বুনন দিদিমনি

পারমিতা দত্ত ও প্লাবন গাঙ্গুলী
Published : 16 June 2020, 10:17 PM
Updated : 16 June 2020, 10:17 PM

মাসে ১২০০ টাকা আয় করেই সন্তুষ্ট থাকার কথা একবার ভেবে দেখেছেন?

'আরও চাই'-এর বাজারে বেশ নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আপনার উত্তর নেতিবাচকই হবে। ছোট হয়ে আসা বৈশ্বিক দুনিয়ায়, টান টান উত্তেজনার থ্রিলার বা আবেগ উসকে দেওয়া রোমান্টিক মুভি দেখার জন্য এর চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমরা নেটফ্লিক্স চালাই। করোনাকালের গৃহবন্দি জীবনে সেই টাকা দিয়ে আমরা ভূত দেখার উত্তেজনা নেই বা এক্সট্রাকশন মুভি দেখে হাতের তালুর মত চেনা নৈমিত্তিক ঢাকা শহরকে নতুন করে চিনি। এমনকি, এর চেয়ে বেশি টাকা যায় এক বসায় কফি খাবার জন্য। স্যরি, কফি না, ও খরচটা সেলফি, চেক-ইন ও তার সাথে দুটো লাইনের। কিন্তু, রংপুরের আজমিরার কাছে এই মাসিক আয়টাই চরম বাস্তবতা। এক বছর আগেও বেকার থাকা একা একজন নারী এই টাকা দিয়েই সংসার চালান। প্রায়ই সংসারে শ্যাম থাকে তো কূল থাকে না! কিন্তু, আজমিরার সম্বল এতটুকুই, যে বাস্তবতাটা আমার-আপনার অনেকেরই চিন্তারও বাইরে।

আড়াই বছর আগে, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি, প্রথম সন্তান জন্ম দেবার সময় আজমিরার ডান পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। তা পঙ্গু বউ কি আর চলে? তার উপর আবার জন্ম দিয়েছে কন্যা সন্তান! তাই, দৈনিক 'জন' বিক্রি করা গরীব স্বামী ঘাড় থেকে বোঝাটা নামিয়ে দিয়েছিলেন কোন কার্পণ্য ও কালক্ষেপণ না করেই। এক মাসের মধ্যেই তালাক। সদ্যোজাত শিশু কোলে নিয়ে শুরু হয় আজমিরার টিকে থাকার লড়াই। সারভাইভাল তো ফিটেস্টদের জন্য! তাই পাটিগণিতের ঐকিক নিয়মেই অর্ধ-ফিট আজমিরার পেট চালানোর সংগ্রাম হয়ে গেল দ্বিগুণ কঠিন। পড়ালেখাটাও হয়ে ওঠেনি তার। অভাবী কৃষক বাপ তো সংসার খরচের তালিকা থেকে মেয়ের পড়ালেখাটা বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। আর, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারে একটি পেট কমিয়েছিলেন ২০১৬ সালেই। আজমিরার বয়স তখন মাত্র ঊনিশ। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকলেও সুযোগটা হয়ে ওঠেনি তার। মজুর যে বেঁচবে, তাও তো সম্ভব না নিজের পঙ্গুত্ব আর ছোট্ট শিশুটার জন্য। কাছেপিঠে না আছে কোন কলকারখানা যেখানে সে হালকা শ্রম দিয়ে উপার্জন করবে, না কেউ তাকে মজুর নেবে কৃষিকাজের জন্য। হাতের কাজ বলতে জানা আছে পাট দিয়ে বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য পণ্য বানানো। কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া অন্য আট-দশটা মেয়ের মতই, পাট দিয়ে গেরস্থালির কেজো জিনিস আজমিরা বুনতে পারে ভালোই। তাই এটাকেই সে বানিয়ে ফেলল উপার্জনের উপায়। কাজ নিল বাড়ির পাশেই মনসুরা জুট হ্যান্ডি ক্র্যাফটস নামের একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে। তার এলাকার আরও বেশ কয়েক জন নারী সেখানে কাজ করেন। তাছাড়া, প্রতিদিন তাকে সেখানে যেতেও হয় না। বাড়িতে বসেই পাট দিয়ে বোনেন শতরঞ্জি। পাশাপাশি বানান আরও কিছু বহুমূখী পাটপণ্য। আর এভাবেই গত এক বছর ধরে তার আয় হয় মাসে গড়ে ১২০০ টাকার মত। যদিও যৎসামান্য, তবুও পেটের ক্ষুধার হিল্লে করতে এ'কটা টাকা তার বড্ড সহায়। ইতোমধ্যে পাটজাত পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণও নিয়েছে সে।

