কোভিড কূটনীতি'

স্বদেশ রায় 

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার 'কোভিড কূটনীতির' কারণে গত এক সপ্তাহ জুড়ে ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্কটি আবার সামনে এসেছে। পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শ্রিংলা একবার ঢাকা এসেছিলেন। সে সময়ে তার সফর  ওইভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি। কিন্তু এবারের সফর প্রথমত তিনটি কারণে, দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে-

এক. ভিজিটটি অনেকখানি অনির্ধারিত বা দ্রুত গতিতে হয়েছে। 

দুই. করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার প্রত্যাশা নিয়ে এই প্রথম কোনও দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সফর। 

তিন. এ সফরের দিন ভারতের পত্র পত্রিকায়, তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও নদী সংস্কার বিষয়ক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ এ সফরে গুরুত্ব পাবে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। আর ভারতের সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের মধ্যে চীনের এ প্রকল্প নিয়ে এমন একটি সময়ে রিপোর্টগুলোতে উল্লেখ করা হয়, যখন ভারত ও চীনের সীমান্ত নিয়ে একটা সমস্যা চলছে। যাহোক, শেষ অবধি দৃশ্যত সফরটি 'কোভিড কূটনীতি'র সফরের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে। 

ভারত ও বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন দুইটি প্রতিবেশী যে কেউ কাউকে অস্বীকার করে কখনই চলতে পারবে না। উভয়ে উভয়কে অতি মাত্রায় আন্তরিকতার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে। এবং সে স্বীকারকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। বাংলাদেশ আজ যে কূটনীতি অনুসরণ করছে এই কূটনীতির প্রণেতা ও ভিত্তি প্রদানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তার দেশের কূটনীতি কী হবে সেটা সত্তরের নির্বাচনী ভাষণেই মূল রূপরেখা দিয়েছিলেন। তিনি সত্তরের নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন, "তিনি নির্বাচিত হলে তার পরিচালিত সরকার কোন দেশের সঙ্গে কোনরূপ যুদ্ধে জড়াবে না এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখবে।"

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোতে তার এ কূটনীতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু ওই নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করেই তার স্বাধীন দেশের সরকার গঠিত হয়। এবং সেই সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি তার ক্ষমতাকালে এই কূটনীতিই চালুকরণে। বর্তমানের শেখ হাসিনা সরকার  সে নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন শতভাগ। তাই দেখা গেল, ভারত ও চীন  তাদের সীমান্ত নিয়ে একটি উত্তেজনাময় পর্যায়ে চলে যায়।  এবং ভারতের নিরস্ত্র ২০ জন সামরিক বাহিনীর সদস্যকে আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে অন্য বস্তু দিয়ে আঘাত করে চীনা সেনারা হত্যা করে।  তখন বাংলাদেশ কোনও পক্ষ নেয়নি। বরং বাংলাদেশ সরকার নানান কথার ভেতর দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অবস্থান যে কোনও ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। অন্যদিকে সত্তরোর্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিডের মধ্যেও নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ বার্তা নিয়ে আসা তার পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে নব্বই মিনিটের মিটিং করে বুঝিয়ে  দিলেন বাংলাদেশ প্রতিবেশীর সঙ্গে সব সময়ই বিশেষ সম্পর্ক রাখে। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশ সৃষ্টির এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফরের ভেতর দিয়ে নতুন দেশটি জন্যে ভিন্ন কূটনীতি চালু করেন।  বাংলাদেশের জন্যে তিনি যে নীতি অনুসরণ করা শুরু করেন -সেটা তাদের চাণক্যনীতির খানিকটা বাইরে চলে আসা। অর্থাৎ নিজের স্বার্থকে সব সময় সর্বোচ্চ না দেখে বাংলাদেশের সঙ্গে গভীরতম সম্পর্ক রাখা। বস্তুত ভারতের তিন সংযুক্ত প্রতিবেশী অর্থাৎ নেপাল, ভূটান ও বাংলাদেশের ভেতর বাংলাদেশের অবস্থান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কারণ, নেপাল ও ভুটানের নাগরিকরা ভারতের নাগরিকদের মতই ভারতের ইউনিয়ন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভারতের সরকারি চাকরি করতে পারেন। 

