আপনি, নইলে কে? এখনই, নইলে কখন?

আশফাক আনুপআশফাক আনুপ
Published : 24 Sept 2019, 10:05 AM
Updated : 24 Sept 2019, 10:05 AM

মনে করুন আপনাকে আগামীকাল সকালে উঠে কর্মস্থলে যেতে হবে। স্বভাবতই আপনি এই মুহূর্তে বাড়িতে গিয়ে ঘুমোবার যোগাড়যন্তর করছেন। কিন্তু আপনাকে একে একে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট তথ্য জানানো হলো ঘুমোতে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে। প্রথমত মহাসমারোহে জানানো হলো– আপনার আয়-রোজগার বেশ খানিকটা বাড়তে চলেছে আগামীকাল থেকেই। এবার দ্বিতীয়ত কিঞ্চিত মৃয়মান হয়ে জানানো হলো– যতই অর্থাগম হোক না কেনো শীঘ্রই আপনার এই অঞ্চলে শিক্ষা-দীক্ষার পরিবেশের বারোটা বাজতে চলেছে। এরপর তৃতীয়ত আপনাকে জানানো হলো– শিক্ষা-দীক্ষা তো পরের কথা, এলাকায় ইদানিং যে হারে চুরিচামারি চলছে তাতে আজ রাতেই চুরি হতে পারে আপনার বাড়িতে। আর সবশেষে আপনাকে শীতলকণ্ঠে জানানো হলো– আপনার ঘরটি আজ রাতেই বিলীন হয়ে যেতে পারে ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে; কিম্বা অথৈ জলরাশি এসে ভাসিয়ে নিতে পারে আপনার ঘুমোবার চৌকিটি পর্যন্ত! এরমধ্যে কোন তথ্যটিতে আপনি আঁতকে উঠবেন সহসাই? আসুন একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করি। যদি না আপনি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকেন, এটা সম্ভবত নিশ্চিতভাবেই বলা চলে যে সর্বশেষ তথ্যটিতে আপনার পিলে চমকে ওঠবার কথা! সম্ভবত এই ভয়ানক তথ্যটি আপনাকে এতো দেরিতে জানানো হলো কেনো তা নিয়েও তথ্য সরবরাহকারীকে একহাত নেবেন আপনি। মনে কিছুটা সন্দেহ থাকলে দ্রুত নিশ্চিত হবারও চেষ্টা করবেন যে আসলেও ব্যাটা সঠিক তথ্য দিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে। সে যাই আপনি করুন না কেনো, একটা কাজ আপনি নিশ্চিতভাবেই করবেন না; তাহলো কাঁথাটা গায়ে টেনে সটান শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া। এখন ধরুন– এই শেষ তথ্যটি আপনাকে জানানোই হল না। সেক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? ধরে নেয়া যায়– বাকি তথ্যগুলোর বদৌলতে হর্ষ কিম্বা বিষাদজনিত কারণে আপনার ঘুমে ব্যাঘাত হয়তো ঘটতে পারে, রাতভর অস্বস্তিতে এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে পারেন, কিন্তু আপনি নিদ্রাত্যাগপূর্বক তাৎক্ষণিক গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে বোধ করি না। এতে আপনার নিজের অজান্তেই সলীল সমাধির একটি বন্দোবস্ত হবে বটে, কিন্তু তাতক্ষণিক দুশ্চিন্তাটুকু বেশ কমই হবে বলা যায়। তবে এভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করাটা কি ভালো সিদ্ধান্ত? সম্ভবত না।

