মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারলে, আমরা পারবো

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 August 2020, 04:07 PM
Updated : 6 August 2020, 04:07 PM

ঈদ-উল-আজহা শেষ হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। করোনাভাইরাসের কঠিন সময়েও মানুষ যতোটা সম্ভব তাদের সাধ্যমতো আনন্দ উৎসব করেছেন। এই ফাঁকে একটা বড় খবর আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে বলে মনে করি। পশুর হাট নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া সরগরম তখন আসাম সীমান্তে চারজন বাংলাদেশিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে- গরু চোর সন্দেহে। 

ভালো করে দেখুন খবরটি। ওরা যে চোর তাও কিন্তু প্রমাণিত না। আর প্রমাণ হলেও কি পিটিয়ে মারা জায়েজ? আইন আছে, পুলিশ আছে, সাজা আছে। সেসব কিছু না করে সরাসরি পিটিয়ে মেরে ফেলা! কি সাংঘাতিক আর কি নির্মম! ঘটনাটা ঘটার পর থেকে আমি খেয়াল করছিলাম আমাদের দেশের সরকার বা উচ্চ পর্যায় থেকে কী বলা হয়। 

না, তারা চুপ থাকেন নি। তারা কী বলেছে জানেন? সবাই যেন আরো শান্তিপূর্ণ আর সহনশীল হয়ে ওঠে। শুনে মনে হলো- কোনও নতুন বুদ্ধের বাণী শুনলাম।  প্রতিবাদ বা বিবৃতি দূরে থাক একটু যে কড়া করে বলা সেটাও দেখলাম না। এই কারণে আমার মনে হলো- দেশের পররাষ্ট্র নীতিতে যে একটা কথা আছে, 'সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা না',  এ কথাটা কতো ঠুনকো। যদি সেটাই সত্য হতো আমাদের দেশ থেকে এখনো কোনও কোনও দেশে যাবার ব্যাপারে আপত্তি থাকতো না। 

ধর্ম রাজনীতি বা বড়ভাইদের খুশি রাখার কারণে একসময় আমাদের পাসপোর্টে তাইওয়ান, রোডেশিয়া যা এখন জিম্বাবুয়ে- সেখানে যাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। অথচ এদের সাথে আমাদের কোনও বিবাদ নাই। বিবাদ নাই ইসরায়েলের সাথেও। আরবের দেশগুলো থেকে আকছার মানুষজন সেখানে যায় আসে কিন্তু আমরা যেতে দেই না। কিন্তু বলি- সবার সাথে মিত্রতা চাই।

ভারতে এর আগেও সীমান্তে মানুষ মরেছেন। ফেলানীকে নিয়ে প্রচুর লেখাপত্রও হয়েছে। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। অথচ আমাদের চোখের সামনে পাল্টে যাওয়া রাজনীতি আর দৃশ্যপটে কতো সব কাণ্ড ঘটে চলেছে। চীনের সাথে ভারতের লাগালাগি পুরনো। একসময় হিন্দি-চীনা ভাই ভাই হলেও চৌ এন লাই ভাইকে মারতে ছাড়েনি। সে মার খাবার দু:খ সহ্য করতে না পেরে নেহেরু অকালে বিদায় নিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি এখনো। পাকিস্তান সেই তখন থেকেই চীনের দোস্ত। এতটাই দোস্ত যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে এসে লাগতো চীনা বুলেট। পাকিস্তানের সাথে চীনের মিত্রতা পুরনো। চীনে মুসলিম নির্যাতন হোক, মারুক, কাটুক অন্যদিকে পাকিস্তানে জঙ্গিরা দুনিয়া একদিকে নিয়ে গেলেও তাদের স্বার্থও সম্পর্ক অটুট। এই প্রাচীন কৌশলগত সম্পর্কে নতুন বন্ধু বাংলাদেশ কতোটা সুবিধা নিতে পারবে? কতোটা আপন হতে পারবে চীনের?

এখানে দুটি কথা বলতেই হয়। বিএনপিসহ আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির মূল শক্তি হলো ভারতবিরোধিতা। বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে তারা সার্থকভাবে এটা প্রচার করতে পেরেছে- আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারতের সেবাদাস। ইন্দিরা গান্ধী, বাজপেয়ী বা মোদীর আমলে ভিন্ন ভিন্ন ইমেজ কিংবা তাদের নীতিতে যতো পরিবর্তনই আসুক না কেন, আওয়ামী লীগের কপালে সেই লেখা এখনো অটুট। তাই হঠাৎ করে ইমরান খানের ফোন আর আলাপে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা আসলে কতোটা সেটা ভাবার বিষয়। 

রাজনীতি জটিল বিষয়। সবাই জানেন আমাদের দেশে সমস্যার ওপর বিষফোঁড়ার নাম রোহিঙ্গা। বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক মহলের অভিমত চীনের হাত আছে এর পেছনে। মিয়ানমারের এই এলাকায় ফ্রি পোর্ট খোলার জন্য নাকি এই বিতাড়ন!