ডুবতে থাকা মানুষ যখন একটু আশার আলো দেখতে পায় তখন যেমন তার দেহে কোত্থেকে এক অসুর-শক্তি এসে জমা হয়, আজমিরার কণ্ঠও ঠিক তেমন শোনালো। "তালাকপ্রাপ্ত, পঙ্গু ও একা মা হয়ে নিজের কন্যাকে বড় করতে আমার এখন বিন্দুমাত্র পরিতাপ বা লজ্জা নেই। আশেপাশের বাড়ির মহিলাদের সাথে কাজ করাটা বরং আমি উপভোগই করি। তাছাড়া এই শরীর নিয়ে, বাড়িতে ছোট বাচ্চা একা ফেলে আমাকে যেতেও হয়না কোথাও। পঙ্গুত্ব এখন আর আমার কাছে আলাদা কিছু মনে হয় না। আর্থিকভাবে সাবলম্বী হয়ে সংসার চালানোর তীব্র ইচ্ছাটাই আমার শক্তি"- মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আজমিরা যখন কথাগুলো বলছিল তখন তার উচ্ছ্বসিত চোখ বলছিল আরও তীব্র এক কথা। সেটা সাহায্যের আকুতি না, 'আমি পারব' নামক একটা আত্মবিশ্বাস। নেইরাজ্যের অভাব কাটিয়ে মেয়েটাকে ভালোভাবে বড় করবার এক সুতীব্র আকাঙক্ষা। শতরঞ্জি না, আজমিরা প্রতিদিন তার অস্তিত্ব ও স্বপ্ন বুনে চলেছেন পাটের বেণীতে।

ধান ভানতে (পড়ুন পাট বুনতে) শিবের গীত কেনে গাইছি? সে প্রসঙ্গে আসি তাহলে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলোর মধ্যে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলা অন্যতম। এই চার জেলায় দৈনিক ১৭০ টাকার কম (ডলার ৮৫ টাকা ধরে) আয় করা মানুষ আছেন যথাক্রমে শতকরা ৬৩.৮, ৪৮.০, ৪৬.২ ও ৩৪.৫ ভাগ (বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী, বিবিএস, ২০১৪)। এই হতদরিদ্র্য জনগোষ্ঠির নারীরা মূলত গৃহস্থালির নানা অকৃষিজ অনুপার্জনশীল কাজ, যেমন: সূচীকর্ম, সেলাই, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ-এর সাথে জড়িত (এফএও, ২০১১; কেয়ার, ২০১৫; প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, ২০১৬)। শিল্প-কল-কারখানার বিকাশ এ অঞ্চলে তেমন হয়নি বললেই চলে। চার জেলার গ্রামাঞ্চলের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি লোকের পেশা কৃষিকাজ। ছদ্ম-বেকার লোক আছেন প্রচুর। বিভিন্ন ফলন ঘরে তোলার মৌসুমে কায়িক শ্রম বিক্রি করতে এরা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েন পরিযায়ী পাখির মত। অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে এরা শ্রম বিক্রি করেন বলে এদের চাহিদা থাকলেও, পকেটের খুব একটা শ্রীবৃদ্ধি এদের ঘটে না। আর তখন গৃহ আগলে নারীরা চালান কঠিন সংগ্রাম। স্থানীয়ভাবে শিল্পের বিকাশ সেখানে ঘটাতে পারলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে, বিশেষত নারীদেরকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। আর পাট শিল্প এ দৌড়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। কিন্তু এতে প্রতিবন্ধকতাও আছে অনেক। অপর্যাপ্ত প্রযুক্তি, আধুনিকায়ন ও দক্ষ শ্রমিকের অভাব এর মধ্যে অন্যতম (বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট, ২০১৫; ডেইলি স্টার, ২০১৫, সিআরআইজেএএফ-ভারত, ২০১৫, কেয়ার ২০১৬, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, ২০১৬)। এই সমস্যার অন্যতম সমাধান হলো নারীদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভূক্ত করা।

