ভারতের লোকসভা নির্বাচন: মেরুকরণে সঙ্ঘ-বিজেপির নয়া কৌশল

গৌতম রায়
Published : 10 April 2019, 05:51 PM
Updated : 10 April 2019, 05:51 PM

ভারতের আসন্ন সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক ইস্যুগুলি সব থেকে বেশি গুরুত্ব পাবে? নাকি রাজনীতি ব্যতিরেকে বিভিন্ন ধরনের অ-রাজনৈতিক ইস্যুগুলি রাজনীতির মোড়কে পুড়ে সামনে উঠে আসবে?

এ প্রশ্নগুলো নিয়ে এখন রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। এই চাপানউতোরের প্রধান কারণ হলো, নরেন্দ্র মোদির শাসনকালের বিগত পাঁচ বছর রাজনৈতিক ইস্যুর থেকে বিভিন্ন ধরনের অ-রাজনৈতিক ইস্যুই, রাজনীতির একটা আবরণ নিয়ে আমাদের সামনে উঠে এসেছে। রাজনীতির বাইরের সেই সব ইস্যুকেই সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশ 'রাজনীতি' বলে ভুল করছেন। আসন্ন লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে সেইসব অ-রাজনৈতিক ইস্যুই প্রধান বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে এ মুহূর্তে দেশের শাসক বিজেপি সব থেকে বেশি তৎপর। বামপন্থীরা ব্যতীত অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বিজেপির এ ফাঁদে অনেকখানি পা দিয়েছেন।

রাজনীতি থেকে খোদ রাজনীতিকেই নির্বাসিত করবার তাগিদে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে  বিজেপির এই ফাঁদ তৈরি করেছিল। সেই ফাঁদকে আরো প্রসারিত করবার তাগিদেই গত ৫ বছর ধরে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি 'সাম্প্রদায়িকতা'র প্রসার ও প্রচারের লক্ষ্যে নানা ভাবে কাজ করে গিয়েছে। সেই লক্ষ্যেই তাদের চিরাচরিত উগ্র হিন্দুত্বকে এবারের নির্বাচনে সেভাবে সামনে তুলে না এনে 'দেশপ্রেমিক' এবং 'দেশপ্রেমে' এর  ইস্যুর মোড়কে উগ্র হিন্দুত্বের পালে হাওয়া জুগিয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি তাদের নিজস্ব কায়দায় রাজনৈতিক মেরুকরণ, সামাজিক মেরুকরণের কাজটি করতে শুরু করে দিয়েছে।

সাধারণ মানুষের কাছে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের বেশ কিছু আগে থেকেই বিজেপি এবং তাদের মূল চালিকাশক্তি আরএসএস, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ককে ঘিরে নানা ধরনের প্রচার চালাতে শুরু করে দিয়েছিল। সেই প্রচারের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান মুসলমানপ্রধান দেশ, তাই ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা পাকিস্তানপ্রেমী- এমন সরলীকৃত একটা তত্ত্ব হিন্দুত্ববাদীরা এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ আদাজল খেয়ে শুরু করে দিয়েছিল। সেই প্রচারেরই অঙ্গ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে দেশভাগের প্রায় সমসাময়িক কাল ধরেই সীমান্তজনিত যে সমস্যা রয়েছে, সেই সমস্যাকে একটা অন্য রকমের  দৃষ্টিকোণ দিয়ে তুলে ধরে ধরেছে হিন্দুত্ববাদীরা।

পাকিস্তান বিরোধিতার নামে এদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরোধিতার কাজটি বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের কর্মসূচির ভিতর দিয়ে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে করতে শুরু করে দিয়েছিল।

পাকিস্তান বিরোধিতার সঙ্গে এই দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান বিরোধিতার কাজটিকে একাত্ম করে তুলে ধরবার যে 'সামাজিক প্রযুক্তি' দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি চালিয়ে আসছে সেই প্রযুক্তিকেই আরো গভীরভাবে আমাদের সমাজ জীবনে গেঁথে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া গত পাঁচ বছর ধরে মোদি জামানাতে চলে এসেছে। এভাবেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে একটা সামাজিক বিভাজনকে তীব্র করে তুলতে তৎপর ছিল সঙ্ঘ এবং বিজেপি। এখন সেই বিভাজনের ফসলকে ভোট রাজনীতির অঙ্গনে টেনে তুলতে সব রকমের চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি।

