দাবায়ে রাখা যায়নি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 July 2020, 02:01 PM
Updated : 16 July 2020, 02:01 PM

তের বছর আগের ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই দিনটি নিন্দা, ক্ষোভ ও হতাশার। দুর্ভাগ্যজনক তো বটেই। একইসঙ্গে তা সাহস ও দৃঢ়তার, সংকল্প ও একাগ্রতার, আবেগ ও উদ্দীপনার। ওই দিন বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন বাহিনী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে তাঁর ধানমণ্ডি সুধা সদনের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সে সময়ের টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার ও আদালতে তোলার সময় সামান্যতম শিষ্টাচার-সৌজন্য প্রদর্শন করা হয়নি। কিন্তু পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই শেখ হাসিনা ছিলেন ধীরস্থির, কিন্তু নির্ভীক ও সংকল্পবদ্ধ।

'ওয়ান ইলভেন' সংঘটিত হয়েছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। জরুরি অবস্থা জারি করে বিএনপি থেকে মনোনীত রাষ্ট্রপতি অধাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদের হাতে। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমদ ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জরুরি আইন জারির আগের কয়েকটি মাস শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভূয়া ভোটার তালিকা বাতিল, কলঙ্কিত ও নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিচারপতি আবদুল আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বাতিল ও বিএনপির দুঃশাসনের হোতাদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠেছিল প্রবল গণআন্দোলন।

রাজপথে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেও এ আন্দোলন দমন করা যায়নি। জনগণ প্রকৃতই ছিল অদম্য। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রথম মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন, ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু- রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল নেতা ও তাদের অনুগামী রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ছিল দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্তরাও দুর্নীতিবাজ তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত 'হাওয়া ভবন' চক্রের অপশাসন অবসানের দাবি নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি পাতানো-ভূয়া নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছিল। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির ২০ জনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ নেতা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন। রাজপথের আন্দোলন মোকাবেলায় বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ঠেঙ্গারে বাহিনী ব্যবহার করে।

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর মতোই সশস্ত্র দল গড়ে তুলেছিল খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় থাকার সুযোগ নিয়ে। ২০০৮ সালের ২৮ অক্টোবর তারা পল্টন এলাকা ও অন্যান্য স্থানে সশস্ত্র শক্তি প্রদর্শন করে। কিন্তু জনগণ ছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে। তাঁর 'লগি-বৈঠা' নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাকে অভাবনীয় সাড়া মেলে। প্রকৃতপক্ষে লগি-বৈঠা ছিল একটি প্রতীকী আহ্বান। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনে গঠিত জাতীয় সংসদ বাতিলের দাবিতে মার্চ মাসে শেখ হাসিনার অসহযোগ আন্দোলনের সময় তোপখানা রোডে গঠিত হয়েছিল জনতার মঞ্চ। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অস্ত্রের জোরে সে মঞ্চ ভেঙে দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দলে দলে নিরস্ত্র নারী-পুরুষ লাঠি-টিয়ার গ্যাস-গুলি উপেক্ষা করে জনতার মঞ্চ রক্ষা করেছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরও জনতা ছিল নিরস্ত্র। কিন্তু তারা বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর হিংস্র হামলা প্রতিহত করতে পারে।

আন্দোলন দমন করতে না পেরে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ ক্ষমতা তুলে দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। কিন্তু এ সরকার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার করে শেখ হাসিনাকে। তারও দুই মাস ৯ দিন আগে ৭ মে শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকেসহ আওয়ামী লীগের গোটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে একসঙ্গে হত্যার যে ভয়ঙ্কর অপচেষ্টা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান চালিয়ে ছিলেন, তাতে শেখ হাসিনা গুরুতর আহত হন। তার শ্রবণ শক্তি কমে যায়। আরও কিছু শারীরিক জটিলতাও ছিল।