'শতরঞ্জি'র এই এলাকায় নারীরই মূল 'শতরঞ্জ কা খিলাড়ি'। বংশপরম্পরায় তারাই বুনে চলেছেন এই ঐতিহ্য। এখন তো বাহারি শতরঞ্জি রপ্তানিও হচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। বিনা প্রশিক্ষণেই তারা এ কাজটি করে চলেছেন। আর যদি তাদেরকে নকশা, গুণগতমান, আধুনিক প্রযুক্তি, বুনন পদ্ধতি, ইত্যাদির উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারা হয়ে উঠবেন আগামীর সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশের অন্যতম কারিগর। কেননা, সোনালী আঁশ পাট, আবহমানকাল ধরেই সোনার বাংলার অর্থনীতির অন্যতম চলৎশক্তি। বর্তমানেও এটি প্রধান কৃষিজাত রপ্তানি পণ্য ও প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস। বিশ্বজুড়ে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিবর্তে পাটপণ্য ব্যবহারের দাবি ও চাহিদা- দুটোই বাড়ছে। ফলে গত কয়েক বছরে পাটপণ্যের বাজার বিস্তৃত হয়েছে কয়েকগুণ, যেটা আগামী দিনগুলোতে বাড়তেই থাকবে ক্রমাগত। তাই, ভবিষ্যতের ভাবনায় পুরুষ শ্রমিক নির্ভর পাটকল চালানোর প্রথা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। এতে, দরিদ্র্য নারীরা একদিকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, অপরদিকে পাটকেন্দ্রিক অর্থনীতিও টেকসই হবে। গার্মেন্টসখাতের 'সেলাই দিদিমনি'দের মতন তারাও হবেন 'বুনন দিদিমনি'।

 বাংলাদেশে দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীদের স্বনির্ভরতা অর্জনে, তৈরি পোশাক শিল্পের পর পাট খাত সবচেয়ে গুরুত্বপ‍ূর্ণ ভূমিকা পালন এবং একটি বিশাল সংখ্যক নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে। কেননা, দেশব্যাপী, মূলত গ্রামীণ কৃষিজীবী পরিবারের, নারীরা নানাবিধ বহুমূখী পাটপণ্য তৈরি আসছে আবহমানকাল ধরেই। সামগ্রিকভাবে কাজটি অনুপার্জনশীল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বেশ বলিষ্ঠ। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা পাট দিয়ে নানা ধরণের কারুপণ্য তৈরি করেন, এবং এই দক্ষতাটা তারা উত্তরাধিকারসূত্রে পারিবারিক ভাবে মা বা দাদি-নানিদের কাছ থেকেই রপ্ত করে নেন। পাশাপাশি, কৃষিজীবী পরিবারগুলোর বাত্সরিক মোট শ্রমের একটি একটি বড় অংশ ব্যয় হয় বর্ষাকালে পাট চাষাবাদে, এবং এই চাষাবাদের পুরো প্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে, বিশেষত: পাট কাটার পর থেকে, নারীরা সরাসরি অবদান রাখেন। যেমন: পাট জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো, আঁশ ধোওয়া ও শুকানো, পাটকাঠি ব্যবস্থাপনা- এই কাজগুলো পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমানভাবে করেন। নতুন ধান ঘরে ওঠার মতই, চাষাবাদের পুরো মৌসুমজুড়ে, এমনকি মৌসুম শেষেরও কয়েকমাস পর পর্যন্ত নারীরা ব্যস্ত থাকেন এসব কাজে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে, আগের তুলনায় গত একদশকে, পাটখাতে মনোযোগ ও কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে, বেড়েছে বহুমূখী পাটপণ্যের চাহিদা ও বাজার। সেটা সাধুবাদ পাবার যোগ্য হলেও পর্যাপ্ত নয় মোটেই। দরকার প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতির মাঠ পর্যায়ে প্রসার। সেটা করা সম্ভব হলে, একদিকে যেমন প্রান্তিক দরিদ্র কৃষকদের আয়বৃদ্ধি হবে, অপরদিকে বিপুল স‍ংখ্যক গ্রামীণ নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। আর, সেসব নারীদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে পাট শিল্পও গার্মেন্টস শিল্পের মত মহীরূহ হয়ে ওঠার সমান সম্ভাবনা রাখে।

