বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিকদের প্রগাঢ় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে তাঁদের স্মৃতিকথায়। সেই সব স্মৃতির উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
Published : 15 Aug 2023, 04:43 PM
“বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতাও করেছেন। শুরু থেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’ নামে একটি কাগজ বের করে। এই কাগজের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশিম এবং সম্পাদক ছিলেন কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে বিখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ কৃষক প্রজা পার্টি ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখন হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের উদ্যোগে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ বের হয় কলকাতা থেকে। ১৯৯ পার্ক স্ট্রিটে ছিলো ইত্তেহাদ অফিস। আবুল মনসুর আহমদ হন সম্পাদক। আবুল মনসুর আহমদের দৃষ্টি ছিলো প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের দিকে। তিনি তাদের সাংবাদিকতার দিকে টানতে চেয়েছেন। তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার দিকে। মানিক মিয়া চাকরি নিয়েছিলেন ইত্তেহাদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইত্তেহাদে দু-চার কলম লিখতেন। তিনি তাঁকে সাংবাদিক হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। শেখ মুজিবকেও উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন, মনসুর ভাই, মিল্লাতের মতো ইত্তেহাদেও আমি লিখব। কিন্তু সাংবাদিক হবো না। সাংবাদিকতা আমার নেশা। কিন্তু পেশা রাজনীতি। আমি রাজনীতিক হবো।” আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা থেকে এমনটাই জানা যায়।
তিনি শুধু রাজনীতিক হননি বিশ্ব মানচিত্রে তর্জনী তুলির আঁচড়ে একেঁছেন নতুন এক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সময় তাঁকে পরিণত করেছে বাঙালি জাতির পিতায়। তবুও জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের সঙ্গে হার্দিক সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছিন্ন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিকদের প্রগাঢ় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে তাঁদের স্মৃতিকথায়। সেই সব স্মৃতির কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো। পাঠক এখানে পাবেন অন্য এক বঙ্গবন্ধুকে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ মমত্ব এবং গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টিও উঠে এসেছে তাদের লেখায়।
সন্তোষ গুপ্ত
কলকাতা থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশে এলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধুর সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন, সচিবালয়ে আসুন আমি গেটে বলে দিচ্ছি। উনি যথারীতি দেখা করে আমাদের সংবাদ অফিসে এলেন। তিনি বললেন, একি অবস্থা! প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেলাম; কোনো সিকিউরিটি আছে বলে তো মনে হল না। আমার কাঁধে ব্যাগ কেউ দেখতেও চাইল না। এর ভেতরে তো পিস্তল বা আগ্নেয়াস্ত্র থাকতেও পারত। গেটে এলাম, গেটপাশ পেয়ে গেলাম। আমার কাছে তাজ্জব লাগছে। এত সহজে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করা যায়! আসলেই তোমরা ভাগ্যবান।
একদিন, আমার সাথে ছিলো আজাদের নিউজ এডিটর আবু সাঈদ নান্টু। দুজনে বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকলাম। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা তখন উপস্থিত ছিলেন। বাদশার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একসময়ে আজাদে চাকরি করতেন। আমাকে দেখে বললেন, একটা পরিত্যক্ত বাড়ি নিবেন নাকি? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আমি নেব কেন? বঙ্গবন্ধু বাদশাকে ধমক দিয়ে বললেন, বেয়াদবি করিস্ কেন? কাকে কী বলতে হয় তাও জানিস্ না?