'সম্ভবত' বলছি কারণ গত দু'দিনের বঙ্গীয় সংবাদপত্রসমূহ ঘেঁটে আমার এ ব্যাপারে বিস্তর সন্দেহ জন্মেছে। এই গত কয়েকদিন যাবত সারাবিশ্বে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধের গল্প রচিত হচ্ছে। সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শিশু ও কিশোর নিজেদের শিক্ষাদিবস বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে মনুষ্যসমাজের ঘুম ভাঙাতে। তারা এর নাম দিয়েছে গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক বা বৈশ্বিক জলবায়ু অবরোধ। সিডনি, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, অক্সফোর্ড, টরেন্টো, কলকাতা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল এমনকি সাতক্ষীরায় পর্যন্ত স্কুলগামী শিশু-কিশোরের দল কাতারে কাতারে যোগ দিচ্ছে এই কর্মযজ্ঞে। তাদের এই অবরোধ তারা করছে নিউ ইয়র্কে ঠিক যে মুহূর্তে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে সারাবিশ্বের রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধাকর আর সরকারপ্রধানদের অংশগ্রহণে 'জলবায়ূ কার্যক্রম সম্মেলন (Climate action summit)' অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ঠিক তখন। যাতে করে তারা নিজেদের অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ভয়ানকতম পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দায় কিছুটা হলেও তাদের পূর্বপ্রজন্মের কাঁধে তুলে দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে শিশু-কিশোরদের এই অভূতপূর্ব সমাবেশ থেকে তারা বার বার আমাদের যা জানাতে চেষ্টা করছে তা হলো– সময় হাতে একেবারেই নেই। জলবায়ু বিপর্যয় সামলাতে আগামী দেড় বছরের মধ্যেই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পদক্ষেপগুলো নিতে হবে গোটা পৃথিবীকে। একই সাথে। কোনো প্রকার গড়িমসি ছাড়াই।

ক্লাইমেট স্ট্রাইকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে গোটা পৃথিবীর কোণায় কোণায় কোথায় এই অবরোধে কারা যোগদান করছেন তার তথ্য দেয়া হচ্ছে। টুইটারে চলছে হ্যাশট্যাগ'এর বন্যা। তো দেশে এই উদ্যোগের আদ্যোপান্ত জানতে ঘাঁটছিলাম বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমগুলো। মূলত বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে মোট ৯টি প্রথমসারির ছাপানো দৈনিকের প্রথম পাতা, শেষ পাতা এবং সম্পাদকীয় খুঁজলাম। বেশ আমোদের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, একটি মাত্র ইংরেজি দৈনিক ব্যতিত আর কোনো ছাপানো দৈনিকেই এই সংবাদটির দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো উপস্থিতি নেই। কেউ অবশ্য বলতেই পারেন– কেবল তিন পাতা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটা দারুণ অন্যায়। তাদের একটা গল্প বলি। হোজ্জা সাহেব একবার একটি চকচকে স্বর্ণমুদ্রা কুঁড়িয়ে পেলেন পথে। নীতিনিষ্ঠ হোজ্জা সেই মুদ্রাটির তাৎক্ষণিক সদ্ব্যবহার না করে নিয়ে গেলেন কাজির কাছে। কাজি জানালেন এই মুদ্রায় কেবলমাত্র তখনই হোজ্জার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সে ভরা বাজারে গিয়ে পরপর ৩ বার এই মুদ্রাপ্রাপ্তির সংবাদটি প্রকাশ করবে, এবং সেখানে কেউ এই মুদ্রার মালিকানা দাবি করবে না। হোজ্জা সাহেব কথামতো বাজারে হাজির হলেন। অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন– "কুঁড়াইয়া পাইলাম" এবং তারচেয়েও নিম্নগ্রামে, ফিসফিসিয়ে বললেন, "সোনার মোহর"! এভাবে ৩ বার ঘোষণা করে উনি মহানন্দে কোর্তার জেবে মোহর গুটিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন। দেখুন– সংবাদটি তো উনি প্রকাশ করেছেন ঠিকই; এখন আমার মতো দুয়েকজন দুর্জন তো থাকতেই পারে যারা ওনার ফিসফিসানি ধরতে পারেনি। 

যাহোক, ছাপানো দৈনিকের পাট চুকিয়ে এরপর ভাবলাম অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোতে চোখ বোলানোটাও দস্তুর। সেখানে প্রথম সারির ৪ টিতে খুঁজলাম গত দু'দিনের সংবাদ। দু'টিতে ঢাকার ও সাতক্ষীরার ক্লাইমেট স্ট্রাইক নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। তবে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া সাইট থেকে প্রকাশ করে খবরগুলোকে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে একটি মাত্র দ্বিভাষিক (bi-lingual) পোর্টাল যাদের আবার ইংরেজি অংশটিই মূল। সঙ্গত কারণেই অনলাইন-অফলাইন কোনোটিরই নামোল্লেখের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না, তবে খেয়াল করলে যেটা বুঝতে পারবেন তাহলো ইংরেজি দৈনিক আর ইংরেজি প্রধান অনলাইন সংবাদমাধ্যমেই কেবল ক্লাইমেট-স্ট্রাইক বিষয়ক এই খবর গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্যাপারটি আরেকটি প্রশ্নও সামনে আনে বৈকি! কেউ তো বলে বসতেই পারেন– কে হে তুমি বাপু, কোথাকার এক নাকউঁচু সায়েব এসেছ তোমার "হ্যাশট্যাগ ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড প্রব্লেম" নিয়ে!? বাঙালি জ্ঞানী-গুণী, সম্পাদক-প্রকাশক সাহেবেরা কি এতোই অর্বাচীন যে বুঝবেন না কীসে গুরুত্ব দিতে হবে আর কীসে না?  