অন্যদিকে, মুজিবনগর সরকারের আমল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত আলাদা এবং সমমর্যাদার দেশ। তাই স্বাভাবিকই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সব সময়ই পারষ্পারিক মর্যাদার এবং পারষ্পারিক ন্যায্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। এর বাইরে কিছু নয়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব নেতা হবার কারণে ইন্দিরা গান্ধী সরকার তাকে সব সময়ই সে মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতর যে কোনও সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে। 

আর সে কারণেই ভূ-সীমান্ত রেখা, গঙ্গা পানি চুক্তি এগুলো বঙ্গবন্ধুর সময়ে দ্রুত এবং মর্যাদার সঙ্গে হয়। শেখ হাসিনাও বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম নেতা হিসেবে, সার্কের সব থেকে বড় নেতা হিসেবে সেই সম্মানই ভারতের কাছে পান। 

শেখ হাসিনার ২০১৭ ও ১৯ এই দুটি সফরের সময়ই দিল্লি অবস্থান করে সাংবাদিক হিসেবে যে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা যায় সেখানে থেকে দেখেছি, তাদের সিনিয়র নেতা আদভানি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সকলেই শেখ হাসিনাকে ভিন্ন সম্মান দেন। তিনি শুধু  যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম নেতা, সার্কের সব থেকে বড় ও গ্রহণযোগ্য নেতা- এ সম্মান তাকে সবসময়ই দেওয়া হয়। 

আদভানি তাকে সার্কের মূল নেতা হিসেবেই সম্বোধন করেন। তাই শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। পৃথিবীর অনান্য দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এমনকি আমেরিকা ও মেক্সিকো-র ভেতরকার সমস্যার সঙ্গে হিসেবে করলে দেখা যাবে, শেখ হাসিনা অনেক বেশি সফল ভারতের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে। তারপরও রাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে সমস্যার সৃষ্টি হবে এবং প্রতি মুহূর্তে সেটা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে। 

প্রতিবেশী উভয়ে উভয়ের শত্রু হলে পরষ্পরের ক্ষতি হয়। যে ক্ষতি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েরই। এই ক্ষতি বাংলাদেশেরও হয়েছে। কারণ জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া পাকিস্তানকে খুশি করতে গিয়ে মূল প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কখনই সুসম্পর্ক গড়তে পারেনি। একারণে তিনি ভারত ও বাংলাদেশের কোনও সমস্যাই সমাধান করতে পারেননি।  এই তিন জনের কারণেই ভারত ও বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা শেখ হাসিনাকে সমাধান করতে হচ্ছে। যেমন জিয়ার আমলে ইন্দিরা গান্ধীর সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, খালেদার আমলে রাজীব গান্ধীর প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সংসদে। কিন্তু কেউই উদ্যোগ নিয়ে ভারত বাংলাদেশ ল্যান্ড বাউন্ডারি সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। যেটা পরে সমাধান করতে শেখ হাসিনাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বিজেপি সংসদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া অবধি। 

জিয়া ও এরশাদের যেমন নতজানু কূটনীতি ছিল তেমনি খালেদা জিয়া ভারতের ক্ষেত্রে মেনে চলেছেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশিত পথ। একথা সত্য, সামরিক শাসক বলে জিয়া ও এরশাদ কখনও সঠিক রাষ্ট্র নায়কের সম্মান ভারতে পাননি। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেগম জিয়াকে তারা সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। এমনকি বিরোধীদলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভারতে আমন্ত্রণ করে তাদের হায়দ্রাবাদ হাউজে তাকে ভিন্ন মর্যাদা ভারত সরকার দিয়েছিল। সে সময়ে দিল্লির অনেক সাংবাদিককে বলতে শুনেছি, অনেক দেশের সরকার প্রধানও এই সম্মান পান না ভারতে। কিন্তু তার বিনিময়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর নির্দেশ মত বেগম জিয়া কী করেছিলেন? তিনি গোটা ভারতরাষ্ট্রটিকে এবং ভারতের জনগণকে অপমান করেন নিজ দেশে বসে। কারন, তার দেশে সফররত ভারতের জনগণের ও রাষ্ট্রের প্রতীক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে তিনি দেখা করেননি। প্রণব মুখার্জী তার জন্য অপেক্ষা করলেও তিনি তার সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত বেঠকে যোগ দিতে যাননি। এমনকি ভদ্রতা করে তার না যাওয়ার বিষয়টি তাকে ফোন করেও জানাননি।