যে কোনও নির্বাচন, তা কেন্দ্রেই হোক বা রাজ্যেই হোক, ক্ষমতাসীন দল তাদের বিগত সময়কালের সাফল্যকেই আগামী ভোটে জেতার অন্যতম প্রধান উপকরণ হিসেবে নির্বাচনী প্রচারে তুলে ধরে। এই প্রক্রিয়াযটি গত প্রায় ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে,  স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষে হয়ে আসছে।

মজার কথা হলো, আগামী লোকসভা নির্বাচনের জন্য বিজেপি কিন্তু প্রচারের প্রবাহমান এই পথ ধরে হাঁটছে না। তারা নিজেদের তথাকথিত সাফল্যের থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সামাজিক বিভাজন-কে আরো তীব্র করে তোলার বিষয়টিকে।

'রাজনৈতিক হিন্দুত্বে'র আবেগকে বড় করে তুলে ধরে এ ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে তারা। চাইছে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা অপেক্ষা দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে। সেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক কলা কৌশলটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সেই কলা কৌশলের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে তারা বিগত পাঁচ বছর ধরে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছে এক ধরনের 'শ্যভিনিজিম'- কে। এই দেশপ্রেমের  নামে উগ্রতার উপর ভিত্তি করেই বিজেপি চাইছে আগামী লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের নির্বাচনী সাফল্যকে ধরে রাখতে।

বাজপেয়ীর শাসনকালে যেমন পোখরানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিজেপি এক ধরনের দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার আমদানি ঘটিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সেই উগ্রতাকে তারা আরো নগ্নভাবে কাজে লাগিয়েছিল কারগিল সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে, তেমন পরিবেশ-পরিস্থিতিই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিও তৈরি করে ফেলেছে বিগত পাঁচ বছরে ।

পাকিস্তানের সঙ্গে নরম-গরম সম্পর্কের ভেতর দিয়ে সেদেশের শাসকদের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গীকে এ দেশের শাসক বিজেপি সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপিত করেছে পাকিস্তানের আমজনতার মানসিকতা হিসেবে। আর এই পাকিস্তানের আমজনতার মানসিকতার স্ব-আরোপিত ভাবনাকেই বিজেপি তুলে ধরেছে পাকিস্তানের ভারতবিদ্বেষ হিসেবে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান সমাজকে সেই বিদ্বেষের অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরে বিজেপি-আরএসএস এদেশের মুসলমান সম্প্রদায়কে পাকিস্তানের মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্ম করে দেখার একটা নোংরা খেলা চিরদিনই খেলে গিয়েছে। সেই খেলাটিকেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে একটা ভয়াবহ দিকে তারা নিয়ে যাচ্ছে।

দুই

পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের শাসন ক্ষমতাকে ধরে রাখবার তাগিদে অন্ধ ভারত বিদ্বেষের প্রচার করে থাকে। সেই ভারত-বিদ্বেষের অঙ্গ হিসেবে তাদের দেশের মাটিতে নানা ধরনের ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি প্রশিক্ষণকেও মদত দিয়ে থাকেন তারা। এই প্রক্রিয়ার পেছনে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের সার্বিক সমর্থন আছে– এটি মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই।

পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ শান্তি চান, তারা বন্ধুত্ব চান ভারতবর্ষের সঙ্গে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতবর্ষের সীমান্তজনিত সমস্যা আছে, কাশ্মীর নিয়ে যে সমস্যা আছে, সেই সমস্যারগুলোর রাজনৈতিক সমাধান কিন্তু পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিক চান। সেই সমস্যার সমাধানে আলাপ-আলোচনা, কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যতিরেকে যুদ্ধই একমাত্র সমাধান- এ কথা কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা মনে করেন না ।

মজার কথা হলো ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশেরই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শিবির এই সীমান্ত সমস্যার বিষয়টি, বিশেষ করে কাশ্মীর সমস্যার বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপিত করেন যাতে দুই দেশেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। সেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাটিকে তারা ব্যবহার করেন দুই দেশের পারষ্পরিক সংঘাতের পরিবেশ তৈরির জন্য। এই কাজে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলির অধিকাংশ যেমন তাদের দেশের নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, সে চেষ্টাই ভারতবর্ষের হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকরা বহুদিন ধরে করে আসছেন ভারতের ক্ষেত্রেও।

বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরের মেয়াদে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা বিশেষত সীমান্তজনিত সমস্যা ও কাশ্মীরজনিত সমস্যাকে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে একটি লড়াই হিসেবে তুলে ধরে মূল বিষয়টিকে ভুলিয়ে দেওয়ার কম চেষ্টা করেনি।

পাকিস্তানের রাজনীতিকদের একটি অংশের এই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে গোটা বিষয়টিকে এদেশের হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পর্যবসিত করে দেয়। সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার আশ্রয় এদেশের হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা নেয় এই কারণে যে, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরা যেহেতু জন্মসূত্রে মুসলমান, তাই তাদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সে-ই আঙ্গুলকে হিন্দুত্ববাদীরা সহজেই ঘুরিয়ে দিতে পারে এদেশের মুসলমান সমাজের দিকে।

নরেন্দ্র মোদির গত পাঁচ বছরের শাসনকালে নিবিড়ভাবে একই পথেই হেঁটেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির। সম্প্রতি কাশ্মীরের পুলওয়ামায়ল ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীর উপর যে দুর্ভাগ্যজনক, সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে সেই হামলার প্রেক্ষাপটকে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে যতোটা না পরিচালিত  করেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, তার থেকে অনেক বেশি পরিচালিত করেছে সে দেশের সাধারণ নাগরিক সমাজের প্রতি। এই নাগরিক সমাজের বেশির ভাগ অংশই জন্মসূত্রে মুসলমান। এভাবে পাকিস্তানের গোটা নাগরিক সমাজকে কার্যত সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে এদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের গায়ে কৌশলে সেই তকমাটি  লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ও তাদের হাজার রকমের সঙ্গী-সাথীরা ।

একদিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির সরাসরি এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথে হেঁটেছে । এই মেরুকরণের ভেতর দিয়ে তারা দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশ তাদের দেশপ্রেম আর সঙ্ঘ আরোপিত মুসলিম বিদ্বেষকে যাতে একাত্ম করতে পারে। আরএসএস বিজেপি সরাসরি এই পথে যেমন হেঁটেছে, তেমনি তাদের স্বাভাবিক মিত্রেরা প্রগতিশীলতার ভেক ধরে এমন ধরনের ভূমিকা পালন করে গেছে যাতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শিবিরই কিন্তু শক্তিশালী হয়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থান নিয়ে চলেছেন যাতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি পশ্চিমবঙ্গে নিজের পায়ের তলায় জমি খুঁজে নিতে পারে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পায়ের নিচে জমি করে দেওয়ার ভেতর দিয়ে মমতা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার যে রাজনীতি কায়েম করেছেন, সেই রাজনীতির উপর ভিত্তি করেই তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজের ভোট ব্যাংক হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। এভাবেই তিনি তার নিজের ভোট রাজনীতির সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিকেই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করে তুলছেন। এ পথে হাঁটতে গিয়ে মমতা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নিজেকে এক ধরনের মেকি সংখ্যালঘু প্রেমী হিসেবে তুলে ধরেছেন। সংখ্যালঘু আবেগ, সংখ্যালঘুর অধিকার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে গুলিয়ে দিয়ে সংখ্যালঘুর মধ্যে এক ধরনের ভাবাবেগ তৈরি করে, সেই ভাবাবেগকে সম্বল করে মমতা তার রাজনৈতিক সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান ।

বিগত ২০১১ সালে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে মমতা এই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার রাস্তা খুলে দিয়ে প্রকারান্তে হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের শক্তিশালী করে গিয়েছেন। পুলওয়ামার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে তার পাল্টা হিসেবে বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনা-র অভিযানকে নিয়ে মমতা যে ধরনের অবস্থান প্রকাশ্যে নিয়েছেন, সেই অবস্থানকে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের নিজেদের দিকে ঝোল টেনে প্রচার করতে বিন্দুমাত্র সময় নেয়নি। বিজেপি বা তার মূল চালিকা শক্তি আরএসএস বা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশনীতি ঘিরে মমতার যদি কোনও আপত্তি থাকতো, তাহলে সেই আপত্তি তিনি কেন এতোকাল জানাননি? কেন বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী হিসেবে থাকাকালীন সেই সরকারের বিদেশ নীতি সম্পর্কে একটি শব্দ মমতা উচ্চারণ করেননি ?

পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাজপেয়ী সরকার দুই দেশের মধ্যে যেভাবে উত্তেজনার পারদ-কে চড়িয়ে দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বাজপেয়ী সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। বাজপেয়ীর আমলে এই পারমাণবিক বিস্ফোরণের মূল কারণ কিন্তু ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার পারদ টিকে একটা বল্গাহীন জায়গায় নিয়ে যাওয়া। বাজপেয়ীর সেই তথাকথিত কূটনৈতিক সাফল্যের বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই কারগিল সমস্যাকে ঘিরে ঘটনাবলীর ভেতর দিয়ে। বস্তুত তের মাসের বাজপেয়ী সরকার যখন আস্থা ভোটে সংসদে পরাজিত হয়, তখন সেই বাজপেয়ীকে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরিয়ে আনবার লক্ষ্যে কারগিলের বিষয়বস্তু একটি  বিশেষ রকমের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির ভেতরেই এক ধরনের শ্রেণি সখ্যতা কাজ করে। উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিই অপর সাম্প্রদায়িক শক্তির পরিপূরক হিসেবে একটা বড়ো রকমের ভূমিকা সব সময় পালন করে থাকে।

ব্রিটিশরা ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অব্যবহিত আগে জামায়াতে ইসলামের তৎকালীন আমির মওদুদী 'জামায়াতে ইসলাম কি দাওয়াত' নামক এক পুস্তিকায় হিন্দু মুসলিম উভয় মৌলবাদী শক্তির এই শ্রেণি সখ্যতার কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কার্যত অনুরূপ স্বীকারোক্তি আমরা শুনতে পাই, আরএসএসের তাত্ত্বিক ভিত্তির অন্যতম প্রধান নির্মাতা এম এস গোলওয়ালকারের বিভিন্ন লেখালিখির ভিতর দিয়ে। এই শ্রেণিসখ্যতারই বহির্প্রকাশ আমরা দেখেছিলাম কারগিল সমস্যাকে তৈরি করে বাজপেয়ীকে পরবর্তী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে উভয় দেশেরই মৌলবাদী শক্তির ভেতরে অসম্ভব রকমের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে।

কারগিল সমস্যাকে ঘিরে এক ধরনের দেশপ্রেমের নামে উগ্রতা তৈরি করে, সেই উগ্রতাকে ভোটের বাক্সে চালান করে বাজপেয়ী সেই সময় আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। সেই একই পথে মোদির আমলেও পুলওয়ামা বা পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযানকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মজার কথা হলো, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিজেপির স্বাভাবিক মিত্রেরা এই ঘটনাক্রম সম্পর্কে এমনই অবস্থান প্রকাশ্যে নিচ্ছেন যার দ্বারা প্রকারান্তে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীরাই কিন্তু শক্তিশালী হচ্ছে ।

আজকে বালাকোটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অভিযানকে ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলে পশ্চিমবঙ্গে ভোট রাজনীতির ময়দানে সামাজিক ধর্মীয় মেরুকরণ করে দেশ প্রেমের নামে উগ্রতাকে একটা ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে  যেতে বিজেপিকে সব রকমভাবে সাহায্য করেছেন। মমতার বালাকোট অভিযানকে ঘিরে বক্তব্যকে ব্যবহার করে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার বল্গাহীন প্রকাশ ঘটিয়ে মেরুকরণের যে নগ্ন পথে বিজেপি এ রাজ্যে প্রবেশ করেছে, করছে, কিন্তু তারা আদৌ বাংলাতে করতে পারতেন না, যদি মমতা-র এই বিজেপির শ্যভিনিজিম নিয়ে গরম গরম কথা বলার ক্ষেত্রে কোনও রকম ধারাবাহিকতা থাকতো।

কারগিল সমস্যাকে ঘিরে উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর  ভিত্তি করে বাজপেয়ী  যখন নির্বাচনে গেলেন,  সেই নির্বাচনে বিজেপির জোটসঙ্গী ছিলেন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই আজ বালাকোটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মমতার যে দাবি তুলছেন, সেই দাবি ঘিরে মমতার বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে কোথায়? নরেন্দ্র মোদির জামানার গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের আত্মঘাতী বিদেশনীতির জেরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একদম তলানিতে ঠেকেছে।

