ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, ‘আপস নয়, সংগ্রাম’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বর্তমান বাংলাদেশেই আমাদের সহযাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। আর প্রতি বছর আমাদের মতো ক্যান্সার লড়াকুদের কাতারে যোগ হচ্ছে প্রায় দু’লাখ। আর যারা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন, তাদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।

শরীফ আহমেদ
Published : 24 Feb 2024, 07:15 PM
Updated : 24 Feb 2024, 07:15 PM

কর্কট রোগ তথা নীরব ঘাতক ক্যান্সারকে এখন আর আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মরণব্যাধি বলে মনে হয় না। তবে ক্যান্সার শব্দটার ভয়াবহতাই মানুষকে জীবন্মৃত করে দেয়। যদিও এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আধুনিক বিজ্ঞান মহাকাশ-মহাসাগরের অতলে পাড়ি দিলেও মানুষের দেহকোষের বেশ কিছু অংশের কর্মযজ্ঞকে পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারেনি। তাই মানুষকে ক্যান্সার কোষের সঙ্গে আমৃত্যু যুদ্ধ করতে করতে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ প্রক্রিয়ায় টিকে থাকতে হয়, বেঁচে থাকতে হয়। সেই সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে খুব হিসেব কষে বাকিটা জীবন পথ চলতে হয়। কেননা, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ভাইরাসের মতো এই কোষটাও গোপনে নীরব ঘাতক হয়ে দেহে বসবাস করে। সময়-সুযোগ পেলে দেহের অ্যান্টিবডিকে পরাজিত করে এরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্যান্সারে প্রাণান্তকর চেষ্টা ও গবেষণা চালাচ্ছে, আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুমুখী যাত্রাটাকে দীর্ঘায়িত করার। কিংবা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরির।

যমদূতের মতো আসা ক্যান্সার কোষকে নিত্যসঙ্গী করে সুদীর্ঘ সংগ্রামী পথচলায় ছোট ও বড় ভাই-বোন, বন্ধু-স্বজন, প্রিয়জন, শুভাকাঙ্ক্ষী-শুভানুধ্যায়ীদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা আর ভালোবাসাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। যেমন, অনেকের মতো আমিও দিব্যি বেঁচে আছি মানুষের ভালোবাসায়।

দীর্ঘ চার বছর বেকার থাকার পর বড্ড অসময়ে এসে জানলাম, ক্যান্সারের সঙ্গে আমার নাকি দীর্ঘ দিনের বসবাস! আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয়নি। সেই সঙ্গে আরেকটা প্রশ্ন জাগল নিজের ভেতরে, হায় বিধাতা, জীবনে তো সে রকম কোনো পাপের কথা মনে পড়ে না। তাহলে কোন পাপে আমাকে এত বড় প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হবে? কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। দিন দিন দেহের শক্তি তলানির দিকে যেতে লাগল। কিন্তু মনের শক্তির জোরে আমি সব পরিস্থিতি সামলে নিই। মন খারাপের দিনে হেসে খেলে দুঃখগুলো উড়িয়ে দেই। সুখের স্মৃতিচারণ করি। যন্ত্রণাকর-কষ্টদায়ক পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে যাই। কেমোথেরাপির পরে আমার দাড়ি-গোঁফ আর এলোমেলো সুন্দর চুলগুলো আর থাকবে না। তাই কেমোথেরাপির আগেই কেটে ন্যাড়া করে ফেলেছি। যা থাকবার নয়, তার মায়া বাড়িয়ে কী লাভ?

এমনি করে অনেক কিছু থেকে নীরবে দূরে সরে এসেছি। আপাতত চেপেই যাচ্ছি, কোনো চাপ নিচ্ছি না। জীবনের জন্য চাকুরি, চাকুরির জন্য জীবন নয়। তাই আপাতত জীবনের জন্য আছি। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পর অন্ন-সংস্থানের নিমিত্তে চাকুরি বা একটা কর্মের সংস্থানের আপ্রাণ চেষ্টা করব। যা দিয়ে উন্নত না হলেও দুঃখ দিনের দুঃখি প্রেমিকা সুস্মিতাকে নিয়ে অন্তত সুখে-শান্তিতে বাকি জীবনটা পার করতে পারলেই খুশি।

সামনে যে জীবনটা পাব, সেটা একটা বাড়তি জীবন। সুতরাং জীবনের বাকি দিনগুলো গঠনমূলক কাজে লাগাতে হবে। তাই এই নিরর্থক জীবনটা অর্থপূর্ণ করার প্রয়াসে নতুন করে কিছু পরিকল্পনা করেছি—

# আমার চোখটা সন্ধানীকে দান করে যাব। যাতে আমার মৃত্যুর পর ওই চোখ দিয়ে আরেক জন এই পৃথিবীর আলো, রূপ-সৌন্দর্য দেখতে পারে। আর আমার দেহের কিছু অঙ্গও মরণোত্তর দান করে যাব।