আসলেও তো; এই যে এতো লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, হিল্লি-দিল্লি করছি এই ঘটনা নিয়ে– ঘটনাটি কি বাঙালির জন্যেও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা উন্নত বিশ্বের জন্য? নাকি এটা আমার উন্নাসিক মনের খেয়ালি চিন্তায় গুরূত্ব পাওয়া একটি #ফার্স্টওয়ার্ল্ডপ্রব্লেম মাত্র? আসুন এটার উত্তর একটু পুরোনো কথা থেকে শুরু করি। ২০০৫ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দল হিসেব করেন যে, গাঙ্গেয় বদ্বীপের এই অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার প্রতি বছরে ১ ইঞ্চি। তাঁরা অনুমান করেন যে এই হারে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাস্তুহারা হবে অন্তত ৩০ লাখ মানুষ। আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নে লাগাম না টানা গেলে ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে। পরবর্তীতে গত ২০১১ সালে ম্যাপলক্রফট নামক ব্রিটিশ একটি কনসাল্টিং ফার্ম, যাদের কাজ মূলত নানান প্রকার বৈশ্বিক ঝুঁকি পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করা, তারা 'জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি (Climate change vulnerability)' শীর্ষক একটি বৈশ্বিক ইনডেক্স প্রকাশ করে। সেখানে নানান মাপকাঠিতে হিসেব করে তারা প্রকাশ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সকল দেশসমূহের সম্ভাব্য ঝুঁকির তীব্রতার একটি তুলনামূলক তালিকা। সেই তালিকায় গোটা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে এক নম্বর নামটি এসেছিলো যে হতভাগ্য দেশটির, তার নাম বাংলাদেশ। দ্বিতীয় নামটি ভারতের। এবং তৃতীয় নামটি দ্বীপদেশ মাদাগাস্কারের। অথচ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে ভারতের অবদান প্রায় ৫ শতাংশ হলেও, বাংলাদেশ-মাদাগাস্কারের যৌথ অবদান ০.৫ শতাংশেরও কম! আবার ম্যাপলক্রফটের প্রকাশিত মানচিত্র থেকে আরো খানিকটা খেয়াল করলে বোঝা যায় ভারতের যে অংশটুকু সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে অনুমিত, তাও আসলে বাংলাদেশ লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের অংশবিশেষ এবং মূলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ডেলটার সুন্দরবন ঘেঁষা অঞ্চল যা কিনা ভারতের সাম্প্রতিক কার্বন নিঃসরণের ৭% এর জন্যেও সাকুল্যে দায়ী নয়। সে হিসেবে বলা চলে সর্বমোট ০.৬% কার্বন নিঃসরণের জন্যেও দায়ী না হয়েও, আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপই জলবায়ুগত দিক থেকে বর্তমান পৃথিবীর ঝুঁকিপূর্ণতম অঞ্চলের একটি। পরবর্তীতে এবছরই করা জার্মানওয়াচ'এর 'জলবায়ু ঝুঁকি ইনডেক্স (Climate Risk Index) ২০১৯' অনুসারেও গত দুই দশকে জলবায়ু বিপর্যয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দশটির একটি বাংলাদেশ। এই ইনডেক্স অনুসারেও উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণে বাংলাদেশের ক্ষতির মাত্রা গোটা পৃথিবীতে অন্যতম সর্বোচ্চ। কেবল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়াটাই সমস্যা না। অব্যাহত সমুদ্র উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণবাংলার মাটির লবনাক্ততাও বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। খুব সম্প্রতি নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাকর্মে দেখানো হয় যে, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণবঙ্গে নিজ নিজ জেলার মধ্যেই উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হবে সম্ভাব্য প্রায় দেড় লাখ মানুষ। আর জেলা ছেড়ে বড় শহরে পাড়ি জমাবে আরো প্রায় ষাট হাজার মানুষ। রাজনৈতিক পাশা খেলার বলি হয়ে যে অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বাংশ (মিয়ানমার সীমান্ত) ইতিমধ্যেই বর্তমান পৃথিবীর বৃহত্তম উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত, যে অঞ্চলের উত্তর-পূর্বাংশ (আসাম সীমান্ত) কাঁপছে আরো বড় উদ্বাস্তু পরিস্থিতির উদ্ভবের আশংকায়, অচিরেই সে অঞ্চল নিজেই তার উপকূলে জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি করবে লাখে লাখে। চোখটা বন্ধ করে ব্যাপারটা ভাবুন একটু। 

