গণমাধ্যমের কর্মীদের বেতন নিয়ে টালবাহানা কেন?

আনিসুর রহমান
Published : 18 June 2020, 02:10 PM
Updated : 18 June 2020, 02:10 PM

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি।

মে দিবসের সম্পাদকীয়

– বল কী বলতে চাস।

একটা কথা বলব?

– বললাম তো বল।

স্যার …

– স্যার স্যার বাদ দিয়ে কি বলতে চাস বলে ফেল। হাত কচলানোর কি হলো?

আপনার পত্রিকায় মে দিবসের সম্পাদকীয় আমি পড়েছি।

– পড়েছিস। ভালো করেছিস, তো হয়েছে কি?

আমার বেতন?

– তোর বেতন মানে?

আমার বেতন স্যার মাত্র পাঁচ হাজার। কাজ করি ১২ ঘণ্টা। মেস ভাড়া আড়াই হাজার। স্যার আমার চলে না।

– চলে না মানে কী? তাহলে কালকে থেকে আসিস না।

গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল করোনাকালের পূর্বেকার। করোনাভাইরাসের ছোবলে গণেশ উল্টে গেছে জীবন ও জীবিকার। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ধনী-গরীব সকলের 'ইয়া নফসি' 'ইয়া নফসি' অবস্থা হলেও ধনীদের জীবনযাত্রার ব্যত্যয় ঘটেনি। ক্ষেত্রবিশেষে কারো কারো আয় আর সুযোগের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। তার বিপরীতে গরীবের আর গরীব ধনীর মাঝামাঝি চিড়েচ্যাপটা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর অবস্থা কোথায় থাকি, কী খাই, কেমনে বাঁচি- হায়দায় পর্যায়ে। এতে কর্পোরেট অর্থব্যবস্থার মালিক 'দেবগণ' ভ্রক্ষেপ করার সময় কোথায়? তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি বড়ই বেপরোয়া। তা দেশের কোটি কোটি আদমীকে দর্শন দেবার জন্যে ব্যাকুল। কেউ যেমন ব্যাংকের বড় কর্তাকে অপহরণ আর হত্যাচেষ্টার মামলাকে সিনিয়র আঙ্গুল দেখিয়ে বিমান ভাড়া করে বিদেশে উড়াল দিলেন। উড়াল দিলেন ধনকুবের সাবেক এক পররাষ্ট্র মন্ত্রী। উড়াল দিলেন আরেক ধনকুবের দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপের মালিক। তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলগুলো দেখে দেখে জীবন ও কপালের সঙ্গে আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু ঝামেলা হলো, পেট তো সে কথা মানে না। ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালা ভাড়া না দিলে তো থাকতে দেবে না। এসব নিয়ে বড় আঙ্গুলওয়ালা মালিকদের ভাবার সময় নাই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিকরা দেবদেবীর চেয়েও ক্ষমতাবান কি? আর এই ব্যবস্থায় যদি বুড়ো আঙ্গুল দেখাবার মতো সুযোগ থাকে, নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করার রেওয়াজ থাকে – তাহলে তাদের ঠেকায় কে? আর এইসব ধনকুবেরের অনেকেই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে দেশের গণমাধ্যমের বড় অংশের বিশেষ করে পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক। বিমানে উড়াল দেয়া একজনের শিল্পগ্রুপ পরিচালিত পত্রিকা এবং টেলিভিশনের কর্মরত কর্মীরাও তাদের বেতন ও কর্মহীনতায় বিপদজনক দিন পার করছেন। তারা এখন কী করবেন? তারাও কী ত্রানের জন্যে লাইনে দাঁড়াবেন? তা না হয় দাঁড়ালেন। কিন্তু বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচাপাতির জোগান আসবে কোথা থেকে?