১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকাতে তোপখানা ইউএসআইএস (ইউনাইটেড স্টেটস্ ইনফরমেশন সার্ভিসেস)-এর সামনে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলি হল। দুজন ছাত্র মারা গেল। আমরা এর প্রতিবাদ করার জন্য ১০/১৫ জন স্লোগান দিতে দিতে সচিবালয়ে ঢুকে পড়লাম। আমাদের সাথে সাংবাদিক নির্মল সেনও ছিলেন। ... বঙ্গবন্ধুর অফিসে উঠার পথে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, স্লোগান দেয়া যাবে না। আমরা বললাম, আপনি তো রাজনীতি করেন। এসব স্লোগানের কী অর্থ তা আপনি জানেন। তোফায়েল হাসলেন।
আমরা বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকলাম। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। আমরা দুজন ছাত্রের মৃত্যুর কথা বললাম। তিনি সমবেদনা প্রকাশ করে বললেন, আহত-নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ ছাড়া তো কিছুই করার নেই। আমরা তো ক্ষুব্ধ। বললাম, গুলি চালাল কেন? অন্য ব্যবস্থা তো নেয়া যেত। তিনি বললেন, দূতাবাস আক্রান্ত হলে সরকারকে নিরাপত্তা বিধান করতে হয়। আমি বললাম, ওটা তো দূতাবাস নয়, তথ্যকেন্দ্র। তিনি বললেন, ঘটনা তো একই। ওদের কাছে বোমা ছিলো, ওরা আক্রমণ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিত। সে-সংবাদ তো পেয়েছি।
আমি বললাম, জনগণ ক্ষেপে গেলে অনেক কিছু করা যায়। সেজন্যে তো গুলি চালাবার প্রয়োজন ছিলো না। ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ খাল আক্রান্ত হলো, তখন আপনার নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু এবার রাগান্বিত হয়ে বললেন, 'What?' আমরা চুপ হয়ে গেলাম। আসার পথে কেউ কেউ বলাবলি করলো, মুখের ওপর এত বড় কথা বলা ঠিক হয়নি। আমি বললাম, শেখ মুজিবের মুখের ওপর বলা যায়।
ফয়েজ আহমেদ
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার জন্যে গঠিত বিশেষ ট্রাইবুন্যালের প্রথম দিন সকাল ন’টার পূর্বেই আমরা আসন নিয়েছি। কৌঁসুলিদের পেছনে যে কটি বেঞ্চ ছিলো দর্শক-শ্রোতা-আত্মীয়দের জন্যে, তার প্রায় সব কটিই পূর্ণ করে রেখেছে নিরাপত্তা ও গুপ্ত পুলিশের লোকেরা। আমরা ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়াই না বিচারকের চাইতে গুপ্ত পুলিশের ভয়ে। বিচারকদের প্রবেশের পূর্ব মুহূর্তে অভিযুক্তদের আনা হলো তাদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘেরাও করা এলাকায়। এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবের আসন নির্দিষ্ট ছিলো রিপোর্টারদের এলাকার পাশেই প্রথমটি। এর ফলে আমার ডান পাশে দেড় গজ দূরেই তাঁর আসন। টু শব্দটি নেই, এখন বিচারকগণ আসবেন। কোথায় কি অপরাধ করে ফেলি, তার ভয়ে সবাই অস্থির।
হঠাৎ আমার নাম ধরে একজন ডাকতে শুরু করলেন একটু চাপা কণ্ঠে। কিন্তু ওদিকে মঞ্জুর কাদের, এদিকে সালাম খান, আতাউর রহমান খান, সামনে বিচারকগণ এসে গেছেন-সবাই এই ডাক শুনছেন অস্পষ্টভাবে। সবাই দাঁড়িয়ে বসলাম (জজ সাহেবদের আগমনে দাঁড়াতে হয়), কোন উপায় নেই। ডাকে কোন সাড়া দিতে পারি না। কাঁঠালের গুঁড়ির মতো শক্ত হয়ে বসে রইলাম বিচারকদের দিকে চেয়ে। এর পরই শেখ মুজিবের ভারি চাপা কণ্ঠ পুনরায় ভেসে এলো : বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে, ফয়েজ!
আর সত্যই আমরা শেখ মুজিবের সাথে কথা বলেছি; যদিও রাজনৈতিক প্রশ্নে ভিন্ন মত ছিলো।
নির্মল সেন
সাংবাদিক ইউনিয়নের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, সংবাদপত্রের সকল কর্মচারীর জন্য একটি বেতন বোর্ড গঠিত হবে। এই বেতন বোর্ডের সুপারিশ ভিন্ন ভিন্ন পর্ব থাকবে এবং ভিন্নভাবে নির্ধারিত হবে সাংবাদিক প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীর বেতন ভাতা। তখন কোনো মহলেই এর প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়নি। এই প্রস্তাব নিয়ে আমরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করলাম। তিনি একমত হলেন না। ... তখন রব কমিশনের রিপোর্ট বের হয়েছে। রিপোর্টে সরকারি কর্মচারীদের জন্যে দশটি গ্রেড নির্ধারিত হয়েছে। শেখ সাহেব বললেন, সাংবাদিকরা এই দশ গ্রেডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজস্ব অবস্থান নির্ণয় করে নিক। তাদের জন্য নতুন বেতন বোর্ড করার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি রাজি হলাম না। আমাদের যুক্তি সাংবাদিকতা ও সরকারি কর্মচারীদের পেশা এক নয়। তারা একই ধরনের কাজ করে না। তাদের সামাজিক অবস্থানও এক নয়। এই যুক্তির ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের জন্যে ভিন্ন বেতন বোর্ড গঠিত হয়। পাকিস্তানেও তাই