Published : 03 Jun 2013, 01:22 PM
জর্জ ম্যালরি একবাক্যে দুর্ধর্ষ পর্বতারোহী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এভারেস্টজয়ের স্বপ্ন নিয়ে তার বক্তব্য ছিল, 'বিকজ ইটস দেয়ার'। ১৯২৪ সালের জুনে জর্জ ম্যালরি এবং অ্যানড্রিউ আরভিনের এভারেস্ট-উপাখ্যান এখনও গবেষণার বিষয় হয়ে রয়েছে।
এ দুজনের আগেও এভারেস্ট হাতছানি দিয়েছিল আরও অনেক অনুসন্ধিৎসুকে, তবে সেসব অভিযাত্রা অসফল ছিল। তাহলে কি ম্যালরি-আরভিন সফল ছিলেন? আসলে এ দুই চৌকশ পর্বতারোহী শেষ পর্যন্ত সামিট ছুঁয়ে ফিরে আসছিলেন নাকি হাল ছেড়ে ফিরতি পথ ধরেছিলেন অথবা সামিটে পৌঁছুনোর আগেই দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন তা বিশ্ববাসীর কাছে রহস্য হয়েই আছে।
৭৫ বছর পর, 'খোঁজ' অভিযানের সদস্যরা ১৯৯৯ সালে জর্জ ম্যালরির দেহ খুঁজে পান এভারেস্টের বুকে, সামিট থেকে ২০০০ ফুট নিচে। ১৯৩৩ সালে ওই স্থানের আরও নিচে আরভিনের কুঠার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে অনুসন্ধানী দল প্রথমে ভেবে নিয়েছিল যে এ শীতল-নিথর দেহটি আরভিনের, যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃতদেহের গায়ের কাপড়ে লাগানো ট্যাগে 'জি লেই ম্যালরি' লেখা পাওয়া গেল।
আরভিনের মৃতদেহ এখনও নিখোঁজ, সে সঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায়নি ম্যালরি-আরভিনের ক্যামেরাটিও। গবেষকরা বলছেন, ক্যামেরাটিই অমীমাংসিত রহস্যের জবাব দিতে সক্ষম। ম্যালরির কন্যা গবেষকদের জানিয়েছিলেন যে ম্যালরি তার স্ত্রীর ছবি সঙ্গে নেন জয়ের চিহ্ন হিসেবে সামিটে গেঁথে আসবেন বলে। ম্যালরির মৃতদেহ খুঁজে কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। ম্যালরি তার স্ত্রীর ছবি ভুলে ক্যাম্পে ফেলে গেছেন এমন কথা ম্যালরির অপর সহযাত্রী নোয়েল ওডেল কখনও জানাননি।
এ দুটি তথ্য থেকে অনেকেই ধারণা করেন, ম্যালরি সত্যিই শুভ্র সামিটে পৌঁছে সেখানে তার স্ত্রীর ছবি গেঁথে এসেছিলেন। গবেষকরা এখন আরভিনের মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গে কোডাক ক্যামেরাটিও খুঁজে পেতে আগ্রহী। পর্বতারোহী দুজন সামিট পৌঁছে বিজয়ের ছবি ধারণ করলে সে ছবিই হবে চূড়ান্ত প্রমাণ। কোডাক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পুরনো হলেও হয়তো ক্যামেরার ফিল্ম এখনও ডেভেলপ করা সম্ভব।
সহযাত্রী নোয়েল আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানিয়েছিলেন, দুপুর ১২:৫০ নাগাদ ম্যালরি-আরভিনকে সামিট লক্ষ্যের 'সেকেন্ড স্টেপ' আরোহণ করতে দেখেছিলেন যা ২৮৩০০ ফুট উচ্চতায়। এরপরই ছিল 'থার্ড স্টেপ' এবং অতঃপর আরাধ্য সামিট। চৌকশ ম্যালরি ও আরভিন পথটুকু ঠিকই পাড়ি দিয়েছিলেন বলে ধারণা করেন অনেক পর্বতারোহী।
ম্যালরির মৃতদেহের পোশাক হাতড়ে পকেটে পাওয়া গিয়েছিল গগলস। সময়ের হিসেব করলে সামিট পৌঁছে ফিরতি পথ ধরতে সূর্যাস্ত হওয়ার কথা। ম্যালরি এ সময় গগলস চোখে না পরে পকেটে রাখবেন এরকমটাই স্বাভাবিক মনে করছেন গবেষকরা।
যদি জানা যায় ম্যালরি-আরভিন সত্যিই সামিট আরোহণ করেছিলেন তাহলে কি স্যার এডমন্ড হিলারির প্রথম এভারেস্টবিজয়ী খেতাবটা হাতছাড়া হয়ে যাবে? এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগের আইন পরামর্শক বেশ দৃঢ়ভাবেই জানিয়েছিলেন, এমনকি ম্যালরি-আরভিনের সামিটে আরোহণের বিষয়টি প্রমাণিত হলেও হিলারি-তেনজিং রচিত ইতিহাস রদ করা অনুচিত হবে।
এন্ডমন্ড হিলারিও সর্বোচ্চ শৃঙ্গের প্রথম বিজয়ী হিসেবে নিজেকেই মানতেন। তিনি বড় আত্মবিশ্বাস নিয়েই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আপনি প্রথমবারের মতো শৃঙ্গের চূড়ায় পৌঁছুলেন কিন্তু অবতরণকালে মারা গেলেন, তবে কি তা একটি সম্পূর্ণ পর্বতারোহণ হল?'
