Published : 12 Apr 2017, 10:44 PM
গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ বলেছিলেন, "পৃথিবীতে ভালোবাসার চেয়ে জটিল কিছু ছিল না।"
সেলুলয়েডের সুপারস্টাররাও এই জটিলতার বাইরে নন একদমই। সেলুলয়েডে যাদের জীবনের অধিকটা কেটে যায়, তাদের ব্যক্তিগত জীবনও ক্যামেরায় ঘুরেফিরে আসে নানাভাবে। চিত্রজগতের কেউ কেউ ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফিরিস্তি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন; কেউ কেউ হৃদয়ের ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন ক্যামেরার সামনে অথবা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে। যেমন অমিতাভ প্রসঙ্গে রেখা। ভিভ রিচার্ডসকে নিয়ে নীনা গুপ্তা। সন্তান মাসাবা গুপ্তা সাবলীলভাবে তাঁর ক্যারিবিয়ান বাবা ভিভ রিচার্ডস সম্পর্কে বলতে পারেন মিডিয়ার কাছে। নোরা জোনস পারেন তাঁর বাবার (পণ্ডিত রবিশংকর) সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতার কথা অকপটে বলতে। ব্র্যাড পিট আর অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বিচ্ছেদের আগেও যেমন ছিলেন, পরেও নিয়মিতই মিডিয়ার খবরে থাকছেন।
সম্পর্কের হালহকিকত নিয়ে মিডিয়ার নজর এড়াতে পারেননি লেখকরাও। আশি পেরুনো নোবেলজয়ী মারিও ভার্গেস ইয়োসা এখনও শিরোনাম হচ্ছেন তাঁর নতুন সম্পর্ক ঘিরে।
হলিউড সুপারস্টারদের মিডিয়া অনুসরণ করে সবখানে। ব্যতিক্রম নয় বলিউড। টিভির বিনোদন শো আর পত্রিকার মিডিয়া পাতা– স্টারদের নিয়ে আগ্রহ এখানে তুঙ্গে। আমাদের ঢালিউডের অধিকাংশ পত্রিকার মিডিয়া বিভাগ হলিউড-বলিউড সেলেব্রিটি খবর দিয়েই পাঠক ধরতে চায়। অর্থাৎ আমাদের স্টারডম এখনও আন্তর্জাতিক নয়। এখানে ঢালিউড নিয়ে মাপা-মাপা খবর।
এর মাঝে অপু বিশ্বাস আর শাকিব খানের বিয়ে ও সন্তান-চমক ঢালিউডের উপর উজ্জল স্পটলাইট ফেলতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের সিনেপাড়ার নায়ক-নায়িকারা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রেম-স্ক্যান্ডাল নিয়ে খোলামেলা আলাপে সাংবাদিক-ক্যামেরার মুখোমুখি হতে অভ্যস্ত নন। অভ্যস্ত নন ঢালিউডের দর্শকরাও। ফলে পক্ষ-বিপক্ষ-নিরপেক্ষ হতে গোল বাঁধিয়ে ফেসবুকে ভজঘট করে ফেলছেন পুরো ঘটনা।
সিনেজগত তুচ্ছজ্ঞান করে এ বিষয়ে কথা বলায় অনেকের নাকসিঁটকানো বিজ্ঞতা থাকলেও বস্তুত এদের জীবন থেকেও সামাজিক মনস্তত্ত্ব বোঝা সম্ভব। এই ঘটনার দুজনের একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ। নারীর অভিযোগ, দীর্ঘ ৮ বছরের বিবাহিত সম্পর্কের কথা পুরুষটি গোপন রেখেই চলেছেন। তাঁর আরও দাবি, নিজের ক্যারিয়ারের তোয়াক্কা না করে তিনি সংসার করেছেন, সন্তান ধারণ করেছেন, একা একা সন্তান জন্ম দিয়েছেন এবং এখনও সন্তান-পরিচর্যার অনেক বিষয় তাঁকে একাই সামলাতে হচ্ছে।