কিন্তু সচরাচর যা হয় আর কী! হস্তশিল্প যতক্ষণ পর্যন্ত পারিবারিক ব্যবহারের কাজে বা গেরস্থালির শোভাবর্ধক শোপিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা নারীর এখতিয়ারেই থাকে। তা সে অভাবে হোক আর স্বচ্ছল পরিবারের "মায়ের-নানির-দাদির হাতের জিনিস" নামক মায়ার বাঁধনেই হোক। শিল্প যখন কুটির থেকে বের হয়ে একটু বড় হয় তখন তা আর নারীর মালিকানায় থাকে না। এমনকি তার স্বাভাবিক ও ন্যায্য অংশগ্রহণের সুযোগটাও সেখানে দুরূহ হয়ে পড়ে। আর জমি, উত্পাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে নারীর প্রবেশাধিকার প্রথাগতভাবেই তো সীমিত।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময়। বাড়ছে দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) পরিমাণ, আকারে তরতর করে বাড়ছে অর্থনীতি। স্বল্পন্নোত দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। শুধু যে মানুষের আয় বেড়েছে তা নয়, বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে বাজেটের আকার। বাজেট বাস্তবায়নে পরনির্ভরতাও কমছে। দৃশ্যমান হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বাড়ছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতাও। উল্লেখ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, আয়ুস্কাল বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, স্যানিটেশনসহ এমডিজি লক্ষ্য অর্জনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়নশীল দেশ এমনকি প্রতিবেশী বড়-অর্থনীতির দেশ ভারতের জন্যও বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে জনবহুল ও সমস্যাসংকুল বাংলাদেশ কিভাবে এ অসম্ভবকে সম্ভব করছে? এ অর্জনের মূলে রয়েছে জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকা উন্নয়নের প্রচণ্ড অভিপ্রায় ও শাসন প্রক্রিয়ার দুর্বলতাসমূহ কাটিয়ে শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, অভ্যন্তরীণ চাহিদার বৃদ্ধি এবং বিশাল অংশের কর্মক্ষম তারুণ্যের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা। আর বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর সাফল্যের জন্য আরেকটা যে বিষয় বড় ভূমিকা রেখেছে তা হলো নারীর অংশগ্রহণ ও অগ্রগতি।

মেয়েরা এখন অনেক বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছেন ও হচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পোশাক খাতে নিয়োজিত চল্লিশ লাখেরও অধিক শ্রমিকের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি। এঁরাই বাংলাদেশকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়েছেন, নিচ্ছেন উন্নতির পথে। তা সে অর্থনৈতিক সূচকে হোক বা সামাজিক। কিন্তু অনেক সম্মৃদ্ধি ও ঐতিহ্যের বুলি আওড়ানো পাটখাতে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ যে কী সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এ খাতে নিয়োজিত মোট শ্রমের পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও কম নারী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন পরিচালিত পাটকলগুলোতে মাত্র ১৮ শতাংশ নারী কর্মরত আছেন। উপরন্তু, দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগের অভাব, নামমাত্র পারিশ্রমিক ও বেতন বৈষম্যের কারণে এ খাতে নিয়োজিত নারীরা না পারেন সঞ্চয় করতে, না পারেন তাদের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাতে (জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান, ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপ, ২০১০), যা এ খাতে নারীদের অংশগ্রহণের উত্তোরত্তর বৃদ্ধির জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী নয় মোটেও।

