নিজেদের বেতন-ভাতা নিজেরাই বাড়িয়ে নিলেন

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 30 Jan 2016, 04:10 PM
Updated : 30 Jan 2016, 04:10 PM

দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁরা তাদের বেতন-ভাতা বাড়ছে। ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের বেতন-ভাতা বাড়াতে পৃথক তিনটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। বিলে তাদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলগুলো আইনে পরিণত হলে তা ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।

এর আগে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সাংসদদের বেতন-ভাতা বাড়াতে জাতীয় সংসদে পৃথক দুটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। বিল দুটি আইনে পরিণত হলে তাদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ হবে। বিলে রাষ্ট্রপতির বেতন ৬১ হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ ২০ হাজার টাকা এবং বিমান ভ্রমণের জন্য বিমা কভারেজ ১৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বেতন ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, মাসিক বাড়ি ভাড়া ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা, দৈনিক ভাতা ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা, বিমান ভ্রমণের জন্য বিমা কভারেজ ১৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা এবং স্বেচ্ছাধীন তহবিল ১ কোটি থেকে বাড়িয়ে দেড় কোটি টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

মন্ত্রীদের বেতন ৫৩ হাজার ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা; প্রতিমন্ত্রীদের বেতন ৪৭ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯২ হাজার টাকা এবং উপমন্ত্রীদের বেতন ৪৫ হাজার ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা হচ্ছে। মন্ত্রীদের নিয়ামক ভাতা ৬ হাজার টাকা থেকে হবে ১০ হাজার টাকা; প্রতিমন্ত্রীদের বেলায় এটি ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা এবং উপমন্ত্রীদের জন্য ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, একজন মন্ত্রী বাড়ি ভাড়া পাবেন ৮০ হাজার টাকা এবং প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পাবেন ৭০ হাজার টাকা করে। এছাড়া মন্ত্রীর স্বেচ্ছাধীন তহবিল ৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে হচ্ছে ১০ লাখ টাকা; প্রতিমন্ত্রীর তহবিল ৩ লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং উপমন্ত্রীর তহবিল ৩ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা। মন্ত্রিসভার সব সদস্যের বিমান ভ্রমণের বীমা কভারেজের টাকা ৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রীদের দৈনিক ভাতা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা এবং প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর দৈনিক ভাতা ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এর আগে ২১ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন বাড়ানো হয়েছিল।

দেশের মানুষের গড় আয় বাড়ছে। আয়-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বাড়বে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তারপরও রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-স্পিকার-মন্ত্রী-এমপিদের বেতন-ভাতা যখন বাড়ে, একলাফে দ্বিগুণ হয়, তাঁরা নিজেরাই যখন নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নেন, তখন কেমন যেন ভব্যতায় বাধে!

আমাদের দেশে রাজনীতিকে এখনও বেশিরভাগ মানুষ 'সেবামূলক কাজ' বলে মনে করে। তারা নিজের প্রয়োজন ও স্বার্থ তুচ্ছ করে সব সময় জনস্বার্থ বড় করে দেখবেন, এটাই সাধারণের আকাঙ্ক্ষা। এখন এই নেতা-নেত্রীরা যদি সুযোগমতো নিজেরাই নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নেন, তাহলে তা জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য প্রমুখের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে কারও তেমন আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে তা প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ানো কতটা যৌক্তিক, সেটি ভেবে দেখা দরকার। এছাড়া তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেড়ে একত্রে ব্যক্তিপর্যায়ে কত টাকায় দাঁড়াল, তা জনগণকে জানানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। যেহেতু তারা জনপ্রতিনিধি, সেহেতু তারা আলাদাভাবে বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাবদ একত্রে কত টাকা পান, তা জানার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে।

মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবটি সাধারণ মানুষকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কেননা দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে পারেন না। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের বর্তমানে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ কোনো সরকারের হর্তাকর্তারা এক ধাপে নিজেদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করে নিতে পারেন না। এটা দৃষ্টিকটু তো বটেই, এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতাও বটে।

এমপিরা বর্তমানে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা পান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যারাই মন্ত্রী-এমপি হন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে শুধু সচ্ছলই নন, বিত্তশালীও বটে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কিছু দিন আগে বলেছিলেন, দেশের রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হন, তাদের কমবেশি ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী। এরা সবাই ধনী। অনেকের ধন-সম্পদ অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। তাদের অনেকেই নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেবা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মূল্যস্ফীতি তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তাদের শুধু ব্যক্তি-অর্থই নয়, সঙ্গে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাকারী অনেক প্রভাবশালী-বিত্তশালী লোকও রয়েছেন।

