সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশবাসীকে আবারও বৈদ্যুতিক শক!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 2 March 2020, 08:18 AM
Updated : 2 March 2020, 08:18 AM

আমাদের দেশে কোনো কিছুর দাম কমে না, কেবল বাড়ে, বাড়তেই থাকে। সর্বশেষ বাড়ল বিদ্যুতের দাম। পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন–তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার; এর ফলে ভোক্তাদের প্রতি মাসে গুণতে হবে বাড়তি টাকা।

বিদ্যুতের এই দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিইআরসি চেয়ারম্যানের মতে, আমদানি করা কয়লার উপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা হয়েছে, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের উপর ১০ পয়সা করে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বেড়েছে, এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোকে তুলনামূলক কমমূল্যে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কাছে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে।

যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মূল্যবৃদ্ধি অন্যায্য ও অযৌক্তিক। বিদ্যুৎ খাতে অপব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের পকেটে হাত দিয়েছে। ৯ হাজার কোটি টাকার উপরে অযৌক্তিক ব্যয় যদি সমন্বয় করা হত, তাহলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হত না। সরকার রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মুনাফা অর্জন ও লুণ্ঠনের এক অভয়ারণ্য তৈরি করেছে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কোনো বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা তাদেরকে দিতে হচ্ছে। আর এ অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের উপর। প্রশ্ন হচ্ছে এই লুটপাটের দায় জনগণ কেন নেবে?

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর তেল নিয়েও চলছে তুঘলকি কাণ্ড। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির দেওয়া তেলে চলতে পারলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিজেরা পৃথকভাবে তেল আমদানি করে। ফলে সেখানে বাড়তি খরচ হয়। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া নিজেরা তেল আমদানির নামে বহু রকমের দুর্নীতি হয়। বিপিসির তেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে সেটার সমাধান করা উচিত। বেসরকারিভাবে তেল আমদানির এই ফাঁদ দুর্নীতির একটি উৎস। এই উৎস বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই। স্বচ্ছতার সঙ্গে ঘাটতির প্রকৃত পরিমাণ হিসাব না করে, কেবল দাম বাড়িয়ে টাকার অংক মেলানোর সরকারি প্রয়াস জনগণের সঙ্গে প্রতারণারই নামান্তর।

যে সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে এবং বেশি দামের বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, সে অনুযায়ী এ বছর থেকেই বিদ্যুতের দাম কমার কথা। অথচ সরকার বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ালো। এটা বিদ্যুৎখাতে সরকারের অদক্ষতারই বহিঃপ্রকাশ। সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করে অপেক্ষাকৃত কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই এখন আবার দাম বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

কিন্তু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য নেতবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনিতেই বিভিন্ন কারণে অর্থনীতি চাপে রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগ নেই। উৎপাদন পরিস্থিতিও দুর্বল। দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৮ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় তা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়বে। এতে দেশের শিল্পখাতে বড় ক্ষতি হবে। পিছিয়ে পড়বে উৎপাদন খাত। তৈরি পোশাক খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কৃষিকে এই দাম বৃদ্ধির আওতায় রাখা হলে সেখানেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ না করে শুধু ভর্তুকি সুষমকরণের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফল ভালো হওয়ার কথা নয়। এর ফলে অপচয় ও দুর্নীতি বেড়ে যাবে। অপব্যয় ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে। ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয় বেড়ে যাবে। এসব দিক বিবেচনায় বিদ্যুতের দাম আবারো বাড়ানো মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। দেশের আপামর সাধারণ জনতাকে এই বাড়তি বোঝা বইতে হবে। যা সরকারের অবনতিশীল জনপ্রিয়তাকে আরো নিচের দিকে নামাবে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস–ইত্যাদি খুবই সংবেদনশীল বিষয়। সাধারণ মানুয এসবের দাম বৃদ্ধি মোটেও ভালো চোখে দেখে না। বরং কীভাবে এসব সেবা আরো ভালো ভাবে এবং কম দামে দেয়া যায় তা যেকোনো সরকারেরই গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু সে ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