এটুকু পড়ে যারা ভাবছেন কেবল উপকূলের ওপর দিয়েই ক্ষয়ক্ষতি যাবে, তাদের জন্য আরো কিছু তথ্য জানাতে চাই। Organisation for Economic Cooperation and Development এর তথ্যানুসারে ২০৭০ নাগাদ যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের হার একই থাকে তবে পৃথিবীর যে শহরটি দীর্ঘস্থায়ী বন্যাপরিস্থিতিতে সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে তার নাম কলকাতা। প্রশ্ন আসতে পারে– তাতে আমাদের কী? এটা বুঝতে জাতিসংঘের জলবায়ূ পরিবর্তন গবেষণা বিষয়ক পর্ষদ Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর তথ্যের দিকে দেখতে হবে। IPCC অনুসারে শিল্পায়ন পরবর্তীতে গোটা পৃথিবীতে উষ্ণতা বৃদ্ধির গড় পরিমাণ হচ্ছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো মেগাসিটির মধ্যে কেবল দু'টো মেগাসিটিতেই এই উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ বৈশ্বিক গড়ের তুলনায়ও ২০% বেশী, প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই শহর দু'টির একটির নাম কলকাতা এবং অপরটির নাম ঢাকা! অবধারিতভাবেই বাঙালি অধ্যুষিত সর্ববৃহত দুটি শহর। এখনো এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারটিকে কেবল দু'এক ডিগ্রি সেলসিয়াসের তারতম্য দিয়ে ভালো বোঝা না গেলে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

সাধারণত যখন পরিবেশের তাপমাত্রা নির্ণীত হয় তখন দু'ধরণের পরিমাপ করা হয়। একটি কেবলমাত্র তাপমাত্রার একক পরিমাপ, একে বলা হয় ড্রাই-বাল্ব টেম্পারেচার। অন্যটি হচ্ছে তাপমাত্রার সাথে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান বিবেচনা করে মনুষ্যত্বকের সহনীয়তার সাপেক্ষে তাপমাত্রার পরিমাপ, যাকে বলা হয় ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচার। এই ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা পরিমাপের মাধ্যমেই আসলে ধারণা করা সম্ভব জলীয়বাষ্পপ্রবণ অঞ্চলে কোন তাপমাত্রাটি মানুষের জন্য সহনীয় হবে। এই তাপমাত্রার পরিমাপ মূল তাপমাত্রা থেকে কম হয়। সাধারণত মনুষ্যত্বকের স্বাভাবিক সহনীয় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যেকোন অবস্থাতেই ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচার এর নিচে থাকা বাঞ্ছনীয়। ৩৫ ডিগ্রীর অধিক ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রায় কয়েক ঘন্টা কাটালেও তা যেকোনো সবল ও সুস্থ মানবশরীরের জন্যেও জীবনসংশয়ী হতে পারে। ২০১৭ সালের এক প্রকাশনায় এমআইটি (MIT)'র এক গবেষক দল ১৯৭৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত গোটা বিশ্বের ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচারের একটি বন্টন প্রকাশ করেন। সেখানে স্পষ্ট যে, এই তিন দশকে গোটা বিশ্বের যে জনবহুল অংশটিতে ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রার দৈনিক পরিমাপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছে তাহলো আমাদের গাঙ্গেয় অববাহিকা, প্রায় ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই প্রকাশনাতেই গবেষকদল অনুমান করেন যে, এই অঞ্চলই পৃথিবীর সবথেকে জনবহুল এলাকা যেখানে আগামী এক থেকে দুই দশকের মধ্যেই এই তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রীর বিপদসীমায় পৌঁছাতে পারে। এর বাইরে অন্যান্য যেসব অঞ্চলের তাপমাত্রা এই সীমায় পৌছাবার সম্ভাবনা আছে তার মূল অংশ হয় জনহীন মরুভূমি কিম্বা সমুদ্রবক্ষ। অর্থাৎ, কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় উপকূলে বাস্তুহারা হওয়াই নয়, বরং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবংগ সংলগ্ন মূলভূমির মানুষেরও গোটা অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে জীবনসংহারী খড়তাপের কারণেও।