বিপরীতে, সরকারি হিসাবে দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ এখনও দরিদ্র। এর মধ্যে চরম দরিদ্র্র ১১ শতাংশ। সেই হিসাবে বর্তমানে সাড়ে ৭৪ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন।

সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, তাদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করে, এমনকি বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের ব্যবস্থা না করে তাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা বহুগুণ বর্ধিত করার জন্য আইন প্রয়োগ করবেন, কড়ায় গণ্ডায় সব বুঝে নেবেন– এটা কি মানবিক ও দায়বদ্ধ নেতৃত্বের কাজ হতে পারে? এটা কি সঠিক জনপ্রতিনিধিত্ব?

জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা অবশ্যই বাড়ানো উচিত। কিন্তু কতটা বাড়ানো হবে, সেটা নির্ধারণের জন্য যথোচিত সমীক্ষা দরকার ছিল। কাজটি করতে পারত কেবল একটি স্বাধীন পে-কমিশন। একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা তা গায়ে মাখেননি। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে তারা নিজেদের বেতন নিজেরাই ঠিক করেছেন। সরকার নিদেনপক্ষে ফরাসউদ্দিন কমিশনকে এ দায়িত্ব দিতে পারত। তাও করা হল না।

নিরপেক্ষ কমিশনের সুপারিশ আর যে কারণে দরকার তা হল, মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি-সম্পর্কিত বিল জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হলে তা নিয়ে বিতর্ক হয় না। এটা অতীতেও হয়নি, এবারও হবে না। কারণ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিল পাসে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত থাকে না। তারা এখানে একাট্টা হয়ে যান।

কোন নীতি মেনে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে, এর ব্যাখ্যা নেই। বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুয়েকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। বেতন কম হলে অন্য ক্যারিয়ার ছেড়ে কেউ সংসদে না-ও আসতে পারেন। আবার বেতন বেশি হলেও বিপত্তি। তখন শুধু টাকার লোভেই সবাই সংসদ সদস্য হতে চাইবেন বলে আশঙ্কা থাকছে।

তবে সরকার মন্ত্রী-এমপিদের বেতন ঠিক করতে নিরপেক্ষ কমিশন তৈরি করলেই ভালো করতেন। ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের বেতন স্বাধীন সংস্থাই ঠিক করে। ব্রিটেন ছাড়া ভুটান ও নামিবিয়াতেও একই প্রথা চালু রয়েছে। ভারতও সম্প্রতি কমিশনের মাধ্যমে সদস্যদের বেতন নির্ধারণের প্রক্রিয়া চালু করেছে।

মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বৃদ্ধির এই খবরের সার্বিক প্রভাব ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না। তাতে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন বৃদ্ধির পর বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। অথচ দেশে সরকারি কর্মচারির সংখ্যা প্রকৃত অর্থে ১ শতাংশেরও কম। আর পরিবর্তনীয় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের বেতন বৃদ্ধি করেই সরকার মনে করে তার দায়িত্ব খালাস। তাই প্রজ্ঞাপূর্ণ পদক্ষেপ হল আসলে বেতন বৃদ্ধির পরিবর্তে সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা এবং তাতে প্রয়োজনে ভর্তুকি দেওয়া।

গাজীপুরের এক কৃষক জানিয়েছেন, ফুলকপি আর টমেটো আবাদ করে তার এখন পথে বসার যোগাড়। তিনি ফুলকপি বিক্রি করছেন ৮ থেকে ১০ টাকায়। আর টমেটো ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে। অথচ প্রতিটি ফুলকপি উৎপাদন করতে তার উৎপাদন খরচ ছিল ১৫ টাকা এবং এক কেজি টমেটোর জন্য ছিল প্রায় ২৫ টাকা। এ রকম উদাহরণ শুধু এক টমেটো বা ফুলকপির ক্ষেত্রে নয়। আর তা শুধু গাজীপুরের চিত্রও নয়, গোটা দেশেরই।

কাজেই সরকারের উচিত হবে শুধু প্রথাগত কায়দায় বেতনবৃদ্ধি নয়, বরং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে দ্রব্যমূল্যের তেজ কমানো। তাতে ১ শতাংশ সরকারি কর্মচারির পরিবর্তে দেশের ১৬ কোটি মানুষই উপকৃত হবেন।

নিজেদের বেতন তো আপনারা নিজেরাই বাড়িয়ে নিচ্ছেন, দেশবাসীর জন্য এমন একটা কিছু অন্তত করুন।