ছিলো। বাংলাদেশেও তাই হবে। এ ব্যাপারে আমাদের নতুন কিছু বলার নেই। শেখ সাহেব রাজি হলেন। আমি জানতাম তাঁকে রাজি হতে হবে। সাংবাদিকদের ব্যাপারে তিনি কোনোদিনই খুব কঠোর ছিলেন না। আর বেশিক্ষণ আমাদের সাথে বিতর্কেও যেতেন না। সুতরাং ১৯৭৪ সালে সংবাদপত্র কর্মচারীদের জন্যে বেতন বোর্ড গঠিত হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর খুন হলেন। এই খুনের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে এখনো কেউ বলতে পারে না। পুলিশ কোনো হদিস করতে পেরেছে বলে আমি জানি না। হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী সুলতানা রেবু এক সময় আমাদের দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হুমায়ুন কবীর খুন হয়ে যাওয়ায় পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। আমি বঙ্গভবনে গেলাম। দেখলাম দূরে তার কক্ষে প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে রফিকুল্লাহ চৌধুরী। রফিকুল্লাহকে বললাম, চেক বইটা নিয়ে আসুন। প্রধানমন্ত্রী, আপনার তহবিল থেকে দুই হাজার টাকার একটি চেক লেখেন সুলতানা রেবুর নামে। তার টাকার বড় প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী হেসে বললেন, আপনি কি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন নাকি। হুমায়ুন কবীর কি মুক্তিযোদ্ধা? তার পরিবারকে টাকা দেবো কেন? আমি বললাম, টাকা দিতে হবে এটাই শেষ কথা। আমার যুক্তি হচ্ছে—আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনার আমলে হুমায়ুন কবীর খুন হয়েছে। আপনার সরকার এখনো আততায়ীকে ধরতে পারেনি। তাই আপনাকে জরিমানা দিতে হবে দুই হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রী জোরে হেসে ফেললেন। রফিকুল্লাহ চৌধুরী চেক লিখে নিয়ে এল। প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করলেন।
এবিএম মূসা
আমি চব্বিশ বছরের সান্নিধ্যকালে বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, একচোখা দৃষ্টিতে মুজিব ভাইকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু বলতাম না, তাই আমাকে দেখলেই বলতেন, বঙ্গবন্ধু সবার বন্ধু, তোমার বন্ধু নয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ ও আমি ছিলাম সাংবাদিকদের মধ্যে তাঁর অতিপ্রিয় তিনজন। একসঙ্গে দেখলেই বলতেন, এই রে সারছে! আপদ, বিপদ আর মুসিবত একসঙ্গে। কী জানি কী ফ্যাসাদে ফেলবে।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে ধানমন্ডির অস্থায়ী বাসভবনে ডেকে পাঠান। তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালকের পদে নিয়োগ দেন। আমি বিব্রত বোধ করে বললাম, ‘নেতা, আমি সংবাদপত্রের লোক, টেলিভিশন বুঝি না।’ বঙ্গবন্ধু রেগে বললেন, ‘আমাকে বুঝিস তো?’ উত্তর দিলাম, ‘সবটা না হলেও বোধ হয় অনেকখানি বুঝি।’
তিনি বললেন: যা, তাতেই হবে।
তোয়াব খান
বাসা থেকে টেলিফোনে আমার স্ত্রী জানালেন, কিছুক্ষণ আগে লবণের কেজি ১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন এসে বলছে ১৫ টাকা। তার ১০ মিনিট পর বলছে ২০ টাকা। আমি তখন খিলগাঁও থাকি। আমার মনে পড়ে গেল, ১৯৫২ সালে নুরুল আমিনের আমলে ২০ টাকা সের দরে লবণ বিক্রি নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল। আমি তক্ষুনি বঙ্গবন্ধুকে পরিস্থিতি জানালাম। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলেন। পুলিশ পাঠানো হলো বাজারে। এজন্য নির্দেশ দিলেন এসপি মাহবুবকে। শিল্প সচিবকে বললেন, লবণের এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা কাজ করতেন, তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যবস্থা তিনি নিতেন। গণভবন যখন শেরেবাংলা নগরের নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হলো, তখনকার একটি ঘটনা—নতুন গণভবনের পাশের একটি লাল বাড়ি আমার জন্য বরাদ্দ হলো। এ সময় আমি খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতাম। বরাদ্দের খবরটি শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোয়াবের জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দ হলো। এটা ভালো খবর। কিন্তু খিলগাঁও ছেড়ে গণভবন এলাকায় চলে যাওয়ায় তোয়াবের কাছ থেকে বাইরের যে খবরগুলো পেতাম, ওটা আর পাব না।’