# একটা হাসপাতাল করার খুব স্বপ্ন ছিল (যদি সামর্থ্য হয়)। একটা ক্যান্সার বিভাগ আর একটা চক্ষু বিভাগ করব। চিকিৎসার অভাবে আমার মায়ের একটা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। হাজার মায়ের চোখের আলো যেন ফিরিয়ে আনতে পারি সেটাই লক্ষ্য। মায়ের চোখটার দিকে তাকালেই রবি ঠাকুরের গানের লাইন মনে পড়ে, “চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে— একলা এসেছি আমি একলা যাবো চলে।”

জীবনের দুঃসময়টাই হয়তোবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। দিনকে দিন নিজেকে চিনছি, মানুষকে চেনার চেষ্টা করছি। দেখেছি দুর্দিনে খুব কাছের মানুষগুলোও খুব নীরবে এড়িয়ে যায়! টাকা আর দুঃসময় মানুষ চেনায়। অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, অনেক মাটির দেবতার সন্ধান পেয়েছি। কারও কাছে আর কোনো প্রত্যাশা নেই, থাকা উচিত নয়। যা পেয়েছি তার তুলনা হয় না, আর যা পাবো সবই উপরি পাওনা। আমি আসলে দিন দিন সর্বংসহা হতে চেষ্টা করছি। সবকিছু মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। আমি এখন জীবনের যে কোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত।

আসলে সময়ের কাছে মানুষ বড্ড অসহায়। লিও তলস্তয়ের মতো জিজ্ঞাসা জাগে, ‘মানুষ কী নিয়ে বাঁচে?’ সত্যিই তো মানুষ বাঁচে মানুষের ভালবাসায়। আবার জিজ্ঞাসা জাগে, ‘পৃথিবীতে কে কার?’ আবার মনে পড়ে, আমরা সবাই সবার। কেননা, মানুষ মানুষের জন্যে। জানি, গতিই জীবন, স্থিতিই মৃত্যু। তাই ছুটছি তো ছুটছিই। মনে পড়ে, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...।’ আসলে সব জীবন তো আর ছক কষা, ধরাবাঁধা নিয়ম অনুসারে চলতে পারে না। ধীরে ধীরে একটা জীবন চলেই যায়। আর ক’বছরই বা বাঁচব? দেখতে দেখতে তো ২৯ বছর চলে গেল। কতো কিছু বাকি, কতো কিছু অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত। রিক্ত জীবনে কেবলই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ, অর্থ-বিত্ত-চিত্তের ঋণ। মনে পড়ে, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শোধিতে হইবে ঋণ।’

আমি জীবনবাদী মানুষ। চারদিকে নৈরাজ্য আর নৈরাশ্যবাদের মাঝেও আমি অসম্ভব রকমের আশাবাদী মানুষ। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, যতক্ষণ আমার দোহকোষের ইন্দ্রিয়গুলো জীবিত থাকবে, ততক্ষণ আমি হাল ছাড়ব না। মরার আগে মরব না। আমার আছে কষ্টদায়ক জীবনটাকে সুন্দর রূপে দেখার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। আর 'জাস্ট লিভ ফর টুডে'-এর একটা দর্শন। আমি মনে করি, প্রতিটা রোগীর এমন কিছুটা দর্শন থাকা উচিত। চিত্তে সাহস ও মনোবল রাখার সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্মরণ রাখা উচিত, ক্যান্সার যখন একবার হয়েই গেছে, তখন এর সঙ্গে দীর্ঘকাল লড়াই করেই আপনাকে একসঙ্গে ঘর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের রয়েছে ষড়রিপু। আর আপনার ভেতরে বসত করা সপ্তম অশুভ রিপুর আরেক নাম ক্যান্সার। একে দমন করেই আপনাকে চলতে হবে। কখনোই এই সপ্তম রিপুর সঙ্গে ‘আপস নয়, সংগ্রাম, সংগ্রাম’।

আপনাকে চলতেই হবে। আমাদের বেঁচে থাকার-টিকে থাকার সংগ্রাম চলবেই। ক'দিন ধরে বিদ্রোহী কবির ক'টা লাইন কেমন যেন বারবার মনে পড়ছে, ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা/ করি শত্রুর সাথে গলাগলি ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।’ ভেলোরের এই দেয়ালবন্দি জীবন নিয়ে আমি মৃত্যুর সঙ্গে প্রহসনের হাসি হেসে যাই, বেঁচে থাকার তীব্র বাসনায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বর্তমান বাংলাদেশেই আমাদের সহযাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। আর প্রতি বছর আমাদের মতো ক্যান্সার লড়াকুদের কাতারে যোগ হচ্ছে প্রায় দু’লাখ। আর যারা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন, তাদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।

প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে এই সংগ্রামী পথচলায় আমরা একা নই। সুতরাং জীবনে যত ঝড়-তুফান, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি আসুক না কেন, আমাদের সংগ্রাম চলবেই। কবিগুরু বলেছেন, “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।" সুতরাং এখনও অনেক পথ বাকি, অনেক কাজ বাকি, অনেক ঋণ বাকি। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। সকল সহযোদ্ধার জন্য নিরন্তর শুভ কামনা ও ভালোবাসা।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)