করোনাকালীন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এটা অনুমিত যে, আগামী দিনগুলোতে রপ্তানিমুখী খাতগুলোতে বড়সড় ধাক্কা আসতে যাচ্ছে। এমনকি, এসেও গেছে অনেক। এটি বোঝার জন্য অর্থনীতির মনোযোগী ছাত্র-ছাত্রী হবার দরকার নেই; আর আমাদের মত অর্বাচীনের পক্ষে অর্থনীতির সেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সামর্থ্যও নেই। সাদাচোখে এটি স্পষ্টভাবেই বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে, আমাদের উৎপাদন সচল রাখার পাশাপাশি রপ্তানিমূখী খাতগুলোকে আরও বহুমূখী করতে হবে। এবং এই তালিকায় পাট হতে পারে অগ্রগণ্য। সুস্থ থাকার ডামাডোলে, দেখতে দেখতেই দেশে চলে এসেছে পাটের মৌসুম, হয়ত আগের মত জোড়াতালি নিয়মে চলেও যাবে। কিন্তু করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে পরিবেশ সচেতনতা বাড়তেই থাকবে। তাই, বাংলার পাটে বিশ্বমাত করতে হলে, ছালা-বস্তা-ব্যাগের বাইরে এসে পণ্য বহুমূখী করার ও আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য বাড়ানোর এখনই মোক্ষম সময়। আর নগ্ন সত্য এটাই যে, এ কাজটি করতে হলে গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারী জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তুলতেই হবে ও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ বাড়াতেই হবে। অন্যায্য অনুষঙ্গগুলো বাদ দিলে, গত কয়েক দশক ধরে দেশে বিপ্লব ঘটানো গার্মেন্টস খাতের উদাহরণ পথিকৃত হতে পারে এই পরিবর্তনের।

এ নিয়ে যে একেবারে কাজ হচ্ছে না তাও না। বেশ ভালো ভালো কিছু কাজ ক্ষুদ্র পরিসরে সারাদেশেই হচ্ছে। তেমনই একটি হলো- তুলনামুলক বেশি খরাপ্রবণ উত্তরবঙ্গের চার জেলা- রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন পরিচালিত পাট বিষয়ক কর্মসূচি। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির আওতায়, চালু করা হয়েছে পাটের ছাল ছাড়ানোর সেমি-অটোমেটিক মেশিন "আঁশকল"। ক্ষেত থেকে পাটগাছ কাটার পরপরই এই মেশিনে খুব দ্রুততম সময়ে আঁশ ছাড়ানো হয়। অটোমেটিক মেশিনে পাটগাছ থেকে ছাল সংগ্রহ করলে সময় এবং খরচ দুটোই বাঁচে। পুরনো পদ্ধতিতে আঁশ সংগ্রহ করলে পাটগাছের গায়ে কিছু পরিমাণ আঁশ রয়ে যায়, যা অপচয় হয়। অপর দিকে অটোমেটিক মেশিনে পাটের ছাল ছাড়ালে অপচয় হয় কম। পাটের আঁশ ছাড়ানোর পরে লম্বা লম্বা লাচ্চি করে বাঁশের মাচা পদ্ধতিতে খুব তাড়াতাড়ি পুকুরে জাগ দেওয়া হয়। এ ধরনের জাগ পদ্ধতিতে সময় ও শ্রমিক কম লাগে বলে খরচ কম হয়। আঁশের দৈর্ঘ্য বড় ও গুণগতমাণ ভালো হয় বিধায় দামও পাওয়া যায় বেশি। যেহেতু এসব এলাকায় পানির অভাব প্রকট, তাই এ পদ্ধতি এখানে খুবই কার্যকর। পাশাপাশি, গড়ে তোলা হয়েছে মেশিন কেন্দ্রিক উদ্যোক্তা, প্রশিক্ষিত করা হয়েছে স্থানীয় ওয়ার্কশপের মালিক-শ্রমিকদের যাতে তারা মেশিনের যে কোন সমস্যা সমাধান করতে পারেন। শুধু তাই না, ব্যবস্থাটিকে টেকসই করার জন্য উন্নত বুনন পদ্ধতি, চাহিদাসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে স্থানীয় নারীদের।