এই দুই এর বাইরে আরো একটি বড় ঝুঁকি এই বদ্বীপের জন্য অপেক্ষা করছে। তা হলো আমাদের একমাত্র নিঃস্বার্থ রক্ষাকবচ ও প্রাকৃতিক ঢাল, বিশ্বের বৃহত্তম উপকূলীয় বন সুন্দরবনের ক্রমনিঃশেষ। সুন্দরবন গোটাটাই প্রায় সীমানা নির্বিশেষেই বঙ্গীয় বদ্বীপের উভয় অংশকে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বুক পেতে রক্ষা করে। ক্রমাগত মনুষ্য বসতি আর জীবিকার সংস্থান করে দিতে আর সমুদ্রে আহূতি দিতে দিতে সুন্দরবনের একটা বড়ো অংশ ইতিমধ্যেই বিপন্ন। বৈজ্ঞানিক অনুমান বলছে এই শতাব্দীর মাঝ বরাবরই সম্পূর্ণ লুপ্ত হতে পারে এই বিশাল রক্ষাকবচ। তখন উপকূলীয় ঘূর্ণীঝড় ও সাইক্লোন বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারবে এই ভূখন্ডের মূলভাগে। গত কিছুদিন আগেও যেই সিডর আর আইলা এসেছিলো সম্পদবিনাশী রূপ নিয়ে তা এসে হাজির হবে জনবিনাশী রূপ নিয়ে। উপকূলীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্যের খতিয়ান সে ঝড়ে নাও টিকতে পারে।

বছর চারেক আগে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত অনুষ্ঠান অক্সফোর্ড ইউনিয়ন বিতর্কে ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ ও সুবক্তা সাংসদ ড. শশী থারুর যখন দাবী করেছিলেন– ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বলি হয়ে এক কোটি 'ভারতীয়'র হত্যাকাণ্ড, 'ভারতীয়' বস্ত্রশিল্পের উদ্দেশ্যমূলক ধ্বংসসাধন, 'ভারতীয়' খাদ্যনির্ভর কৃষিকে জোরপূর্বক শিল্পনির্ভর কৃষিতে রূপান্তর ইত্যাদি অপকর্মের বিপরীতে ব্রিটেনের উচিত 'ভারত'কে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা; তখন হিশাম খন্দকার নামক এক বাঙালি ব্যবসায়ী তাঁর এক লেখায় দাবি করেছিলেন, এই সবগুলো অপকর্মই মূলত সাধিত হয়েছিলো ভারতবর্ষের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিরূদ্ধে। তারা বাঙালি। তাই বারবার ভারতীয় বলে এই অপরাধের জাতিগত যে আঙ্গিকটি আছে তা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। হয়তো পুরোপুরি এক নয়, তবে অনেকটা একই ধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করি 'বৈশ্বিক' উষ্ণায়ন ও 'বৈশ্বিক' জলবায়ু বিপর্যয়ের আলোচনাগুলোর সময়েও। এই সমস্যার অংশ গোটা বিশ্ব, এটাতো অনস্বীকার্যই। কিন্তু, তথাকথিত অনেক 'বৈশ্বিক' নেতাদের কাজকর্ম দেখে কেনো যেন মনে হয় বাকি বিশ্ব এই সমস্যার স্রষ্টা যতটুকু, ঠিক ততটা যেনো ভুক্তভোগী নয়। বরং ফলভোগের দায়টা যেনো আবারো ঠিক ওই বাঙালির ওপরেই এসে বর্তাচ্ছে!                

