গতি, গন্তব্য ও একটি দীর্ঘশ্বাস

Published : 20 Nov 2019, 11:52 AM
Updated : 20 Nov 2019, 11:52 AM

যেসব কথা বলবো সেসব ঘটনা হামেশাই ঘটে আমাদের আপাতঃ সুখী, গৎবাঁধা জীবনে। ঘটনা এক: একদিন অফিস ছুটির পর বাড়ি ফিরছি রিকশায়। রিকশাওয়ালা ভাই রিকশার তিন চাকাকে প্লেনের তিন চাকা ভেবে মনের আনন্দে উড়ালপঙ্খী গতিতে ছুটছে। আমি ভীষণ ভয়ে বললাম, ভাই একটু আস্তে যাওয়া যায় না! এইটা তো প্লেন না, আর রাস্তাও তো রানওয়ে না। আর যায় কোথায়! উনি আরো উদ্দাম গতিতে দে উড়াল, দে উড়াল। উল্টে আমাকে বললেন, চুপ করে বসে থাকেন, রিকশা কেমনে চালাইতে হয় আমি জানি। আমার আস্তে চলার 'টাইম' নাই। ঘটনা দুই: যথারীতি নিত্যদিনের ট্রাফিক সিগনালে বসে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিচ্ছি। চারপাশে গাড়ি, মোটরবাইক, বাস সবই স্থিরমান। এরই মধ্যে একজন মোটরবাইক চালক অধৈর্য্য হয়ে একটানা তীব্র হর্ণ বাজিয়ে চলেছে। আশেপাশে সবাই মোটামুটি বিরক্ত। এরমধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল, ভাই অকারণ হর্ণ দিচ্ছেন কেন? দেখেছেনই তো সামনে সিগন্যাল। এ কথার উত্তরে বাইকওয়ালা বলল, 'সময়' নাই ভাই, তাড়া আছে। আর কতক্ষণ দাঁড়াবো! ঘটনা তিন: হঠাৎ মাঝপথে দুই রিকশাওয়ালার মারামারি। একে অন্যকে অজস্র ও অস্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন। কারণ কে কার আগে যাবে এই প্রতিযোগিতা করতে যেয়ে দুই রিকশার চাকায় বেঁধে বিরাট জ্যাম বাধিয়ে একাকার অবস্থা। কারণ ওই একটাই, কারোরই 'সময়' নাই।

পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে যখন কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে তখন একে গতিশীল বস্তু এবং এই ঘটনাকে গতি বলে। কোনো কিছু চলমান অর্থাৎ ক্রিয়াশীল বলেই আমরা তাকে গতি বলি। গতির একটি নিজস্ব ধর্ম আছে। আবার নিউটনের তৃতীয় সুত্র অনুসারে একথাও প্রমাণিত যে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। আমরা গতির সাথে তাল মিলিয়ে সবাই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছি। যেন বা রবি ঠাকুরের 'হঠাৎ দেখা' কবিতার মত "সময় কোথায় সময় নষ্ঠ করার"! এই ছুটতে যেয়ে আমরা বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কথা ভুলে যেতে বসেছি। অথচ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো অহেতুক এই ছোটছুটি কত অর্থহীন! এ কথা সত্য যে, গতিময়তাই জীবনের ধর্ম। কিন্তু এখন মনে হয় চিন্তা করার সময় এসেছে আমারা কখন, কিভাবে সময় ও গতিকে ব্যবহার করবো। আমাদের চেতনা থেকে বোধগুলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে বলে আমাদের ইন্দ্রিয় আজ গতির কাছে হার মেনেছে। মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক সৌজন্যবোধও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। পথ চলতে যেয়ে আমারা একে অন্যের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি অথচ একে অন্যেকে 'দুঃখিত' বলার বদলে আক্রমণাত্বক কথা বলছি, আগে গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে বলে আমাদের মোটর সাইকেল উঠে যাচ্ছে ফুটপাতে, আমরা অবলীলায় পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে হর্ণ বাজিয়ে চলে যাচ্ছি। সময় নাই, তাড়া আছে বলে আমরা ফুটওভার ব্রীজ ব্যবহার না করে চলন্ত বাস-ট্রাকের সামনে দিয়ে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত রাস্তা পার হচ্ছি। যেন বা জীবন গেলে যাক কিন্তু যেকোনো মূল্যে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে হবে। আবার কখনো বা জীবনের সকল উত্তেজনা মোবাইল ফোনে বর্ণনা করতে করতে পরিপার্শ্ব ভুলে মারাত্মক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্ত কোনোকিছুই আমাদের এই গতিকে রোধ করতে পারছে না।

