চলচ্চিত্রে চাঁদাবাজি: কাজীর গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নাই

রেজা ঘটক
Published : 2 Feb 2020, 12:37 PM
Updated : 2 Feb 2020, 12:37 PM

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড (বিএফডিসি) এর ছাড়পত্র ছাড়া আমার 'হরিবোল' চলচ্চিত্রের সেন্সর দেবে না। প্রথম কথা হলো, যারা বিএফডিসি-র বাইরে স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তাদের কেন বিএফডিসি-র ছাড়পত্র লাগবে? যার সাথে কোনও কাজই হলো না, তার থেকে কীসের ছাড়পত্র নিতে হবে? আর বিএফডিসি-র ছাড়পত্র আনতে গেলেই দেখা যাবে সেখানে নানান কিসিমের সমিতির নামে প্রকাশ্যে চলছে যত চাঁদাবাজি। আর এ চাঁদাবাজিতে একজন স্বাধীন নির্মাতা/প্রযোজকের লাগবে মোটামুটি তিন লাখ টাকা। তিন লাখ টাকার একটা প‌্যাকেজ। আপনি সিনেমা বানানোর পর এই চতুষ্টয় সিন্ডিকেটকে তিন লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে তবেই পাবেন বিএফডিসি-এর ছাড়পত্র। এই দুষ্টু সিন্ডিকেট চক্রের পারস্পরিক সম্পর্কটা আপনি বুঝতে না পারলে আপনার মত আহাম্মক আর দুনিয়ায় নাই।

সরকারি নিয়মের দোহাই দিয়ে এ সিন্ডিকেট সরকারের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের উপর প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। আর চাঁদাবাজির জন্য তারা টার্গেট করেছে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। অথচ আমাদের দেশে যারা বিকল্পধারার স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা বলেন, তারা এ সিন্ডিকেটের- এ সরকারি নিয়মের দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজি নিয়ে কিছুই বলেন না। বলেন না কেন? কারণ এই চতুষ্টয় সিন্ডিকেটের তারা শত্রু হতে চান না। এই সিন্ডিকেটের সকল অনিয়ম মেনেই নিজেদের চলচ্চিত্রের সেন্সর করিয়ে নেয়।

চতুষ্টয় সিন্ডিকেট কারা? বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি এবং চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। কী আপনি আকাশ থেকে পড়লেন নামগুলো শুনে? থামুন মশাই, আগে মন দিয়ে সবকিছু জানুন।

১. বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের চলচ্চিত্রের সেন্সরের জন্য যে সুনির্দিষ্ট আবেদনপত্র, সেই সেন্সর আবেদনপত্রের কোথাও বিএফডিসি থেকে ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র নামক কোনও কাগজ চাওয়া হয় না। অর্থাৎ সরকারি নিয়মে কোথাও বিএফডিসি এর ছাড়পত্র নেওয়ার কোনও নিয়ম নাই। এবার প্রশ্ন হলো, তাহলে সেন্সর বোর্ড কীসের ভিত্তিতে এই ছাড়পত্র দাবি করে? তারা নিজেরা (এই দুষ্টচক্র) একটা মিটিং করে সেই কপি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবকে সিসি দিয়ে সেই স্মরকের দোহাই দিয়ে এই ছাড়পত্র চায়! সেন্সর বোর্ডে চলচ্চিত্র জমা দেবার পর সেন্সর বোর্ড থেকে চিঠি দিয়ে আপনাকে বিএফডিসি-র এই কথিত ছাড়পত্র জমা দিতে বলা হয়।

২. এবার স্বাভাবিক কারণেই আপনি ছুটে যাবেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে। সেখানে তারা তাদের মত কিছু নিয়ম কানুন বানিয়ে রেখেছে। তার আগে আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন কী লেখা থাকে এই ছাড়পত্রে? এই ছাড়পত্রে লেখা থাকবে অমুক চলচ্চিত্রের জন্য বিএফডিসিতে কোনো দেনা পাওয়া নাই। অতএব অমুক চলচ্চিত্রে সেন্সরের জন্য বিএফডিসি'র কোনো আপত্তি নাই। এই দুই লাইনের ছাড়পত্র পেতে এবার আপনার সত্যিকারের লড়াইটা শুরু হবে।