যাহোক, মূল কথায় ফিরি। তো যে উদ্দেশ্যে এই তথ্যসমাহারের আয়োজন করেছিলাম তা ছিলো– এটা উল্লেখ করা যে এই জলবায়ু বিপর্যয়ের হুমকি কেবল উন্নত বিশ্বের জন্যই প্রযোজ্য নয়। বরং জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রাদুর্ভাব সবথেকে জলদি এবং ব্যাপকমাত্রায় যে ভূখন্ড অনুভব করবে তা হচ্ছে আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এবং যে জনগোষ্ঠী সবথেকে ব্যাপকমাত্রায় ও বিপুল সংখ্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা হচ্ছে বাঙালি জনগোষ্ঠী। বরং আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমের আচরণে যাকে উন্নত বিশ্বের সমস্যা বলেই ভ্রম হচ্ছ – তা আদতে উন্নত বিশ্বের অদূর ভবিষ্যতের আশংকামাত্র। অথচ আমাদের জন্য তা প্রায় সমাগত বিভীষিকা। এই ভাষ্যের সত্যতা ধরা পড়বে যদি আপনারা কোন একটি রিস্ক ইন্ডেক্সের একেবারে নিম্নঝুঁকির দেশগুলোর নামের দিকে চোখ রাখেন। স্পষ্টত চোখে পড়বে যে নামগুলো তার বড় অংশ পূর্ব ইউরোপ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহ, গালফভুক্ত তেলসমৃদ্ধ দেশসমূহ (কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব ইত্যাদি) এবং রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র! এবার লক্ষ্য করুন জলবায়ু পরিবর্তন ও এর হুমকির ব্যপকতা নিয়ে সবথেকে উচ্চকণ্ঠ (ইউরোপ) এবং এর সত্যিকারের অস্তিত্ব নিয়ে সবথেকে সংশয়ী (গালফ, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) এই দুই অংশকেই আপনি পাবেন তালিকার নিচের দিকে। অথচ সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষতির ঝুঁকির মধ্যে থেকেও আমাদের অবস্থান কোথাও নেই। নীতিনির্ধারণীতে তো নেই-ই, এমনকি প্রচারমাধ্যমেও না। অবশ্য এও সত্যি যে, এব্যাপারে আসলে সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের একহাত নেয়াটাই তুলনামূলক অনেক সহজ। তারচে বরং অনেক কঠিন পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কিছু কথা সবাইকে জানানো। রাজনীতির কথা এলো যখন, চাইলেই এখন আমি তাপবিদ্যুত আর উন্নয়নের নামে কয়লানির্ভরতার আদিমতা নিয়ে এখানে বাংলাদেশের সরকারকেও দু'চার কথা শুনিয়ে দিতে পারি। তবে এটাও আসলে তুলনামূলক সহজ কাজই। কঠিন কাজ হলো গোটা বিশ্বকে বার বার করে মনে করিয়ে দেয়া যে, আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন সংস্থা (IIED)'র সর্বশেষ তথ্যানুসারে গত অর্থ বছরে নিতান্তই নিম্নমধ্য আয়ের দেশ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন সামলাতে যে ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, তার সাকুল্যে ১০ শতাংশও উন্নত বিশ্বের শিল্পায়িত দেশসমূহের কাছ থেকে আসেনি। কঠিন কাজ হলো এই হুমকিটি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তথাকথিক বৈশ্বিক নেতৃত্বের কাছে তুলে ধরা যে, অস্তিত্বের সংকটে মরিয়া মানুষ সীমান্ত মানে না। কঠিন কাজ হলো বিশ্বের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করা– গাঙ্গেয় অববাহিকার যে ১০ কোটি বাঙালি নিকটতম ভবিষ্যতেই ডুবতে বসেছে, তাদের হাতড়ে ধরা খড়কুটোয় জড়িয়ে তথাকথিত বহু বৈশ্বিক শক্তির মসনদই যে টলে যাবে না তার নিশ্চয়তা তাদের কে দিয়েছে? কঠিন কাজ হলো, এই সিদ্ধান্ত নেয়া যে কঠিন কাজগুলো কে করবে? নিউ ইয়র্কে 'রোহিঙ্গা' সমস্যাকে পাখির চোখ করে হাজির হওয়া প্রধানমন্ত্রী? ঢাকার মিডিয়াপাড়ায় ব্যস্ত সময় কাটানো সম্পাদকেরা? তথাকথিত রাজনৈতিক হতাশায় ডুবে থাকা সিভিল সোসাইটি? ভিসি বাঁচাতে বা নামাতে সংকল্পবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা? কিংবর্তব্যবিমূঢ় আপনি, আমি? নাকি, স্কুল ছেড়ে আসা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানো বাকেরগঞ্জের ওই সদ্য শৈশব পেরোনো কিশোরটি?