বেগম জিয়ার এই আচরণের পরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে ভারতের জনগণের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উচ্চে। তার প্রমাণ মেলে ২০১৯ এ শেখ হাসিনার পেঁয়াজ সংক্রান্ত বক্তব্যের পর। তার বক্তব্যে দিল্লীর মানুষ এতই মুগ্ধ হন যে শুধু দিল্লীর সাংবাদিকরা নন, একজন কাশ্মীরি চাদর বিক্রেতা যখন জানতে পারেন আমি বাংলাদেশি- সে সময়ে তিনি বলেন, "আমাদের প্রধানমন্ত্রীর থেকে হাসিনাজি এখন ভারতে বেশি জনপ্রিয়। তিনি ভারতে নির্বাচন করলে কারো কাছে ভোট চাওয়া লাগবে না এমনি ভোট দিয়ে দেবে।"

আর এই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ ও ২০১৯ এ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সামনে দেওয়া তার বক্তব্যে বলেন, তার কাছে ' বাংলাদেশ ফার্স্ট'। তিনি তার পররাষ্ট্র নীতিতে প্রথম গুরুত্ব দেন বাংলাদেশকে। এবং তিনি অনেকখানি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার তিস্তা চুক্তি না করতে পারার ব্যর্থতার কথা। তিনি তার ওই ভাষণে আরও বলেছিলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে তিস্তা পানি চুক্তি হবে। 

কোন হিসেবে তিস্তা পানি চুক্তি এক বছরের মধ্যে করতে সমর্থ হবেন সেটা অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুলে বলেননি। তবে এটা বলেছিলেন তিনি ২০১৭ সালে। তারপরে তিনি নির্বাচনে অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি দ্বিতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু তারপরেও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে তিস্তা পানি চুক্তি জুড়ে তিনি নিশ্চয়ই এক বছরের কথা বলেননি। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের ওই কথা শুনে মনে করেছিলাম, তিনি মনে হয় আই কে গুজরালের পথে হাঁটছেন। গুজরাল তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা পানি চুক্তি করার আগে তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে পুরোপুরি সাড়া পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি সংবিধানের মধ্যে থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই চুক্তির কথা ভাবছিলেন। মি. মোদির ওই বক্তব্যের পরে তাই স্বাভাবিকই মনে করেছিলাম, তিনি হয়তো গুজরালের পথে হাঁটবেন। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ এখনো অবধি দেখা যায়নি। বরং গত এক বছরের বেশি সময়ে তার দেশ থেকে তার মন্ত্রীরা এমন কিছু বার্তা দিয়েছেন যা বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। যেমন আসামের নাগরিকত্ব আইন। বিষয়টি আদালতের। মোটেই তার সরকারের নয়। এই মামলা আদালতে যায় কংগ্রেস সরকার অর্থাৎ রাজীব গান্ধীর আমলে। এই মামলার রায়ের ফলে প্রাথমিক নাগরিকপঞ্জিতে আসামে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়েছেন। বিষয়টি উচ্চ আদালতে গেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাবেক সম্পাদক হিরন্ময় কারলেকারের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলাপ করার সময় তিনি বলেন, "দেখ বিজেপির কতকগুলো নেতা আছে যেগুলো মুর্খ। মোদীর উচিত এদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া।  আসামের নাগরিকপঞ্জির প্রাথামিক রায় আসতে লেগেছে ৩৫ বছর। এটা এখন উচ্চ আদালতে। শেষ হতে আরও পঞ্চাশ বছর সময় নেবে। ততদিনে জল কোথায় গিয়ে গড়াবে তা কেউ জানে!" 