এডমন্ড হিলারির মতে, এভারেস্টের পাদদেশে নেমে আসাটা ভীষণ জরুরি, কারণ এভারেস্ট-জয় হচ্ছে সামিট পর্যন্ত পৌঁছুনোর পর নিরাপদে পাদদেশে ফিরে আসা। ম্যালরি-আরভিন যে সময় পর্বতযাত্রা করেছিলেন, তখনকার তুলনায় বর্তমানে আরোহণ-অবরোহণ পদ্ধতি যথেষ্ট উন্নত। তবুও এভারেস্ট এখনও কষ্টসাধ্য। এখনও দুঃসাধ্য।
বৈরী এভারেস্টকে বাংলাদেশিরাও বাগে আনতে পারে, সে বিশ্বাসের সূচনা ঘটেছিল মুসা ইব্রাহিমের মাধ্যমে। আমাদের দেশের অধিকাংশই নিশ্চিত জানত না যে, এমন রোমহর্ষক-বিপদসঙ্কুল এভারেস্ট জয় করার জন্য অবিরত কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছেন একঝাঁক তরুণ। নিশাত মজুমদার আর ওয়াসফিয়া নাজরীন এভারেস্ট সামিটে কেবল নিজেদের পদচিহ্নই রেখে আসেননি, ছাপ রেখে এসেছিলেন নারীশক্তির।
এভারেস্ট-জয়ের বিষয়টি যখন আমরা প্রায় নিত্য করে তুলেছি, তখনই ডেথ জোনে প্রাণ হারালেন সজল খালেদ। আমরা এতদিন এভারেস্ট-জয়ের স্বাদ পেয়েছি। স্পৃহা খুঁজে নিয়েছি এভারেস্টের খাড়া ঢালে। আমাদের জন্য অনাকাঙ্খিত ছিল মৃত্যুর স্বাদ। সজল খালেদের মৃত্যুসংবাদে সকলেই তাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলেন, এ সংবাদ মিথ্যে হোক। কিন্তু তিনি আমাদের অপ্রস্তুত করেই এভারেস্টের ৮৭৫০ মিটার উঁচুতে শ্বেতশুভ্র শীতল প্রকৃতির কোলে নিজেকে সমর্পণ করলেন।
অতপর আমাদের কাছে এভারেস্ট পরিচিত হল 'ডেথ জোন' রূপে (৮০০০ মিটার বা ২৬০০০ ফুট উচ্চতার উপর 'ডেথ জোন' হিসেবে পরিচিত। এ অংশে অক্সিজেন-সংকট তীব্র)। আসলে এভারেস্ট কারও কাছে ধরা দিয়েছে, আবার কারও কাছে অধরা হয়ে রয়েছে। কোনো কোনো বছর তো এভারেস্ট প্রাণঘাতী রূপেই দেখা দিয়েছিল।
১৯২২ সালে ৭ জন, ১৯৭০ সালে ৮ জন, ১৯৭৪ সালে ৬ জন, ১৯৭৯ সালে ৬ জন, ১৯৮২ সালে ১১ জন, ১৯৮৪ সালে ৮ জন, ১৯৮৫ সালে ৭ জন, ১৯৮৮ সালে ১০ জন, ১৯৮৯ সালে ৮ জন, ১৯৯২ সালে ৫ জন, ১৯৯৩ সালে ৮ জন, ১৯৯৬ সালে ১৫ জন, ১৯৯৭ সালে ৯ জন, ২০০৬ সালে ১১ জন, ২০১২ সালে ১০ জন, ২০১৩ সালে ৮ জন এভারেস্টের বুকে শেষনিঃশ্বাস নিয়েছিলেন।
পর্বতারোহীদের এভারেস্টে প্রাণহানির তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে সজল খালেদের নাম। বিষয়টা হৃদয়বিদারক, এমন একটি তালিকায় এ প্রথম একজন বাংলাদেশির নাম যুক্ত হল।
এভারেস্ট এতটাই বিচিত্র যে, একে একদিকে জয় করেছেন অশীতিপর বৃদ্ধ, অন্যদিকে ২২ বছরের তরুণের যাত্রার চিরসমাপ্তি ঘটেছে এভারেস্টের মাঝপথে। মৃতদেহগুলোকে তুষারাচ্ছাদনে সমাধিস্থ করে রাখছে খোদ সাগরমাথা (নেপালে এভারেস্টকে 'সাগরমাথা' বলে ডাকা হয়) । যাদের খোঁজ মেলে, অভিযাত্রীদল শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে সেসব মৃতদেহ রেখে আসছেন এভারেস্টের কোলে।