চিকিৎসা শেষে তিনি যেন দেশে ফিরতে না পারেন সে জন্য লন্ডন থেকে ঢাকাগামী সকল এয়ারলাইন্সের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়- শেখ হাসিনাকে যেন কোনো বিমান বহন না করে। কিন্তু তিনি ছিলেন অদম্য। এয়ারলাইন্সগুলোকে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে আদেশ দিয়েছে, সেটা বেআইনি- এটা তিনি বোঝাতে পারেন। তিনি ফিরে আসে বীরের বেশে, বিজয়ীর মর্যাদায়। বিমান বন্দরে তাকে যেন দলের নেতা-কর্মীরা স্বাগত জানাতে না পারে সে জন্য সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। কিন্তু রাজপথের সংগ্রাম গড়ে তোলায় অভিজ্ঞ এবং তৃণমূলে বিস্তৃত দলটি কোনো বাধা মানেনি। শেখ হাসিনা গাড়িতে বিমান বন্দর থেকে ধানমণ্ডি সুধা সদন পর্যন্ত আসার দীর্ঘ পথে ফুলেল সংবর্ধনায় সিক্ত হন। পথ ছিল অন্তত ১০ কিলোমিটার। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মীরা ভেবেছিল আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফাকা সড়ক পথে শেখ হাসিনার গাড়ি পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। কিন্তু তাঁর গাড়ি যতই এগিয়েছে, পথের দু'পাশে দেখা গেছে নারী-পুরুষের প্রচণ্ড ভিড়। তারা 'জয় বাংলা', 'শেখ হাসিনা ভয় নাই- রাজপথ ছাড়ি নাই' স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছে গোটা পথ। রাজপথে তাদের দৃপ্ত পদচারণার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল যানজট। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এ দিনটি অনন্য এ কৌশলের কারণে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

[প্রসঙ্গক্রমে আমরা ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের দিনটি স্মরণ করতে পারি। দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দিতে তিনি গুলশান থেকে বকশি বাজারের আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এই দীর্ঘ পথে তাকে 'লাখ লাখ নেতা-কর্মী' অভ্যর্থনা জানাবে, এমনই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কিন্তু মগবাজারে কয়েকশ কর্মী ছাড়া কোথাও কেউ ছিল না। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর 'মার্চ ফর ডেমোক্রাসি' এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে খালেদা জিয়ার অনির্দিষ্ট কালের হরতাল-অবরোধের আহ্বানেও জনগণ তো দূরের কথা, দলের নেতা-কর্মীদেরও দেখা মেলেনি। মার্চ ফর ডেমোক্রাসিতে অংশ নিতে খালেদা জিয়া যখন গুলশানের ফিরোজা ভবন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন, তখন তার সঙ্গে কেবল দেখা গিয়েছিল 'গৃহকর্মী' ফাতেমাকে। এই গৃহকর্মীকেই তিনি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন।]

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে কারাগারে প্রেরণ করা করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের একটি অংশকে তখন ঘোষণা করা হয়েছিল কারাগার হিসেবে। অথচ সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তখন ক্যান্টনমেন্টের বাসায় বসে দেশের সর্বত্র ভিডিও কনফারেন্স করে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী এবং জামায়াতে ইসলামীর অন্য নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও চলছিল বিনা বাধায়।

শেখ হাসিনাকে আটক করা হয় ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময়ে 'দুর্নীতির' জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতাচ্যূৎ হয় অন্যায়ভাবে- নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটন করে। এর পর আর ক্ষমতা হস্তান্তর স্বাভাবিক উপায়ে হয়নি। জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও এইচ এম এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়াই। বেগম খালেদা জিয়াও প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

শেখ হাসিনা ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সংসদের ভেতরে ও বাইরে যে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, তার লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট- নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহন ও ক্ষমতা হস্তান্তর। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই তিনি বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কেবল ওই একটি বারেই সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর পরিণতি বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি। শেখ হাসিনা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু ওই দিনেই দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। বিচারপতি লতিফুর রহমান অন্যায়ভাবে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে রদবদল ঘটান। নির্বাচনের সময় প্রমাণিত হয়েছেÑ-এটা তিনি করেছেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। শেখ হাসিনা সাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, কিন্তু তার কোনো মূল্যায়ন হলো না। তিনি দলের বাইরের একজন ব্যক্তি- সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করেন। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন একের পর অন্যায় পদক্ষেপ নিয়ে চলছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ করছিলেন- তিনি নিরব থাকেন।

