ধান কাটা হবে তো?

আফরোজা চৌধুরী
Published : 17 April 2020, 01:20 PM
Updated : 17 April 2020, 01:20 PM

করোনাভাইরাসের ছোবলে সরকারি-বেসরকারি জরুরি ত্রাণ সহায়তার আশায় ভীড় করা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশাল লম্বা লাইন দেখে অনেকেই বুঝতে পারছে না এবার কেন সারা দেশে ধান কাটা শ্রমিকের সংকট হতে যাবে। গত বছরের বোরো মৌসুমের সংকটের সাথে তুলনা করে সবাই মনে করছে এবার যেহেতু উর্পাজন হারানো গ্রামমুখী মানুষের ব্যাপক স্রোত পরিলক্ষিত হয়েছে, তারমানে এ বছর ধান কাটতে লোকের কোনো অভাব হবে না। বরং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আপনাআপনি কর্মসংস্থান হয়ে যাবে বলে ধরে নিচ্ছে কেউ কেউ।

আসলে আমরা অনেকেই গত বছরের বোরো ধান কাটার সময়ের সংকটের মূল কারণটি ধরতে পারিনি। বিষয়টা রোগ আর রোগের উপসর্গের মত। গত বছর ধানকাটা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল আট শত থেকে এক হাজার টাকা, যা এক মণ ধানের দামের দেড় থেকে দুই গুণ। এক বছর আগে এ সময়ে দেশে গরীব মানুষ কম ছিল না, এবং হাজার টাকা দেওয়ার মত অবস্থা থাকলে শ্রমিক কিন্তু সহজলভ্যই ছিল। অর্থাৎ বিষয়টি এমন যে, বাজারে জিনিস আছে কিন্তু আমার কেনার সামর্থ্য নেই।

বাংলাদেশের ইন-এফিশিয়েন্ট লেবার মার্কেট স্ট্রাকচারে কেবল একটি সময়েই কৃষি শ্রমিক বারগেনিং পাওয়ার উপভোগ করে। যাকে বলে জামাই আদর। বোরো ধান কাটার সময় ব্যতীত বছরের বাকি সময় তাদের রোজ ভোরের আলো ফোটার আগে কোদাল কাঁধে গ্রামের বাজার বা কোনো চৌরাস্তার মাথায় কাজের আশায় অনিশ্চিত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একদিন কাজ থাকলে তিনদিন নেই। অসহায় মানুষ যখন অন্যের অসহায়ত্ব দেখার সুযোগ পায় তখন নির্দয় হয়ে যায় হয়ত। এটি উপলব্ধি করার জন্য লেবার ইকোনমিকস পড়ার দরকার নেই, নিজেকে দিনমজুর পরিবারের কর্তার আসনে কল্পনা করলেই বুঝতে পারা যায়।

প্যানডেমিক করোনাভাইরাসের কারণে উপার্জন হারানো মানুষেরা না খেয়ে আছে, তাদের অনিশ্চয়তা কবে কাটবে সেটি কেউ জানে না। গত বছরের তুলনায় এ বছর নগদ টাকার প্রয়োজন নিঃসন্দেহে বেশি। এবার তারা ভাত চাইবে, মাস্ক তথা স্বাস্থ্য সুরক্ষা চাইবে, পাখাওয়ালা থাকার ঘর চাইবে, ফেরার সময় মজুরির উপর এক্সট্রা ৫ মণ ধান চাইবে।

অপরদিকে কৃষকের হাতে কোনো টাকাই নেই। শাক, সবজি, মাছ, দুধ, ডিম কিছুই লাভজনক দামে বিক্রি করতে পারেনি গত একমাসে। অকৃষিজ উর্পাজন হারিয়ে বাড়তি চাপে রয়েছে অনেক কৃষি পরিবার। ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে সামনে আকাল। ধার শোধ দিতে হবে তাদের। ধানের বিনিময়ে দেনা শোধ করতে হলেও ফসল ঘরে তুলতেই হবে। ত্রাণের ট্রাক যারা লুট করে তারা মাসখানেক লকডাউনে চললে মাঠের ধানও কেটে নিতে পারে।

পরিস্থিতি বিবেচনায়, সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে যে বল এবারও কৃষকের কোর্টে নেই। মজুরি দেওয়ার সার্মথ্যের দিক থেকেই বলুন আর বারগেইনিং পাওয়ার বলুন, স্বল্প সময়ের মধ্যে ধান কাটার তাগিদ কৃষকদের নিরুপায় করে ফেলবে। ভাত ছিটালে কাকের অভাব হোক না হোক, কম দামে ধান কাটার লোকের অভাব হবেই।

দুঃখের কথা হচ্ছে কৃষি খাতের জন্য সরকার ঘোষিত ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনায় রাইস সেক্টরের কোনো স্থান এখন পর্যন্ত নেই। ঋণ সুবিধা বা সার-সেচ ভর্তুকির মতো করোনাভাইরাস পরবর্তী উদ্যোগ বোরো মৌসুমের কোনো কাজে আসবে না। আমরা প্রতিকারে বিশ্বাসী, প্রতিরোধে অভ্যস্ত নই। কিন্তু বরাবরের মতো মাঠের সোনালী ধান দেখে উৎপাদনের অঙ্কে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার আগে আমাদেরকে এ ধান কৃষকের গোলায় পৌঁছে দেওয়ার ভাবনাটিও ভাবতে হবে। গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে ফসল পাহারা ও কাটার ব্যবস্থা করা ছাড়া সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে সঠিক সমন্বয় সাধনের দায়ভারটুকু স্থানীয় প্রশাসনকে নিতে হবে। অন্যথায় অচিরেই দেশজুড়ে অরাজকতা, শ্রম মজুরির অতি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এমনকি ব্যাপক ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।