২০১১ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাগরমাথায় খোঁজ-নিখোঁজ সমাহিতের সংখ্যা দুশোরও বেশি। এভারেস্টের শীতল আবহাওয়ার কারণে মৃতদেহগুলো সংরক্ষিত থাকছে বছরের পর বছর। এভারেস্টের বুকে শেষনিঃশ্বাস নেওয়ার আট বছর পর ন্যান্সিকে এভারেস্টের বুকেই সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমাধিস্থ করে একটি অভিযাত্রীদল। তারা ন্যান্সির সমাধিতে গেঁথে দিয়েছিল আমেরিকার পতাকা আর ন্যান্সির পরিবারের পক্ষ থেকে একটি চিরকুট।
নেপালিরা সাগরমাথাকে পবিত্র মানেন। সাগরমাথা সমাধিস্থল হয়ে উঠুক এমনটা তারা চান না। তবে মৃতদেহ পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত নামিয়ে আনা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়সাপেক্ষ। অপরদিকে পর্বতারোহীদের কেউ কেউ, কখনও কখনও মৃতের পরিবারও, হয়তোবা নিরুপায় হয়েই এমনটা মানেন যে, এভারেস্ট-বুকে সমাধিস্থ থাকা মৃতের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান।
বাংলাদেশ সরকার সজল খালেদের মৃতদেহ এভারেস্ট থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যয়ভার বহনে সাড়া দিয়েছিল এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল ইতোমধ্যে। সজল খালেদের নাম এভারেস্টজয়ীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে না হয়তো, তবে তার মৃতদেহ এভারেস্টের পাদদেশে পৌঁছুবে এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন অনেকে। ইতোমধ্যে তার ব্যবহার্যসামগ্রী নামিয়ে আনা হয়েছে। কেবল সজল খালেদ সাগরমাথাকে আলিঙ্গন করে রয়ে আছেন এখনও।
এভারেস্টপৃষ্ঠে সজল খালেদের অসময় দেহান্ত সংবাদের পর আবেগঘনচিত্তে অনেকেই ভেবেছেন, এরপর আর কেউ হয়তো এভারেস্টের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে আগ্রহী হবেন না। অথচ এভারেস্টের বৈরীতাকে বারবারই প্রত্যাখ্যান করেছেন পর্বতারোহীরা। এভারেস্ট প্রাণঘাতী হয়ে উঠলেও পর্বতারোহীদের দমাতে পারেনি আজ পর্যন্ত।
বাংলাদেশি পর্বতারোহীরাও পিছপা হবেন না। কারণ আমরা অদম্য প্রাণের তারুণ্যে ভরপুর। আমরা নেভার-রেস্ট তারুণ্য, এ কথা পিচ্ছিল-খাড়া বরফের চাঁইয়ে লেখা হয়ে গেছে। হতে পারে সে লেখা আবার ঢাকা পড়ে গেছে তুষারে। তারপর ঠিক ওখানটাতেই পা পড়তে যাচ্ছে আরেক আত্মবিশ্বাসী-দক্ষ-অভিজ্ঞ বাংলাদেশি পর্বতারোহীর। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, সে তরুণ যেন সামিট ছুঁয়ে নিরাপদে পাদদেশে ফিরে আসতে পারেন।
যদি শেষপর্যন্ত সজল খালেদকে পাদদেশে নামিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তবে আগামীর সে এভারেস্টজয়ী বাংলাদেশি তরুণ অথবা তরুণীটি যেন সজল খালেদের নিশ্চল দেহটির কাছে গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা হাতে জানিয়ে আসেন- আমরা 'পর্বতের নেশায় অদম্য প্রাণ' আছি এখনও।
আইরিন সুলতানা: ব্লগার।