অভিজ্ঞমহলের মতে, শুরু থেকেই যদি বিদ্যুতের উৎপাদন, ব্যবহার এবং এর বণিজ্যিকীকরণে সততা এবং দক্ষতার পরিচয় দেয়া যেত, তাহলে দফায় দফায় এভাবে দাম বাড়ানোর দরকার হত না। এদেশে রাজধানীতে রাতভর রাজপথের বাতি জ্বলে, কিন্তু সেই বাতির অনেকগুলো যে সারাদিনও জ্বলে তার খবর কে রাখে? দুপুর ১ টায়ও এয়ারপোর্ট রোডসহ এরকম অনেক রোডের বাতি জ্বলতে দেখা যায়। এদেশে ব্যবহারকারীরা এখনও কেউ কেউ বিশেষ ব্যবস্থায় বিল ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যায়। এসব ব্যাপারে নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এদেশে দুর্বল কিছু ব্যবহারকারীকে প্রিপেইড মিটার দেয়া হলেও ১০০% ব্যবহারকারীকে এর আওতায় আনা হয়নি, নানারকম অসার কারণ দেখিয়ে। কোনো সমস্যার সমাধান না করে এভাবে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আর্থিক জুলুমের মুখে ঠেলে দেওয়াই কী সরকারের একমাত্র কাজ? বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্র সম্পূর্ণরূপে অচল। অপচয়, চুরি, দুর্নীতি বন্ধ না করে কেবল দাম বাড়িয়ে ব্যয় সমন্বয়ের চেষ্টা মোটেও ভালো কাজ নয়। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিসহ অন্যান্য খরচ মেটাতেই যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের, সেখানে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সাধারণ মানুষকে নির্মম পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেওয়ার সামিল।

সরকার ভর্তুকি কমানোর কথা বলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি করে জনসাধারণকে এক দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে সরকারের কাজই হচ্ছে, হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনসাধারণের সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা, সেখানো উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। এ কথা সবাই জানেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। দেশের বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জ্বালানি তেলের মাধ্যমে। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় খরচ আরও কমেছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ার পরিবর্তে কমার কথা। তা না করে সরকার উল্টো বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা জনসাধারণের উপর জুলুম ছাড়া কিছু নয়।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, সরকার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, মতামতকে গ্রাহ্য করছে না। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারের উপর কথা বলার কেউ নেই। যে সরকার জনগণের হওয়ার কথা, সে এখন নিজের হয়ে গেছে। জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থই বড় করে দেখছে। সে মনে করছে, যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা জনগণকে মেনে নিতে হবে। এই স্বেচ্ছাচারিতার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। যে দেশে সরকার জনগণের সুখ-দুঃখের কথা বিবেচনা করে না, কেবল নিজের লাভের কথা চিন্তা করে, সে দেশের জনগণের দুঃখের অন্ত থাকে না। বাংলাদেশের মানুষ এখন এই দশার মধ্যেই পড়েছে।

অথচ সরকারের কাজ হচ্ছে জনসাধারণের জীবনযাত্রাকে স্থিতিশীল রাখা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার একের পর এক গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনসাধারণকে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যেতে বাধ্য করছে। শুধু জনসাধারণকে নয়, শিল্প-বাণিজ্য, বিনিয়োগের ক্ষেত্রটিকেও কঠিন করে তুলছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে অনেক শিল্প-কারখানা চালু করতে না পারার কথা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যমান শিল্প-কারখানা নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এসব সমস্যার সমাধান না করে এবং এসবের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সরকার কেবল দাম বৃদ্ধি করে চলেছে। মাঝে মাঝে অবকাঠামো নির্মাণের একটি উছিলা দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণকে দীর্ঘস্থায়ী টানাপড়েনের মধ্যে রেখে এ ধরনের অজুহাত দেয়া কতটা যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য? কেবল জনসাধারণের উপর একের পর এক রাজস্ব বোঝা চাপিয়ে দিয়ে যদি সরকারকে চলতে হয়, তবে সে সরকারের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা অস্বাভাবিক নয়।