আরেকবার লাহোর ইসলামিক সামিট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন, বাদশাহ ফয়সাল ও ইউএইর শেখ জায়েদ বলেছেন, তুমি যত টাকা চাও, পাবে। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বা পাকিস্তানি সেনাকে ছেড়ে দাও। ফিরে এসে একটা ক্লিমেন্সি ফরমান জারি করলেন। জেলে ছিল যারা, তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। ক্লিমেন্সির প্রথম যে ড্রাফটা ছিল তাতে সবাই ছাড়া পেয়ে যেত। তখন আমলারা খুব খুশি। এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও খুশি। একজন বললেন, সবুর ভাইয়ের টেলিফোনটা রেস্টোর করা দরকার। অমুক জায়গায় তাঁর বাড়িটা দখল হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু বলছেন, এগুলো করে দেওয়া যাবে। ওখানে আমি, গাফ্ফার চৌধুরী আর এমআর আখতার মুকুল আমরা তিনজন ছিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সবাই দেখো। সবার আজকে খুব আনন্দের দিন। কেবল তিনজনের মুখে কোনো হাসি নেই।’ আমি বললাম, স্যার, হাসিটা কী করে আসবে! আমাদের মা-বোনদের যারা রেপ করেছে, তাদেরও ছেড়ে দিতে হবে। যারা বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, তারাও ছাড়া পাবে। যে খুন করেছে, তাকেও ছাড়তে হবে। সব শুনে বঙ্গবন্ধু আমলাদের বললেন, ‘তোমরা কর কী? আমাকে তো ডেনজারাস পথে নিয়ে যাচ্ছিলে।’ তখন ডেকে আবার সংশোধন করা হলো। এটা বলা সম্ভব হয়েছিল তিনি শেখ মুজিব বলে। তিনি বঙ্গবন্ধু বলে। তিনি জাতির পিতা বলে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম দেখতে চাইতেন। তিনি গঠনমূলক সমালোচনা সাদরে গ্রহণ করতেন। তবে সেটা যাতে প্রপাগান্ডামূলক না হয়। বঙ্গবন্ধু চাইতেন সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করুক। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সমালোচনা যেমন তিনি গ্রহণ করতেন, তেমনি তিনি চাইতেন প্রয়োজনে মালিকের সমালোচনাও যেন সাংবাদিকরা করেন। অর্থাৎ সাংবাদিকরা যেন বিক্রি না হয়ে যান। তারা যেন সরকার ও মালিকের আধিপত্যমুক্ত হন। বাকশাল হওয়ার পর চারটি সংবাদপত্র ছিলো। বঙ্গবন্ধু চাইতেন এ সংবাদমাধ্যমগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করুক।
এ প্রসঙ্গে সে সময়ের একটি ঘটনা। ১৯৭৫ সালের সম্ভবত জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে তখন একটি সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিলো। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু পছন্দ করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনাদের ওপর জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। কারও ব্যক্তিগত বিয়ে নিয়ে নয়।
রাহাত খান
১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি শিক্ষকতা ছেড়ে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু সে সময় বেশ কয়েকবার সদলবলে ইত্তেফাক অফিসে এসেছেন। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) এবং বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্ব বলতে গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অংশ। বঙ্গবন্ধু ইত্তেফাক অফিসে ঢুকে ‘মানিক ভাই কই’ বলতে বলতে এগোতেন, মানিক মিয়া সাহেবের সাথে জমে উঠত তাঁর আড্ডা। আমি দু’একবার সেই আড্ডার আশপাশে থাকার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমার মতো সামান্য মানুষকেও দেখে চিনতে পারতেন। জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বলতেন: এই যে সাংবাদিক, কী খবর?
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে ছিলাম বেশ কিছুদিন। তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন: রাহাত খান, শান্তিনিকেতন গেলে তুমি আমার সঙ্গে যাবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার সময় পাননি, আগেই খুনিচক্রের বুলেটের আঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বেশ কয়েক বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঠিকই আমাকে আরও অনেকের সঙ্গে কলকাতার বইমেলা এবং শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আমাদের নিঃশ্বাস ও বিশ্বাসে মিশে আছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি শাহাদাত-বরণ করেছেন বাংলাদেশে বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার সাধনায় নিরত থাকার সময়। তাঁর আদর্শ ও অবদানের মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চাইলে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমাদেরও অগ্রজদের মতোই বঙ্গবন্ধুর কথা তাঁর আদর্শের কথা বলতে হবে। ঘাতকেরা তাঁকে হত্যা করেছে কিন্তু যে আর্দশ তিনি রেখে গেছেন তা বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত লড়াই সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। সেই লড়াইয়ে তাঁর আদর্শ ধ্রুবতারা হয়ে আমাদের পথ দেখাবে, পৌঁছে দেবে বিজয়ের বন্দরে। তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে অনন্তকাল। তিনি চিরঞ্জীব।