শেখ হসিনা ১৯৯৬ সালের জুন থেকে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর এ শাসনকালেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। তিনি ১৯৯৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের প্রবল বন্যা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেন। জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা শুরু হয় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ শুরু হয়। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ফের মাথা তুলে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। বিএনপি সরকার এ উপলক্ষে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা, সুলেমান ডেমিরেল ও ইয়াসির আরাফাতকে আমন্ত্রণ জানান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের জনসমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এ ময়দানেই বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী উচ্চারণ ছিল- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পাকিস্তানি শাসকচক্র সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবে না'। সে সংকল্পও ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন।

স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ বিএনপি সরকার একে একে বিসর্জন দিয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পঞ্চম সংসদে ছিল না। তাকে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই কেবল জনগণ উপকৃত হয়- এ সত্য পুনর্বার প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ এ সময়কালের 'অন্যায়ের জন্যই' তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে কারারুদ্ধ করে।

আশির দশকে এইচ এম এরশাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা ছিলেন ১৫ দলের নেতা। খালেদা জিয়া ৭ দলের নেতা। দুই জোট যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু রাজপথে প্রধান শক্তি ছিল ১৫ দল। সে সময়ে এ জোট সমাবেশ করেছে মানিক মিয়া এভিউনিউতে। খালেদা জিয়ার জনসভা হতো অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট স্থানে- গুলিস্তান চত্বরে। হরতাল-অবরোধ সফল করায় আওয়ামী লীগ ও ১৫ দলের কর্মীরা থাকত সামনের সারিতে। শহীদের তালিকায় ছিল কেবলই ১৫ দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নাম। রাজনৈতিক দলের বাইরে পেশাজীবী-সংস্কৃতিসেবীরা যে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী।

ওয়ান ইলেভন সরকার এ সব বিবেচনায় নেয়নি। কিংবা নিতে চায়নি। এ সরকারের পেছনে থাকা একটি মহল নতুন করে সেনা সমর্থিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো কিংস পার্টি পড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এ পথে শেখ হাসিনাই যে প্রধান বাধা, সেটা বুঝতে তাদের সমস্যা হযনি। এ কারণে 'হাওয়া ভবনের দুঃশাসন-অনিয়ম-দুর্নীতি' তারা অনেকটাই উপেক্ষা করে চলে। মাইনাস টু ফর্মুলা তারা ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। কিন্তু প্রকৃত টার্গেট গোপন রাখেনি- শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়া। তাদের উচিত ছিল ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অসমাপ্ত বিচার কাজ সম্পন্ন করা। শেখ হাসিনা এটা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকার তা শিকেয় তুলে রাখে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে একযোগে হত্যার যে ভয়ঙ্কর অপরাধ বিএনপি করেছিল, তার বিচারেও হাত দেয়নি ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সরকার। তারা কেবল চেয়েছে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে রাখতে। এ শিক্ষা অবশ্য ইতিহাস থেকে তারা সঠিকভাবেই নিয়েছিল যে আমাদের এ ভূখণ্ডে সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম কেবল একটিই দল- আওয়ামী লীগ। ষাটের দশকে এ দলটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল-কে চ্যালেঞ্জ করেছিল। এ দলটিই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে অপশাসনের বিরুদ্ধেও এ দলটির নেতৃত্বেই দেশবাসী রুখে দাঁড়িয়েছিল। খালেদা জিয়া ২০০১ সালে ১৯৭১ সালের ঘাতক দল জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসিত করেন। শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর অশুভ চক্রান্ত রুখে দিতে সক্ষম হন। রাজপথে জনতার শক্তি সম্বল করে তাদের সফলভাবে মোকাবেলা করেন। তাকে দৃশ্যপট থেকে সরাতে পারলেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ক্ষমতায় থাকা নির্বিঘ্ন হতে পারে।
কিন্তু শেখ হাসিনাকে তারা চিনতে ভুল করেছিল। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি মোকাবেলার কৌশল তিনি রপ্ত করে ফেলেছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের কাছে যে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তাতে স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল- 'অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। কখনও মনোবল হারাবেন না। মাথা নত করবেন না। আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। আমি আমৃত্যু আপনাদের সঙ্গে থাকব। জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। জনগণের মুখে হাসি ফোটাবই।'

শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে সেনাবাহিনীর একটি দলের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ দিয়ে এর সূচনা। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে। নির্বিচারে গ্রেপ্তার, কারফিউ জারি, ভয়ভীতি প্রদর্শন করেও রাজপথের আন্দোলন স্তব্ধ করা যায়নি।

শেখ হাসিনা পাশাপাশি আইনি লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর আইনজীবীরা দক্ষতার পরিচয় দেন। দুর্নীতির মামলা যে কেবলই হয়রানি ও হেনস্থা করার জন্য- সেটা প্রতিটি শুনানিতে স্পষ্ট হয়ে যায়।

দলের নেতা-কর্মীরাও সক্রিয় থাকে জনতার মধ্যে। প্রায় এক বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জননেত্রী শেখ হাসিনা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু কষ্টকর কারাবাসের মধ্যেই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। তিনি হাত দেন ও পরবর্তী সরকারের আশু ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি প্রণয়নের কাজে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি তুলে ধরেন কয়েকটি নতুন কর্মসূচি-ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন করা, উন্নত বিশ্বের সারিতে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া। আপামর জনগণ এবং বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্ম এ সব কর্মসূচি লুফে নেয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠন এবং পরবর্তী দুটি সাধারণ নির্বাচনে দল ও জোটকে বিপুলভাবে জয়ী করেছেন তিনি। জনগণকে দেওয়া অঙ্গীকার পালনে এক মুহূর্তের জন্যও পথ হারাননি। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ যথার্থভাবেই সমৃদ্ধির সোপানে উঠতে পেরেছে।

শেখ হাসিনার একটি অনন্য কৃতিত্ব পদ্মা সেটু স্পিরিট মানুষের মনে গেঁথে দিতে পারা। বহু বছর এ ভূখণ্ডে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি ধনী দেশ যা ওহি নাজেল করে, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে বিনা আপত্তিতে তা মেনে চলতে হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা নিজের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন- আমরা পারি। এমনকি করোনার বিপর্যয়ের মধ্যেও এ সেতুর নির্মাণ কাজ থেমে নেই। বিশ্বব্যাপী এ মহামারির মহাদুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশ রোগ-ব্যাধি মোকাবেলার বহুবিধ আয়োজনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার জন্য সক্রিয় রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি অংকের অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। রপ্তানি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে রেকর্ড পর্যায়ে। করোনাভাইরাসের মধ্যেও কৃষকরা ২ কোটি টনের বেশি বোরো চাল ঘরে তুলতে পেরেছে। আগামী অন্তত ৬ মাস বাংলাদেশকে খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। অথচ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আভাস দিচ্ছে জাতিসংঘ। এমন শঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতে পারছেনÑ আমরা নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্য দেশকে খাদ্য এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য সরবরাহ করতে পারব। আমাদের সবজি উৎপাদন ভাল হচ্ছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে নতুন নতুন সাফল্য সংবাদ মিলছে। গবাদি পশু এবং দুধের উৎপাদন বাড়ছে।

এটাতো অদম্য বাংলাদেশেরই চিত্র। প্রায় পাঁচ দশক আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না'। একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েও বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শেখ হাসিনাকেও দাবায়ে রাখা যায়নি। যাবেও না। বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াতে জানে। উঠে দাঁড়াতে জানে। এগিয়ে যেতে জানে।