এদিকে আমরা উপমহাদেশের রাজনীতিতেও ব্যাপক মেরুকরণ দেখছি। ইতোমধ্যে চীন আফগানিস্তান আর পাকিস্তান মিলে হয়েছে নতুন এক বলয়। শোনা যায় মালদ্বীপও আছে সাথে। এদিকে ভুটানের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও এখন তাতে চিড় ধরেছে চীনের চাহিদা- তাদের কোনও কোনও এলাকার আসল মালিক নাকি চীন। কিছুদিন আগেও শ্রীলংকার সাথে নিবিড় সম্পর্কে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বন্দর সহযোগিতা এখন তোপের মুখে। শোনা যায়, যেসব শর্তে শ্রীলংকা ঋণ নিয়েছিল তা শোধ করতে না পারায় বন্দরগুলো, এখন চীনের মালিকানাধীন। নেপাল অবশ্য এখন চীনের সাথে হানিমুন পিরিয়ডে। তাদের যৌথ ভারত বিরোধিতা চরম পর্যায়ে। বলাবাহুল্য লোকসানে আছে ভারত। তারা বলতে গেলে প্রতিবেশিদের সাথে বন্ধুত্ব আর বৈরিতার সমান পাল্লায় কোথাও কোথাও দুশমন হয়ে আছে। এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশ কী করবে?

একটা কথা পরিষ্কার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে আমাদের যেমন ভারতকে প্রয়োজন তেমনি চীনকেও অবহেলা করা যাবে না। চীনের যে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দানের ঘোষণা বা তাদের যে শক্তি তা ভারতের নেই। কিন্তু এগুলোর শর্ত আর ভবিষ্যতও ভাবা দরকার। আগেই বলেছি আমাদের পররাষ্ট্র নীতি মুখে যাই বলুক আসলে অস্পষ্ট। শক্ত বা দৃঢ় কোন অবস্থান কখনো নিতে দেখা যায় নি। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর আমল আর শেখ হাসিনার গোড়ার দিকের স্পষ্ট ঋজু ভূমিকাই ছিল ব্যতিক্রম।

গরু চোর মারতে আগ্রহী প্রতিবেশিদের সাথে যেমন বন্ধুত্ব করতে হবে জেনে বুঝে, তেমনি নতুন মিত্র সম্পর্কেও সাবধান থাকা দরকার। সবচাইতে বড় বিষয় আমাদের দেশের মানুষ ও রাজনীতির গতি প্রকৃতি। মানুষ  এখনো সমাজ ও জ্ঞান বিবেচনায় যে তিমিরে সে তিমিরেই আছে। আওয়ামী লীগ এতো বছর বারবার দেশ শাসনে থাকার পরও এ নিয়ে কোনও বড় কিছু করতে পারেনি। বরং তাদের নিজেদের ভেতর ক্রমাগত অন্ধত্ব আর উগ্রতা বেড়েছে। আইন করে মানুষের মুখ বন্ধ করা সাময়িক। একসময় সবকিছু খোলসা হবেই। তাই মানুষের মন বা পালস বোঝার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা আছেন বলেই এখনো তাদের দেশ শাসন আর পথচলা নিরাপদ। কিন্তু সময় তো বহমান। তার বয়স হচ্ছে। নতুন কেউ  বা কারা আসবেন সেটাও কেউ জানে না। অন্যদিকে রাজনীতি বলতে গেলে অচলায়তন। বুদ্ধিবৃত্তি আছে- কি নাই, বোঝা মুশকিল। কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো দূরে থাক চোখও খোলেন না। অথচ এমন সব কঠিন সময় আর সংকটকালে তারাই পারতেন পথ দেখাতে।

আমরা ইতিহাস দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মম পরিণতি দেখতে হয়েছে আমাদের। আমরা বাকরুদ্ধ নেতৃত্বহীন সমাজ দেখেছি। দেখেছি বছরের পর বছর জেনারেলদের একনায়কতান্ত্রিক শাসন। আমাদের বুকের ওপর চলেছে নিরব স্ট্রিম রোলার। কথাহীন, কাজহীন- এক আপসকামী জাতির খোলস থেকে মুক্তি পেতে কতো মানুষ জান দিয়েছিলেন আজ তাদের কেউ মনেও করে না। তাই সামাজিক মিডিয়ার এ সরবকালে ভয় পাই মানুষ যেভাবে আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থনির্ভর তাতে কোনও কিছু উল্টে গেলেও, তাদের কিছু আসবে যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের ভৌগলিক অবস্থান আর সামাজিক নিরাপত্তা মাথায় রেখে বন্ধু চেনা আর পরিচিত বন্ধুকে ঠিক করে চলার পথে আসতে বাধ্য করাই মূল কাজ। সে শক্তি বাংলাদেশের আছে। যদি ওপরের মহল সচল ও সবল হয়, বাংলাদেশ পারবে তার অবস্থান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে।

সবার আগে মেরুদণ্ডটা সোজা রাখা জরুরি।