নারীটি দরিদ্র আর পুরুষটি ক্ষমতাবান হলে সমীকরণ সহজ হত। তিনি এক বাক্যে সকলের সহমর্মিতা পেতেন। কিন্তু এখনকার ঘটনাগুলোতে পুরুষের একেবার সমকক্ষ না হলেও নারীটিও অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিচয় নিয়ে আসেন। এতে অসুবিধা হচ্ছে, নারীকে যতটা অসহায় চেহারায় দেখতে আমরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করি তিনি ততটা অসহায়রূপে থাকেন না। এটি পুরুষতন্ত্রকে বিব্রত করে। ফলে নারীটির প্রতি সন্দেহের বহুমুখী তীর ছুটে আসতেই থাকে।
সমাজ নারীকে পাহাড়সম ধৈর্য নিয়ে সংসারে পুরুষটির মন জোগাতে শেখায়। স্বামীকে সংসারে ফেরাতে নারীকে সন্তান নিতে হয়। এভাবে স্বামীকে ফেরাতে ফেরাতে কেটে যায় নারীর জীবনের অনেকটা সময়। তারপর সমাজ থেকে মেলে সংসারী নারী হওয়ার হাততালি। অপু বিশ্বাসের উপস্থাপনে অতিরঞ্জিত অসহায়ত্ব নেই– অশ্রু থাকলেও অনুনয় নেই। তাই নারীকে ধৈর্যশীল হতে শেখানো ব্রিবত পুরুষতান্ত্রিক সমাজই প্রশ্নটা করে, কেন তিনি ৮ বছর চুপ করে ছিলেন! কেউ কেউ বলছেন, যা হয়েছে দুজনের যুগ্ম সিদ্ধান্তেই হয়েছে, তাহলে এ নাটক কেন?
দাসপ্রথার যুগে দাসত্ব সামাজিকভাবে ও আইনত অনুমোদিতই ছিল। দীর্ঘ সময় লাগলেও দাসপ্রথার সেই সমঝোতা বিলুপ্ত হয়। কোনো এক পক্ষ দীর্ঘকাল দমিত থাকলে যত সমঝোতা চুক্তিই থাকুক না কেন, একসময় না একসময় দ্রোহ ঘটবেই। মানুষ মূলত তার সম্পর্কের অস্তিত্ব বড় পরিসরে প্রকাশ করতে চায়। সম্পর্কের লুকোচুরি স্বল্প সময়ের জন্য যতটা অ্যাডভেঞ্চারাস, দীর্ঘ সময়ের ক্ষেত্রে ততটাই মানসিক চাপের কারণ। ফলে এর প্রকাশ স্বাভাবিকের বদলে 'বোমা ফাটানোর' মতোই হবে। যেমনটা ঘটেছে অপু বিশ্বাসের ক্ষেত্রে।
দুজনের মধ্যে যত সমঝোতাই থাকুক, সম্পর্কের গোপনীয়তা নিয়ে, আপন অস্তিত্ব সংকটের মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনেই অপু গোপনীয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবেন। সন্তান ধারণ ও পরিচর্যার যাবতীয় কাজ 'সিঙ্গেল মাদার' হিসেবে সম্ভব হলেও 'হিডেন মাদার' হিসেবে দুঃসহ। অপু বলেছেনও, তাঁকে বাচ্চার টিকার জন্য যেতে হচ্ছে, বাচ্চার জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে, ফোনে কথা বলার সময় বাচ্চা কাঁদলে লুকিয়ে ফেলতে হচ্ছে যেন তার মাতৃপরিচয় কেউ জেনে না যায়।
যারা (শাকিব খানসহ) অপু বিশ্বাস কী চান তা বুঝতে অপারগ, তারা মানুষের আত্মস্বীকৃতির মনস্তস্ত্ব বুঝতে অপারগ। 'মাদারহুড ক্রাইসিস' বলে একটি টার্ম রয়েছে। নারী যখন বাড়তি ওজন বহন করতে শুরু করেন তখন মাতৃত্বের আনন্দের পাশাপাশি শারীরিক পরিবর্তন তাকে অবসাদগ্রস্ত করতে পারে। প্রসবের পর নারীর জীবন অনেকখানি সন্তানকেন্দ্রিক হয়ে যায়। তাকে নিজের ক্যারিয়ারে ও ব্যক্তিগত সময়ে ছাড় দিতে হয়। পাশাপাশি দেখতে হয় নিজের বেঢপ অবয়ব। এসবও নারীকে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত করতে পারে ক্রমাগত।
অপু বিশ্বাস যেহেতু সিনেজগতের একজন, তাঁর পক্ষে এই শারীরিক পরিবর্তন থেকে মানসিক চাপ বোধ করাটা খুবই স্বাভাবিক। তদুপরি পুরো ব্যাপারটিতে গোপনীয়তার চাপ তো রয়েছেই। এই মানসিক চাপ থেকে বেরিয়ে আত্মস্বীকৃতির জন্য অপু বিশ্বাসের মনোজগত তাঁকে ক্রমাগত সামনে নিয়ে আসতে চাইবে। আর তাই ৮ বছরের গোপনীয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারায় তাঁকে অভিনন্দন।