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনার কথা বলি।

আমাদের ঢাকা শহরের বাস্তবতায় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক আলোচনা সভায় দেশের দর্জিশিল্পের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ-র বড়কর্ত্রী কোনোরকম দায়দায়িত্বের ধারে কাছে না গিয়ে উইনস্টন চার্চিলের মত নিষ্ঠুর কায়দায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আগাম খবর দিয়ে দিলেন। তিনি আবার কবিতাও লেখেন। বলতে হয় বড়কর্ত্রীর হৃদয়ের পাটা বটে।

দ্বিতীয় ঘটনা, ধানমণ্ডির এক গৃহকর্ত্রী বাসার কাজের মেয়েটিকে সাত বছর বিনা বেতনে খাটিয়েছেন। নির্যাতনও করেছেন সময়ে সময়ে। তারপর মেয়েটি উপায়ন্তর না দেখে বেতন না নিয়েই কাজ ছেড়ে চলে গেছেন। মালিক কর্ত্রী মেয়েটির নামে পুলিশের কাছে মিছেমিছি চুরির মামলা দিয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করে বের করেছে অভিযোগ ডাহা মিথ্যে। শেষতক পুলিশ কাজের মেয়েটিকে সাত বছরের বেতন আদায় করে দিয়েছে। আমরা কথায় কথায় বলে থাকি দেশের পুলিশ কত খারাপ। অথচ আমরা ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা নামধারী মালিক খাটাশেরা নিজেদের বাসাবাড়িতে কত মজুর ছেলেমেয়েকে নিরন্তর ঠকিয়ে চলেছি।

তৃতীয় ঘটনা- একটি ইংরেজি দৈনিকে কর্মরত আমার এক সময়ের সহকর্মী মিজানুর রহমান দীর্ঘ চার মাসের বেতন ভাতা না পেয়ে সঙ্কটের চরম পর্যায়ে পৌঁছে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষে করোনাভাইরাস তাকে ধরে ফেলে। তিনি চলে গেলেন। যিনি অন্যের জীবন ও জীবিকার খবরের ছবি সংগ্রহ করে গেলেন সারাজীবন ধরে, আর তার চলে যাবার করুণ কাহিনী খবর দীর্ঘশ্বাসে চাপা পড়ে গেল। এই খবর নাড়া দেয়নি আমাদের মালিকপ্রবর বিমানে উড়াল দেওয়া বড় আঙুল দেখানো প্রজাতির মানুষদের কাউকেই।

মিজান ভাইয়ের মতো অবস্থা ঢাকা শহরসহ সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সংবাদপত্র আর টেলিভিশনে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের। অথচ এই নিয়ে দায়িত্বশীল কোনো মহল থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। অথচ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস গণমাধ্যমের এই কাজকেই শ্রেষ্ঠ পেশা বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মার্কেসকে উদ্ধৃত করে সাপ্তাহিক হলিডে এবং নিউ এজ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান, আমাদের সকলের মিন্টু ভাই বলতেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে জগতের সেরা পেশা। তিনি তা মুখে যেমন বলতেন, লেখায় তা উদ্ধৃত করতেন। একই সঙ্গে বাস্তবে তা মেনে চলতেন। তার জীবদ্দশায় হলিডে এবং নিউ এজ-এর বেতন অনিয়মতি হতে দেননি। পত্রিকার পিয়ন থেকে শুরু করে বড়পদের কর্তা পর্যন্ত সকলের সুবিধা অসুবিধাকে নিজের পরিবারের সদস্যের সুবিধা অসুবিধা মনে করতেন। কখনও বেতন দিতে আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দিলে তিনি তার বন্ধুবান্ধবদের দ্বারস্থ হতেন। বেতন না দেয়া পর্যন্ত তিনি স্থির হতে পারতেন না। এখনকার সম্পাদক মালিক যারা আছেন তারা টকশো, সভা সেমিনার আর সম্পাদকীয় কলামে যত বড় বড় কথা বলেন, আদতে করেন তার উল্টো।

কারো নাম উল্লেখ করে কাউকে ছোট বা বড় করার খায়েশ আমার নাই। কেবল একটা কথা বলে রাখি, আমাদের পত্রিকা আর টেলিভিশনের বড়কর্তারা আয়নায় একবার নিজেদের চেহারাটা দেখুন। এই আপনাদের কারণে গণমাধ্যমের হাজার হাজার মজুর আজ ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে।