সেই গোটা বিষয়টি নিয়ে গত পাঁচ বছরের মমতার নীরবতার প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, আজ ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে বালাকোট নিয়ে মমতার এই অবস্থান প্রকারান্তে বিজেপির কাছে তাদের সেই বিভাজনের রাজনীতি কেই আরও পরিষ্কার করে তুলে ধরবার পথটি অনেক পরিষ্কার করে দিয়েছে। মমতা যদি বিজেপি সরকারের বা বিজেপি দলের এই বিভাজনের রাজনীতি সম্পর্কে তার প্রতিবাদের কোনওরকম ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেন, তাহলে আজকে বালাকোটের ঘটনার পর গোটা বিষয়টি নিয়ে তার এই প্রশ্ন তোলার একটা বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে থাকতো। তেমন প্রেক্ষাপট থাকলে বিজেপির পক্ষেও মমতার এই অবস্থানকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে তাদের বিভাজনে রাজনীতিকে স্পষ্ট করে দেওয়ার সুযোগ এভাবে তারা পেতেন না ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবেই তাদের স্বাভাবিক মিত্র বিজেপিকে  সামাজিক বিভাজনের রেখাটি কে তীব্র করে তুলে ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে সুযোগ পাইয়ে দিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি তাই খুব সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে এই তত্ত্ব তুলে ধরছে যে- আগামী লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে 'দেশপ্রেম 'বনাম 'দেশদ্রোহিতা'র ভিত্তিতে ।

বিজেপির আসন্ন লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সবকটি বিষয় দগদগে ভাবে রয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, তথাকথিত রাম মন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইত্যাদি আরএসএসের যে একান্ত নিজস্ব কর্মসূচি, সেই কর্মসূচিগুলো রূপায়নের প্রতিশ্রুতি বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে ইতিমধ্যে দিয়েছে ।

পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এই বিষয়গুলোকে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে তারা সাধারণ মানুষের কাছে এ প্রশ্নটাই বেশি করে তুলছে যে, 'দেশটা কি আগামী দিনে পাকিস্তান হয়ে যাবে?'

এই প্রচারের ভেতর দিয়ে তারা অত্যন্ত সূক্ষ্ণভাবে মুসলিম বিদ্বেষের পরিবেশ পরিস্থিতিকে সাধারণ মানুষের কাছে বিকৃতভাবে তুলে দিচ্ছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চল, যে অঞ্চলে পূর্ববঙ্গ থেকে বা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজন, যারা ধর্ম সূত্রে মূলত হিন্দু, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় হিন্দু, তাদের কাছে এই মুসলিম বিদ্বেষ, মুসলিম জাতি সম্পর্কে বিকৃত ধারণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথাকথিত মুসলিম প্রেমকে ঘিরে তুলে ধরছে বিজেপি। এভাবেই এক ধরনের মারাত্মক সামাজিক বিভাজন রেখা তীব্র করে তুলছে বিজেপি।

উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চল গুলোতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই যে 'দেশটা কি আবার পাকিস্তান হয়ে যাওয়া'র এক ধরনের গোপন স্লোগান ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজেপি তার ফলে ভয়াবহ রকমের সামাজিক এবং ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটে চলেছে। দু:খের বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং তার স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসের এই মানুষে মানুষের সংঘাত লাগিয়ে দেওয়া আর মানুষে মানুষে বিভাজনকে তীব্র করে দেওয়ার নোংরা রাজনীতি, তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রশ্নের সামগ্রিকভাবে বাম-শিবির সেভাবে নিবিড় জনসংযোগভিত্তিক কোনও কর্মসূচি নিতে পারছে কিনা তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন উঠে আসছে ।

সাম্প্রদায়িক শিবিরের এই বিভাজনের রাজনীতির মোকাবিলা করতে বাম শিবিরের পক্ষে বিজেপির পথে হাঁটা কখনোই সম্ভব নয়। বিজেপি, তৃণমূল যে পরষ্পর সাম্প্রদায়িকতাকে ঘিরে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, যে প্রতিযোগিতায় একে অপরের পরিপূরক হয়ে, একে অপরকে সাহায্য করে চলেছে, সহযোগিতা করে চলেছে, সেই পথে হাঁটা বামপন্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচার কাজের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বামপন্থীদের একটা বড় রকমের সংকটের মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে।