দারিদ্র্যপীড়িত এই অঞ্চলের পাটচাষিদের, বিশেষত নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ কর্মসূচিকে টেকসই করার লক্ষ্যে ম‍ূলত তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা আসলে সারা বাংলাদেশের জন্যই প্রযোজ্য। যেগুলো হলো- (১) কারিগরি ও ব্যবসায়িক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও ব্যবসার প্রসার; (২) উৎপাদিত পণ্যের বহুমূখীকরণ যাতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানো যায়; এবং (৩) উদ্যোক্তা, মালিক ও শ্রমিকদের দক্ষতার ক্রমাগত উন্নয়ন যাতে তারা প্রতিযোগিতাপূর্ণ শ্রমবাজার ও পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তাল মেলাতে পারে।

আশার কথা হলো, তিন বছরের এই প্রচেষ্টা এখন ফল দিতে শুরু করেছে। আজমিরার মত অনেক জীবনের গাঁথাগুলো বদলাতে শুরু করেছে। 'মঙ্গার দেশের' প্রায় আড়াই হাজার নারী বুননেই সম্মৃদ্ধির পথ খুঁজে পেয়েছে। ঢাকা ও তার আশপাশ কেন্দ্রিক বস্তিগুলোতে উট পাখির মত মাথা না গুঁজে, নিজে না খেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় না তাদের। ন্যূনতম সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে নয় হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনে কাজ তারা কাজ করছেন স্থানীয় পর্যায়েই। মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এটি আরেকটি চ্যালেঞ্জ- বিকাশের সার্বজনীনতা। এই আড়াই হাজার নারীদের গড় উপার্জন বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ, যাদের শতকরা ৬৮ ভাগের হাতেই আছে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগপত্র।

শুরু করেছিলাম আজমিরার অসধারণ দৃঢ়তার এক গল্প (গল্প? নাকি গল্পকেও হার মানানো সংগ্রাম-গাঁথা?) দিয়ে। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল এমন আরও বেশ কিছু অনন্য পরিবর্তন দেখার। তার দু-একটা বলেই যতি টানব। এতদূর পড়ার পর আপনারা ভাবতেই পারেন, আবার আরও কেনে? শুধু তো আর এই পাট খাত না, ছোট-বড় অসংখ্য খাতে লাখো আজমিরার পায়ে ভর করেই তো এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তারপরেও, পাটখাতের কথাটা বিশেষভাবে কেনে বলছি তা তো এতক্ষণ ধারণা পেয়েই গেছেন। আর আজমিরাদের গাঁথাগুলো কেনে? জীবনটা তো ওদের "সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ"। অনেকেই নদীভাঙ্গনের উদ্বাস্তু। কেউ শুধু ভিটে-সম্বল, কেউবা আবার এককোণে লাগানো লাউগাছটা দিয়ে সবুজে ঢেকে দিয়েছে ভাঙ্গাচোরা ঘরটি। না না… এরা কেউ গ্রেটা থ্রানবার্গের ফলোয়ার না। সংসারের একটু আয়বৃদ্ধির আশায় তাদের এই "সবুজ বিপ্লব"। "কোত্থেকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে বর্তমানের গতি নেই, কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা"। উপরন্তু, আজকাল তো দু:সংবাদ ছাড়া না হয় সংবাদ না হয় ভাইরাল কনটেন্ট! বিনোদনের তরকারিতে 'কান্না' হয়ে উঠেছে 'সঠিক মাত্রার আয়োডিনযুক্ত লবন'। তাই, চারদিকের দু:সংবাদের ভিড়ে এদের কর্মকাণ্ড ও হাসিমুখ আনন্দদায়ক অনুপ্রেরণা বৈকি! আর ভাগাভাগিতে আনন্দ যেহেতু বাড়ে, তাই 'আমার এই ভাগ করাতেই আনন্দ'।

গতবছরের অক্টোবরের শেষের দিককার বুধবারের কথা। কার্তিক মাস এসে গেছে। উত্তরের জেলা বলে রংপুরে গরমের ভাবটা একেবারে ছিল না বললেই চলে। ভ্রমণক্লান্তি তো ছিলই, সাথে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দুপুরের ভাতঘুমের বাপ-ঠাকুরদা'র ঐতিহ্য তো আছেই! বেশ ঘুম ঘুমই পাচ্ছিল। সত্যি বলতে কি, শহরতলীরও কিছু বাইরে ছোট একটি কারখানায় (বুনন হ্যান্ডিক্র্যাফটস) যেতে বেশ আলস্যই লাগছিল। কিন্তু রুটি-রুজি বলে কথা। যেতেই হলো সহলেখকের (পারমিতা দত্ত) চাপাচাপিতে। অবশ্য তাকে সহলেখক বলা খোদার উপর খোদগিরি করা। লেখার মূল কারিগর আসলে তিনিই।