গণমাধ্যমের কয়েকটা ঘটনা কিঞ্চিত খোলাসা করে বলি, কোনো কোনো গণমাধ্যম অফিস থেকে আংশিক বেতন দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় বেতন দেওয়া হচ্ছে না। কারো কারো চাকরি খেয়ে ফেলা হয়েছে হাতে কানাকড়ি না দিয়ে। অথচ ওয়েজবোর্ড, চাকরি বিধিমালা কতসব কথাবার্তা আমরা শুনে এসেছি। যতরকম বাহুল্য আলাপ আর ঝাড়িঝুড়ির কুশীলব আমাদের গণমাধ্যম জগতের নেতারা নেত্রীরা। বিপদের কালে তাদের নিখোঁজ সংবাদ দিয়েও যদি খুঁজে পাওয়া যেত! সাংবাদিক ইউনিয়নের এক বড় কর্তা, যিনি নিজে এখন পত্রিকার মালিক সম্পাদক, অগাধ টাকার মালিক, এমন কি করোনাভাইরাসের সময়েও তার পত্রিকায় পর্যাপ্ত সরকারি বিজ্ঞাপন পাচ্ছেন। অথচ তার পত্রিকার কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিচ্ছেন না। কারো কারো চাকরি আছে কি নাই তারও কোন ফয়সালা নাই।

সরকার থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সরকারি বিজ্ঞাপনের যাবতীয় বকেয়া বিল অনতিবিলম্বে পরিশোধ করে দেয়ার। কোটি কোটি টাকার বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল পেলে পত্রিকাগুলোয় কর্মরত সাংবাদিকসহ অন্যান্য কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা অনেকটাই সম্ভব। আর বাকিটা সমাধানের জন্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে একটা সঙ্কটকালীন তহবিলও গঠন করা অসম্ভব নয়। অথচ সেদিকটায় না গিয়ে পত্রিকা আর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বেতন ভাতা না দিয়ে গণমাধ্যমের কর্মীদের বিপদগ্রস্ত করেছেন।

গণমাধ্যমে কর্মরত কর্মীদের ঘোরতর এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে স্বল্পমেয়াদী আর দীর্ঘমেয়াদী কতগুলো পদক্ষেপ নেয়া যায়। স্বল্পমেয়াদী উদ্যোগগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্যে জরুরি তহবিল গঠন করে সেখান থেকে নামমাত্র সুদে তাদের বেতনের বিপরীতে ছয়মাস বা একবছর চলার মত মাসিক কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ঋণের ব্যবস্থা করা। সরকারি বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধ করে নতুন বিজ্ঞাপন জোগানের জন্যে সরকারি প্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি আর গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতিনিধি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ কমিশন বা কমিটি গঠন করা।

সরকারি আর গণমাধ্যমের কর্তৃপক্ষের অংশীদারিত্বে লাগসই আপতকালীন তহবিল গঠন করা।

দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগগুলোর মধ্যে-

১। প্রভিডেন্ট ফান্ডের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

২। গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্যে বেকার বীমা চালু করা।

৩। গণমাধ্যমের জন্যে নতুন যুযোপযোগী বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসংস্থান নীতি প্রবর্তন করা।

সর্বোপরি গণমাধ্যমকে মলিকদের নিজেদের ব্যবসা রাজনীতি আর মাস্তানির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার অবাধ সুযোগকে রহিত করা। এখন সময়, এখনই সুযোগ গণমাধ্যমের মালিক আর সম্পাদকদের নীতিমালার মধ্যে আনা। গণমাধ্যমে পেশাদারিত্ব সম্ভব। এটা একটা লাভজনক খাত। আমাদের দেশের মতো কোনো দেশেই এতটা বেপরোয়া মাস্তানি খাত নয়। এখানে যারা কাজ করেন তারাও মানুষ। তাদের বাসা ভাড়া দিতে হয়। খেয়ে পরে বাঁচতে হয়। গণমাধ্যমের কর্মীদের বেতন নিয়ে টালবাহানা কেন? এই টালবাহানা এখনই বন্ধ করুন।