এবার আসা যাক শাকিব খানের প্রতিক্রিয়ায়। তিনি শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে আপত্তিকর, পশ্চাৎমুখী ও পুরুষতান্ত্রিক 'পাওয়ার প্লে'এর উদাহরণ দেখিয়েছেন। তিনি অপুকে দেখে নেওয়ার হম্বিতম্বি করেছেন, সাংবাদিক সম্মেলনের হাঁকডাক দিয়েছেন এবং অপু সম্পর্কে নানা কটূক্তি করে যাচ্ছেন। নিজেকে বারবার সুপারস্টার হিসেবে পরিচয় দেওয়া শাকিবের আচরণ স্টারসুলভ তো নয়ই, ভদ্রতাবোধেরও অভাব পরিলক্ষিত। তিনি অপু বিশ্বাসকে এমনকি যদি আর স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ না-ও করতে চান, তথাপি তাঁর মনে রাখতে হবে যে, তিনি একজন ব্যক্তি এবং সিনেজগতের স্টারও। একজন সহকর্মী সম্পর্কে শাকিব খানের কাছ থেকে শালীন ভাষায় মন্তব্য কাম্য। বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে তিনি অপু বিশ্বাসের মুটিয়ে যাওয়া নিয়ে যেভাবে বলছেন তা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়।
ভারতীয় অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনও তাঁর ছিপছিপে গড়ন হারিয়ে বেজায় মুটিয়ে গিয়েছিলেন সন্তান ধারণের আগে ও প্রসবের পরে। কেউ কেউ এটা নিয়ে বিদ্রূপ করতেই তাঁর পরিবার তো বটেই, বলিউডের বড় বড় সেলেব্রিটিরা তাঁর মাতৃত্বকালীন মুটিয়ে যাওয়া নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে উৎসাহ দিয়ে গেছেন ঐশ্বরিয়াকে। তিনি একজন সিনেব্যক্তিত্ব। তাঁর মাতৃত্বের পরিচয় যেমন তাঁর জন্য গর্বের, তেমনি আত্মপরিচয়ও জরুরি। তাই তিনি দ্রুতই ফিরে আসলেন সিনেমায়, মেদ ঝরিয়ে।
এককালের 'জিরো ফিগার' কারিনা কাপুর আরও এগিয়ে। তিনি সন্তান ধারণকালীন সময়ে মুটিয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে ক্রমাগত ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েছেন, র্যাম্পে হেঁটেছেন এবং সন্তান জন্মদানের পর দ্রুত কাজে ফেরায় প্রাধান্য দিচ্ছেন। ভারতীয় নায়িকাদের মধ্যে অনেকেরই মাতৃত্বকালীন মুটিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং তাঁরা প্রত্যেকেই এই যাত্রায় মানসিক সমর্থন ও ইতিবাচক উৎসাহ পেয়েছেন তাদের পরিবার ও সহকর্মীদের কাছ থেকে।
শাকিব এমন মন্তব্যও করছেন যে, অপু বিশ্বাস সুন্দর করে কথা বলতে পারেন না। অথচ অপু কথায় ধীরস্থির ছিলেন বরাবর। আর শাকিব ছিলেন উচ্চকণ্ঠ এবং প্রশ্নোত্তরে অসংলগ্ন। তিনি একটি টিভি চ্যানেলে একটু ঘুরিয়ে এমনটা বলেছেন যে, বিয়ের কথা প্রকাশ পেলে তাদের সিনেক্যারিয়ারে ভালো হবে না– দর্শক তাদের গ্রহণ করবে না, ইত্যাদি। অথচ হলিউড এবং বলিউডে গণ্ডায় গণ্ডায় বিবাহিত নায়ক-নায়িকা বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। এখনকার সময়ে শাকিব খানের এই ধ্যানধারণা হতাশাব্যঞ্জক। আজকের যুগের নায়ক-নায়িকাদের এরকম ক্লিশে ট্যাবুমুক্ত থাকা জরুরি।