এই সংকট মোকাবিলায় সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে যে ধারাবাহিক আন্দোলন দরকার ছিল সেই আন্দোলন কতখানি হয়েছে সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। বামপন্থীদের পক্ষে মমতার যে সাম্প্রদায়িক অবস্থান অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়ে হিজাব পরে মোনাজাতরত ভঙ্গিমায় ফটো শুট করা, আবার হিন্দু প্রধান অঞ্চলে গিয়ে বা হিন্দুদের বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে ইসকনের মন্দিরে বা অন্যত্র গিয়ে ঝাড়ু হাতে রাস্তা ছাড় দেওয়া- এগুলোর কোনটাই সম্ভবপর নয়।

মমতা এই যে একই সঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে হাজিবিবি সাজছেন, আবার গঙ্গাসাগরের কপিলমুনির আশ্রম এগিয়ে হনুমান গাড়ি আখড়ার প্রধান মহান্ত জ্ঞানদাসের পাশে দাঁড়িয়ে সেই ব্যক্তির মুখে নিজের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা উপভোগ করছেন, এই বিষয়টিকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে, মমতারই ধর্মের রাজনৈতিক কারবার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করবার যে নিবিড় জনসংযোগ মুখী কর্মপন্থা নেওয়া দরকার ছিল, তা কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে ধর্মকে নিয়ে মমতার এই নোংরা রাজনীতির কথা তুলে ধরবার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির লোকেরা কতখানি সফল বা কতখানি আন্তরিক ছিলেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বিজেপি এবং মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিভাজনের রাজনীতি দেখে সে প্রশ্ন বার বার উঠে আসছে।

মমতা মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য একমাত্র উপক্রম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ওয়াকফের টাকায় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতা। অপরপক্ষে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতাকে কেন্দ্র করে মমতার এই অবস্থানকে নিয়ে হিন্দু সমাজসহ খ্রিস্টান, জৈন- সমস্ত সম্প্রদায়েরই পুরোহিত শ্রেণীর ভেতরে একটা ক্ষোভের পরিবেশ তৈরি করে সেই ক্ষোভকে সেই ধর্মাবলম্বীদের সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করে মুসলিম বিদ্বেষের সামাজিক পরিবেশ রচনা করতে বিজেপি এতোটুকুই কসুর করেনি। কার্যত বলা যায়, মমতার এই অবস্থান বিজেপিকে তার মুসলিম বিদ্বেষের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করবার কাজটি করতে দেওয়ার এক ধরনের সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রের মোদি সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা  দেশের অর্থনীতির এই ভয়াবহ সংকট, বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে সীমাহীন ব্যর্থতা, ভয়াবহ বেকার সমস্যা, দুর্নীতিসহ নানা প্রশ্নকে ছাপিয়ে মমতার তৈরি করে দেওয়া দুটি ইস্যু, 'তথাকথিত মুসলিম তোষণ' এবং 'বালাকোটে বায়ু সেনাদের অভিযান', নিয়েই আবর্তিত বিজেপি।

বালাকোটে নেতা অভিযান ঘিরে মমতার এই ধারাবাহিকতাবিহীন অবস্থান কে বাংলার প্রেক্ষিতে এক রকম ভাবে বিজেপি নিজেদের ভোট রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। বাংলার বাইরে বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান বা গুজরাটসহ দেশের অন্যান্য অংশে আর এক রকমভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এই প্রশ্নে বামপন্থীদের কথার ধারাবাহিকতার জেরে বামপন্থীদের কোনো অবস্থাতেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে না বিজেপি। বিদেশ নীতির প্রশ্নে বামপন্থীদের চিরদিনই একটা দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। এই অবস্থান কংগ্রেসি জামানাতে যেমন ছিল, তেমনই থেকেছে বাজপেয়ীর আমলে। মোদির আমলেও বিদেশ নীতির প্রেক্ষিতে বামপন্থীরা তাদের অবস্থান বিন্দুমাত্র বদলাননি। তাই পাকিস্থানের মৌলবাদী অবস্থান, সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিদের মদত দেওয়া, তাদের ভারত বিরোধী কাজে প্ররোচিত করার প্রশ্নে সর্বদা সোচ্চার বামপন্থীদের গায়ে নতুন করে তথাকথিত ' দেশদ্রোহিতা' র তকমা দিয়ে বিজেপির পক্ষে ভোট বাজারে আলাদা করে কোনও মাইলেজ পাওয়া সম্ভব নয়।

পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ, যারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে- তাদের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে বামপন্থীদের নিয়ে আলাদা করে প্রচার করে বিজেপির কোনও যে ফায়দা হবে না- এটা হিন্দুত্ববাদী নেতারা খুব ভালো ভাবেই জানেন।