৩. বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে ছাড়পত্রের জন্য একজন স্বাধীন নির্মাতা/প্রযোজককে দিতে হবে এক লাখ টাকা। কিন্তু যারা এফডিসিতে সিনেমা বানায় তারা বিনামূল্যে এই ছাড়পত্র পায়। এই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে ট্রেজারি চালান হিসেবে জমা হয় না। এই টাকা জমা দিতে হবে বিএফডিসি এর ফান্ডে। গত ১৫ জানুয়ারি ২০২০ বিএফডিসি স্বাধীন নির্মাতা/প্রযোজকদের জন্য নতুন ফিস ধার্য করেছে এক লাখ টাকা। এর আগে এই দুই লাইনের ছাড়পত্রের ফিস ছিল দশ হাজার টাকা।

এই এক লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকার পাবে না। এই টাকা পাবে বিএফডিসি'র নিজস্ব ফান্ড। আপনি কী এবার এক লাখ টাকা বিএফডিসি এর তথাকথিত ফান্ডে জমা দিলেই ছাড়পত্র পাবেন? আরে না মশাই! এবার আপনাকে এই সিন্ডিকেটকে আরো চাঁদা দিয়ে আসতে হবে। এবার বিএফডিসি বলবে আপনি প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি এবং পরিচালক সমিতির সদস্য না হলে আপনি এই ছাড়পত্র পাবেন না। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কোনওভাবেই দুটি বেসরকারি সমিতি'র সদস্য হতে আপনাকে বাধ্য করতে পারে না। অথচ সবার চোখের সামনেই একটা অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।

৪. এবার আপনি প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সদস্য না হলে বিএফডিসি ছাড়পত্র দেবে না। এই বেসরকারি সমিতি হলো বিএফডিসি'র চাঁদাবাজির আরেকটা চক্র। এখানে এক বছরের জন্য সদস্যপদ পাবেন এক লাখ তিন হাজার টাকার বিনিময়ে। এই টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি চালান হিসেবে জমা হয় না। সমিতির ফান্ডে জমা দিতে হবে। আপনি পরের ছবি বানাতে বানাতে আপনার এক বছরের মেয়াদ শেষ। নতুন ছবি বানানোর সময় নতুন করে আবার চাঁদা দিয়ে সদস্য হবেন। চাঁদাবাজির কৌশলটা কী একটু বোঝা যাচ্ছে?

৫. প্রযোজক সমিতির সদস্য হতে আপনাকে পরিচালক সমিতির সদস্য হতে হবে। পরিচালক সমিতির সদস্য ফি ৫৫ হাজার ৭০০ টাকা। এই টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি চালানে জমা হয় না। আপনাকে জমা দিতে হবে ওদের সমিতির ফান্ডে। এরাও এফডিসি-র এই চাঁদাবাজির আরেক চক্র।

৬. এই তিন চক্র আবার সেন্সর বোর্ডের সবকিছুর যোগসূত্র। সেন্সরের মূল আবেদনপত্রে কোথাও বিএফডিসি-র ছাড়পত্রের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নাই। আপনাকে ধরিয়ে দেবে সেন্সর বোর্ডের একটি স্মারক। এই স্মরকের আগামাথা তথ্য মন্ত্রণালয়ে কেবল কাগজে কপি আছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এই স্মারকের শক্তি ও এটা নিয়ে চলচ্চিত্রে চাঁদাবাজির খবর স্বীকার করে না। তারা বলবে এটা নিয়ম। নিয়মটা কে বানালো? বিএফডিসি, প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, পরিচালক সমিতি আর সেন্সর বোর্ড মিলে এই নিয়ম বানিয়েছে।

৭. এর বাইরে আপনি কেবল সরকারি নিয়ম অনুসারে আপনার ছবির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সেন্সর বোর্ডে আপনার ছবি পরীক্ষণ ও প্রদর্শনের ফি দেবেন। সেটাই একমাত্র সরকার বাহাদুরের কোষাগারে যায়। আর ওটা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার মত। সরকার বাহাদুর কেবল এই ২০/৩০ হাজার টাকার খবর জানে। মাঝখানের এই স্মারক আর সমিতি আর ছাড়পত্রের নামে যে নিরব তিন লাখ টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে, এটা সরকার বাহাদুর জানেই না।

যদি সরকারি নিয়ম হয় তাহলে সকল টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা হবার নিয়ম। এর বাইরে আপনি যত টাকা যাদের ফান্ডে দেবেন, এটার কোনো হিসাব সরকার জানবে না। চাঁদাবাজির এই কৌশল দিয়েই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সায়েস্তা করার কৌশল নিয়েছে চলচ্চিত্রের এসব দুষ্টু সিন্ডিকেট।