গত পরশু পত্রিকায় দেখলাম একটি বাস ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে দুইজন বয়ষ্ক মানুষকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে এবং এরই পাশ দিয়ে আরেকটি দ্রুতগতির বাস সামনে ধেয়ে আসছে। মৃত্যু ভয়ে ভীত দুই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মাঝবয়সী মানুষ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছেন। কী বিপুল অসহায়ত্ব! কি নিদারুণ দৃশ্য! যেন কারোরই কিছু যায় আসে না, শুধু দেখা ছাড়া। এর কয়েকদিন আগে বাসের এক সহকারী অবলীলায় স্কুলগামী এক ছাত্রীকে প্রায় জোর করে বাস না থামিয়ে রাজপথের মাঝখানে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। ধাক্কা সামলাতে না পেরে মেয়েটি মাঝ রাস্তায় পড়ে গেল এবং আমি নিশ্চিত ওর ভাগ্য সহায় বলে সে বেঁচে গেল।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাইয়ের দিনটি আমাদের সবার বিশেষভাবে মনে থাকার কথা। কারণ ওইদিন বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় নিহত হয় দুই শিক্ষার্থী। এই রকম মৃত্যু তো নিয়ত ঘটে আমাদের মতো দেশের ভাগ্যহত জনগণের। তাতে অবশ্য কারোরই কিছু যায় আসে না, শুধু মানুষটির পরিবার ছাড়া। কিছুদিন হৈচৈ হয় ফেসবুকে, টকশোতে, পত্রিকার পাতায়, অফিস পাড়ায়, চায়ের দোকানে তারপর অবস্থা আবার তথৈবচ। গত বছরের ২৯ জুলাইয়ের কথা বিশেষভাবে বললাম কারণ ওই যে নিউটনের তৃতীয় সূত্র। প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়া বিরাজমান। রমিজ উদ্দিন ক্যান্টমেন্ট কলেজের ওই শিক্ষার্থী দু'জন নিহত হওয়ার পরপরই মূলতঃ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে; যেন কোনো গণঅভ্যুত্থান! পেছনে যেতে যেতে যখন মানুষের যাওয়ার আর কোনো রাস্তা থাকে না তখনই মানুষ সামনে এগোতে শেখে। এই শিক্ষা কেউ তাকে দেয় না; এই শিক্ষা জীবন থেকে নেওয়া। রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে আমরা বিষয়টিকে সেই সময় যতই ভিন্নরূপে দেখার চেষ্টা করি না কেন কিন্তু ব্যাপারটিতে একধরণের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। এতকিছুর পরও এইসব অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর তালিকা শুধু দীর্ঘায়িতই হয়েছে। থামেনি আমাদের গতি, থামেনি কান্না আর অসহায়ত্বের গল্প।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (এআরআই) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সড়কে যাত্রী ও পথচারী হতাহত হয়েছেন ৪৬,০৮৬ জন। এর ভেতর ৬ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৫,৫৬৬ জন। অর্থাৎ ৩৩.৭৭% হচ্ছে বয়সে তরুণ। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, বিগত পাঁচ বছরে যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন এরমধ্যে ১২.৫০% মানুষই ছিল শিক্ষার্থী। কি ভয়াবহ এই নির্মমতা! আমাদের এক একটি প্রাণের স্পন্দন শুধু সংখ্যা হয়ে থেকে যাবে মহাকালের গর্ভে। সম্ভবনাময় প্রাণগুলো স্পর্শ পাবে না মাটি আর জলের। আমাদের অবাধ্যতা আর গতি তবুও থামবে না। আমরা দায়হীন হয়ে বিএমডব্লিউ চড়ে ঘুরে বেড়াবো মতিঝিল থেকে উত্তরা, শুলশান থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। ঘুণপোকায় খাওয়া এই সমাজ ব্যবস্থা শুধু শেখায় অন্যের ওপর দোষ চাপাতে। আমাদের কৃতকর্মের দায়ভার আসলে যেন আমাদের নয়; বোধহয় অন্য ভুবনের কারো। নজরুলের কবিতার একটি লাইন দিয়ে শেষ করি-'আমরা সবাই পাপী; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে; অন্যের পাপ মাপি'। এতকিছুর পরও আশাহীন হতে ইচ্ছা করে না, মনে হয় কোনো একদিন আমাদের গতি নিয়ন্ত্রিত হবে মানবিক মূল্যবোধ আর শৃঙ্খলার সমন্বয়ে।