অন্যদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অসম্ভব রকমের বাংলাদেশী ও বাঙালি বিদ্বেষী এক বক্তব্য দেন। ওই দিন দিল্লীর একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অভিলাষ পুলজাল কথা প্রসঙ্গে বলেন, "বাস্তবে আমাদের এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দিল্লি মিউনিসিপ্যালিটির একজন কমিশনার হবারও যোগ্য নয়। মোদীর জনপ্রিয়তায় পাস করে এখন প্রতিমন্ত্রী হয়েছে। ওর কি কোনও ধারণা আছে এই নাগরিকপঞ্জি সম্পর্কে।" একথা সত্য আসাম বা  পশ্চিম বাংলায় এই পূর্ববাংলা থেকে যাওয়া মানুষদের নাগরিকত্বজনিত সমস্যাগুলোর জন্য এই নাগরিকপঞ্জি  আসলে কোনও সমাধান নয়। ভারতের উচ্চ আদালতকে এটা আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। এমনকি এ সম্পর্কে বিজেপির অনেক নেতারই ধারণা নেই। অনেকেই জানেন না তাদের নাগরিকত্ব আইন যেটা ১৯৫৫ সালে করা হয়েছিল সেখানে বলা হয়- ১৯৫৫ অবধি যারা ভারতে আছে বা ব্রিটিশ ভারতের যে কোন জায়গায় জম্ম নেওয়া যিনি ভারতে এসেছেন তারা ভারতের নাগরিক। 

কিন্তু বাস্তবে তো নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান চলেনি। তারপরে ১৯৬২, ১৯৬৪তে পূর্ব পকিস্তানে  দাঙ্গা হয়। অনেক পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক ভারতে যায় এবং এখন তারা ভারতের ভোটার। এখন পুরুষানুক্রমে ভারতে বাস করছে। তাই বিজেপির  মাথার ভেতর থেকে নাগরিকপঞ্জিকে বের করতে হবে। বরং আরো বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তা নাহলে এভাবে চলতে থাকলে তার দলের নেতারা লাগামহীন বক্তব্য দিয়ে যাবেন এবং সেটা বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের জন্যে অস্বস্তিকর হবে। 

সর্বশেষ এবারের শ্রিংলার সফরের আগে ভারতের মিডিয়াতে তিস্তা প্রসঙ্গটি এসেছে চীনকে জড়িয়ে। অর্থাৎ তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও নদী সংস্কারের জন্যে চিনের এক বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নিয়ে। তিস্তায় বর্তমানে যে পানি আছে তাতে তিস্তা চুক্তি হলেও এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্যে প্রয়োজনীয়। কারণ, শুধু তিস্তা নয় বাংলাদেশের অনেক নদীই এখন সংস্কার প্রয়োজন। আর এ কারণেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন চীন সফরে গিয়েছিলেন তখন অনেকগুলো প্রকল্পের মধ্যে এটাও ছিল। তবে এটা এখনো পরিকল্পনা কমিশনে। তাছাড়া এটাকে অর্থায়ন করবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। যাদের সুদের হার সব মিলিয়ে পাঁচ পার্সেন্টের মত হবে। এ অবস্থায় ভারতীয় মিডিয়ার অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, তাদের দেশ বিষয়টি নিয়ে স্পর্শকাতর। তারা হয়তো খানিকটা উদ্বিগ্ন তাদের সীমান্তে চীনের এমন একটি প্রকল্প নিয়ে। প্রতিবেশি দেশ পরষ্পরের অনেক কাজে এমন উদ্বিগ্ন হতে পারে। যেমন আমরা উদ্বিগ্ন নাগরিকপঞ্জি নিয়ে। অবশ্য যেহেতু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক শুধু ভালো নয়, দুই দেশের কাছেই 'প্রতিবেশী আগে' নীতিই মূল। তাই ভারতের মিডিয়ার উদ্বেগের সঙ্গে যদি ভারত সরকারের কোনও যোগ থাকে তাহলে তাদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তারা বাংলাদেশের অনেক উন্নয়নের অংশীদার। তাদের লাইন অব ক্রেডিটে অনেক উন্নয়ন এখানে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এক বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পে  চীনের এক্সিম ব্যাংকের পাঁচ শতাংশ সুদের বদলে ভারতের লাইন অব ক্রেডিটে বা অন্য কোনওভাবে ১ শতাংশ সুদে হলেও হতে পারে। নিশ্চয়ই একটা সমাধানে দুই দেশ আসতে পারবে। কারণ, দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের জন্যে কখনই কোন সমস্যা শেষ অবধি সমস্যা থাকে না। আর শ্রিংলার মাধ্যমে 'কোভিড কূটনীতি' যদি সব মিলিয়ে এ বার্তা দেয়- দুই দেশ যে কোনও সমস্যারই সমাধান আন্তরিকতার সঙ্গে করবে।  তাহলে বলা যায়, এই কোভিড কূটনীতি নিশ্চয়ই দুই বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্য ঘটে যাওয়া একটি সফল বিষয়।