তাই তারা বেছে নিয়েছেন মমতাকে বা বলা যেতে পারে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে প্রচারের এই সুযোগ তুলে দিয়েছেন মমতা স্বয়ং। এভাবেই তিনি তার স্বাভাবিক মিত্র আরএসএস এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ভোট রাজনীতিতে হয়তো সুযোগ করে দিতে চাইছেন।

বালাকোটের ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান ঘিরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ব্যক্তি মমতার ভূমিকাকে তুলে ধরছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তারা তুলে ধরছে মমতাকে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের অন্যতম প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করে। কংগ্রেসসহ অন্যান্য  অবাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাত্ম করে তুলছে বিজেপি।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষদের একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েরা সেনাবাহিনীতে যায় দেশ রক্ষার্থে। তারা দুর্দমনীয় ভূমিকা পালন করেন দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে। বহু কষ্ট সহ্য করেন দেশের জন্য। পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে তাদের থাকতে হয়। প্রবল ঠাণ্ডায়, প্রতিকূল আবহাওয়াতে সতর্ক পাহাড়া দিতে হয় দেশের সীমান্তগুলি।

শত্রুপক্ষের হাতে অনেক সময়ই তাদের শহীদ হতে হয়। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই জীবন বিপণ্ন করে তারা নিজেদের পেশাজীবনকে তুলে ধরেন। তাই এই সেনাবাহিনীর বীর জওয়ানদের কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের ভেতরে যেমন একটা বড় রকমের আবেগ রয়েছে, তেমনি আবেগ রয়েছে তাদের একান্ত প্রিয় পরিবার-পরিজন এর ভিতরেও। এইসব বীর জওয়ানদের পরিবার-পরিজনের কাছে আরএসএস নিজেদের নানা ধরনের সঙ্গী-সাথীদের ভেতর দিয়ে এই বার্তাই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে যে, তোমার ঘরের যে ছেলেটা দেশ রক্ষার্থে শত্রু-শিবিরের সঙ্গে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে তার জীবন যৌবন দিচ্ছে, সেই সেনাবাহিনীর কৃতিত্বকে ঘিরে প্রশ্ন তুলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাহলে বোঝো,  তোমাদের ছেলেরা যে দেশের মর্যাদা রক্ষার্থে জীবনকে বাজি ধরে দিন কাটাচ্ছে, সেই ছেলেদেরই এই অপরিসীম আত্মত্যাগকে ব্যঙ্গ করছেন মমতা। উপেক্ষা করছেন মমতা।

পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেনাবাহিনীতে যোগদানকারী বীর জওয়ানদের পরিবার-পরিজনদের ভিতরে আরএসএস এর এই ভয়াবহ প্রচার একটা মারাত্মক জায়গায় চলে গিয়েছে। এই প্রচারের  ভেতর দিয়েই' দেশপ্রেমিক', 'দেশদ্রোহী' তত্ত্বকে সামনে তুলে আনছে অত্যন্ত সূক্ষ্ণভাবে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার কথাবার্তার ভেতর দিয়ে আরএসএস- বিজেপির হাতে এভাবেই তুরুপের তাস তুলে দিয়েছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে থেকেই তথাকথিত 'ফেডারেল ফ্রন্ট' নামক এক সোনার পাথরবাটি ঘিরে বহু শিবাকীর্তন গেয়েছেন, তাই বালাকোট ঘিরে মমতার বক্তব্যকে নানা ভাবে তুলে ধরে বিজেপি তাঁদের নিজেদের মেরুকরণের কাজটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করে চলেছে।

সবচেয়ে যন্ত্রণার বিষয় হলো এই যে, বামপন্থীরা ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলই বিজেপির  তৈরি করে দেওয়া এই ফাঁদে ধরা দিচ্ছে। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু, রাজনৈতিক ইস্যু, বৈদেশিক ইস্যু –  কোনও কিছুরই সেভাবে ধার-কাছ দিয়ে না হেঁটে প্রকারান্তে বিজেপির উগ্র অসাম্প্রদায়িকতার পাল্টা হিসেবে নরম সাম্প্রদায়িকতা,  বিজেপির উগ্র দেশপ্রেমের পাল্টা হিসেবে নরম দেশপ্রেম, এইসব বিষয়গুলোকেই রাজনৈতিক প্রচার অপেক্ষা ভোট প্রচারের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয়বস্তু করে তুলছেন।