ব্যস্ত বুধবারের অলস বিকেল। পরিচয় হলো মাহফুজার সাথে। বিশ বছর বয়সী ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মাহফুজা, বুনন হ্যান্ডিক্র্যাফটস-এ সপ্তাহে পাঁচ দিন ও প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে কাজ করে। সেখানে সে নানা ধরনের কারুপণ্য তৈরি করে মাসিক প্রায় তিন হাজার টাকা পান। জিজ্ঞেস করেছিলাম – "এই বুননে চলে আপনার?" "দারিদ্র্যের কারণে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল বাপ-মা। কিন্তু সেখানেও সেই অভাব আর সংসারের ঘানি টানা। সে জীবন তো আমি চাইনি। বাপ-দাদা কৃষক। ছোটবেলাতেই নানীর কাছ থেকে শিখেছিলাম পাট দিয়ে সংসারের নানা পণ্য বানানো। যখন এই ট্রেনিং-এর খবর পেলাম, তখন ভাবলাম যে এটাকেই পেশা বানানো যায়। ছয় মাসের ট্রেনিং নিলাম। সেই সামান্য থেকে শুরু। এরপর থেকেই শুরু আমার জীবন বদলের গল্প। প্র্যাকটিকাল এ্যাকশন-এর লোকেরাই ব্যবস্থা করে দিল, চাকরি হলো এখানে। এখন সংসারে অবদান রাখার পাশাপাশি লেখাপড়াটাও চালাতে পারছি এ আয়ে।" মাহফুজার উত্তর শুনতে শুনতে তাকিয়ে ছিলাম তার চোখের দিকে। কত স্বপ্নাতুর হলে নিজের কষ্টের কথা বলতে বলতে চোখদুটো আনন্দে চকচক করে ওঠে তা নতুন করে আরেকবার টের পেয়েছিলাম সেদিন।

হালিমা খাতুন, অভাবের ঘানি টানতে টানতে পোড় খাওয়া, গাইবান্ধার মধ্যবয়সী একজন নারী। একই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তিনিও। বর্তমানে কাজ করছেন নিজ গ্রামেরই 'আছিরউদ্দিন জুট প্রোডাক্টস'এ। প্রেরণাদায়ক তথ্য হলো এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আছিরউদ্দিন নিজেই একজন বামন ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। আছিরউদ্দিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। উচ্চতায় আমাদের অর্ধেক, চলাচলে হুইলচেয়ারনির্ভর মানুষটি কী অদম্য মনোবলে হালিমা খাতুনদের সাহায্য করে যাচ্ছেন। শুধু টাকা আয় করা না, মাহফুজা, হালিমাদের মত 'বুনন দিদিমনি'দের কাছে এটি সম্মৃদ্ধির বুননও বটে।

জানি বা বুঝি বললে অত্যুক্তি হবে। কিছুটা টের পাই সম্মৃদ্ধি বুননের এই কন্টকযাত্রা সহজ না মোটেই, ছিলও না কোনোকালে। ঘরের আড়ায় কুমড়ো ঝুলানোর শিকা বোনার বাইরে এসে বাণিজ্যিক বহুমূখী পাটপণ্য উত্পাদনের জন্য গেরস্থালির চৌহদ্দির বাইরে আসায় মাহফুজা, হালিমাদের অনেক বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সম্মৃদ্ধি এমন এক মন্ত্র, এমন এক আত্মবিশ্বাস যা ভুলিয়ে দেয় সব কষ্ট। সেটিরই প্রতিধ্বনি পেলাম কুড়িগ্রামের নূরজাহান বেগম-এর কণ্ঠে। "শুরুতে কেই পাত্তা দেয়নি। এখন আমি সামনে এগুচ্ছি কারও দয়ায় না, সহযাত্রী নারীদের অনুপ্রেরণায়।"