আমাদের বড় বড় নির্মাতারা এসব নিয়ে কথা বলেন না। সোজা কথা তারা এই চক্রের শত্রু হতে চান না। যার যার নিজের স্বার্থ নিয়ে তারা এক একজন বড় বড় নির্মাতা। আমি বলতে চাই এফডিসি-র বাইরে আপনি যদি সিনেমা বানাতে চান, তাহলে এই চক্রের চাঁদাবাজি খাতে মিনিমাম তিন লাখ টাকা পকেটে রাখবেন। নইলে আপনি চলচ্চিত্রের জন্য সেন্সর পাবেন না।

প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি যখন একটা বই লেখেন তখন কী বাংলা একাডেমিতে চাঁদা দিয়ে আপনাকে সেই বইয়ের জন্য প্রকাশনা ছাড়পত্র নিতে হয়? আপনি যখন আপনার শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করেন, তখন কী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চাঁদা দিয়ে আপনার প্রদর্শনীর জন্য কোনো ছাড়পত্র নিতে হয়? একজন কৃষক যখন ফসল ফলান, তার কি কৃষি মন্ত্রণালয় বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে টাকার বিনিময়ে কোনো ছাড়পত্র নিতে হয়? তাহলে একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা/প্রযোজককে কেন চলচ্চিত্রে সেন্সর পেতে বিএফডিসি থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে? কোন আইনে নিতে হবে? কেন নিতে হবে? এই তিন লাখ টাকার চাঁদাবাজি নিয়ে সরকার কিছু জানে না কেন?

চলচ্চিত্রের এই চাঁদাবাজি যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন স্বাধীন চলচ্চিত্র বলে আপনি যতই আওয়াজ দেন, সবকিছু এদের নানা উপায়ে ম্যানেজ করার পর বাহাদুরী। আপনি হয়তো পকেটে পাঁচটা পাণ্ডা সরকারি লোক নিয়ে ঘোরেন। আপনি তিন লাখের জায়গায় একটু কম খরচে নিজের পিঠ বাঁচাবেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের নামে এই চাঁদাবাজি নিয়ে আমাদের দেশে কেউ উচ্চবাচ্য করে না।

আমার সিনেমার রিলিজ ডেট কেন তথাকথিত সমিতি থেকে নিতে হবে? সিনেমা বানাবেন আপনি আর সেই সিনেমার রিলিজ ডেট দেবে আপনার থেকে চাঁদাবাজি করা তথাকথিত সিন্ডিকেট? স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বানানো সিনেমায় বিএফডিসি বা প্রযোজক সমিতি বা পরিচালক সমিতি'র যেখানে ন্যূনতম কোনো ভূমিকা নাই, সেখানে তাদের এই অনিয়ম মেনে কেন তিন লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে?

একটা জিনিস খেয়াল করুন, আপনি যদি বিএফডিসি থেকে সিনেমা বানান, তখন আপনি বিনামূল্যে ছাড়পত্র পাবেন। কিন্তু বিএফডিসি-র বাইরে সিনেমা বানালে আপনাকে এই চাঁদা দিতেই হবে। এরকম চাঁদাবাজির কারণে এদেশে ভালো সিনেমা হচ্ছে না। সরকার বাহাদুর মুখে বলছে তারা সিনেমা বান্ধব এবং চলচ্চিত্রের উন্নয়ন চায়। কিন্তু কাজে গিয়ে দেখেন আপনি এই চতুষ্টয় সিন্ডিকেটের বাইরে সিনেমা বানানো কত কষ্টের!

'হরিবোল' চলচ্চিত্রটি আমি বাংলাদেশের মানুষকে প্রথম দেখাতে চেয়েছিলাম। এখন এই তিন লাখ টাকা আমি কোনোভাবে সংগ্রহ করতে পারলে ওদের চাঁদা দিয়ে 'হরিবোল' সেন্সর করাবো কিনা তাই ভাবছেন? মোটেও না। আমি নতুন একটি শর্ট ফিল্ম বানাতে চলে যাব। তবুও এই দুষ্টু সিন্ডিকেটকে এক টাকাও চাঁদা দেব না। তাহলে 'হরিবোল' চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ কী?

দেশের বাইরে আমি যে কোনো দেশ থেকে 'হরিবোল' রিলিজ করে দেব। সেই খবর খুব শিগগিরই পাবেন আপনারা। সিনেমা যখন বানিয়েছি তখন তা দেখানোর সকল কৌশলও আমার জানা আছে মশাই। হয়তো সিনেমা হল থেকে আমার পুঁজি ফেরত আসার রাস্তাটা এরা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু সিনেমা দেখানো এরা কোনওভাবেই বন্ধ করতে পারবে না। কারণ আপনার হাতেই এখন সিনেমা দেখার মত ডিভাইস রয়েছে। আর আপনারা সবাই আমার সিনেমার দর্শক।