এককালে গোপন সম্পর্কে সন্তানের পিতৃপরিচয় স্বীকৃতি পেতে হাতেপায়ে ধর্ণা দিতে হত নারীকে। সমাজ এখনও তত আধুনিক না হলেও, বিজ্ঞান এগিয়েছে। সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ধারণে এখন একটা ডিএনএ টেস্টই যথেষ্ট। এই আজব সমাজে কেবল সন্তানের নয়, নারীরও পুরুষ স্বীকৃতি লাগে– অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে। ধারণা করা যায়, অপু বিশ্বাসের আর্থিক সীমাবদ্ধতা নেই। যেহেতু বিয়ে করেছেন, তাই সামাজিক সংকটও তুলনামূলক কম। তথাপি শাকিব পুরুষতান্ত্রিক ঔদ্ধত্যে কেবল পুত্রের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানান।
ইতোমধ্যে বহুবার তিনি সন্তানের জন্য দেওয়া ১২ লাখ টাকার হিসাব শুনিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর কাছে পিতৃত্বের অর্থ ১২ লাখ টাকা। অপু বারবার যে মর্যাদার কথা বলছেন, তাঁর পরিমাপ শাকিব খানের মতো সুপারস্টার লাখ লাখ টাকা দিয়ে কষছেন।
সন্তানের বয়স প্রায় ৬ মাস। এখন শাকিব বলছেন, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানকে একজন সুপারস্টারের সন্তানের মতো সামনে নিয়ে আসবেন। নিজের স্টারডমে বিভোর শাকিব বুঝতে অপারগ যে, সুপারস্টারের সন্তানের মতো নয়, জন্মের পরপরই একজন বাবা হিসেবে নিজ সন্তানকে সকলের সামনে আনতে পারা দারুণেএকটি বিষয়।
শাকিব ও অপু দুজনেই আধুনিক প্রজন্মের। তদুপরি চলচ্চিত্রে কাজ করেন বলে তাঁরা অনেক আচারে সংকীর্ণতা-বিবর্জিত হবেন এমনটা আশা করা যায়। দুজনের ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন। কিন্তু এই ভিন্নতা যদি মন দেওয়া-নেওয়ার পথে বাধা না হয় তাহলে বিয়েতে কেন?
সাধারণত বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলে অন্যজনকেই ধর্মান্তরিত হতে হয়। পাকিস্তানে ইমরান খানও স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছিলেন। বিয়েতে ধর্মান্তর ও পরে সন্তান উৎপাদন বিশ্বে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধিতে এভাবে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু ধর্ম যেহেতু যার যার ব্যক্তিগত অধিকার, তাই বিয়ের কারণে ধর্মান্তরিত হওয়া গ্রহণযোগ্য চর্চা হতে পারে না। বলিউডে দুই ধর্মের দুজন ব্যক্তির নিজ নিজ ধর্মপরিচয়ে সংসার করার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আমাদের দেশেও মিডিয়া জগতে এমন দৃষ্টান্ত খুব একটা বিরল নয়। যেখানে বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহ আইন রয়েছে নিজ নিজ ধর্মপরিচয়ে বিবাহ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য, সেখানে সুপারস্টার শাকিব খানের স্ত্রী হতে অপু বিশ্বাসকে অপু ইসলাম খান হতে হবে কেন? বিয়ের কারণে ধর্মান্তরিত হওয়ার এই রীতি আইনত বাতিল করা হোক।
অপু বিশ্বাস স্ত্রী ও মা পরিচয়ের পাশাপাশি নিজের কর্মেও পুনরায় পরিচিত হয়ে নারীর জন্য দৃষ্টান্ত রাখুন। শাকিব-অপু দ্বন্দ্বের একটি সুন্দর সমাধান হোক। তাদের সন্তান দুজনকে বাবা-মা হিসেবে একত্রে কাছে পাক, এই শুভকামনা তাদের জন্য।